যুক্তি : সংখ্যা ৪, জুলাই ২০১৩
দীর্ঘ বিরতির পর আবার প্রকাশিত হলো অনন্ত বিজয় দাশের সম্পাদিত ‘যুক্তি’ পত্রিকাটি। সিলেট থেকে প্রকাশ হওয়া এ পত্রিকাটি বরাবরই যৌক্তিক পথ ধরে হেঁটে আসছে। চতুর্থ সংখ্যাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে মৌলবাদের এমন চতুর্মুখী আস্ফালনের মাঝে এরূপ যৌক্তিক সাহসিকতা চলমান সমাজে প্রদর্শন করা একদিকে যেমন বিস্ময়ের, অন্যদিকে প্রশংসনীয়। রাজনৈতিক যাঁতাকলে পড়ে দেশ যেখানে কথিত ‘নাস্তিক’ আর ‘আস্তিক’ –  এই দুই ভাগে বিভক্ত, অর্জিত শিক্ষা যেখানে অপপ্রয়োগে ক্ষয়িষ্ণু, তারই সাথে তাল মেলাতে গিয়ে জনমানুষের কাণ্ডজ্ঞান যেখানে শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকতে বসেছে, সেখানে বিজ্ঞানের যষ্টি হাতে হাজির হলো ‘যুক্তি’।

‘যুক্তি’র একমাত্র অবলম্বন বিজ্ঞান। সমাজে যা কিছু অশুভ, যা কিছু অসংগতি তা যুক্তির নিরিখে মেপে অনিরুদ্ধ কলমে প্রকাশিত হয় ‘যুক্তি’র পাতায়। মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক ও বিজ্ঞান-সম্পর্কিত লেখার সম্ভার নিয়ে এটি প্রকাশিত হলেও নবতর এই সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে নানা অপবিজ্ঞান আর বিজ্ঞানবিরোধিতার ইস্যুকে ভিত্তি করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, হোমিওপ্যাথি, জ্যোতিষশাস্ত্র, সৃষ্টিবাদের মতো বিষয়। এছাড়া বিজ্ঞানবিরোধী কার্যক্রমের মনস্তত্ত্ব এবং কর্মপ্রক্রিয়াও উঠে এসেছে বিভিন্ন লেখায়। এ প্রসঙ্গে সম্পাদকের বক্তব্য, “আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞানের এ যুগে ধর্মগুলির সনাতনী ধ্যান-ধারণা টিকে থাকতে না পেরে নবরূপে-নবকাঠামোর বিজ্ঞানবিরোধী শক্তিগুলো একতাবদ্ধ হয়ে উঠছে। আজকের একবিংশ শতাব্দী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হলেও এটা অবশ্যই শঙ্কার বিষয় যে অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও এইসব ছদ্মবিজ্ঞানওয়ালাদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।”

সংখ্যাটি শুরু হয়েছে অধ্যাপক অজয় রায়ের ‘বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনে গ্রন্থ’ লেখাটির মধ্য দিয়ে। লেখকের বিস্ময় প্রকাশ দিয়ে শুরু হয়েছে লেখাটি। বহুল ব্যবহৃত ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ শব্দটি বাংলা কোনো অভিধানে না পেয়ে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন তিনি। তা হওয়ারই কথা। এমন শব্দ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি জেনে যে কেউ অবাক হবেন বৈকি! কলামিস্ট, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির লিখেছেন ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার ঐতিহ্য’ লেখাটি। এ লেখার মধ্য দিয়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সেই সাথে ঐতিহাসিক পর্যালোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ লিখেছেন ‘ওষুধ নিয়ে নয়ছয়!’। প্রতিষেধক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বিষক্রিয়ার কথা এ প্রবন্ধে উঠে এসেছে। রোগীদের মাঝে ওষুধের যুক্তিহীন ব্যবহারের উল্টো দিকে এর যুক্তিসংগত প্রয়োগ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়টিও নিয়ে কথা বলেছেন লেখক। ডা. মনিরুল ইসলামের ‘ভুয়াবিজ্ঞান মেলা চাই’ লেখাটিতে বিজ্ঞানের আড়ালে থাকা ছদ্মবেশী বিজ্ঞানের চরিত্র-চিত্র উঠে এসেছে। যেমন ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ বিষয়টি বিজ্ঞানভিত্তিক হিসেবে দাবি করা হলেও লেখকের মতে এটি আসলে একটি ভুয়াবিজ্ঞান। অধ্যাপক ড. তানভীর হানিফের ‘বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞান’ শিরোনামের নাতিদীর্ঘ লেখায় বিজ্ঞানের দুনিয়ায় জ্যোতিষশাস্ত্র, হ্যানিম্যানের উদ্ভাবিত হোমিওপ্যাথি, প্যারাসাইকোলজি এসকল বিষয়ের অবস্থান যে ভিত্তিহীন সে বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ একটি লেখা লিখেছেন মনোরোগ চিকিৎসক বিরঞ্জন রায়। ‘ফ্রয়েড-তত্ত্ব কি বিজ্ঞানসম্মত?’ এই লেখাটিতে লেখক জার্মান মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের নানাবিদ তত্ত্ব তুলে ধরেছেন এবং সেগুলো বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, যা অনেকের কাছে নতুন চিন্তার খোরাক হতে পারে। চিকিৎসক ও গবেষক কাজী মাহবুব হাসান লিখেছেন বিজ্ঞানের আলোয় ‘হোমিওপ্যাথি’ লেখাটি। এই দীর্ঘ লেখার মধ্য দিয়ে হোমিওপ্যাথির ইতিহাস পর্যালোচনাসহ বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে হোমিওপ্যাথির ভূমিকা, কার্যকারিতা, উপযোগিতা ও গুরুত্ব ইত্যাদি নানা দিক তুলে ধরেছেন লেখক। এক্ষেত্রে লেখক জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিনের অধ্যাপক ইডজার্ড আর্নস্ট (Edzard Ernst)-এর বেশ কিছু গবেষণা ফলাফলকে লেখার প্রধান উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশ ও বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো জে. আয়ালা’র ‘Am I a Monkey? : Six Big Questions about Evolution’ বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় ‘জীবনের সূত্রপাত হলো কীভাবে?’ শিরোনামে লেখাটির অনুবাদ করেছেন সিদ্ধার্থ কুমার ধর। অনুবাদকের প্রাঞ্জল ভাষাশৈলীতে পাঠকমাত্রই জীবনের বুৎপত্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারবেন অনায়াসে। তুরস্কভিত্তিক ইসলামি ক্রিয়েশনিজম আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হারুন ইয়াহিয়া ওরফে আদনান অকতারের যাবতীয় কর্মকা- বর্তমান পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন অনন্ত বিজয় দাশ। লেখক তাঁর ‘হারুন ইয়াহিয়া : চকচক করলেই সোনা হয় না!’ শিরোনামের এই লেখায় অকতারের সম্পর্কে অনেক জানা-অজানা কথা উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন জনপ্রিয় এ মানুষটির ভ-ামির অনুপুঙ্খ চিত্র। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ম্যাট কার্টমিলের একটি লেখাও অনুবাদ করেছেন উক্ত লেখক। ‘হারুন ইয়াহিয়ার সৃষ্টির মানচিত্র’ শিরোনামের লেখাটিতে জীববির্তনের দুনিয়ায় ইয়াহিয়ার ভিত্তিহীন মনস্তত্ত্বিক বিশ্লেষণকে যৌক্তিকভাবে খ-ন করা হয়েছে। সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের অক্সিডেন্টাল কলেজের ভূতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক ডোনাল্ড প্রোথেরো’র লেখা ‘ঞযব ভড়ংংরষং ংধু ুবং!’ প্রবন্ধটি ‘ফসিলের আলোয় বিবর্তন’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন অভীক দাস। সাবলীল ভাষায় অনূদিত এ লেখাটিতে ঠাঁই পেয়েছে বিবর্তনের নানা প্রাসঙ্গিকতা।

যুক্তি; সম্পাদক : অনন্ত বিজয় দাশ; প্রকাশকাল : জুলাই ২০১৩; প্রচ্ছদ : আফ্রিদা রোশনী; পৃষ্ঠা : ১৭২; মূল্য : ১৫০ টাকা। প্রাপ্তিস্থান : বইপত্র, জিন্দাবাজার, সিলেট; তক্ষশিলা, শাহবাগ, ঢাকা; বাতিঘর, জামাল খান রোড, চট্টগ্রাম।

অঞ্জন আচার্য
কবি, সাংবাদিক