১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের বাঙ্গালীর গর্ব কেননা ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতার সংগ্রামের মাধ্যমে যে মুক্তির জয়গান আমরা দেখিছি তার লিখিত রুপই ছিল ১৯৭২ এর সংবিধান। জাতিগত মূলনীতি, মৌলিক চেতনা এবং শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কথাই ছিল সেই মহান সংবিধানে। বলা হয়ে থাকে তাবৎ দুনিয়ার সেরা লিখিত সংবিধানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেরটাই অনেক দিক দিয়েই অনন্য, অনবদ্য, মহাকাব্যিক এবং জনসম্পৃক্ত; তাহলে এই অমূল্য সম্পদের সদ্ব্যবহার আমরা করতে ব্যর্থ হলাম কেন?
এই বহুমাত্রিক প্রশ্নের কিছু উত্তরের খুঁজে বারবারই ৭২-এর সংবিধান এর সামরিকোচিত দূষণসমূহ আসে মোটা দাগে, আমরা একটু নজর বুলিয়ে নিই ওইসব দূষণের দিকেঃ
১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় দূষণসমূহঃ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা

[বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম]
(দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)

প্রস্তাবনা

আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;

আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে ;

আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;

আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;

এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠারো তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে, আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।

The Second Proclamation (Fifth Amendment) Order, 1978 এর 2nd Schedule বা সংবিধান (৫ম সংশোধন) আইন, ১৯৭৮ এর ২য় ধারাবলে নিম্নোক্ত দূষণত্রয় করেন-

ক) ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ শব্দগুচ্ছের সংযোজন। যা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
খ) ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ শব্দগুচ্ছের পরিবর্তে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে ঐতিহাসিক যুদ্ধের’ শব্দগুচ্ছের প্রতিস্থাপন; এইটা নিছকই সামরিক যথেচ্ছাচার।
গ) ২য় প্যারায় ‘-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে’ এই বাক্যাংশের পরিবর্তে এইভাবে লিখা হয় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে’; এইখানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র মূলনীতিদ্বয়ের মূল চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে।

২) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগঃ প্রজাতন্ত্র

অনুচ্ছেদঃ রাষ্ট্র ধর্ম

২ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।

সংবিধান (অষ্টম সংশোধন) আইন, ১৯৮৮ এর ২ ধারাবলে ২ক অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত। সংশোধনের নামে সামরিক জান্তা এরশাদ কি ক্ষতিটা করে গেছেন তা আমরা সমসাময়িক রাজনৈতিক অস্থিরতা পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারি।

৩) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ, মৌলিক অধিকার এর ৩৮ নং অনুচ্ছেদ সংগঠনের স্বাধীনতাঃ

৩৮) জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে; তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সঙ্ঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তত্পরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।”

যা Second Proclamation Order No. IV of 1978 এর ধারাবলে অনুচ্ছেদটি দাঁড়ায় এমন-
” জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”

মূল সংবিধানের এই বিধানের কারণে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দল বিধিমালা নামে অধ্যাদেশ জারি করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদকে এইভাবেই বদলে দেন এবং একইসঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন।

পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ওই রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

অন্যদিকে সপ্তম সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ে আদালত বলেছে, “এরশাদ অন্যায় করলেও জিয়া করেছেন গুরুতর অন্যায়। কেননা তিনি সংবিধান স্থগিত ও কিছু মূল বিধান পরিবর্তন করেছিলেন। আর এরশাদ কেবল সংবিধান স্থগিত করেছিলেন।”

জিয়া সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, তিনি পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করার পাশাপাশি একই ধারার অনেককে পুনর্বাসিত করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। রায়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের মতো এইচ এম এরশাদকেও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করে হাইকোর্ট। এই রায়টি হয় বিএনপি-জামাত সরকার যখন ক্ষমতায়। এতে করে রায়ের সার্থকতা আর জিয়া-সায়েমের দূষণের স্বরূপ উন্মোচিত হয় আরও জোরালভাবে।

এখন সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে আমরা কি দেখতে পাই? দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল হোতা জামাত – হেফাজত দুটোই উপরোক্ত ৩ টি সামরিক দূষণের ফলশ্রুতিতে আজ বাংলার বুকে বিষবাষ্প ছরাচ্ছে এবং সুবিধা নিচ্ছে এই সব দূষণের পিছনের দুই কারিগর বিএনপি এবং জাতীয়পার্টি।

এইবার দেখি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামাত কে নিষিদ্ধ করলে দেশের সংকট কাটবে কিনা। খবর এসেছে যে জামাত নিষিদ্ধ হলেও তারা রাজনীতি করতে পারবে, এদিকে তারা জেনারেল ইব্রাহীমের কল্যাণ পার্টি নামের নামসর্বস্ব দলটিতে যোগ দিয়ে রাজনীতি করার আভাস দিয়েছে। এইখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে জামাত – হেফাজত বা সকল ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর সাথে সামরিক ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক দলগুলোর সখ্যতা বেশী। যাহোক তাহলে বাঙ্গালীর কি মুক্তি এইসব হানাদারের হায়েনাদের কাছ থেকে? সরকারই বা কেন ২০০৫ এর রায়কে বাস্তবায়ন করে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাচ্ছে না?

সরকারের কাছে রায় সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সবই আছে; তবে কেন করছে না? আচ্ছা, যেই বিষবৃক্ষ আজ ৩৭ বছরে শৈশব থেকে তারুণ্যে তাকে কি একদিনে সমূলে উৎখাত করা যাবে? নাকি ধীরে ধীরে তার ডালপালা কেটে কেটে মূল উৎপাটন করতে হবে? ২৮ ফেব্রুয়ারির সাইদির ফাঁসির রায়ের পর দেশ ব্যাপী নারকীয় তান্ডব দেখেছি, আর সরাসরি ৭২ এর সংবিধানে যখন সরকার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যাবে তখন বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্র ধর্ম আর ধর্মনিরপেক্ষতা ইস্যুতে কি নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ করবে? আর তাই তা ভেবেই যদি বর্তমান সরকার ধীরে ধীরে হায়েনাদের বংশধরদের সমূলে উচ্ছেদ করার প্ল্যান করে তবে সেক্ষেত্রে এমন একটি সরকারের পুনরাবৃত্তিই জনগণকে আপাত একটি মুক্তির পথ হিসেবে দেখাতে পারে। তাই বর্তমান সরকারকে জনগনের মনের দাবীগুলো আর কষ্টগুলো বুঝে দেশের স্বার্থেই বাকি ৫ মাসের মধ্যেই জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে হবে। সাধারণ জনগণের এর থেকে ভাল কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না কেননা আমাদের কাছে আপাতত ২+২=৪ বলবে এমন কোন রাজনৈতিক সংগঠন নেই। বর্তমান দুদলের একদল ৩.৭৫ উত্তর দিলেও অপরটি দেয় ৩; আর তাই আমাদেরকে ৩.৭৫ উত্তরটি অধিকতর সঠিক বা কম ভুল মেনে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।