১.
বিশিষ্ট নাগরিক: ইতিহাস কখনো আওয়ামীলীগকে ক্ষমা করবে না। এমন একটা সুযোগ তারা হেলায় হারাল? নির্বাচকমণ্ডলীর সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল?

টক শো উপস্থাপক: কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম যেহেতু একটি সেন্সেটিভ ইস্যু, আ’লীগ সরকার চাইলেই কি এটি তুলে দিতে পারত? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলিম কি তা মেনে নিত?

বিশিষ্ট নাগরিক: কেন মেনে নেবে না? ভেবে দেখুন, ৩০০ সিটের মধ্যে ২৬৩টিই আওয়ামিলীগ ও তার সহযোগীদের দখলে। অর্থাৎ, তিন-চতুর্থাংশ আসনেরও বেশি। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনার পক্ষে ম্যান্ডেট দিয়েছে? স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এত বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসার নজির আছে আর? অথচ আ’লীগের কাছ থেকে জনগণ এবার প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। সুতরাং, সিটি নির্বাচনে এই দলের ভরাডুবি হবে না তো, কার হবে?

টক শো উপস্থাপক: কিন্তু তিন-চতুর্থাংশ ভোটার যে বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃ-প্রতিষ্ঠার পক্ষেই ভোট দিয়েছে, তা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?

বিশিষ্ট নাগরিক: ভোটের প্যাটার্নটা দেখেন। আগেরবার মাত্র সামান্য কটি আসনের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আ’লীগ। তখনকার দুর্বল সরকারের পক্ষে আসলেই ৭২ এর সংবিধান ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি রাজাকারের বিচারকার্যটাও তারা সংগত কারণেই শুরু করতে পারেনি। আ’লীগের সেই অসহায়ত্ব ঠিকই মনে রেখেছিল ভোটারগণ। তাই ২০০৮ এ ভোট-বাক্স উপচে ভোট দিয়েছে তারা আ’লীগকে, আসলে দলটিকে আর কোন অজুহাত খাড়া করার সুযোগ দিতে চায়নি ভোটাররা, ৭২ এর সংবিধান পুনরুদ্ধারে তারা ছিল বদ্ধপরিকর। লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, বিগত নির্বাচনে আ’লীগ একাই পেয়েছে ২৩০ টা সিট। এটাও বলতে পারেন… ভোটাররা সচেতনভাবেই করেছে। উদ্দেশ্য, সহযোগীরা বিট্রে করলেও যেন আ’লীগ একা একাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অথচ জাতির দুর্ভাগ্য, সহযোগীরা নয়, বরং আ’লীগ নিজেই বেইমানি করল জাতির সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষদের দীর্ঘদিনের একটা স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল!

২.
রতনপুর থানা-আ’লীগ কমিটির সভাপতির ছেলের স্কুলবন্ধুঃ হ্যাঁরে, তোগো দলরে তো সবাই নাস্তিক কইতাছে। হুজুররা যেভাবে মাঠে নামছে, তাতে তোগো তো আর কোন চান্স দেহি না!

ছেলে: হুজুরগো আর কি দোষ, ক? কতগুলান বাম আঁতেল অহন পুরা দলডারে নিয়ন্ত্রণ করতাছে। আ’লীগরে আস্ত কমুনিস্ট পার্টি বানাইয়া ছাড়ব এই আতেলগুলি!

বন্ধু: কি কস? তা কেমনে হয়? আ’লীগ আর বামফ্রন্টের লগে তো চিরকাল দা-কুমড়ার সম্পর্ক দেইখা আইতেছি! কেউ কারে দেখতে পারে না!

ছেলে: আরে কুতুব, আ’লীগের কোলে বইসা মুড়ি খাওয়া বাম নাস্তিকগুলার কথা কইতেছি আমি! দেখ, বঙ্গবন্ধুরে নিয়া সামান্য কটু কতা কইলে, লগে লগে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু নবীর বিরুদ্ধে কতা কইলে কোন অ্যাকশান নেয় না। এগুলি বাম আপদগুলার প্লান মোতাবেকই হইতাছে। আজ যদি নবীকে নিয়ে কটুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত, তাইলে হেফাজত এত উজাইতে পারত? মন্ত্রীগো হেফাজতের বিরুদ্ধে কতা কওয়ার কি দরকার আছিল, ক ত দেহি? শাহবাগরে যেখানে মাসের পর মাস রাখতে পারছে, সেইখানে হুজুরগো একটি রাইত থাকতে দিলে কি মাথার উপর আসমান ভাইঙ্গা পড়ত? তাছাড়া হেফাজতের ১৩ দফার বিরুদ্ধে কতা কওনের কোন দরকার আছিল? আচ্ছা, তুই আমারে ক, হেফাজতের কোন দাবিডা অযৌক্তিক? কোন মুসলমানের কি এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা জায়েয? এই ১৩ দফা মাইনা নিলে আ’লীগের ভোট কি পরিমাণ বাড়ত, চিন্তা কর? হুজুরগো আর কি দোষ দিমু, আমারই তো মাঝে-মইদ্যে মনে হয়, আ’লীগ দলডা আস্তে আস্তে হিন্দু লীগে পরিণত হইতেছে! দেখ, হিন্দুরা বুক ফুলাইয়া হাটতে পারে এই দেশে, কিন্তু টুপি-দাড়িওয়ালারা ভয়ে ঘর থাইকাই বাইর হইতে পারে না।

বন্ধু: বুঝলাম। কিন্তু হিন্দু লীগ ক, আর কমুনিস্ট লিগই ক, তোদের বাণিজ্য ত অটুট আছে, হাট-ঘাট-মহাল সবগুলা থেকেই তো নিয়মিত কড়ি আসে! উহ! কাঁচা পয়সার গন্ধই আলাদা! আচ্ছা, তোদের তো এহন পোয়াবারো… তরা আমলীগের উপর এত ক্ষেপা ক্যান?

ছেলে: দ্যাখ, দলের সমালোচনা করাই দলের বিরুদ্ধে যাওয়া না। দলরে ভালবাসি বইলাই ত সমালোচনা করি। দলের আসল শুভাকাঙ্খি আমরাই।

বন্ধু: হা হা, তুই তো তাইলে অনেক মহৎ! মহৎ না হইলে কেউ নিজের দলের সমালোচনা করতে পারে! যাই হোক, আমলীগ দলডার উন্নতির লাইগা কি করা উচিত বইলা মনে হয় তর?

ছেলে: কিছু বিষয় বদলাইতে হইব। সর্বপ্রথম বামগুলিরে ধাক্কা দিয়া বাইর করতে হইব। শাহবাগের নাস্তিক মঞ্চ এই বাম নেতাগুলার প্লান। তাছাড়া, আরও কিছু কাজ করতে পারলে মন্দ হইব না। যেমন: নজরুলের গান জাতীয় সংগীত করা উচিত। হিন্দু তোষণ বাদ দেয়া উচিত। আমলীগের বুঝা উচিত, হিন্দু তোষণ বন্ধ করলেও হিন্দুগো ভোট হাতছাড়া হইব না। বরং, হিন্দুগো নিয়া বেশি আদিখ্যেতা করলে মুসলিম ভোট হারাইতে হইব। তবে আ’লীগ যদি সাহস কইরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাদ দিতে পারে, তাইলে সবচেয়ে ভাল হয়। দেখ, বাঙালি জাতীয়তাবাদে কেমন যেন ভারত, ভারত আর হিন্দু, হিন্দু গন্ধ! আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাগো পরিচয় বাংলাদেশীই হওয়া উচিত।

বন্ধু: কি কইলি??? তুই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করস না?? আইচ্ছা, দোস্ত, ভাল কইরা ক ত, তোরা নেক্সট ইলেকশানে আবার পোলটি দিবি না তো?

ছেলে: পাগলের মত কথা বলিস না। বিএনপিতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আর বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদও জিয়ার ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। জিয়া কউক আর যেই কওক, যেটা সত্য, সেটা একদিন প্রকাশ পাইবই। বরং আজ আমলীগ যদি এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করতে পারে, তাইলে দেখবি বিনপির সত্তর ভাগ ভোট আমাগো বাক্সে ভরতে পারমু।

বন্ধু: মন্দ কস নাই। তয় বিএনপির ভোট ভরতে যাইয়া, নিজেরাই বিএনপির ভিতর ভইরা যাইস না আবার!

ছেলে: তুই চিরকালই বেকুব রইয়া গেলি, নইলে বুজতি, এইডা কহনও হওয়া সম্ভব না। আমরা কয়েক পুরুষ ধইরা আমলীগ করি। আমলীগ ছাইড়া আমরা যামু কই? আমলীগের জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ আছে, অনেক নির্যাতন ভোগ করতে হইছে, জেল-জরিমানা গুনতে হইছে। আমাগো যত নাম-ডাক, তা তো আ’লীগ করি বইলাই। এতদিনের অর্জন কি আমরা পানিতে ফালায় দিমু?

৩.
রিকশাওয়ালার বউঃ নাউজুবিল্লাহ্‌! নাউজুবিল্লাহ্‌! কি ভাইবা যে নৌকায় ভোট দিছিলাম! কি জবাব দিমু হাশরের ময়দানে!

রিকশাওয়ালা: কই থাইকা কি হাবিজাবি শুইনা মাতারির মাতামুতা দেহি সব গেছে!

রিকশাওয়ালার বউ: কি কইলা, তুমি? আমাগো মুর্শিদা ভাবি কি হাবিজাবি কওনের মানুষ? হের মত পরহেজগার আমাগো পাড়ায় আর কেডায় আছে? হেই ত আইজ সকালে কইল, আমাগো নেত্রী নবীরাসুলরে নিয়া টিটকারি করছে! তওবা! তওবা! এমুন কতা ত মুখে আনাও পাপ!

রিকশাওয়ালা: আরে থোও তোমার মুর্শিদি ভাবি! হেই ত দাঁড়িপাল্লা করে, ক্যান তুমি জান না? একটা জিনিস সবসোময় মাতায় রাখবা, আম্লিগের ভিতর আর বাইরে কুনো ফারাক নাই। অন্য দলের নেতারা মুখে ইসলামের কতা কয় ঠিকই, কিন্তু হারা দিন মাতাল থাকে। মজিবরই ইসলামের সব থাইকা বেশি খেদমত করছে। মজিবরই ত মদ, জুয়া নিষিদ্ধ করছিল, রেসকোর্স উঠাইয়া দিছিল। ভালমত শুইনা রাখ, মজিবরের মত পরহেজগার নেতা বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়ডা আসে নাই, আর মাইয়াডাও পাইছে বাপের স্বভাব, ধর্মকর্মে কহনও অবহেলা করতে দেহি নাই! নেত্রীর মাথা থনে কহনো ঘোমটা সরতে দেকছ? হুনছি, নেত্রী পরতেক দিন সকালে নিয়ম কইরা কোরআন তেলোয়ত করে।

৪.
চাকুরিজীবীঃ কোন বদখেয়ালে যে আ’লিগরে ভোট দেয়ার কথা মাথায় আইছিল, আল্লাহ্‌ জানে!

সহচাকুরিজীবিঃ কি কন? আপনি নৌকায় ভোট দিছিলেন গেলবারের ইলেকশানে? আজব ব্যাপার! আপনারে তো কহনও আ’লীগপন্থী মনে হয় নাই!

চাকুরিজীবীঃ সত্য কথা কি জানেন, আমি ভোটটারে নষ্ট করতে চাই না। গতবার তো একটা নাবালক শিশুও বইলা দিতে পারত, আ’লীগ জিতব।

সহচাকুরিজীবীঃ শুধু এই কারণেই নৌকায় ভোট দিচ্ছিলেন?

চাকুরিজীবীঃ না, শুধু এই কারণেই না। আসলে বিএনপিরেও ভোট দিতে ইচ্ছা করতেছিল না। ভাবছিলাম, তারেইক্কার হাতে পড়লে দেশটা শ্যাষ হইয়া যাইব! আপনি জানলে অবাক হইবেন, হাওয়া ভবন আমার নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকেও টাকা খাইছে। অন্যদিকে, আমলীগ যা বড় বড় খোয়াব দেখাইছিল, সহজে ভুইলা গেলাম! ক্যান, আপনার মনে নাই? ঘরে ঘরে চাকরী। দশ টাকা কেজিতে চাইল।

সহচাকুরিজীবিঃ তাইলে এইজন্যই আপনের ক্ষোভ! ঘরে ঘরে চাকরি দিলে বা জিনিসপত্তের দাম এক টাকাও না বাড়লে আপনি আমলীগের প্রতি সন্তুষ্ট থাকতেন?

চাকুরিজীবীঃ থোন ঘরে ঘরে চাকরি! গেলবারের আমলিগ তাও কিছু রাস্তা-ঘাটের কাজ করছিল, এবার তো কোন কাজই হয়নাই। উলটা এমন আইন করছে, আমাগো পেটে লাথি মারে। আমার এক দূর সম্পর্কের শ্যালকরে একটা ৪র্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরীতে ঢুকাইয়া দেয়ার জন্য এলাকার আম্লিগ এমপির কাছে গেছিলাম। জানেন, কত টাকা চায়? দশ লাখ। শেয়ার মার্কেটে আমার কিছু সঞ্চয় ছেল, এবারকার আমলীগ আমলে তাও গ্যাছে। তারপরও জিগাইবেন, আমলিগের প্রতি আমরা সন্তুষ্ট না ক্যান?

সহচাকুরিজীবিঃ খুবই দুঃখজনক। কিন্তু আপনি যেইসব দুর্নীতি-ফুর্নিতির কথা কইলেন, এগুলান তো কম-বেশী বিএনপি আমলেও হইছে।

চাকুরিজীবীঃ দেখেন, বিএনপি দুর্নীতি করলেও ধর্ম নিয়া টান দেয় নাই। সবার উপর ধর্ম। বিনপিরে ভোট দিলেও না খাইয়া থাকতে হইব হয়ত, কিন্তু আমলিগরে ভোট দিলে সাক্ষাৎ দোযখে যাইতে হইব! মাঝে মইদ্যে মনে হয়, আমরা মুসলমানরাই এই দ্যাশে মাইনরিটি, আর হিন্দুরাই মেজরিটি!

৫.
স্কুল মাস্টারের ছেলে: বাবা, সবাই যা কওয়াকওয়ি করতাছে, তা কি সত্য?

স্কুল মাস্টার: কি কওয়াকওয়ি করতাছে?

ছেলে: আ’লীগ সরকার নাকি পয়গম্বরের অবমাননা করছে?

স্কুল মাস্টার: না বাবা, এইটা একটা অপপ্রচার। স্বাধীনতা বিরোধীদের পুরনো কৌশল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নাস্তিক আর বিধর্মী বলত। আজ যখন রাজাকারদের বিচার চলতাছে, সেই বিচার ঠেকানোর জন্য তারা আবার মাঠে নামছে পুরনো কৌশল নিয়া।

ছেলে: কিন্তু আমার কয়েকজন বন্ধু কয়, আ’লীগ নাকি সবসময় ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে?

স্কুল মাস্টার: দেখ বাবা, আ’লীগ ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ মানে, আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু ধর্মহীনতা না, ধর্মনিরেপেক্ষতা মানে হল, আ’লীগ সব ধর্মের মানুষকে সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে, সবাই যাতে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা বিধান করার কথা বলে।

ছেলেঃ তাইলে, বাবা, সবাই আ’লিগের এত বদনাম করে কেন?

স্কুল মাস্টার: এই বদনামের জন্য, বাবা, আ’লীগই কিছুটা দায়ী। আসলে আ’লীগ আর আগের মত নাই। আস্তে আস্তে বদলায় যাইতেছে। আ’লিগের মইদ্যে অনেক স্বাধীনতা বিরোধী ঢুইকা পড়ছে। তবে আ’লীগ আপোষ করলেও অন্তত মেনিফেস্টোতে ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ – এইসব আদর্শ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়, রাজাকারদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আর পুরোপুরি না পারলেও অন্তত কিছু কিছু বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। আসলে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গড়তে চায়, তাদের কাছে, বাবা, এখনো আ’লীগের বিকল্প নাই।