বাঙলাদেশে প্রথম এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১৯৬৭ সালে। তখনও সমাজে এসিড সন্ত্রাস ততটা মারাত্বক হয়ে উঠে নি। এর পর আবার এসিড সন্ত্রাস আলোচায় আসে ১৯৯৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে। শামিমার নামক এক নারীর ওপর এসিড হামলা চালায় এক নরপশু। তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। শামিমা বলেন, ‘আমি এখন আর আয়না দেখি না। কিন্তু যখনই আমি আমার নাক অথবা কান স্পর্শ করি, তখনই মনের আয়নায় ওই দৃশ্য ভেসে ওঠে।’ এর পর থেকে বিভিন্ন সময় এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। এসিড সারভাইভাল ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ৩ হাজারেরও বেশি এসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০২ সাল। ওই বছর ৫০০ এসিড হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকেই হামলার ঘটনা কমতে থাকে। ২০১১ সালে ৯১টি ও ২০১২ সালে ৭১টি হামলা হয়েছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার এসিড সন্ত্রাস দমনে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি এসিডের ব্যবহার, মজুত ও বিক্রির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এসিড নিক্ষেপকারীর জামিন নামঞ্জুর ও এক বছরের মধ্যে তাদের বিচার শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়, আগে যেখানে বছরের পর বছর লেগে যেত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি দেয়ায় বিধান করা হয়েছে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী এসিড ছোড়ার শাস্তি হিসেবে রয়েছে সর্বনিন্ম ৭-১২বছরের জেল বা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই আইন বিদ্যমান থাকলেও অনেক সময় আইনের অপর্যাপ্ততা ও প্রয়োগ না করার কারনে এসিড নিক্ষেপকারী দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৩০ভাগ এসিড নিক্ষেপকারী দোষী স্বাব্যস্ত হলেও উচ্চাদালতে তাদের আপিলের কারনে দণ্ড স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে প্রায় ৩০০ টি মামলা নিন্ম আদালতে প্রক্রিয়াধীন আছে। পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি ও তথ্যের অপর্যাপ্ততার কারনে অধিকাংশ মামলা যথাযথ ভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে এসিড নিক্ষেপকারী ছাড় পেয়ে যায় ও বাদী উপযুক্ত বিচার পায় না।

নিচে ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত এসিড সন্ত্রাসের প্রকাশিত ঘটনার তালিকা
http://imageshack.us/a/img594/5838/dccv.png

পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশের অধিকাংশ এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে থাকে প্রেমঘটিত কারনে। আবার অনেক সময় যৌতুকের কারনেও এসিড ছোড়া হয়। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় একটি বিষয় হলো এসিড নিক্ষেপের ঘটনা সাধারণত নিম্নবিত্ত বা নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে বেশি হয়ে থাকে এবং নগরাঞ্চলে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে এর প্রভাব খুব কম। সাধারণত ১৮ বছর বয়সের নারীরা এ সন্ত্রাসের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। এসিডের সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে এসিডের শিকার জনগোষ্ঠির মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগ নারী, ২৬ভাগ পুরুষ ও ২৭ ভাগ শিশু। ইদানিং পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারনে গৃহপালিত পশুও এসিডের শিকার হচ্ছে ।

আজকেও প্রথম আলোতে দেখলাম অ্যাসিড দিয়ে ছাত্রীর গায়ে নাম লিখেছে বখাটে!

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় এক যুবক চতুর্থ শ্রেণীর মাদ্রাসাছাত্রীকে ধরে নিয়ে অ্যাসিড দিয়ে তার বুকে নিজের নাম লিখে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৬ জুন এ ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী জানান, সাইফুল ইসলাম ওরফে শিপু (২২) নামের এক যুবক দু-তিন মাস ধরে চতুর্থ শ্রেণীর ওই ছাত্রীকে মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। এতে মেয়েটির অসহায় বাবা বাধ্য হয়ে তার মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেন।
ওই ছাত্রীর মা বলেন, ৬ জুন বিকেলে তাঁর মেয়ে বাড়ির পাশের খালে গোসল করতে গেলে সাইফুল তাকে ধরে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যান। পরে তাঁর মেয়েকে ছোরার ভয় দেখিয়ে তার বুকে অ্যাসিড দিয়ে সাইফুল নিজের নাম লিখে দেন। এ সময় তাঁর মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তিনি বলেন, স্থানীয় লোকজন তাঁর মেয়েকে জঙ্গলে পড়ে থাকতে দেখে খবর দিলে তাঁরা তাকে উদ্ধার করেন। সেদিনই সাইফুলের বাবা উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দিয়ে চিকিৎসার জন্য তাঁর মেয়েকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু তাঁর মেয়ে একটু সুস্থ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি টালবাহানা শুরু করেন।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল –সাইফুলের বাবা উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দিয়ে চিকিৎসার জন্য তাঁর মেয়েকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করান।

এটা একটা জখন্যতম হামলা। রাষ্ট্র তার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে অথচ সাইফুলের বাবা উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন!!! এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় এসিড সন্ত্রাস নিয়ে আমাদের সমাজের লোকরা ততটা সচেতন নয় এবং ক্ষমতার দাপটে অনেক বড় একটি অপরাধের লঘু শাস্তি হয় আমাদের সমাজে। হয়তো দেখা যাবে অর্থ নিয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারপর হামলাকারী বীরের মতনই সামাজে দাপটের সহিত হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমাদের মিডিয়া ও সামাজিক সংস্থাগুলো এসিড সন্ত্রাসের প্রতিবাদে খুন একটা জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে নি। ফলে এসিড সন্ত্রাস আমাদের সমাজে ঠিক কী ভীত করে নিয়েছে। মিডিয়া, সামাজিক সচেতনার ও আইনের কঠোর প্রয়োগ-ই পারে সমাজ থেকে এসিড সন্ত্রাস দূর করতে।

তথ্য সূত্র- আমার হেলথ