‘আমপারা’-পড়া হাম্‌বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মে’রে!
হিন্দুরা ভাবে, পার্শী শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে! (আমার কৈফিয়ৎ, সর্বহারা, নজরুল)

নজরুল জয়ন্তীর আগে-পরের কয়েকটি দিনে ‘অবহেলিত নজরুল’- কথাটি ব্যাপকভাবে প্রবেশ করে থাকে আমাদের কর্ণকুহরে, এক দল বিদগ্ধ ব্যক্তির অন্তর-চাপা ক্ষোভ উগরে পড়তে থাকে এই সময়টাতে। এবারও হয়ত আমরা এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করব না। সত্যি বলতে কি, আমরা গুণীজনের মর্যাদা দিতে জানি না, আর এ ব্যাপারে আমাদের জাতীয় বদনাম আছে। সে অর্থে নজরুলও অন্য অনেক গুণীজনের মতই অবহেলিত, নজরুলের অনেক কাজ এখনো অনাবিষ্কৃত।

কিন্তু ‘নজরুল অবহেলা’র অন্য একটা মানে আছে আমাদের দেশে। যেমন, ধরুন, কোন এক মিডিয়াতে রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে টানা সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্রসংগীত প্রচারিত হচ্ছিল, এক দর্শকের কাছে এটিকেই ‘নজরুল-অবহেলা’ মনে হল, এমনকি ঐ মিডিয়া নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে যে একই রকম দীর্ঘ মেয়াদি প্রোগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে , তা দেখার জন্যও অপেক্ষা করতে রাজী ছিল না সে, তার আগেই রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো তার চক্ষের সামনে ‘নজরুল-অবহেলা’র মূর্ত প্রতীক হয়ে ঝুলছিল! এর আগে একবার রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খবর এসেছিল মিডিয়ায়, তখনো কিন্তু ঐ দর্শকের মন ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল, ‘নজরুল-অবহেলা’য় ক্ষোভের ঝড় উঠেছিল তার অভিমানি অন্তরে। নজরুলের নামে একখানা বিশ্ববিদ্যালয় আগেই হয়ে গেছে – এ খবরের খোঁজ না করেই, তিনি ‘নজরুল-বঞ্চনা’য় দগ্ধ হচ্ছিলেন।

আমাদের দেশে ‘নজরুল অবহেলা’র আরেকটি খুব পরিচিত অর্থ আছে। আর তা হল, নজরুলের গান ‘জাতীয় সংগীত’ না হওয়া। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে নজরুলই আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের জাতীয়তার প্রতিনিধিত্বকারী আসল কবি, রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে বাইরের লোক। কিন্তু কে বোঝাবে তাদের যে, নজরুলের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ এই দেশে, এই জল-হাওয়ায় অবস্থান করেছেন বেশি সময় ধরে, অন্যদিকে এখনো নজরুলের বংশধরেরা কিন্তু ভারতেই বাস করছেন (এবং যেকোনো দেশে তাদের বসবাসের অধিকার আছে)।ীর, অবশ্য এর মানে এই নয় যে, নজরুল আমাদের নন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বাইরের লোক বানিয়ে নজরুলকে ঘরের লোক সাজানো খুব বিচিত্র আর কিম্ভুকিমাকার দেখায় বৈকি!

বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা একবার ‘নজরুল অবহেলা’র দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন অডিও কোম্পানিগুলোকে, তার মতে, রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করার জন্য অডিও কোম্পানিগুলোর যত আগ্রহ, তার সিকিভাগও নেই নজরুলের অ্যালবাম বের করার ব্যাপারে। কিন্তু শিল্পীর প্রতি সন্মান রেখেই এই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা করা যায় কি যে, নজরুলগীতির অ্যালবামের বাজার তৈরির দায়িত্বটা আসলে কার? শিল্পীদের না অডিও কোম্পানিগুলোর? একজন শিল্পী হয়ে একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের স্কন্ধে শিল্পকর্মের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া কতটুকু শোভন?

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আমাদেরকে ‘নজরুল অবহেলা’র কথা মনে করিয়ে দেন ফি বছর। একবার দল-নেত্রীর কাছে তার কাতর আহবান ছিল, বিএনপি যেন ক্ষমতায় এসে ভুলে না যায় নজরুলের এই অবহেলার কথা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে যেন নজরুলকে প্রকৃত মর্যাদায় অভিষিক্ত করে! ব্যাপারখানা এমন যে, বৈষম্যকবলিত নজরুলকে উদ্ধার করার জন্য হলেও আমরা যেন বিরোধী দলকে ক্ষমতায় বসাই!

নজরুল-অবহেলা’র অনেক দিগন্ত তো উন্মোচিত হল, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি নজরুল অবহেলিত এই বাংলাদেশে? বা, অবহেলিত হলেও তার মাত্রা কতটুকু? নজরুল-অবহেলা কি ছাড়িয়ে যায় অন্য অনেক ‘কবি-গুণীজন-অবহেলাকে’ও?

নজরুল আমাদের দেশের জাতীয় কবি। নজরুলের গান আমাদের রণ-সংগীত। নজরুলের জন্ম-মৃত্যু দিবস রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঘটা করে পালিত হয় আমাদের দেশে, যা মাত্র আর একজন কবি, মানে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্যেই জুটেছে। ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’ আছে আমাদের দেশে। আছে ‘নজরুল একাডেমী।’ মিডিয়ায় প্রাত্যহিক সংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ আঁধার নজরুল গীতি। এত কিছুর পরেও অবশ্য এ কথা দাবী করা যায় না যে, নজরুল সম্পূর্ণ আবিষ্কৃত বা পূর্ণমাত্রায় চর্চিত। তবে অল্প হলেও, নজরুল যতটুকু চর্চিত-স্মরিত হন, ততটুকুই বা আর কোন গুণীজনের ভাগ্যে জুটেছে আমাদের দেশে?

আসলে ‘নজরুল-অবহেলা’ নিয়ে যারা সবচেয়ে বেশি মায়াকান্না করেন, নজরুলকে অবহেলা করেন তারাই সবচেয়ে বেশি। নজরুলের সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িক মর্মলোকের কোন খবরই তারা রাখেন না। আশ্চর্য হলেও সত্য, নজরুলকে নিয়ে যারা সবচেয়ে বেশী লম্ফ-ঝম্ফ করেন, তারাই নজরুলকে সবচেয়ে কম বুঝেছেন মনে হয়। আজ যখন ঐ লম্ফ-ঝম্ফকারীরা নজরুলকে একটি বিশেষ ধর্মের বা একটি বিশেষ জাতীয়তাবাদের ভেতর ঠেসে পুরতে চান, আসল নজরুলের কিন্তু তখন দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া উপায়ই থাকে না।

নজরুল তো সেই কবি যার ‘রমযানের ঐ রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ’ ছাড়া বাঙ্গালি মুসলমানের প্রধান উৎসব শুরুই হতে পারে না! একই কবির ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ হয়ে উঠে বাঙ্গালি হিন্দুর প্রাণের সংগীত। নজরুল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের দেয়াল ভেঙ্গে মানবতার যে গান গেয়েছেন, তা কতটুকু অন্তরে ধারণ করে তাকে নিয়ে ‘হা-হুতাশ’কারীরা?

হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি’
ও’মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে। (মানুষ, সাম্যবাদী, নজরুল)

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়। একদল প্রগতিশীল লোক আবার নজরুলের সর্বধর্ম নিয়ে নাড়া-চড়াকে তার আপোষকামিতা বা নতজানু নীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখে থাকেন। অথচ এই ধরণের মূল্যায়ন করতে যেয়ে তারা ভুলেই যান, নজরুল একজন কবি, মানুষের কবি। আর মানুষের কবি মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে নিয়ে লিখবেন, তাই কি স্বাভাবিক নয়? একজন মুসলিম বা একজন হিন্দুর মধ্যে ঈশ্বর-চেতনা যে নিবেদন বা ভাবের জোয়ার তৈরি করে, তা নিয়ে লিখে নজরুল একজন চিরকেলে কবির কাজই করেছেন মনে হয়। নজরুলকে বোঝা যায় যায় ভারতের বিখ্যাত ধর্মসাধক কবীরের (জন্ম: ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ) একটি উক্তিতে:

হিন্দু যায় মন্দিরে, মুসলমান যায় মসজিদে, কিন্তু কবীর এমন স্থানে যায়, যেখানে গেলে দুইকেই জানা যায়। এই দুই ধর্ম দুই শাখার মতো, যার মধ্যস্থলে একটি অনুশাখা গজিয়ে দুইকেই যেন অতিক্রম করে যায়।

নজরুলও মনে হয় অতিক্রম করতে চেয়েছেন, কিন্তু কবীরের মত নতুন কোন ধর্মমতের জন্ম দেননি, আসলে উচ্চকিত করেছেন মানবতা-বোধকে, মানুষের জয়গান গেয়েছেন। বস্তুত নজরুল সবার গানই গেয়েছেন, মুটে-মজুর-চাষা-ধীবর-বারাঙ্গনা-চোর-ডাকাত কার কথা লেখেননি? নজরুল একজন কবি, গায়ক – তাই সাধারণ মানুষের সব ধরণের আবেগ তার লেখায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চলে এসেছিল। স্বভাবকবির যেমন হয়। তাই নজরুলের কিছু মাত্র ধর্মিয় গান-কাব্য দিয়ে তাকে আপোষকামি প্রমাণ করা খুব সহজ নয়। নজরুল দর্শন ছড়ানো ছিটানো আছে তার আরো অসংখ্য কবিতা-গানে-গদ্যে। এরপরও কিছু ধর্মিয় সংগীত দিয়েই তার দর্শনকে বিচার করার লোকের অভাব নেই। বা, অনেকেই তার গাত্রে আপোষকামিতার লেবেল এটে দিতে যেন শশব্যস্ত!

অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্‌ উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়! (মানুষ, সাম্যবাদী, নজরুল)

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দেয়াল ভেঙ্গে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় এখনো বিশ্ব-ইতিহাসের একটি অনন্য ঘটনা, ঐতিহাসিকদের কাছে একটি বিস্ময়বোধক জিজ্ঞাসা, গবেষণার উর্বর ক্ষেত্র। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি ছিল অতি স্বাভাবিক একটা ঘটনা, কারণ তারা নিজেদের জাতিসত্তা একসময় ঠিকই চিনেছিল, আর চিনিয়েছিলেন যারা তাদের সর্বাগ্রেই থাকবেন আমাদের নজরুল। আমাদের মানবসত্তা অথবা মাটির সত্তা যে অন্য সত্তাগুলোর অনেক ঊর্ধ্বে, তা তো নজরুলই শিখিয়েছিলেন, এই জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার চেতনা, অসাম্যকে প্রতিরোধের চেতনা, আর এভাবে এক আবহমান মুক্তির চেতনা।

আমাদের দুর্ভাগ্য, আজ আমরা নজরুলকে ভুলতে বসেছি। আমরা যে নজরুলকে আসলেই ভুলেছি, তার বড় প্রমাণ, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমরা আজ তাকে সাম্প্রদায়িক আসনে বসিয়ে দিচ্ছি। আর এ করতে গিয়েই কিন্তু আমরা কবিকে সবচেয়ে অবহেলা করছি, তাকে একদম না বুঝে বা সবচেয়ে কম বুঝে!

উহারা রত্ন-বেনে,
রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে!
ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে। (ঈশ্বর, সাম্যবাদী, নজরুল)