২০১৩ সালের ১১ই মার্চ এ দেশের উপর একটি বিরল মুহূর্ত নেমে আসে, যখন সবাই একই সুরে কথা কয়ে উঠে, এক চোখে দেখতে শুরু অতি জীবন্ত আর জান্তব একটি ঘটনা! আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মুখ ফুটে একই কথা: তারা একটি মহানাটক অবলোকন করেছেন। আশ্চর্য হলেও সত্য, চৌদ্দ-আঠার ভেদাভেদ লাটে উঠে, তারাও এক চোখে দেখেন ব্যাপারটা!

সত্যি বলতে কি, চৌদ্দ দলীয় জোটের সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে নেতা বা বুদ্ধিজীবী – সবাই আনন্দে আটাখানা হয়েছেন নয়াপল্টন নাটক দেখে, কারণ দেশের মানুষ বিরোধী পক্ষের সাজানো নাটক এবার হাতে নাতে ধরে ফেলেছে। বিএনপি যে নিজেরাই ককটেল ফাটিয়ে নিজেদের সমাবেশ পণ্ড করে আর পুলিশের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হরতাল দেয়ার পায়তারা খোঁজে, তা বুঝে ফেলেছে দেশবাসী! বিএনপির অফিস থেকেই পাওয়া গেছে গণ্ডায় গণ্ডায় ককটেল। আর বোকা বানানো যাবে না দেশের ১৬ কোটি দর্শককে!

ওদিকে আঠার দলীয় জোট সমর্থক, কর্মী, নেতা বা বুদ্ধিজীবীরাও আনন্দে দিশেহারা! কারণ দেশের মানুষ এবার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করল সরকারের ফ্যাসিবাদী চেহারা। আগে জনগণকে বলে বিশ্বাস করানো যেত না, এখন তো তারা নিজের চোখেই দেখতে পেল, সাদা পুলিশের দল কি করে ককটেল ফুটিয়ে পণ্ড করে বিরোধী দলের সমাবেশ, আর নিজেদের সাপ্লাই করা ককটেলের সূত্র ধরেই কিভাবে গ্রেফতার করে বাঘা বাঘা সব লিডারকে! ১৬ কোটি চোখকে আর ফাকি দেয়া যাবে না সরকারের ভাড়াটে মিডিয়া দিয়ে! হুম!

এভাবে জাতির জন্য পরম আনন্দের উপলক্ষ তৈরি করে এক সুরে কথা কইতে থাকেন আমাদের পথ ও বুদ্ধি নেতারা, এক চোখে দেখতে থাকেন একই নাটক! আমরা ষোল কোটি দর্শকও নাটক দেখে যাচ্ছি পরম সুখে, শিশুরা লেখা-পড়া ভুলে নাটক দেখছে, ব্যবসা-বাণিজ্য-কারাখানা-অফিস-আদালত সব কিছু ঝিম মেরে যাচ্ছে এ নাটকের অমোঘ আহবানে। কিন্তু কি দোষ কোমল-মতি শিক্ষার্থীদের অথবা তাদের ব্যাবসায়ী বা চাকুরে পিতা-মাতার? এমন জমজমাট নাটক যে, কেউই পারে না এর টানটান আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে! তাকিয়ে থাকে এক চোখে! এক চোখেই কিন্তু!

তবে আমাদের সৌভাগ্য হল, এমন ‘এক চোখে দেখার’ মত ঘটনা আরো ঘটে চলেছে, আমাদের অজান্তেই! যেমন: প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীগণ জাতির উদ্দেশ্যে একটি ওয়েক আপ কল অনেক আগে থেকেই করে যাচ্ছেন, আর তা হল: বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর সুগভীর ষড়যন্ত্র চলছে! আশ্চর্য হল, আঠার দলীয় জোট থেকেও কিন্তু বলা হচ্ছে একই কথা: বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর ব্লু-প্রিন্ট বাস্তবায়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে! সরকার বা বিরোধী দলের যেকোনো সাধারণ সমর্থকের কাছে গেলেও আমরা জানতে পারব এই আপ্তবাক্য: বাংলা হবে আফগান! সত্যি এ এক অদ্ভুত মিল! যখন জাতি চরমভাবে বিভক্ত, তখন এই ঐতিহাসিক ঐক্য মুগ্ধ না করে পারে না! তবে এও কি নাটক? বা নাটক নাটক খেলা? ১৯৫৭ সনের ১৭ অক্টোবর ‘পাকিস্তান টাইমস’ পাকিস্তানে বিদ্যমান রাজনৈতিক খেলার একটি চরিত্র তুলে ধরেন, যার সাথে বোধ করি আমাদের দেশের রাজনৈতিক খেলার কিছু মিল আছে:

প্রথমত, একই মুখ বার বার দেখা যায়। দ্বিতীয়ত যে জনগণের নামে এই খেলা চলে তাদের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। স্বচ্ছ পুরুষ্কার হচ্ছে ক্ষমতা এবং এর বেদিমূলে নীতি অথবা আনুগত্যের বিসর্জন মহানকর্ম বলে বিবেচিত হয় না। যারা এ থেকে বঞ্চিত হয় তারা এর পুনরুদ্ধারে পাগল হয়ে যায়, যারা ক্ষমতা আঁকড়ে আছে, তারা মনে করে তা টিকিয়ে রাখতে পারবে।

বাংলাদেশে যে মৌলবাদের আবাদ ঘটিয়ে একটি আফগানিস্তানের জন্ম দিতে চলেছে বিএনপি-জামাত জোট, সরকারি দলের এ পুরনো অভিযোগ সবারই জানা। কিন্তু বিরোধী জোট একই কথা বলছে কি করে? তাদের এক বুদ্ধি নেতা সম্প্রতি টকশোতে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এভাবে: বাংলাদেশ ক্রমেই বিশ্বের একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। শীতল যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা সাম্রাজ্য তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইসলামকে আর যেখানেই ইসলামি শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে, নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে তাকে! তবে কোন ইসলামি দেশকে আক্রমণ করার অজুহাত হিসেবে সেখানে গোলযোগ তৈরি করা হবে সুকৌশলে, যা আজ বাংলাদেশে করা হচ্ছে, উদ্দেশ্য: ইন্দো-ইঙ্গ-মার্কিন হামলা ত্বরান্বিত করা আর বাংলাদেশের অফুরন্ত তেল-গ্যাস ছিনিয়ে নেয়া!

এট্রু খেয়াল কইরা, আঠার দলীয় সমর্থিত ‘বাংলা হবে আফগান’ তত্ত্বে একটা নীল বইয়ের অস্তিত্ব রয়েছে। এই বইয়ের চ্যাপ্টারগুলোতে ধাপে ধাপে লেখা রয়েছে, কবে ওসামা বিন লাদেনকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে কাজে লাগান হবে, কবে তাকে দিয়ে আল-কায়েদা বানানো হবে, কবে তালেবানদের ক্ষমতায় বসানো হবে, কবে লাদেনকে দিয়ে ৯/১১ অ্যাটাক করা হবে, কবে তালেবান দমনের নামে আফগান আক্রমণ হবে, কবে সাদ্দাম দমনের নামে ইরাক আক্রমণ হবে, কবে বাংলাদেশে ১/১১ ঘটানো হবে, কবে ভারতের মনমত সরকার বসানো হবে, কবে শাহবাগ তৈরি করা হবে, কবে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের উস্কে দিয়ে মাঠে নামান হবে, কবে শহীদ মিনার-মন্দির-মঠ ভাংচুর হবে ভারতের সহযোগিতায়, কবে বাংলাদেশে শুরু হবে গৃহযুদ্ধ, কবে বাংলাদেশ আক্রমণ করবে ইন্দো-ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইত্যাদি ইত্যাদি। আশ্চর্য হলেও সত্য, এই কথিত নীল বইতে আমলনামার মতই সবকিছু আগে থেকেই লেখা রয়েছে আর এমনটাই বিশ্বাস করা হয়! স্রষ্টার আমলনামায় যাদের পরিপূর্ণ আস্থা, তাদেরই আবার অগাধ আস্থা তথাকথিত আমেরিকান নীল বইয়ের উপর। খুব মজার, তাই না?

যাহোক, এভাবে বড় দুটি জোটই কিন্তু আবারও কথা কয় এক সুরে, ঘুমন্ত জাতিকে দেয় মুহুর্মুহু অ্যালার্ম কল: বাংলা হবে আফগান, এবার হও সাবধান! চোদ্দ জোট এখন জামাত ঠেকাতে চাইছে, আর তা করতে গিয়ে দ্বারস্থ হয়েছে অন্যান্য কট্টর জামাত-বিরোধী ইসলামি দলের! সত্য যে, জামাত-বিরোধী ইসলামি দলগুলোর নীতিমালা তালেবানি নীতিমালার সাথে মিল খায় বেশি, কিন্তু তাতে কি! ওদের তো ভোট নেই! জামাতের ভোট আছে! জামাত নির্মূল হলে আঠার জোট দুর্বল হয়, আর চোদ্দ জোট ফের ক্ষমতায়! আর এভাবেই বাংলার ঘাড় থেকে ছাড়িয়ে দেয়া যায় আফগান আসর! এই হল চৌদ্দ দলের তালেবরদের তালেবান বিনাশের অভুতপূর্ব ফর্মুলা!

এদিকে, আঠার জোটও বাংলাকে আফগান হতে দিতে চায় না, কারণ তা হলে তাদের এ সম্পদপূর্ণ দেশটা যে দখলে নেবে বিধর্মীরা! তো, একটাই উপায়: দেশের পুতুল সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠানো! কিন্তু এ পুতুল সরকারের সাথে ইন্ডিয়ার যে মিতালি, তা তো ছুটাতেই হবে! কি করা যায়? একটু ইন্ডিয়ার বন্ধু সাজার চেষ্টা করলে কেমন হয়? সঙ্গে ওবামাকেও একটা পত্র লেখা যায়! ওবামাকে যদি নিছক বন্ধুতার ছলেই এ দেশটিকে রক্ষা করার নিমন্ত্রন জানানো যায়, তাহলে কত খুশি হবেন ওবামেরিকা, ভাবা যায়? ইন্ডিয়া আর আমেরিকাকে যদি সরকারের পাশ থেকে সরিয়ে আনা যায়, আর কি সম্ভাবনা আছে যে, আ’লিগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে? এরপর নির্বাচনে বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে আঠার জোট ক্ষমতায় এলে বাংলাকে আফগান বানানোর সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়া যাবে! পাল্টে দেয়া যাবে সো-কল্ড পশ্চিমা নীল বইয়ের চ্যাপ্টার! আঠার জোটের তালেবরদের এ আরেক অব্যর্থ প্রেসক্রিপশন তালেবান নির্মুলের!

এভাবে আবারো চরম ও বিরল এক ঐক্য পরিলক্ষিত হয় দেশের দুটো প্রধান জোটের মাঝে! চোদ্দ জোট বাংলায় আফগানি ভুত ঠেকাতে সিদ্ধান্ত নেয় জামাত নির্মূলের, সেজন্য তারা মাঠে নামিয়ে দেয় জামাত-বিরোধী ইসলামি দলগুলোকে আর তাদের খুশি রাখতে খোলে ব্লগার খতমের এক শক্তিশালী মিশন! অন্যদিকে, আঠার জোটও বাংলায় আফগানি সংকেত দূর করতে মরিয়া হয়ে দ্বারস্থ হয় ইন্ডিয়ার, ওবামাকে জানায় উদার নিমন্ত্রণ এই ছবির মত দেশে, উনি এসে যেন কিছু করেন। রক্ষা কর বাবা-ওবামা!

পরিশিষ্টঃ

২০১৪ সালের মার্চ মাস। দুই জোটের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাও ঠেকাতে পারেনি বাংলার আফগান ভবিষ্যৎ। সবুজ বাংলায় এখন শুধু রুক্ষ আর কঠিন সব পাথরের স্তূপ! মরুভূমির তপ্ত বাতাস গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেয়। আর খেলে না বর্ষা-বসন্তের পাগলা হাওয়া! দিগন্ত বেয়ে নামে আগুনের হলকা! সোনার বাংলা এভাবে সত্যি একদিন শ্মশান হয়ে যায়!

তারা হা-এর পাশাপাশি মাঠে নামিয়ে দেয় খা-কে
ফলে, একটি ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্ব -সংঘাতের জটিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়
বাংলা বর্ণমালা ও তার জনগণ।
তবে নাটক দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি,
নাট্যকারদের মতো এমন নিষ্ঠুর প্রাণী পৃথিবীতে আর নেই।
——কবি নির্মলেন্দু গুণ