কালকেই জানতে পারি বিসিএস পরীক্ষার কোটা পদ্ধতি নিয়ে অনেকের অসন্তোষ থাকার কারণে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। পরীক্ষা বিষয়ক অসন্তোষ, দুর্নীতি, হতাশা বাংলাদেশে খুবই পরিচিত ব্যাপার, তাই খুব একটা গা করিনি প্রথমে। আজ বিশ্ববিদ্যালয় যাবার সময় নীলক্ষেতের মোড়ে অসংখ্য পুলিশ দেখে প্রথম টের পেলাম ব্যাপার বেশ ভালোই সিরিয়াস। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটু ভিতরে ঢুকে চোখ জ্বালা করা শুরু করলো, বুঝলাম পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। যাই হোক, এহেন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে গেল।

বাসায় এসে দেখলাম ফেসবুকে এখন ট্রেন্ডিং- বিসিএস কোটা। এবং অবধারিত ভাবেই মানুষ দুইভাগে বিভক্ত। নিজের উপর যথেষ্ট ভরসা আছে, তাই ভাবলাম একটু ঘাটাঘাটি করেই দেখি আসলে ব্যাপারটা কী!

 

বিসিএস পরীক্ষায় কোটার ব্যবচ্ছেদ  

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে কোটা সিস্টেম বাংলাদেশে চালু হয়। প্রথমে মাত্র ২০% মেরিট অনুযায়ী সিভিল অফিসার নেওয়া হলেও ১৯৭৬ সালে সেটি ৪০% এ উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ সালে এটি আরও বেড়ে ৪৫% মেরিট অনুযায়ী নেওয়া হলেও এরপর আর কোন পরিবর্তন আসেনি।

৫ম আদমশুমারির ডাটা অনুসারে কোটা ব্যবস্থাকে এক নজরে নীচের টেবিলে দেখুনঃ

 

 

এছাড়াও জেলা ভিত্তিক ১০% কোটা বরাদ্দ আছে। সুতরাং কোটা ব্যতীত মেরিট অনুযায়ী ৪৪% বরাদ্দ থাকবে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য।

এখন একটু খতিয়ে দেখা যাক এই কোটা ব্যবস্থা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। প্রথমেই আসি শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড এবং আদিবাসী প্রসঙ্গে। শারীরিক ভাবে চ্যালেঞ্জড এবং আদিবাসী যে আমাদের দেশে   সমাজের অনগ্রসর অংশ, এইটা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ দেখিনা। কোটা সিস্টেমের উদ্দেশ্যই তো আসলে সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তা করা। পুরো জিনিসটা আরও ভালো ভাবে বুঝতে হলে নীচের ছবিটা দেখতে পারেনঃ 

 

 

এরপরও যদি আপনার আদিবাসী আর শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জডদের জন্য বরাদ্দ কোটা নিয়ে আপত্তি থাকে, আপনি দয়া করে আমার বন্ধু ‘অন্যরকম ধ্রুব’-এর স্ট্যাটাসটা পড়ে নিতে পারেনঃ

‘আপনার বাড়ির গ্যাস-পানি-কারেন্টের কানেকশান কাইটা দিই, যাতায়াতের রাস্তাঘাট সব গুড়ায়া দিই, তারপর বাপ-দাদার ভিটা দখল কইরা চিড়িয়াখানা বানাই, তারপর ফিরিঙ্গি কোন ভাষায় পড়ালেখা করানোর পরে বুঝবেন আদিবাসিদের কোটা দাওয়ার কী দরকার। 

দুইটা হাত, পা, চউক্ষু কিংবা কানের কুনডা কাইট্টা ফালায়া দ্যান, তারপর সকাল-বিকালে ক্যাম্নে দৌড়ায়া দৌড়ায় দুনিয়া জয় কইরা ফালান দেখব; আর তারপর আইসেন ভিন্নভাবে সক্ষম প্রতিবন্ধীদের কোটা নিয়া কথা বলতে।

পেছন থেকে শুরু করা একদল মানুষ সামনে আগায়ে আসতেছে এইটা সহ্য হইতেছে না।’

সুতরাং আপনি যদি দাবি করেন, কোটা ব্যবস্থা একেবারে নির্মূল করে ফেলতে হবে, তাহলে অবশ্যই কোনভাবেই আমি আপনার সাথে একমত নই। এমনকি আমি শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জডদের জন্য কোটাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষপাতী। মোট জনসংখ্যার ১.৩২% হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য ১% কোটা আসলেই যথেষ্ট না, নিদেনপক্ষে ৩%-৫% করার ব্যাপারেই আমি মত দিবো।

এবার আসা যাক, নারীদের কোটার ক্ষেত্রে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সমসাময়িক ডাটা পেলাম না। ২০০৫ সালের ইউএনডিপি’র এক রিপোর্টে দেখলাম বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে মাত্র ৮.৫% নারীর অংশগ্রহণ। মোট জনসংখ্যার ৫০% হওয়া সত্ত্বেও নারীদের এই নগণ্য অংশগ্রহণ অবশ্যই আমাদের চিন্তায় ফেলার কথা। তাই তাদের জন্য বরাদ্দ ১০% কোটাতে আমার আপত্তি না থাকলেও একটা কিন্তু আছে। আদিবাসী এবং নারীদের ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমার আপত্তি না থাকলেও সরকারের উচিত একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া। নিশ্চয়ই আগামী একশ বছর ধরে আমরা উপজাতি আর নারীদের কোটার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইনা। প্রত্যেকটা সমাজের লক্ষ্য হওয়া উচিত শেষমেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মেরিটোক্র্যাসি নিশ্চিত করা। সেজন্য চাই একেবারে নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা। ৫ বছর, ১০ বছর বা ১৫ বছরে আমরা ঠিক কতটুকু নারী এবং আদিবাসী অংশগ্রহণ দেখতে চাই সেইটা আগে থেকেই ঘোষণা করে সেজন্য একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ করা। কোটা সিস্টেম যাতে আর প্রয়োজন না পড়ে সে লক্ষেই ধীরে ধীরে ফেজ আউট করা’টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোন পরিকল্পনা ছাড়া শুধু কোটা ঘোষণা করে বসে থাকলে অগ্রগতি শামুকের গতিতে চলবে। 

এখন আসা যাক, জেলা কোটা প্রসঙ্গে। জেলা কোটা যখন চালু হয় তখন বাংলাদেশে জেলা ছিল মাত্র ১৭টি। জেলার সংখ্যা বেড়ে এখন ৬৪ হলেও এই কোটা এখনও চালু আছে। কোন ধরনের সংস্কার ছাড়াই বছরের পর বছর জেলা ভিত্তিক এই কোটার কোন যৌক্তিক কারণ আমি দেখিনা। কিছু বিশেষ জেলা চিহ্নিত করা যেতে পারে যেখানকার অধিবাসী তুলামূলকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু এরকম কোন গবেষণা ছাড়াই একেবারে ৬৪ জেলাতেই কোটা রাখার কোন কারণ কেউ খুঁজে পেলে অবশ্যই জানাবেন। 

শেষমেশ কথা বলি মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে, মূল বিতর্কও আসলে এই কোটা নিয়েই এবং সেইটাই স্বাভাবিক কারণ অন্যান্য কোটার তুলনায় অনেক বেশি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় (৩০%) বরাদ্দ আছে।

মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের অবিসংবাদিতভাবেই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের জন্য যে ত্যাগ তাঁরা স্বীকার করেছেন,  কোন পুরস্কারের আশায় তা না করলেও স্টেট অবশ্যই সেই দায়িত্ব নিতে পারে। যাই হোক, প্রথমেই দেখা যাক আমাদের সংবিধান কী বলে। সংবিধানে সবার ইমপ্লয়মেন্টের ব্যাপারে সমান অধিকারের কথা বলা হলেও একটি ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ আছে। শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যই স্পেশাল প্রভিশন সংবিধানে রাখা আছে। দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে অনেক অবস্থাসম্পন্ন লোক যেমন যোগ দিয়েছিল, ঠিক তেমনি গ্রামের খেটে খাওয়া কৃষকও অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধাপরবর্তী অবস্থায় অনেকেই আহত থাকার কারণে স্টেটের দায়িত্ব ছিল তাদের দেখাশোনা করা। প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটার মধ্যে ১৯৯৭ সালে অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযুদ্ধের সন্তানেরা কি ওভারঅল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে? যেহেতু সংবিধান অনুসারে শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যই ব্যতিক্রম নিয়ম আছে, তাই আমি ধরেই নিচ্ছি সরকার তাই মনে করে যদিও এরকম কোন স্টাডি বা রিসার্চ আমার চোখে পড়লো না কোথাও, থাকলে অবশ্যই জানাবেন। আমি যদি ধরেও নিই, তাঁরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশ, মনে রাখতে হবে তাঁরা পুরো দেশের ১% ও না, আপনি তাদের জন্য বড় জোর ১০% কোটা রাখার কথা বলতে পারেন, ৩০% এর যৌক্তিকতা আমি কোন ভাবেই দেখছিনা।

যুক্তি যে আসলেই নেই, তাঁর কারণ হিসেবে আপনাকে জানতে হবে এবার ঠিক কেন প্রিলি’র রেজাল্টের সময়ই কোটার কথা মাথায় রেখে ফল ঘোষণা করা হলো। প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে,  “ পিএসসির আরেকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই কোটার কারণে অনেক পদ শূন্য থেকে যায়। কারণ মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন কোটায় শেষ পর্যায়ে গিয়ে প্রার্থী পাওয়া যায় না… হুট করে এবার প্রিলিমিনারি থেকেই কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো জানতে চাইলে ওই সদস্য বলেন, কোটায় প্রার্থী না পাওয়ায় বারবার পদ শূন্য থাকে।”  অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০% পূরণ করার মত লোকই খুঁজে পাওয়া যায় না, আর তাই এই সমস্যা এড়ানোর জন্য শুরুতেই কোটার কথা মাথায় রেখেই এবার এই ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাঁর উপর মনে রাখতে হবে প্রিলি’তে কারও স্কোরও প্রকাশ করা হয়না, এমনকি কাট অফ স্কোর কত তাও বলা হয় না, সুতরাং সন্দেহ, অবিশ্বাস দানা না বেঁধে উঠাটাই অস্বাভাবিক।   

 

সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, শাহবাগে বিসিএস কোটা নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে সেইটা যথেষ্টই যৌক্তিক। এখন এই আন্দোলন নিয়ে আমার দুই-চারটা কথা আছে। 

আন্দোলন যেহেতু সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হচ্ছে এবং সরকারকে চাপ প্রয়োগের জন্য হচ্ছে, এইটা খুবই স্বাভাবিক যে সেখানে এই আন্দোলন থেকে ফায়দা লুটার জন্য এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হরেক রকম লোকের আমদানি হবে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক ধরনের কথা বলা হচ্ছে এরকমও শোনা যাচ্ছে। যারা আন্দোলন করছেন, তাদের মনে রাখা উচিত যে আপনাদের আন্দোলন খুবই যৌক্তিক। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে কটু কথা বলে যারা তাদের ব্যাপারে আপনাদেরই সতর্ক থাকা উচিত এবং অন্য কেউ কিছু বলার আগে আপনাদেরই উচিত তাদের সোজা করা। সোজা করতে না পারলে দেখবেন এরা ভাস্কর্য পোড়াবে, ভাঙবে, মাঝখান থেকে আপনাদের যৌক্তিক আন্দোলন মাঠে মারা যাবে।

যাই হোক, কোটা সিস্টেম কেন শেষমেশ তুলে দেওয়া উচিত সেইটা বুঝাইতে একটা গল্প বলেই শেষ করি। কিছুদিন ধরে টিম হারফোর্ডের লজিক অফ লাইফ বইটি পড়ছিলাম। সেখানেই বলা হয়েছিল যে দেখা গেছে অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন(কোটা সিস্টেমের সাথে গুনগত পার্থক্য থাকলেও স্পিরিট একই) আমেরিকাতে রেসিজম কমাতে বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবহার করলেও অনেক স্টাডিতে দেখা গেছে যে এটি আসলে কখনো কখনো রেসিজম বাড়াতে ভূমিকা রাখে। ধরুন, ১০ জন প্রার্থী আবেদন করেছে একটি চাকরির জন্য। একজন কৃষ্ণাঙ্গ আর নয়জন শ্বেতাঙ্গ। ধরুন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটি এমনিতেই খুব ভালো প্রার্থী, বাকি নয়জন শেতাঙ্গ প্রার্থীদের মধ্যে ধরুন শুধু একজন তাঁর সমকক্ষ। যেহেতু ঐ কোম্পানি অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন অনুসরণ করে, তাই শেষমেশ শ্বেতাঙ্গ প্রার্থীকে বাদ দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গকে নেয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়া হল। সমস্যা হচ্ছে হয়ত একজন শ্বেতাঙ্গর ক্রুব্ধ হবার একটা ভিত্তি থাকলেও বাকি নয়জন কোন ভিত্তি ছাড়াই ঐ কৃষ্ণাঙ্গর উপর ক্রুব্ধ হয়, মনে মনে ভাবে অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন নামক জিনিস না থাকলে সে-ই হয়ত চাকরিখানা বগলদাবা করত। 

শাহবাগে যারা আন্দোলন করছে, আমি নিশ্চিত তাদের ৬০-৭০% এমনিতেও টিকত না, কিন্তু কোন ধরনের ট্রান্সপারেন্সি না থাকার কারণে সবাই নিজেদের বঞ্চিত ভাবার সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের তাই উচিত হবে কোটার উপর নির্ভরতা কমিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার, কীভাবে ঢাকার একটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবধান কমিয়ে আনা যায়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কীভাবে শুরু থেকে ঠেলা দেয়া যায়, সেইটা নিয়ে কাজ করা উচিত।     

 

পুনশ্চঃ ডক্টর আকবর আলী খান এবং কাজী রাকিবুদ্দিন আহমেদ সিভিল সার্ভিসে কোটা সিস্টেম নিয়ে একটি স্টাডি করেছিলেন। সেই স্টাডিতেও তাঁরা কোটা সিস্টেমকে ‘আনজাস্ট’ বলেই অভিহিত করেছেন।