মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে ধারাবাহিক
(৬)
মা তখন সাত মাসের অন্ত:সত্বা| দেশে যুদ্ধ চলছে| বর্ষাকাল| যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা| বিপদে আপদে হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন| গ্রামের হোমিওপ্যাথ জ়িতেন ডাক্তারই অগত্যার ভরসা; কিংবা তেরশ্রীর এলএমএফ ডাক্তার লোকমান হাকিম| তাছাড়া ঠাকুমায়েরও অগাধ সাহস এবং অভিজ্ঞতা| বাবাসহ নয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ঠাকুমা| তারপরে সাত-সাতটি ছেলের বউদের সন্তান তো হচ্ছেই বাড়িতে প্রতি বছরই দু’একটি করে|
বাবা তাই তাঁর মা ও বৌদিদের উপর ভরসা করেই একরকম নির্ভাবনায় থাকেন| রাতে ঘুমের সময় একবার হয়ত জিজ্ঞেস করেন, তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? ডাক্তার লোকমান ভাইকে একবার নৌকা পাঠিয়ে নিয়ে আসি?
মা সারাদিন কাটিয়ে দেন বই পড়ে আর রেডিও শুনে| অসুবিধে থাকলেও মুখ বুজে সব সহ্য করেন| বাবার কথার উত্তরে বলেন, না, দিদিরা তো আছে| তাছাড়া মাকেও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি খারাপ লাগলে|
বাড়িতে যৌথ পরিবার| ছেলেমেয়েসহ মোট ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জনের খাবারের যোগাড়আত্তি করতে হয় প্রতিবেলা| এক জেঠিমার ভাই তার দুজন সোমত্ত মেয়েকে নিরাপদ ভেবে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে| বাবার এক চিরকুমার কাকা তখন মরনাপন্ন | তাছাড়া একান্নবর্তী পরিবারের নানাবিধ সাংসারিক জটিলতা তো আছেই| সেবার আউশ ও পাটের ফলনও হয়েছিল খুব ভাল| যুদ্ধের ফলে জ়েঠামশাইদের ব্যবসায়ের টানটান অবস্থা জমিতে ভাল ফলনের জন্য পুষিয়ে গেল| তাই অন্যান্য বছর বর্ষাকালে সংসার নির্বাহের যে চিন্তা থাকে এবারে সেটা আর নেই|
জলেও মাছ পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর| বাড়ির সামনের খালে প্রতি বছরের মতো সেবারও কার্তিক হালদার ভেসাল জাল দিয়েছে| প্রতিদিন বিকেলেই বাড়ি যাওয়ার আগে বাড়িতে একটু থামে আর জেঠাদের বলে, দাদা, এবার এতো মাছ ভগবান দিয়েছে ভাবতে পারিনা|
নৌকার তলা দেখিয়ে বলে, মাঝে মাঝে এমন একটা ঝাঁক আসে যে, পা দিয়ে ঠেলে জাল উপরে ওঠাতে পারিনা| আর মাছের এত তেল আগে কখনো দেখিনি, দাদা| থাকবেই না কেন, ধলেশ্বরী দিয়ে তো কলা গাছের মতো মানুষের লাশ ভেসে যায়| মরা মানুষের চর্বি আর পচা লাশ খেয়ে খেয়ে মাছের যে বিশাল সাইজ এবার!
শ্রাবন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাবার ছোট কাকা, মানে ছোট দাদু মারা গেলেন| ছোট বেলায় রোগে পা দু’টো শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গিয়েছিল ছোট দাদুর| সারাজীবন লাঠির উপর ভর দিয়েই চলাফেরা করে গেলেন| বিয়ে-থা করলেন না| ভাতিজাদের সংসারেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন| বাড়ির দক্ষিন দিকে নারকেল আর কড়ুই গাছের মাঝখানে জলের পুরানো টিউবওয়েল| টিউবওয়েলের গা লাগোয়া বৈঠক ঘর, যাকে কাছারি ঘর বলে সবাই| সে বিশাল কাছারী ঘরের এক পাশে ছোট দাদুর ঘর| শেষদিকে আর চলাফেরা বিশেষ করতে পারতেন না| ধরে ধরে পায়খানা-প্রস্রাব করাতে হোত| মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হোত| বিছানার পাশে থাকা লাঠিটাই এক সময়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল ছোট দাদুর| একদিন সকালে সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন|
চারদিকে থমথমে অবস্থা| সকাল-সন্ধ্যা-রাত সব সময় এক উৎকন্ঠায় কাটে| সবার চোখ দক্ষিন দিকে| নিমাই বিলে কোন বড় নৌকা দেখলেই সবাই ভয়ে আঁতকে ওঠেন| এই বুঝি পাকিস্তানী মিলিটারিকে গ্রামে নিয়ে এলো রাজাকারেরা| বর্ষা এসেছে মাত্র মাসখানেকের বেশী হলো| তাই লঞ্চ নিয়ে এখনো মিলিটারি আসবে না; যদি লঞ্চের প্রোপেলার কোন কিছুতে আটকে যায় সে ভয়ে? তাই ভয় শুধু বড় বড় ছইওয়ালা নৌকায়|
ছোট দাদুর মৃত্যুতে বাড়িতে সবাই শোকে মূহ্যমান| কিন্তু কান্নার রোল নেই| অনেকে আবার হাঁফ ছাড়লেন এ ভেবে যে, বাড়িতে মিলিটারি আগুন দিলে সবাই পালাতে পারলেও ছোট দাদু কোথায় যাবেন? তাকে হয়তো বা ঘরের মধ্যেই পুড়ে মরতে হতো| তারচেয়ে ভগবান নিজ হাতে নিয়ে নিলেন সেটাই ভাল!
এদিকে ছোট দাদুর মরদেহ নিয়ে মুশকিলে পড়া গেল| গ্রামের শ্মশাণটা জলে প্রায় তলিয়ে গেছে| একটু টিবির মতো জায়গা তখনো জেগে আছে| কিন্তু যুদ্ধের এ অবস্থায় ছোট দাদুকে সৎকার করতে কেউ সাহসী হলো না| চিতার আগুন যদি পাকিস্তানী মিলিটারিকে হিন্দুগ্রাম চিনিয়ে দেয়?
বাবা মৃদু আপত্তি করলেন, পাকিস্তানী মিলিটারি কী আর চিতার আগুন দেখে চিনবে কোনটা হিন্দু গ্রাম? শুনেছি শওকত চেয়ারম্যান থানায় গিয়ে হিন্দু গ্রামগুলোর নাম-ঠিকানা দিয়ে এসেছে| কোন বাড়ির ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে গেছে, কোন বাড়িতে যুবতী বউঝি আছে সব তথ্য এখন থানায়| যাই হোক, তোমরা পুড়াতে না চাইলে, না পুড়াবে| তবে কাকার মৃতদেহকে তো কোথাও পুঁতে রাখতে হবে?
বড় জেঠামশাই বললেন, নৌকা করে ধলেশ্বরীতে নামিয়ে রেখে আসি কাকাকে| গঙ্গামার শরীরেই বি্লীন হয়ে থাকুক|
পাটের চটের বস্তা বড় একটা মশলা বাটার পাথরের পাটা ভরে লম্বা গলুইওয়ালা ছিপ নৌকায় তোলা হলো| শাস্ত্র মতে বাড়ির ঘাটে বড় জেঠা মুখাগ্নি করলেন ছোট দাদুর| তারপর চাঁটাই দিয়ে মুড়িয়ে নৌকার পাটাতনের নীচে লম্বা করে শুইয়ে দেয়া হলো| উপরে কাঠের পাটাতন বিছিয়ে কয়েকটা পাটের গাঁইটও তোলা হলো| যেন সবাই ভাবে, বেপারী নৌকা তরা হাটে যাচ্ছে পাট বেচতে|
ছোট দাদুর মৃতদেহ ধলেশ্বরী নদীতে চটের বস্তার সাথে বেধে নামিয়ে দেয়া হলো স্রোত দেখে মাঝ নদীতে| মরদেহ জলে নামানোর আগে মাথার দিকটা পূর্বদিক করে প্রথমে জলের সমান্তরাল করে রাখা হলো| তারপর ভারি চটের বস্তাটা জলের মধ্যে ছেড়ে দিল মন্টু | বাঁশের চাটাইয়ে জড়ানো ছোট দাদুর দেহ ধলেশ্বরীর জলে সোজা তলিয়ে গেল| বাঁশের চাটাই থেকে কয়েকটা জলের বুদবুদ উঠে ঢেউয়ের সাথে মিলিয়ে গেল নিমিষেই| মেঝো জেঠা তার আদরের কাকাকে মাঝ নদীতে ছেড়ে দেয়ার সময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন| বাকী সবাই ক্ষীনস্বরে ‘হরিবোল হরিবোল, বল হরি’ করতে করতে নৌকা গ্রামের দিকে নিয়ে এলো| প্রায় নিরবেই ছোট দাদুর অস্তিত্ব সংসার থেকে নেই হয়ে গেল সেদিন| পাড়ার কিছু মানুষ ছাড়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষই জানলো না, বাড়ির ল্যাংড়া-খোড়া সে বুড়োটা আর নেই|
(৭)
ত্রিশ দিনের অশৌ্চ পালন করা হলো বৈশ্য মতে| ছোট দাদু ছেলের মতো ভালবাসতেন মেঝ জ়েঠাকে| তাই তিনিই ছেলের মতো নিয়ম মেনে অশৌ্চ পালন করতে চাইলেন| পারিবারিক ব্রাক্ষণ বললেন যেহেতু বড় জ়েঠা মুখাগ্নি করেছেন, তাই বড় জ়েঠাকেই এক কাপড়ে এক মাস ছেলের ব্রত পালন করতে হবে| মেঝ জ়েঠার মন খারাপ| কিন্তু মন খারাপের সময় নেই এ যুদ্ধের খারাপ সময়ে| বড় জ়েঠা আর বড় জ়েঠিমাই ছোট দাদুর ছেলে আর ছেলে-বঊয়ের নিয়মে শাস্ত্র মেনে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য সদাকর্মে করতে লাগলেন|
বাড়ির সবার জন্য অল্প তেলে নিরামিষ রান্না হলেও মায়ের জন্য আলাদা রান্না হয় অনেকের অগোচরেই| মায়ের প্রসবের তখন আর মাস দেড়েক বাকী| তাই বড়মা অর্থ্যাত সেজো জেঠিমা বাবার সাথে যুক্তি করে মায়ের জন্য আমিষের ব্যবস্থা করতে লাগলেন| কার্তিক জেলের কাছ থেকে গোপনে মাছ চলে আসতো বড়মার কাছে| দুপুরে সবাই যখন বাড়ির অন্য কাজে ব্যস্ত বড়মা তখন পাশের বাড়ি থেকে মাছের ঝোল রেঁধে নিয়ে আসেন মায়ের জন্য|
মা একবার মৃদু আপত্তি করলে বড়মা ধমকে উঠে বললেন, ওই মেয়ে, তুই সন্তানের মর্ম বুঝবি কি করে লো? তোর তো দু’বছর পর পর বাচ্চা হচ্ছে; হতিস আমার মতো বাঝা তখন বুঝতিস? এই পেটে বিশ বছরে একটা সন্তানও ধরতে পারিনি| আমি বুঝি সন্তান পেটে ধরা কী জিনিস| যে গেছে তার জন্য শোক না করে, যে আসবে তার জন্য ব্যবস্থা কর|
বাবার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন বড় মা সংসারে আসেন| বড়মারই বা কত বয়স তখন? বড়জ়োর বারো তেরো হবে| তারপর থেকে নিঃসন্তান বড়মা সন্তান হিসেবে মানুষ করেছেন বাবাকে| বিয়ের পর এ সংসারে এলে বড়মাই মাকে আগলে রেখেছে কখনো বড় দিদি, কখনো বা মায়ের মমতায়| মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, দু’মাসের সে শিশু সন্তানকে নিয়ে মহুকুমা শহরে গিয়ে পরীক্ষা দেয়া সেও তো সম্ভব ছিল বড়মার জন্যই| তার বছর দেড়েকের মধ্যেই আরেক কন্যাসন্তান| কিন্তু বড়মাই মায়ের লেখাপড়ায় বন্ধ করতে দেননি| বাড়িতে পড়েই মা তখন ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম শ্রেনী পান প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে| সব কিছুরই পেছনে বড়মা|
বাবাও বড়মার কথার বাইরে কিছুই করেন না| তাছাড়া সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফেরার অভ্যেস বাবার| এখন তো ইস্কুলে যাওয়ার কথা বলে সারাদিন মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করা নিয়েই সারা এলাকা ঘুরে বেড়ান| বড়মার ভয় সেখানেই| বারবার বাবাকে বলছেন, শোন তুই ইণ্ডিয়া চলে যা| তোর শ্বশুর বাড়িতে কিছুদিন থেকে আয়| ছোট বউয়ের দায়িত্ব আমি নেব|
বাবা জানেন বড়মাকে কোন কথায় বশে আনা যাবে| বাবা বলেন, ঠিক আছে বৌদি, তুমি যখন বলছো ইন্ডিয়াতেই যাই| কিন্তু ছেলে আর স্ত্রীকেও নিয়ে যাবো সংগে| ওদের রেখে আমি যেতে পারবো না|
বড়মা এবার পিছু হটেন| ছেলেকে অর্থ্যাত আমাকে সারাক্ষণ বুকে-পিঠে করে রাখেন বড়মা| চোখের দূরে আমাকে নিয়ে যাবে শুনে বড়মা আঁতকে ওঠেন| কথা ঘুরিয়ে বলেন, বালাই-ছাট! আমাদের এ বিল এলাকায় মিলিটারি আসবে কোন সাহসে? শুনেছি ওই খান-সেনারা নাকি সাঁতারই জানে না? ওদের জীবনের মায়া আছে না?
কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরেই বড়মার কথা মিথ্যে প্রমানিত হলো| সকাল গড়িয়ে সবেমাত্র দুপুর| বাবার সেদিন বেরোতে একটু দেরী হয়েছে| উত্তর দিকের বাঁশের ঝাড়ের কাছে রান্না ঘর আমাদের| বাবাসহ কয়েকজন রান্না ঘরের বারান্দায় কাঠের পিঁড়ি পেতে দুপুরের ভাত খাচ্ছেন| হঠাত করে কেউ একজন চিৎকার করে উঠলো, নিমাই বিলের মাঝ দিয়ে দৌলতপুর থানা থেকে দুই নৌকা মিলিটারি নাকি পূর্বদিকে অর্থ্যাত আমাদের গ্রামের দিকে আসছে|
কোথায় রইল ভাতের থালা? কোথায় খাবার-দাবার? সবাই যে যার মতো বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো| সবাই জানে গ্রামে মিলিটারি আসলে এ বাড়িতেই আসবে এবং টার্গেট বাবা| কয়েকদিন আগেই কালু রাজাকারের সাথে বাবার কথা কাটাকাটি হয়েছে| বাবা নির্বিকার রইলেন| আস্তে করে হাতটা ধুঁয়ে বললেন, কেউ চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না| আমি আগে দেখি আসলেই মিলিটারির নৌকা কিনা?
বাবা ভিতর বাড়ি থেকে বাইরের উঠোনে এলেন| তারপর দক্ষিন-পশ্চিম দিকের কড়ুই গাছের নিচে ধানের খড়ের পালার আড়াল থেকে দেখলেন, দু’টো বড় বড় ছইওয়ালা নৌকা গ্রামের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকের বটগাছের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে| নৌকার সাইজ ও ছইয়ের ওপর মানুষজনের নড়াচড়া দেখে বুঝলেন এগুলো পাকিস্তানী মিলিটারির নৌকা|
বাবা বড়মাকে বললেন, বৌ্দি তুমি ছেলে আর ছোট বউকে নিয়ে বহেরাতলির মুসলিম পাড়ায় চলে যাও| আর বাড়ির মেয়ে আর অন্য বউদেরকেও পারলে অন্য কোথাও পালাতে বলো| মনে হয় রাজাকারের পাকিস্তানী মিলিটারি নিয়েই আসছে এদিকে|
বড়মা বললেন, তুই কী করবি? তোরই তো আগে পালানো উচিত| তুইও চল আমাদের সাথে|
বাবা বললেন, আমি তো আর একা মিলিটারির সাথে লড়তে পারবো না| তাছাড়া এ বাড়িতে আমরা যত লোকজন অস্ত্র ছাড়া হয়তো কেউ ঢুকতে পারবে না| কিন্তু লাঠি নিয়ে তো আর অস্ত্রের সাথে যুদ্ধ করা যাবে না| তাছাড়া বর্ষার দিন, পালানোর জায়গাও নেই| তাক করে করে গুলি করবে ওরা| তাই আমাকেও পালাতে হবে| তবে তুমি আগে যাও ছোট বউকে আর ছেলেকে নিয়ে|
বাবা অন্য সবার মতো মাকে ছোট বউ বলতেন সবার সামনে| মাকে ডেকে বললেন, পূবদিকের ঘাটে ছোট ডিংগি নৌকাটা আছে| তুমি ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি মুসলিম পাড়াও যাও| বৌ্দি আর ভাস্তেদের কাউকে সাথে নিও নৌকা তো চালাতে হবে| দেরি করো না, তাড়াতাড়ি কর|
মা কিছু বলতে চাচ্ছিলেন| বাবার ধমকে মায়ের সে কথাটা আর স্পষ্ট করে বলা হলো না| বড়মা আমাকে কোলে নিয়ে মায়ের হাত ধরে পূবদিকের নৌকা ঘাটের দিকে দৌঁড় দিলেন|
নৌকায় ওঠার পর মায়ের মনে হলো মেয়েকে তো আনা হয়নি? আমার দু’বছরের বোন হয়তো কোন জেঠাতো বোনের কোলে ছিল| ওকে নিয়েই হয়তো জেঠাতো বোনটি আমাদের বিরাট বাড়ির কোন ঝোপজংগলে কিংবা ঘরের মধ্যে পালিয়েছে| মা তাঁর দুবছরের মেয়েকে রেখে পালাতে হচ্ছে বলে কেঁদে উঠলেন| ছোট ডিংগি নৌকায় তখন আমি,মা, বড়মা আর নয়-দশ বছরের আরেক জেঠাতো ভাই বীরেণ| কে নৌকা চালাবে? নৌকা সোজা করেই বা রাখবে কে? এত সব কিছুই মনে না করে বাবা তখন ঘাট থেকে নৌকা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে নিজে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন| আমি বড়মাকে জোরে জড়িয়ে ধরে, বাবা ,বাবা বলে কেঁদে উঠলাম| বড়মা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে নৌকার মাঝখানের গুঁড়ার কাঠের মধ্যে জোর করে বসিয়ে দিল|
বড়মা বীরেণকে একটা বৈঠা দিয়ে বললো, বাবা, তুই পেছনের গলুইয়ে গিয়ে নাও সোজা করে রাখতে পারবি না?
নয়-দশ বছরের বীরেণ তখনই বৈঠা চালাতে শিখে গেছে| বীরেণ তাড়াতাড়ি পেছনের গলুইয়ে গিয়ে বৈঠা নামালো| বড়মা আরেকটা বৈঠা নিয়ে সামনের গলুইয়ে গিয়ে সামনের দিকে বৈঠা দিয়ে জল কাটতে শুরু করে দিলেন| মা আমার পাশে বসে অসহায়ের মতো বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন|
আমাদের বাড়িটি গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে| তার পাশ দিয়েই একটি ছোট খাল গিয়ে মিশেছে নিমাই বিলে| খাল দিয়ে সিকি মাইলের মতো গেলেই আরেকটি মুসলিম পাড়া| জুগিন্দা| খালের গা-লাগোয়াই রহিমুদ্দিন খলিফার বাড়ি| রহিমুদ্দিন চাচার কাছে লুংগি সেলাই থেকে শুরু করে ছোট খাঁটো জামা-কাপড় বানায় সবাই| আমাদের বাবা-জেঠাদের সাথেও রহিমুদ্দিন চাচা ও চাচীর ভাল সম্পর্ক| সে কথা চিন্তা করেই বড়মা বীরেণকে বললেন, নৌকা খলিফা বাড়ির দিকে ধরে রাখ|
খালের জলে তখন তেমন স্রোত নেই| কিছু কচুরিপানার থোক থোক ঝাঁক নৌকাকে মাঝে মাঝে থামিয়ে দিচ্ছে| বড়মা তার অনভ্যস্ত হাতে যত জোরে পারেন নৌকা সামনের দিকে চালাচ্ছেন| পেছন থেকে বীরেণ বারবার বলে উঠছে, জেঠি আর পারি না তো?
-আর একটু সোজা করে রাখ বাবা| এই তো একটু গেলেই খলিফা বাড়ি|
বীরেণ তার ছোট্ট হাতের দক্ষতায় বৈঠা দিয়ে জল কেটে কেটে বড়মাকে সাহায্য করছে| মা এক হাতে আমাকে, অন্য হাতে তলপেট শক্ত করে ধরে আছেন|
নৌকা রহিমুদ্দিন খলিফার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন| হঠাত করে দেখা গেল রহিমুদ্দিন চাচার ছেলে বাঁশের বড় একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে| ঘাটে নৌকা ভিড়ানোর আগেই জোরে জোরে বলছে, মালাউনের কোন জায়গা নেই আমাদের বাড়িতে| যা অন্য বাড়িতে যা|
বড়মা বলছে, দিলু তোরা এই বিপদের দিনে এমন করছিস কেন? আমাদের একটু আশ্রয় দে, মিলিটারি গেলেই তো আমরা চলে যাবো| ও বুজি, তুমি দিলুরে একটু থামাও না|
বুজি অর্থ্যাত রহিমুদ্দিন খলিফার বউ বড়মার কথা না শোনার ভাণ করে অন্য দিকে সরে গেল| দিলু জলের আরো কাছাকাছি নেমে এসে লাঠি দিয়ে জলে আঘাত করতে লাগলো| একেবারে ঘাটের কাছাকাছি নৌকা চলে এসেছে দেখে দিলু আরো চিৎকার করে বলতে লাগলো, নাও ঘাটে ভিড়ালে কিন্তু লাঠি দিয়ে মাথায় মারবো, মালাউনের বাচ্চারা|
বীরেণ দিলুর লাঠি দেখে ভয় পেয়ে হাতের বৈঠা ছেড়ে দিয়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো| মা পেটে হাত দিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো| বড়মাকে বললো, দিদি চল বাড়ির দিকে যাই| আমি আর পারছি না|
বীরেণের হাতে আর নৌকার হাল নেই| বড়মার শত কাকুতি মিনতিতেও দিলুদের মন একটুও নরম হলো না| রহিমুদ্দিন চাচা কিংবা তার স্ত্রীকেও আর বাড়িতে দেখা গেল না| কিছুতেই নৌকা রহিমুদ্দিন খলিফার ঘাটে ভিড়ানো গেল না| নৌকা তখন খাল পেরিয়ে প্রায় নিমাই বিলের মুখে চলে এসেছে| মায়ের চিৎকারে আমি আর বীরেণ হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম|
বড়মা আবার শক্ত হাতে সবকিছু সামলানোর চেষ্টা করলেন| বীরেণকে আবার বললেন, বাবা, আর একটু সময় নৌকাটা সোজা করে রাখ| মাত্র একটু তো বিল| পাড়ি দিলেই বহেরাতলী| নুরুদের বাড়ি ওই দেখা যাচ্ছে| ধর একটু বাবা|
বীরেণ আবার নৌকায় তুলে রাখা বৈঠা জলে নামালো| বড়মা সামনে দিকে নৌকা চালাতে লাগলেন| আধামাইলের মতো নিমাই বিল তখন যেন এক মহাসমুদ্র| এদিক দিয়েই তো মিলিটারির নৌকা আসবে| তাই যত তাড়াতাড়ি বিলের ওদিকে ধান খেতের কাছে পৌঁছুতেই হবে|
অনেক কষ্টে নিমাই বিল পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতেই দেখা গেল বহেরাতলী থেকে কয়েকজন একটা নৌকা নিয়ে এদিকে আসছে| বড়মা একটু সাহসে বুক বাঁধলেন| কিছুক্ষণ পরে নৌকাটা কাছে আসতে দেখা গেল নুরু আর আরশাদ কয়েকজনকে নিয়ে এগিয়ে আসছে| নুরু আরেকজনকে নিয়ে আমাদের নৌকায় এসে সজ়োরে বৈঠা চালিয়ে বহেরাতলীর তমিজদের বাড়িতে নৌকা ভিড়ালো| বড়মা মাকে হাতে ধরে নৌকা থেকে নামাতেই বড়মার গলা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মা| ততক্ষণে তমিজের বউ মাকে ধরে বাড়ির উঠোনে বসিয়েছে|
তমিজদের নৌকা ঘাটের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল পাকিস্তানী মিলিটারির নৌকা আমাদের বাড়ির ঘাটে ভিড়ে গেছ|
আগের পর্বগুলোর লিঙ্ক –
আবারো মুগ্ধ হলাম।
পুরো লেখাটি অবশ্যই একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ হবে নিশ্চিত। এমন লেখা আমাদের দেশে খুবই বিরল।
মাঝে মাঝে প্যারা গ্যাপ দেবেন, নইলে পড়তে সমস্যা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অনেকের অবদান এরকম জলের বুদবুদ উঠে ঢেউয়ের সাথে মিলিয়ে গেছে স্বাধীনতার পরপরই। এরই গল্পগাঁথা যেন দেখছি চন্দ্রমুখী জানালা দিয়ে।
জানি না, অপ্রাসংগিক হচ্ছে কিনা লেখার সাথে; তবুও নোটটি দিলাম।
“কাবুলিওয়ালার বাঙালী বউ’ আর নেই।সুস্মিতা বন্দোপাধ্যায় নামের সেই সাহসী লেখক মেয়েটি আর নেই। আফগানিস্তানে নিজ শ্বশুরবাড়িতে তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছেন সুস্মিতা।
মনে পড়ে “কাবুলিওয়ালার বাঙালী বউ” বইটি পড়ি টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরীর ডয়েজ রোড শাখা থেকে তুলে ২০০১ সালে। কোন বাংলাপ্রেমী হয়ত বইটি কলকাতা থেকে এনে দান করেছিলেন লাইব্রেরীতে! এক সাহসী মেয়ের কলকাতার বাইরে সুদূর আফগানিস্তানে এক প্রথাবিরোধী জীবনযাপন নিয়ে অপূর্ব লেখা পড়ে আমি বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে বইটি পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল এবং কয়েকবার বেষ্ট সেলারও হয়েছিল শুনেছি। তাঁর কাহিনী নিয়ে হিন্দি ছবি তৈরী হয়েছিল ” এসকেপ ফ্রম তালিবান”।
লেখার প্রতি অদম্য নেশা, সেই সাথে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধ সুস্মিতাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল চরম বিপদসঙ্কুল আফগানিস্তানে। কিন্তু মানবতার শত্রু তালেবান তাঁকে বাঁচতে দেয়নি; বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে সুস্মিতাকে।
মালেলা ইউসুফ বেঁচে গেছে কিন্তু সুস্মিতা বাঁচতে পারেননি। সুস্মিতার স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। তালেবান, আল-কায়দাসহ ধর্মীয় চরমপন্থীদের প্রতিহত করার মাধ্যমেই সুস্মিতাদের আত্মত্যাগের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে। আসুন, ধর্মীয় মৌলবাদ ও তাদের সহযোগীদেরকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করি।
যুদ্ধই বুঝি মানুষকে এমন অমানুষ বানিয়ে দেয়। আরো লিখুন। এই সব অমূল্য কথনসমূহ বাংলাদেশের ইতিহাসটি সঠিকভাবে জানার জন্য জরুরি।
এই ধারাবাহিকটি অনলাইইনপত্র গুরুচণ্ডালি ডটকম-এর ‘মুক্তিযুদ্ধের কথা’ নামক সংকলনে যুক্ত করা হয়েছে। (Y)
পুনশ্চ: আপনার নোটগুলোর বর্ণনা খুব প্রাণোজ্জ্বল। লেখার ভেতরে ছোট ছোট প্যারা [লাইন স্পেসসহ] থাকলে পড়ারার সময় চোখের আরাম হবে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সামগ্রিকভাবে শুধু একটি জাতির যুদ্ধ নয়,কোটি পরিবারের তীব্র যন্ত্রনা,লাঞ্ছনা এবং আত্মত্যাগের ইতিকথা| “চন্দ্রমুখী জানালা”-য় সে কোটি পরিবার থেকে শুধু কয়েকটি পরিবারের দুঃখগাঁথাকে তুলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে মাত্র|মুক্তিযোদ্ধা ব’লে ব’লে যাঁরা সবসময় আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে অভ্যস্ত, ইতিহাসে স্থান না পাওয়া অসংখ্য সাধারণ মানুষের সাহসিকতার লড়াই যে তাঁদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়, সেটাও এ ধারাবাহিকটির উপজীব্য|মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির আজকের এ আপাতঃ আস্ফালন হয়ত সম্ভব হয়েছে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতার সে বীরত্বগাঁথাগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যর্থতার জন্যই|
আপনি সুলেখক। আপনার রচনাশৈলির গুণে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের এই অজানা অধ্যায়গুলো। ইতিহাসে স্থান না পাওয়া এইসব মানুষগুলো, যাদের অবদানে আমাদের বাংলাদেশ তাদেরকে সবার কাছে পরিচিত করার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও আপনার দায় মিটলো। আর আমাদের দায় রইল লেখাটি পড়ে সেই সময়ের মানুষগুলোর জন্য হৃদয়ে সহানুভূতি ধরে রেখে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এইরকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অধ্যায়গুলো বেশি বেশি করে পড়া। এর মধ্য দিয়েই একটা জাতি তার জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তির সঠিক উত্তোরাধীকারী হতে পারে। ভজন সরকার আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়…।
অসাধারণ বর্ণনা,তাই বোধহয় সাধ মেটে না।পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।অনেক সময় নানা করণে প্রথম পাতা থেকে লেখা সরে যেতে বেশ দেরি হয়,যেমনটা আগের পর্বে হয়েছে।সেক্ষেত্রে ৩/৪ চার দিন পরে আপনি নিজেই প্রথম পাতা থেকে লেখাটি সরিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে নিয়ে, নতুন পর্ব দিতে পারেন।