হে পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক,
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন। তাহ’লেই আমি
দ্বীনের নামে দিরের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিরল,
গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণ পোকার মতো অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের ক্যঠামো, অবকাঠামো।

রোগ, শোক, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনিরাপদ সড়ক, রেলের লাইনচ্যুত হওয়া, জলপথে লঞ্চ, জাহাজের পাতালমুখি অভিযান, রাহাজানি, খুন-জখম, ধর্ষণ, ভবনধ্বস, অগ্নিকাণ্ড, ঘুষ, চাঁদাবাজিতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আহাজারি ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। গত পরশুদিন মহামান্য আদালত বাংলাদেশের মানুষের সেই চাহিদা পূরণে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। গোলাম আযমের মত একজন নব্বই বছর বয়েসী সম্মানীয় বুজুর্গ রাজনীতিবিদের অপঘাতে  মৃত্যু হবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি আদালত। তাইতো মহামান্য বিচারক দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে আরো নব্বই বছর নিরাপদে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।  স্বাভাবিক মৃত্যুর এই নিশ্চিতকরণে আসুন আমরা সবাই আনন্দে উদবেলিত হয়, শোকরানা নামাজ পড়ি। নিশ্চয় পৃথিবীটা অনেক সুন্দর, তার চেয়েও সুন্দর আমার জন্মভূমি!

চুতিয়া এক দেশে জন্মেছিলাম আমি। সারাজীবন অপমানে, লজ্জ্বাতেই কাটলো এই দেশে জন্ম নিয়ে। যে দেশে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করে,  না হয় কায়িক পরিশ্রম করে জীবনযাপন করে, আর দেশের জন্মের বিরোধিতা করা রাজাকারেরা সম্মানীয় হয়, সমাদৃত হয়, জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে হাওয়া খেয়ে বেড়ায়, সেই দেশে জন্মানোটাই একটা বড় পাপ। আর বড় সমস্যা হচ্ছে যে, এই পাপের কোনো প্রায়শ্চিত্তও নেই। অনেকদিন আগে একবার দেশে গিয়েছিলাম। অর্কবুড়ার কচি মনে  বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হয়েছিল তখন। তারপর থেকে ছেলে আমার আর বাংলাদেশে যেতে চায় না। আমার দশাও এখন তাই। মনের কোণে সুপ্ত বাসনা ছিল কোনো একদিন ঠিকই ওই মাটিতে ফিরে যাবো। এখন পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর না। ওই বাংলাস্তানে ফিরে যাবার আর কোনো মানে নেই আমার।

খামোখাই আমরা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, এগুলোকে বর্ণিলভাবে পালন করি। রাজাকারি মানসিকতা যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুস্পষ্ট, পঁচে যাওয়া পাকিস্তানি গন্ধ যেখানে তীব্র, সেখানে এইসব বর্ণালী সমাবেশের কোনো মূল্য নেই। যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নের্তৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দলটি সামান্য  কিছু ভোটের আশায় রাজাকারদের সাথে গোপনে খানা খায়, যে দেশের প্রধান বিরোধি দল রাজাকার দলের লেজুড়বৃত্তি করে, সেই দেশের এইসব স্বাধীনতা ফাধিনতা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। বরং পাকিস্তানের সাথে অতিসত্বর কনফেডারেশ গঠন করে ফেলাটাই সমুচিত এখন। পাক সার জমিন সাদবাদ আর গোপনে গাইতে হবে না, গলা ছেড়ে মনের সুখেই তখন গাওয়া যাবে সেই পাকপবিত্র গান।

কবি শামসুর রহমান অনেক বুদ্ধিমান একজন মানুষ ছিলেন। তিনি টের পেয়েছিলেন, কী অপরিসীম শ্রদ্ধা আর মর্যাদা আমরা আলাদা করে রেখেছি রাজাকারদের জন্য। কী অপরিসীম ক্ষমতা এই বীর যোদ্ধাদের।  একাত্তরে শুধু একবারই পরাজিত হয়েছিলেন তাঁরা ভাগ্যের ফেরে। তারপর বাউন্সব্যাক করেছেন, রাজকীয় প্রত্যাবর্তন একেবারে। যাঁদের কাছে হেরেছিলেন, তাঁদেরকে গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে হারের তিক্ত স্বাদ দিয়ে চলেছেন তাঁরা প্রতিনিয়ত। তাইতো তিনি মহান আল্লাহতালার কাছে তাঁকে একজন তুখোড় রাজাকার বানিয়ে দেবার জন্য মোনাজাত করেছিলেন। আসুন আমরা সবাই কবি শামসুর রাহমানের পথ ধরি। আমাদেরকে সম্মানীয় রাজাকার বানিয়ে দেবার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি।

একটি মোনাজাতের খসড়া

– শামসুর রাহমান

হে রাব্বুল আলামীন,
হে লৌকিক, পারলৌকিক আর অলৌকিকের রাজাধিরাজ,
আমার একটি সামান্য ইচ্ছাপূরণের আশায়
আজ আমি আপনার জ্বলজ্বলে পুণ্য আরশ লক্ষ্য ক’রে
সেজদা দিয়েছি। আশৈশব শুনে আসছি,
এই জগত সংসারে, সৌরলোকে, আমাদের অজ্ঞাতলোকে
এমন কিছুই ঘটে না, হে রাহমানুর রাহিম,
যাতে আপনার সায় নেই। কুল মখলুকাতে
হাওয়া বয় না, নদীতে ঢেউ জাগে না, মাটি ফুঁড়ে
উদ্ভাসিত হয় না শস্যরাশি,
বাঁশিতে সুর মঞ্জরিত হয় না,
গান গায় না পাখি,
মায় একটি গাছের পাতাও নড়ে না
আপনার হুকুম ছাড়া।

হে দ্বীন ও দুনিয়ার মালিক, চোখের পলকে,
হে সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে
এমন তৌফিক দিন যাতে আমি
আপাদমস্তক মনেপ্রাণে একজন খাস রাজাকার
হয়ে যেতে পারি রাতারাতি। তাহলেই আমি সাত তাড়াতাড়ি
মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবো, এই চর্মচক্ষে
দেখে নেবো হাতিশালে হাতি আর
ঘোড়াশালে ঘোড়া আর আমার হাতে আমলকির মতো
এসে যাবে সব পেয়েছির দেশের সওগাত।
তবে সেজন্যে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে, হাত
কচলাতে হবে অষ্টপ্রহর আর জহরতের মতো
পায়ের চকচকে জুতোয় চুমো খেতে হবে নানা ছুতোয় সকাল সন্ধ্যা
এবং মাঝে মাঝে শিন্নি দিতে হবে পীরের দরগায়।
না, না, এতে জিল্লতি নেই একরত্তি, বরং চোখ-ঝলসানো
জেল্লা আছে এই জীবনে। হে আলেমুল গায়েক, হে গাফফার,
আপনি আমাকে এক্ষুণি
একজন চৌকশ রাজাকার ক’রে দিন। তাহ’লেই আমি
চটজলদি গুছিয়ে নেবো আখের।

আপনার চেয়ে বেশি আর কে জানে যে, আমি
জেনাসের মতোই যুগল মুখ নিয়ে
বেঁচে বর্তে আছি। আমার একটি মুখ তেজারতির দিকে
এবং অন্যটি ওজারতির দিকে ফেরানো।
যদি ওজারতির তাজ আমার মাথায় আজ
শোভা না পায়, ক্ষতি নেই। সবুরে মেওয়া ফলে,
এই সুবচন জানা আছে আমারও। একদিন না একদিন
আপনার রহমতে আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বেই।
আপাতত ব্যাংক থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার ওভারড্রাফট পেয়ে যাবো
তদ্বিরবিহীন, আমার বানিজ্যতরী ভাসবে
সপ্ত সিন্ধুতে আর দশ দিগন্তে দেখা যাবে
আমার সাফল্যের মাস্তুল।
হে পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক,
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন। তাহ’লেই আমি
দ্বীনের নামে দিরের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিরল,
গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণ পোকার মতো অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের ক্যঠামো, অবকাঠামো।