‘ছিল এক ভাজা মাংসের ভক্ত,
দেখে কোরবানির ছুরি-টুরি-রক্ত
মাখন হৃদয় তার হাউমাউ কাঁদত!
দুপুর বেলা, এলে গরম গরম গোশত,
মসলার মৌ ঘ্রানে ভুলে যেত সে কষ্ট,
ডুবি নাক-মুখ-হস্ত, ভুঁড়িখানা ঠিক ভরত’

যদিও এক পরিচিত-জনকে নিয়ে এই পদ্য-প্রচেষ্টা, আশে-পাশে তাকালেই এমন ভুরি ভুরি ভোজন-রসিক চোখে পড়বে আমাদের। তারা নাক ডুবিয়ে মাংস ভক্ষণ করতে পারেন, কিন্তু মাংস কর্তন, বা ভুঁড়ি ছেদন একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, কোরবানির সময় জবাই-কৃত পশুর গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে থাকলে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, সাময়িক জ্ঞানও হারান কেউ কেউ। ডাক্তারি ভাষায় ‘দুর্বল চিত্তে’র এই মানুষগুলি কিন্তু আবার পরিপূর্ণ সবল হয়ে উঠেন প্লেট-ভর্তি মাংসের গন্ধে!

অনেকে আবার এতটা দুর্বল চিত্তের নন, তারা পশুর হাড্ডি, মাংস, রক্ত, নাড়ি-ভুঁড়ি দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যান না, কিন্তু অনুভব করেন সভ্যতার অভাব। কেন রে ভাই, রাস্তায়, বাড়ি-ঘরে, ছোট ছোট বাচ্চাদের সামনেই চালাতে হবে এই রক্তোৎসব?? এগুলো কি আমাদের বাচ্চাদের কোমল হৃদয়ে কুঠরাঘাত করে না? তাদের কি করে তুলে না হিংস্র? এই অমানবিক কাজগুলো কি একটু আড়ালে আবডালে করা যায় না? এই প্রজাতির মানুষেরা উৎসব করে পশুহত্যা পছন্দ করেন না বটে, তবে উৎসব করে মাংস খেতে ভালবাসেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে হপ্তা হপ্তা দামী রেস্টুরেন্টে চলে যান। বিফ বার্গার অথবা বটি কাবাবের ভোজে হন মাতোয়ারা ।

আমেরিকা, ক্যানাডা অথবা পশ্চিম ইউরোপের ধনী কোন দেশের কোন ধনী রেস্টুরেন্টে বসে বিফ বার্গার বা স্যান্ডউইচ চিবোন যারা, তারা যদি একটু কম খেতেন, তাহলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে আর অভুক্ত থাকতে হত না। কেন এই অতি উন্নত দেশগুলোতে পশু খাদ্য উৎপাদনের জন্য এমনকি অর্ধেকের বেশি জমি ছেড়ে দিতে হয়? কেন তাদের জন্য এত্ত এত্ত খাদ্যের যোগান দেয়া হয়, যা দিয়ে পুরো বিশ্বের অনাহারী পেটগুলি ভরিয়ে তোলা যায়?? কারণ আর কিছুই নয়, পশুসম্পদ শিল্পপতি-গণেরা এই জমি বা খাদ্যের জন্য অকাতরে অর্থ বিলোতে সক্ষম, কারণ তাদের মাংস-খেকো কাস্টমারদের হাতে অঢেল ধন-মানিক, তারা যতটা না প্রয়োজন, তার চেয়েও অনেক বেশী মাংস চিবোনই না শুধু, চর্বিত চর্বণও করেন পশুকুলের মত! আর দেখুন, এই লোকগুলির চর্বি কমানোর জন্য ডাক্তার বা ব্যয়ামগারেরও অভাব নেই কিন্তু। পরিসংখ্যান মেলে, একটি বড়সড় ষাঁড়ের পেটে যে পরিমাণ পানি যায়, তা দিয়ে একটি সাবমেরিন বিধ্বংসী জাহাজ ভাসানো যায়। যেখানে মাত্র ২৫ গ্যালন পানি দিয়েই এক পাউন্ড গম উৎপাদন করা যায়, সেখানে এক পাউন্ড মাংস উৎপাদনে প্রয়োজন পড়ে প্রায় ২৫০০ গ্যালন পানি। মাংস উৎপাদকেরা নাকি পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান শিল্প দূষক, তাদের কারণে পৃথিবীর তাবৎ নদী আস্তে আস্তে মরেই যাচ্ছে না শুধু, দূষণ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশের বিস্তীর্ণ অববাহিকায়। আশ্চর্য শোনালেও সত্য, পৃথিবীর তাবৎ মানব প্রজাতিকে ৫ বার খাওয়ানো যায় এমন সয়াবিন এবং দানাদার খাদ্যশস্য শুধুমাত্র আমেরিকার পশু-শিল্পের জন্য ব্যয়িত হয়। আমেরিকার গরু, শুকর, মুরগী, ভেড়া প্রভৃতি অমূল্য পশুসম্পদ খেয়ে ফেলে দেশটির ৯০ ভাগ গম, ৮০ ভাগ খাদ্যশস্য, ৯৫ ভাগ যব। আমেরিকার মোট কৃষিজ ভূমির অর্ধেকেরও কম ব্যবহৃত হয় মানবসম্পদের ভোগের নিমিত্তে। পশুকূলকে ছেড়ে দিতে হয় অর্ধেকেরও বেশী! তাহলে বুঝুন!!
 এমন ভুঁড়িওয়ালাদের জন্য ভুরি ভুরি অনাহারীর জন্ম হয়!!

আরও এক প্রজাতির লোক আছেন, যারা সুরম্য প্রাসাদে বসবাস করেন, ঝকঝকে তকতকে রাজপথে রাজার মত করে হাঁটেন, আর মনে মনে ভাবেন, কবে যে এই পৃথিবী থেকে প্রাণীহত্যার মত একটি নৃশংস ঘটনার বিলোপ হবে!! আশ্চর্য হল, এই শ্রেণীর লোকেরা ভুলেই যান, তার জন্য এই মনোরম শহরটির পত্তন ঘটাতে বিনাশ করতে হয়েছে বেশুমার বন-জংগলের, জান গেছে কতশত অবলা জানোয়ারের!! এই ভাবুক লোকটিকে এই সুসভ্য আর সুশোভিত শহরটি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে থাকতে বলুন না! দেখবেন, আপনার উপর তেড়ে আসবে!!

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা চল্লিশ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সাথে এক সম-অংশিদারিত্বের জীবন যাপন করেছে। তারা নিজেদেরকে জঙ্গলের তত্ত্বাবধায়ক মনে করত, কখনোই জংগলের প্রাণী বা উদ্ভিদকুলের অঘোষিত মালিক বনে যেত না। এই লোকগুলি শিকারও করত, কিন্তু কখনই তা ধ্বংস ডেকে আনত না সেই আদিম পৃথিবীতে। এতই ভারসাম্যপূর্ণ ছিল তা! তারা এমনকি একটি গাছকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের জীবনটা দিয়ে দিতে থাকত সদা-প্রস্তুত। কিন্তু পরে উপনিবেশবাদীরা এসেছে যখন, তারা প্রকৃতি তো ধ্বংস করেছেই, সঙ্গে বিনাশ করেছে ঐ আদিবাসী গোষ্ঠীটিকেও। যারা তাদের সার্থক ক্রীতদাস বনতে পেরেছে, তারাই শুধু বেঁচে যেতে পেরেছে। আর ঐ সেট্‌লারদের হাতেই কিন্তু গড়ে উঠেছে আজকের ঝকঝকে তকতকে অস্ট্রেলিয়া….তাহলে বুঝুন, সভ্যতার সাথে কি মারাত্মক সংশ্লেষ রয়েছে বলির!!!! পশু শুধু নয়, মানুষকেও যার যূপকাষ্ঠে দাড়াতে হয়েছে বারবার….

এবার আসা যাক আর এক দলের কথায়। তারা পেট পুড়ে মাংসই খায় না শুধু, পশুহত্যার ব্যাপারেও তাদের দারুণ উৎসাহ! তাদের মতে, প্রাণীর কি অনুভূতি আছে নাকি? তাহলে তাদের কর্তনে কি এমন ক্ষতি? প্রাণী হত্যা ও তার মাংস ভক্ষণ তাদের কাছে কোন অমানবিক বিষয়ই নয়। তাদের প্রশ্ন: যদি আহারের জন্য প্রাণী হত্যা এতই খারাপ, তাহলে বনের জন্তুদের কি প্রাণী হত্যায় বাঁধা দেয়া উচিত নয়? বা, একটি কীটের জীবনও কি গুরুত্বপূর্ণ নয়??? খাদ্যচক্র ভেঙ্গে দাও তাহলে! বৃহৎ মাংসাশী প্রাণী কর্তৃক ক্ষুদ্র প্রাণীদের আহারে পরিণত করা প্রসঙ্গে ডঃ লিভিংস্টোনের সেই অমর বানী এদের কাছে বাইবেল:

‘..কোন ব্যথার ধারণা বা ভীতির অনুভূতি ছিল না। ক্লোরোফরম দেয়া রোগীদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়ে থাকে, মানে, তারা পুরো অপারেশনটাই দেখে, কিন্তু ছুরিকে অনুভব করতে হয় না তাদের…. এই বিশেষ অবস্থাটি মাংসাশী প্রাণীদের হাতে মারা যাওয়া সব প্রাণীর মধ্যেই অনুভূত হয়; এবং আমাদের দয়াবান প্রভুর তরফে মৃত্যু ব্যথা উপশমের একটি বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে দেখা যেতে পারে একে..’

কিন্তু যারা শুধু উদ্ভিদ খায়, প্রাণী খায় না, তাদের বেলা? তারা কি দ্বিচারিতা করেন উপরোল্লিখিত প্রজাতির মানুষগুলোর মত? না, তারা কোন দ্বিচারিতা করেন না। তাদের যেই কথা, সেই কাজ। তারা বলেন, মাংস ছোঁবও না, খাবোও না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কেন মাংসের মত অতিশয় মজাদার (মাংস-ভক্ষকদের মতানুযায়ী) একটি জিনিস চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়ার শখ থেকে বঞ্চিত রাখেন নিজেদের? অবলা প্রাণীগুলার প্রতি মায়া? প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা?? নাকি দেবতাকে খুশী-করণ চেষ্টা?? দেবতাকে খুশী করার আশায় কেউ যদি মাংসের বাটি থেকে মুখ সরিয়ে রাখেন, মহৎ মানবের খেতাব একখানা জুটে যাবে সন্দেহ নেই; কিন্তু দেখা দেবে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিদ্বন্দ্বী!! কারণ মানিকগঞ্জের সলিমুদ্দিন, যে নিজের কষ্টের টাকায় একখানা গরু কোরবানি দিয়েছিল, সে বলবে, আমি কি তবে সৃষ্টিকর্তাকে খুশী করতে চেয়ে অন্যায় করেছি ? সলিমুদ্দিন যখন মাংস খায়, তখন সেও কি ‘দেবতার প্রসাদ’ এর মত পবিত্র কোন খাদ্যানুভূতির অংশীদার হতে চায় না? যেখানে বিশ্বের প্রায় ৭ ভাগ মানুষ ভেজিটেরিয়ান, সেখানে ইন্ডিয়াতেই এই অনুপাত প্রায় তিরিশ শতাংশের কাছাকাছি। মাংস না খাওয়ার সাথে ধর্মের যে কি ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে, তা তো এই অনুপাত থেকেই সম্যক বোঝা যায়।

পশু-মাংস খান না, এমন অনেকে আবার পশু বলী দিতে একটুও কার্পণ্য করেন না। আর সেও করা হয় দেবতাকে খুশি করতে। কোন কোন ক্ষেত্রে ভস্ম-বলী দিতে দেখা যায় যেখানে স্বর্গের দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় দাহকৃত মাংস, অন্যদিকে, রক্ত আর অন্ত্রাদি নিবেদিত হয় মৃত্তিকা-দেবীর উদ্দেশ্যে। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আতোয়ার রহমানের বইতে পাওয়া যায়:

মানুষ উপায়নের জন্য সব সময়ই বেছে নিয়েছে খুত-হীন ও স্বাস্থ্যবান পশু। পরোক্ষত, তার প্রিয় পশুকে। হিন্দু শাস্ত্র যখন বাঘ, সিংহ ইত্যাদির মত বন্য পশু বলিদানের অনুমোদন দেয়, তখন অবশ্য প্রিয় অপ্রিয় বিচারের অবকাশ রাখেনি। এসব পশু বলিদানের কথা বলা হয় সম্ভবত এগুলিকে শক্তির প্রতীক বলে ধরে নিয়ে। অন্যদিকে, মোষ, ষাঁড়, পাঠা, এবং মর্দা শুয়োর বলি দিয়েছে হিন্দু সমাজ, তাদের উর্বরতা আর প্রজনন শক্তির প্রতীক ভেবে।

অনেকে প্রাণী খান না, কিন্তু প্রাণীর চর্বিতে নির্মিত সুগন্ধি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, প্রাণী হত্যার উপর নির্ভরশীল যে বিশাল পশম বা চামড়া ইন্ডাস্ট্রি, তার উৎপাদিত পণ্য ভোগে তাদের দ্বিধা নেই বিন্দুমাত্র। তবে প্রাণী না-খাওয়াদের দলে আর এক প্রজাতির মানুষ পাওয়া যায়, যারা প্রাণীর দেহ টুকরো টুকরো করে গবেষণা করেন বৃহত্তর মানবকল্যানের উদ্দেশ্যে; হয়ত ক্যানসারের মত প্রাণঘাতী রোগ সারাতে তাদের কোরবানি দিতে হয় অসংখ্য প্রাণী। মনুষ্যত্বের ছলে এখানেও যে পশুত্ব বিরাজ করে, তার প্রমান মেলে, জর্জ বার্নার্ড শ’এর নীচের কমেন্টটিতেঃ

যদি একটি গিনিপিগকে যৎসামান্য জ্ঞানলাভের জন্য হত্যা করা জায়েজ হয়, তাহলে গিনিপিগের তুলনায় অনেক অনেক বেশি জ্ঞানলাভের স্বার্থে একটি মানুষকে স্যাক্রিফাইস করা সহি হবে না কোন যুক্তিবলে?

যদিও গবেষণাগারে মানুষকে পরীক্ষার উপকরণ তেমনটা হতে হয় না, তবু মানুষ যে গিনিপিগের চেয়েও বেশি মাত্রায় বলি হচ্ছে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় কি? যদি তেমন কোন ব্রেকথ্রু হওয়ার আশা থেকেই থেকত, তাহলে কি আর মানুষ বসে থাকত? তেমনতরো বড়সড় আবিষ্কারের জন্য অসংখ্য মানুষকে বলি না দিয়ে? মানুষ যে আদতে একটি প্রাণীই!!! তাই খুব বেশী ভরসা পাই কোথা?

যদিও পরীক্ষাগারে অ্যানিম্যাল টেস্ট করা হচ্ছে প্রোডাক্ট সেফটির কথা বলে, এর ভিতর রয়েছে শুভংকরের ফাঁক। Herbert Gundersheimer নামক একজন আমেরিকান ডাক্তার আসল রহস্য ফাঁস করে দিয়েছেন এভাবে:

বাস্তবে এই টেস্টগুলো ভোক্তাদের অনিরাপদ পণ্য থেকে কোন সুরক্ষাই দেয় না, বরং এইগুলো ব্যবহৃত হয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি দায় থেকে প্রতিরক্ষা দিতে।

সবশেষে আরও এক প্রজাতির মানুষের কথা, প্রাণী না খাওয়ার ব্যাপারে যাদের রয়েছে জোর দার্শনিক যুক্তি। এরা যেন গ্রীক দার্শনিক প্লুটার্ক (খ্রিস্টাব্দ ৪৬-১২০) এর সার্থক উত্তরসূরি। প্লুটার্ক এক পর্যায়ে বলেছিলেন:

প্রানীমাংস যদি ভক্ষণ করতেই হয়, তাহলে ছুরি আর কাঁটাচামচের পরিবর্তে জন্তুদের মত করে খাওয়াই শ্রেয়তর।

Baron Cuvier নামক একজন প্রসিদ্ধ অ্যানাটমিস্ট এর মতে, মানুষের হাত, দাঁত, বা চোয়ালের গঠন এমন যে, ফলমূল, শেকড় আর সবজিজাতীয় খাবারই তার জন্য সত্যিকারের (প্রাকৃতিক) খাবার বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষ কি সে প্রাকৃতিক খাদ্যে সন্তুষ্ট থেকেছে?? বরং সে শিকারে নিপুন দক্ষতা অর্জন করেছে অন্য মাংসখেকো প্রাণীগুলোর মতই। মাংসাশী অন্য প্রাণীগুলোর সঙ্গে এখন তার মূল পার্থক্য হচ্ছে, মাংসাশী প্রাণীগুলো জংলি কায়দায় খাদ্য সংগ্রহ করে, আর মানুষ সভ্য কায়দায় আধুনিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সেগুলোকে (সুসভ্য ও শৃংখলাবদ্ধভাবে ? ?) সংগ্রহ করে আর পরে মাংস কেটে, মসলা মাখিয়ে সুসভ্য নাগরিকের মত ভোগ করে। তাই নয় কি??

আসলে কোন সুনির্দিষ্ট নৈতিকতা দাড় করানো যায় না, বলি, পশু হত্যা, মাংস ভোজনের পেছনে। আর এগুলি ভাল কি মন্দ, তার বিচার আসলেই গুরুত্বহীন যতক্ষণ না আমরা ঠিক করি আমরা কি চাই! আমরা কি এমনটাই চাই যে, কোন একটি বিশেষ প্রজাতি সুখ ভোগ করতে পারবে না অন্য একটি প্রজাতির কষ্টের বিনিময়ে?? সত্য হল, আমরা তা কখনই চাই না। মানুষ অন্য প্রজাতির কষ্ট থোরাই কেয়ার করে!! আদতে মানুষ যেমন শ্রেষ্ঠত্ব চায় অন্য প্রাণীদের উপর, তেমনি উন্নত মানুষকূলও চায় শ্রেষ্ঠত্ব দুর্বলের মানুষের উপর। আশ্চর্য হল, মানুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করতে যেয়ে নিজেদের পশুত্বের পরিচয়টিকে কিন্তু আরও পরিষ্কার করে তোলে! বস্তুত, আদিম পাশবিক রীতি তো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠারই রীতি……

এই সহস্রাব্দের শুরুতেই ২০০১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রায় ৬ মিলিয়ন স্বাস্থ্যবান গরুকে পুড়িয়ে মেরেছিল; হত্যাযজ্ঞটি এত বিশাল ছিল যে, সেনাবাহিনী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। কারণ কি জানেন? গরুগুলো ভাইরাস আক্রান্ত ছিল, মানব-দরদি ব্রিটিশ সরকার বিন্দুমাত্র রিস্ক নিতে চায়নি, শুধু এফেক্টেড ফার্মগুলোই তারা বিনাশ করেনি, সঙ্গে আশেপাশের খামারগুলিও নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলে তারা, যেগুলিতে এমনকি ভাইরাস সংক্রমণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই বিশাল গণহত্যায় মাইলের পর মেইল দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্যাতনামা বিজ্ঞানী প্রফেসর ফ্রেড ব্রাউন একে ‘বারবারিক কন্ডাক্ট’ আর ‘মানবতার জন্য একটি লজ্জা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই তো সেদিন অস্ট্রেলিয়ার জনৈক নিক বোথা তার খামারের ৩০০০ গরুকে শুট করার সিদ্ধান্ত নেন। বোথা খামারটি ক্রয় করেছিলেন গরুগুলোকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খামার থেকে খালাস করার শর্তে, যেহেতু সেগুলোকে খাওয়ানোর মত যথেষ্ট ঘাস ছিল না, আর ইন্দোনেশিয়ায় গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ হওয়ায় সেগুলো বিক্রি করাও সম্ভব ছিল না বোথার পক্ষে। ফলে বাধ্য হয়ে, গরুগুলিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হয় বোথাকে। মজার ব্যাপার হল, ইন্দোনেশিয়ার কসাইখানায় গরুগুলির প্রতি যে নিষ্ঠুরতা করা হচ্ছিল, তার প্রতিবাদেই কিন্তু গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ফলাফল দেখুন: হাজার হাজার গরুকে আরও মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করতে হয়!!
আগুনে পুড়িয়ে পশু গণহত্যার অধিকার মানুষের সভ্যতাগত!!

আচ্ছা, ভাইরাস আক্রান্ত হলে বা খামার খালি করার প্রয়োজন হলেই যে গরুগুলিকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তা কি মানুষের পশুত্বের লক্ষণ?? সত্য হচ্ছে, মানুষ নিজেই পশু, আর শুধু গরু নয়, প্রয়োজনে তারা মানুষকেও গণহত্যার শিকার করে! এমন ইতিহাস ত ভুরি ভুরি রয়েছে!

Jeremy Bentham (1748–1832) তার The Principles of Morals and Legislation গ্রন্থে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, ফরাসিরা ইতিহাসের যে অমোঘ পরিক্রমায় একজন মানুষের গায়ের রং-কে আজ আর দাস হওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ বলে মনে করছে না, ঠিক সেই পথেই, এমন দিন আসবে, যখন পায়ের সংখ্যা, চামড়ার লোমশ ভাব বা os sacrum এর বিলুপ্তি কোন সেন্স-ওয়ালা প্রাণীকে নিগৃহীত করার জন্য যথেষ্ট কারণ বলে আর বিবেচনা করবে না মানব প্রজাতি। তবে বাস্তব হল, কার বিচারশক্তি/সেন্স আছে, আর কার নেই তার বিবেচনা কি মানুষ প্রজাতি কখনো করেছে?? একটি কীটের চেয়ে একটি ঘোড়ার বেশী মর্যাদা পাওয়া উচিত, বা একটি ঘোড়ার চেয়ে একটি একদিনের শিশুর জীবন বেশী মর্যাদা পাওয়া উচিত, যদি প্রাণীটির বিচারশক্তিই হয় নিয়ামক। কিন্তু আমরা কি দেখি? পাশ্চাত্যের একটি ধনী লোক হয়ত ৩য় বিশ্বের হাজার হাজার শিশুর চেয়ে একটি ঘোড়ার যত্নে বেশি অর্থ ব্যয় করছে। আবারও প্রমাণ মিলল, মানুষ একটি প্রাণীর মতই আচরণ করে, সে তার নিজস্ব চাহিদা বা পছন্দকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, বাস্তব দুনিয়ায় নৈতিকতার আসলেই কোন অস্তিত্ব মানুষ রাখেনি।

আতোয়ার রহমান বলেন:

বলি হিসেবে প্রাণ দিতে কেউ কখনো স্বেচ্ছায় খাঁড়ার নিচে ঘাড় পেতে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। বলি-দাতারা সব সময়ই বলিদানের উদ্দেশ্যে মানুষ সংগ্রহ করেছে ছলে বলে কৌশলে, দুর্বল শ্রেণী থেকে। কখনো দাসদের। কখনো বন্দীদের। দুই-একটি ক্ষেত্রে অপহরণের অভ্যাসও বলি-দাতাদের ছিল।

আসলে মানুষের সাম্প্রতিক ইতিহাস তো দুর্বলের উপর শক্তিশালীর জয়ের ইতিহাস, সভ্যতার বিনির্মাণও এই পথেই। সে হিসেবে আমরা মানুষেরাও কি নিরাপদ? একসময় মানুষকেই বলি হতে হত দেবতার শক্তিবৃদ্ধির আশায়, বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পাপের প্রায়শ্চিত্ত থেকে রক্ষা পেতে। এখন সভ্যতা অনেক এগিয়েছে। কিন্তু মানুষ কি আর বলী হচ্ছে না? হিরোশিমা বা নাগাসাকিতে যা হয়েছে? মানুষ যে নীতির উপর ভর করে বলি দেয় বা মাংস খায়, ঠিক সেই নীতির প্রতিফলনেই কি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা পড়েনি???

C. S. Lewis এর একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি রয়েছে:

In justifying cruelty to animals we put ourselves on the animal level.

আমরা পশু হতে চাই না। পশু হত্যা, চামড়া ছিলা, আর মাংস খাওয়ার মধ্যে একপ্রকার অসভ্যতার, জংলি-পনার ছোঁয়া আছে, সে যতই মসলা মাখাই না কেন, বা আগুনে ছেঁক দিয়ে, আর মসৃণ টেবিলে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করি না কেন বা মার্কেটগুলিতে মনোরম পরিবেশে সাজিয়ে রাখি না কেন। বাস্তবতা হল, আমাদের মানবিক বোধকে (যাকে নিয়ে আমরা অহংকার করি) বলি দিয়েই আমরা পশু খাই , খেয়েই চলেছি সেই আদি যুগ থেকে, নিজেদের পশুর স্তরে নামিয়ে…শুধু সমস্যা হল, ব্যাপারটা আমরা স্বীকার করতে চাই না…… মানুষের জ্ঞান মানুষকে এইটুকু অন্তত শিখিয়েছে যে, নিজেকে পশু ভাবা খুব বোকামি!!! চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে মানুষ অনেক বেশী শৈল্পিক ও সভ্য কায়দায় মাংস খাওয়া রপ্ত করেছে। শুধু তাই নয়, পশুদের থেকে নিজেদের পার্থক্যকে পরিষ্কার করার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে যুক্তির পসরা সাজিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি হিরোশিমা, নাগাসাকি, টুইন টাওয়ার, বা সাম্প্রতিক সিরিয়া মানুষের সভ্যতার পোশাক শুধু খুলেই নিচ্ছে না, আদি ও অকৃত্রিম উলঙ্গ চেহারাটি ফিরিয়ে দিচ্ছে! আসলে, সভ্য জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল দিয়ে মানুষ নিজের পশুত্বকে আবডালে নিয়ে যেতে পারে শুধু, পশুত্বকে বিসর্জন দিতে পারে না কখনই। সেটি ডালের ফাকে ফাকে ঠিকই ঝুলে পড়ে!

তথ্যসূত্রঃ
১.লোককৃতি বিচিত্রা- আতোয়ার রহমান
২.Ethical Dilemma
৩.অন্যান্য ইন্টারনেট উৎস