আমার বাড়ীতে যাইওরে বন্ধু খালে হাঁটু পানি
ভিজা চুলে মুছ্যা দিবাম তোমার পা দুখানি

‘আহা কি মধুর! কি সুন্দর! থামিও না বালক গাও।’
– এই আবেগমথিত আহবান আর কারো নয়, প্রায় সোয়াশ বছর আগে ময়মনসিংহের কেন্দুয়ায় জন্ম নেয়া জনৈক চন্দ্রকুমার দে’র। চন্দ্রকুমারের আশংকা, বালকটি হয়ত পরের লাইনগুলি বলতে পারবে না, থিয়েটার যে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে! চন্দ্রকুমারের কণ্ঠে আর্তি ঝরে পড়ে:

দশ বৎসর আগে যাহা ছিল- তাহাও আর নাই। যা আছে, তাও বুঝি থাকিবে না।

চন্দ্রকুমারের যুগে তবু আংশিক/আধলা গান শোনা যেত। কিন্তু আজ? আপনি যদি লোকসংগীত-প্রেমী হন আর গান শোনার আশায় আজই ময়মনসিংহের মাঠ-ঘাট চষে ফিরেন, কোন বালকের মুখে এমনকি প্রথম লাইন দু’টিও শুনতে পাবেন? এখন গান গাওয়া তো রীতিমত অন্যায়, বেআইনি, বেশরীয়তি। তবু যদি সৌভাগ্যবশত কোন গান শুনেই ফেলেন, খুব বেশী আহ্লাদিত হতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত, কারণ আপনার কর্ণ ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে হাল আমলের জনপ্রিয় কোন হিন্দি গানের তীক্ষ্ণ ফলা।

এক সময় গ্রাম-বাংলার ঘাটে-মাঠে-হাটে কান পাতলেই শোন যেত সুর। কৃষক ছেলের কণ্ঠে থাকত পালাগান:

জলভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছ ঢেউ
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।/
লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর
গলায় কলসী বান্ধ্যা জলে ডুইবা মর
কোথায় পাব কলসী কন্যা, কোথায় পাব দড়ি
তুমি হও গয়িন গঙ্গা, আমি ডুব্যা মরি। (ময়মনসিংহ গীতিকা, মহুয়া)

বা,

তারা হইল নিমি ঝিমিরে রাত্র নিশিকালে
ঝম্প দিয়া পড়ে কন্যা সেই না নদীর জলে (ধোপার পাট)

বা,

আমার বাড়ী যাইওরে বন্ধু অমনি বরাবর
নল খাগরার বেড়া আছে দক্ষিণ দুয়ারিয়া ঘর
আমার বাড়ী যাইওরে বন্ধু বইতে দিব মোড়া
জল পানি করিতে দিবাম সাইল ধানের চিড়া

কিন্তু কি মূল্য আছে এই পালার? কি দরকার ছেলেটির এমনতরো গান গাওয়ার? এর চেয়ে বরং মায়ের সুবোধ ছেলের মত সাংসারিক কাজগুলি করলেই হয় না? তা হয়ত হয়, কিন্তু তাতে পৃথিবীটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে যে! বিশাল জলাধার পরিণত হয় বদ্ধ ডোবায়। প্রানভরে নিঃশ্বাস নেয়ার আর কোন জায়গাই থাকে না! ভাগ্যিস, কেউ কেউ মা-বাবার সুবোধ ছেলে হয়ে থাকতে চায় না, বরং অন্তরের আহবানে সাড়া দিয়ে বাঁশি হাতে ছুটি বেড়ায় বনে-জলে, দিক-দিগন্তে, আর তার ফলেই আমরা পেয়ে যাই অমর সব সংগীত, যাতে চন্দ্রকুমারের কথায়:

পিতামাতার সাংসারিক আনন্দ না বাড়ুক, পথের দু’একজন পথিক সে বাঁশী শুনিয়া ভয় সন্তাপ এড়াইতে চায়। বনের পশু পক্ষী সে গান শুনিয়া মুগ্ধ হয়। অকেজো উন্মাদ ছেলে সংসারের কাজে না লাগুক, বিশ্বকে এমনি এক অপার্থিব পরমার্থ শান্তি দান করিয়া যায়।

কিন্তু কে এই চন্দ্রকুমার? পল্লীর গাথাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেন তার এই হৃদয় নিংড়ানো আকুতি?

বাংলা ১৩৪৬ সনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীনেশচন্দ্র সেনকে এক পত্রে লেখেন:

বাংলা প্রাচীন মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ বাংলা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে থেকে স্বতঃউচ্ছসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্মবিস্মৃত রসসৃষ্টি আর হয় নি। এই আবিষ্কৃতির জন্য আপনি ধন্য।

এদিকে বাংলা ১৩৩৬ সনে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত ‘সারস্বত সাহিত্য সম্মিলনে’ চন্দ্রকুমার দে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন, যার উপসংহারে তিনি বলেন:

আমি ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক। আমি হীন নহি-উপেক্ষিত নহি-ইহার চাইতে গর্ব গৌরব করিবার জিনিস আমার কিছুই নাই। আমার ময়মনসিংহ আজ সমগ্র জগতের মধ্যে তাহার সন্মানের আসন বাছিয়া লইয়াছে।

হ্যাঁ, চন্দ্রকুমার আর কেউ নন, জগৎবিখ্যাত ‘ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক’। বিনয়ী চন্দ্রকুমার যদিও নিজেকে উপেক্ষিত ভাবেননি, বাঙালি পাঠককুলে তার মত উপেক্ষিত নায়ক কিন্তু আর একজনও আসেনি। বিশ্বকবি যেভাবে জানেন, ঠিক তেমনিভাবেই বাঙালি পাঠককুলের কাছে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ মানেই দীনেশচন্দ্র। এখানে চন্দ্রকুমারের কোন স্থানই নেই, অনেক অনেক আগেই তার অর্ধচন্দ্র সম্পন্ন হয়েছে!

চন্দ্রকুমার দে কতটা উপেক্ষিত, তার একটি প্রমাণ হল, উনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যু তারিখটি নিয়ে এখন পর্যন্ত সাহিত্য বোদ্ধারা নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। যখন চন্দ্রের ব্রাকেটে লেখা হয় (১৮৮১-১৯৪৫), তখন তা অনেক সংশয় ও কিন্তুর সঙ্গে আপোষ করেই লেখা হয়। এই উপেক্ষিত চন্দ্রের জীবনটাও ছিল দুঃখে ভরা। খুব অল্প বয়সেই চন্দ্র মাতৃহারা হন। কৈশোরে গ্রামের জমিদার তার পিতার সহায় সম্পত্তি চোখের সামনে কেড়ে নিলে পিতা রামকুমার অচিরেই শোকে দুঃখে পৃথিবীর মায়া কাটান। এরপর পেট বাঁচাতে চন্দ্র নিজ গ্রামের মুদি দোকানে ১ টাকা বেতনের চাকুরী নেয়। কিন্তু ভাবুক ও সাংসারিক বিষয়াদি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ চন্দ্রকে কিছুদিনের মধ্যেই ঐ দোকান থেকে অর্ধচন্দ্র পেতে হয়। এরপর হতভাগা চন্দ্রকুমার কলেরায় আক্রান্ত হন। পরিত্রাণের আশায় হাতুড়ে চিকিৎসকের ঔষধ গিলেছিলেন। এতে সুস্থ তো হলেনই না, উপরন্তু মানসিক বৈকল্য দেখা দিল, যা প্রায় দু’বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই চরম দুর্দিনে এক গ্রাম্য জমিদার তাকে মাসিক ২ টাকা বেতনে তহশীল আদায়ের চাকুরী দেন। এই চাকুরীটিই চন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তহসীল আদায় করতে চন্দ্রকে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরতে হত। ঐ সময়ই তিনি কৃষকদের কণ্ঠে শুনতে পান অপূর্ব সব পল্লী গাথা ও উপাখ্যান। গানগুলো চন্দ্রকে এতই মোহিত করে যে, শুনে শুনেই তা খাতায় লিখে রাখতেন। এক সময় চন্দ্রকুমার এই পল্লী গাঁথাগুলোর সৌন্দর্যের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রবল তাগিদ অনুভব করেন। আর সেই কারণেই বিখ্যাত সৌরভ পত্রিকায় এগুলোর উপর লেখা পাঠাতে আরম্ভ করেন।

অল্প শিক্ষিত চন্দ্রকুমার এমনকি ‘আমি’ বানানটি ঠিকমত লিখতে পারতেন না। ভুল করে লিখতেন ‘আমী’। ‘কৃত্তিবাস’কে লিখতেন ‘কীর্তিবাস’। কিন্তু চন্দ্রকুমারের বিরল সাহিত্য-মনন , প্রতিভা ও লেখক সত্তা ‘সৌরভ’ সম্পাদক কেদারনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। এমনকি চন্দ্রকুমার নামক মুক্তোটি বেশিদিন দীনেশচন্দ্রেরও অনাবিস্কৃত থাকেনি। মনীষী ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রকুমারকে মাসিক ৭০ টাকা বেতনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পালাগান সংগ্রহের জন্য নিয়োগ দান করেন।

এরপর শুরু হয়ে যায় চন্দ্রকুমারের গ্রাম-বাংলার আনাচ -কানাচ থেকে হারানো মানিক খুঁজে বের করার অমানুষিক সংগ্রাম। কেমন ছিল এই সংগ্রাম? চন্দ্রের ভাষায়:

এই সংসার চিন্তা বিব্রত পথিক দুঃখ দারিদ্র্যের বোঝা ঘাড়ে ফেলিয়া যখন পাগলা বন হরিণের মত বাঁশীসুরে উধাও হইয়া ছুটিয়াছিল, পাড়াগায়ের এক হাটু কাঁদা ভাঙ্গিয়া মেঘে ভিজিয়া রৌদ্রে পুড়িয়া কৃষকের গোয়াল ঘরের সাঁঝালের ধারে বসিয়া এই কৃষক গীতি সংগ্রহ করিয়াছে, তখন তাহাকে লোকে ক্ষ্যাপা বলিয়া উপহাস করিতে ছাড়ে নাই।

অপরিসীম ভালবাসা না থাকলে, আত্মত্যাগ না থাকলে কারো পক্ষে সম্ভব এমন সাধকের রূপ পরিগ্রহ করা? একবার চন্দ্রকুমার কবি রামকান্ত রায়ের প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন কবির লিখিত ‘মনসা ভাসান’ সংগ্রহের জন্য। রামকান্তের বংশধরের কাছে বইটির কথা বলতেই সে চন্দ্রকে ভুল বুঝে, মনে করে যে, ছল-চাতুরী করে চন্দ্রকুমার তার কাছ থেকে অনেক মূল্যবান একটি জিনিস হাতিয়ে নেয়ার মতলব করছে। অথচ ঐ বংশধরের গৃহে কীট ছাড়া আর কারো কাছেই বইটির ন্যূনতম কোন মর্যাদা বা মূল্য ছিল না। তবু যখন রামকান্তের বংশধর বইটি দিতে রাজী হচ্ছিল না, চন্দ্র অনেকটা মরিয়া হয়েই চুরি করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চুরিবিদ্যায় সম্পূর্ণই অনভিজ্ঞ চন্দ্র শেষ পর্যন্ত সফল না হওয়াতে কীটের উদরেই বইটির চূড়ান্ত সমাধি ঘটে। এভাবে যে কত অমূল্য সাহিত্য-সম্পদ কীটের গর্ভে বিলীন হয়েছে, তার কোন হিসেব আছে আমাদের কাছে? না, থাকা সম্ভব? কিন্তু চন্দ্রকুমারের মত কেউ কেউ ছিলেন বলেই অন্তত কিছু মনি-মুক্তো আমরা বের করে আনতে পেরেছি। কিন্তু কি সন্মান দিয়েছি সেই বিরল মুক্তো সংগ্রাহককে?

চন্দ্রকুমারের স্ব-গ্রামবাসী ভূপেন্দ্র মজুমদার আক্ষেপ করে লিখেছেন:

চন্দ্রকুমার সম্বন্ধে ডঃ দীনেশ সেন তাঁর ময়মনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় যে-পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তার আসল পরিচয়টাই অজ্ঞাত রয়ে গেছে। …যার একক কীর্তি সমস্ত বঙ্গ সাহিত্যে এক উচ্চ স্থানের দাবী করছে- তাকে আমরা কতখানি মূল্য দিয়েছি?

হ্যাঁ, দীনেশচন্দ্র সেন তার জগদ্বিখ্যাত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় তথ্যদাতা হিসেবে চন্দ্রকুমারের পরিচয় সন্নিবেশ করেছেন, তাকে বিনে পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন, অনাথ ও চিররুগ্ন চন্দ্রকুমার যখন স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে সংসার নির্বাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন দীনেশচন্দ্র তাকে চাকুরী-থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চন্দ্র সংগ্রাহকই রয়ে গেছেন, হতে পারেননি নায়ক। চন্দ্রকুমার বিনয়ের আতিশয্যে বলেন:

দীনেশচন্দ্র আমার সংগৃহীত ভাঙ্গা ইটে আজ বঙ্গ ভাষার বিচিত্র তাজমহল গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, আমি তাহার মজুর মাত্র। তিনি এ বিরাট যজ্ঞভূমির অধিনায়ক হোতা। আমি শুধু সমিধ কাস্ট বহন করিয়াছি মাত্র।

আসলেই ময়মনসিংহ গীতিকা এক তাজমহল, যার রসে বুঁদ হয়ে থাকেন রোমান রোঁলা, জুলে ব্লক, সিলভান লেভি, গ্রীয়ারসন প্রভৃতি জগৎ প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ। কিন্তু এই তাজমহল গড়ার নায়করূপে যুগে যুগে স্বরিত-পূজিত হন দীনেশচন্দ্র সেনই, দীনেশচন্দ্রের আলোয় জ্বল জ্বল করে বিশ্বসভায় দ্যুতি ছড়িয়ে যায় ময়মনসিংহ গীতিকা, অনেকটা সম্রাট সাজাহানের তাজমহলের মত করেই। এদিকে আড়ালে-আবডালে, লোকচক্ষুর একেবারে অন্তরালে থেকে যান তাজমহলের আসল কারিগর হতভাগা চন্দ্রকুমারেরা।

কিন্তু এভাবে নকল চন্দ্রের আলোয় বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না বাংলার লোকজ তাজমহল, সঠিক আলো-হাওয়া আর পরিচর্যার অভাবে তার ধসে পড়ার দিন হয় আবার সমাগত। যে আসল চন্দ্রের আলো আমাদের লোকজ তাজমহলটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ছিল বড্ড প্রয়োজনীয়, তাকে যে আমরাই নিভে যেতে দিয়েছি, হারিয়ে যেতে দিয়েছি বিস্মৃতির অতলে !

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ
১. চন্দ্রকুমার দে, অগ্রন্থিত রচনা
– বাংলা একাডেমি, ঢাকা
২. চন্দ্রকান্তি এক কবি চন্দ্রাবতী
– ফরিদ আহমেদ