লিখেছেন – আহমদ মিনহাজ
দেশের হাল-হকিকত দেখে হঠাৎ-ই ‘বুরিদানের গাধা’র কথা মনে পড়ে গেলো। বহুকাল আগের কথা। এক মালিকের একটি গাধা ছিল। মালিক তার গাধাটিকে নিয়ে সফরে বের হয়েছিল। লম্বা পথ আর চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে গিয়ে গাধা বেচারা একদম কাহিল হয়ে পড়ে। সেকালে মানুষ কমবেশি গাধার খাটুনি-ই খাটতো। আর গাধাকে এর দশগুণ খাটতে হতো। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে পছন্দসই খাবার কিন্তু সবসময় জুটতো না। মানুষের মধ্যে একদল ছিলেন যারা অন্যের নাকের ডগায় মূলা ঝুলিয়ে তাদেরকে খাটিয়ে মারতেন। আর খাটুরের দল গাধার ওপর শোধ তুলতো। অবলা জীবের নাকের ডগায় মূলা ঝুলিয়ে তাকে ভার বহন করাতো কিংবা লম্বা পথ পাড়ি দিতে বাধ্য করতো। এতোসব ঝক্কি সইবার পর বেচারা গাধার পক্ষে নিজের জীবন ও তার সার্থকতা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সুযোগ জুটতো বলে মনে হয় না। সেই প্রসঙ্গে আর নাই-বা গেলাম। আপাতত কাহিনীতে ফিরে যাই।
বিবরণে প্রকাশ, লম্বা পথের ধকল সইতে না-পেরে গাধাটি পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছিল। বেচারার এই কাতর অবস্থায় মালিকের মনে দয়া জেগে উঠলো। সে তখন গাধাটির সামনে মূলার বদলে এক গামলা খাবার ও এক গামলা পানি ধরিয়ে দিলো। গাধার জীবন রক্ষায় বস্তু দুটি তখন জরুরি ছিল। সে যাহোক, গাধার আহার-নিদ্রার বিলি-বণ্টন সেরে মালিক নিজেও দিবানিদ্রার আয়োজনে গেলেন। ওইদিকে বেচারা গাধা পড়লো উভয় সংকটে। তার তখন ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। তৃষ্ণায় ছাতি ফাটো ফাটো। তাই ভাবলো প্রথমে এক ঢোক পানি পান করা যাক। কিন্তু গামলায় মুখ বাড়াতেই পেটের খিদে দাবানলের মতো জ্বলে উঠলো। কী আর করা! গামলাভরা খাবারের দিকে মুখ ফিরাতে হলো। অমনি তার মনে হলো পানি না খেলে এক গ্রাস খাবার গলা দিয়ে নাববে না। পানি পানের জন্য বেচারা কেবল রেডি হচ্ছে, এমন সুময় পেটের খিদেয় মাথা বনবন করে ঘুরতে শুরু করলো। যেন গলাভর্তি খাবার ছাড়া এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না!
পানির গামলা নাকি খাবারের গামলা, -কাকে দিয়ে উদরের জটিলতা মেটাবে সেই ভাবনায় গাধাটি তখন কাহিল হয়ে পড়েছে। কিছুতেই মত ঠিক করতে পারছিল না। তেষ্টা ও খিদার মধ্যে এভাবে লড়াই করতে-করতে, পানির গামলা থেকে খাবারের গামলায় ঘুরপাক খেতে-খেতে বেচারা জ্ঞান হারালো। ভাতঘুম শেষে মালিক খবর নিতে এসে দেখলেন, -গামলা দুটি যেমনটি রেখে গিয়েছিলেন সেভাবে পড়ে আছে। আর গাধাটি জিহবা বের করে চিৎপটাং শুয়ে রয়েছে। মালিক তার গায়ে হাত রাখলেন। যুক্তির দোটানায় ক্লান্ত গাধা ততক্ষণে ইহলোক ছেড়ে পরলোকের রাস্তা ধরেছে! জীবনে কখনো তেষ্টা ও খিদা মেটাতে গামলার দিকে সে মুখ বাড়াবে না!
এই ঘটনা জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়ে যায়। ঘটনার পরিশেষে সেটি উঠানো যেতে পারে :-
প্রাণীকূলে গাধাকে নিয়ে নানারকম কাহিনী চালু আছে। আমরা তাকে বোকাসোকা ভাবি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে ভাবনাটি মোটেও সঠিক নয়। নিজের হেফাজতের ব্যাপারে গাধাকুল যথেষ্ট সচেতন। তাদের যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞান বেশ টনটনে। যদিও কাহিনীতে যুক্তির দোটানায় পড়ে তাকে জান খোয়াতে হলো। একইসঙ্গে যুক্তি, বিবেচনা ও চিন্তাশীলতা প্রয়োগ করতে গিয়ে সে মারা পড়লো। প্রশ্ন হচ্ছে গাধার জায়গায় আমরা হলে কী করতাম? দেহের দাবিকে মনের ওপর প্রাধান্য দিতাম? নাকি দোটানায় ভুগতাম? অস্তিত্বের সংকটকে কি চিন্তাশীলতা দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব? এরকম ইস্যুতে আমরা আসলে কাকে প্রাধান্য দিবো? আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও বিবেচনাবোধকে? যদি তাই হয় তবে মানুষ গাধার চেয়ে অধিক চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ এমন দাবি করার ভিত্তি থাকে না। তাহলে কি আমরা কাণ্ডজ্ঞান ও বিবেচনাকে বিচার করতে সক্ষম যুক্তিশীলতাকে বেছে নেবো? সেক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও প্রান-সংশয় কি এড়ানো যাবে? নাকি উভয়ের মাঝে বোঝাপড়া করে মত ঠিক করে নিবো?
সে যাহোক, ‘বুরিদানের গাধা’কে নিয়ে ভাবনা করলে গুরুতর গাধামির কবলে পতিত হওয়া বিচিত্র নয়। পনেরো শতকে ফরাসি দেশের অধিবাসী বুরিদান সাহেব যখন ঘটনাটির দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তখন মানবজীবনে নৈতিকতার ভূমিকা ও সংকট নিয়ে ঘোরতর কোন্দল চলছে। সে অন্য ইতিহাস। অনুসন্ধানীরা ইচ্ছে করলে তার খবর নিতে পারেন।
আপাতত এই শিরোনামটি সহি যে, ‘বুরিদানের গাধা কি সত্যিই গাধা ছিলো, নাকি যুক্তি ও বিবেচনার লাড়াই তাকে শহিদ অথবা গাধায় পরিণত করলো।’ যেভাবে আমরা জীবনের অস্তিত্ব আর অর্থ খুঁজতে গিয়ে হয়রান হই। দোটানায় পড়ে তব্দালাগা মানুষের নিয়তি বরণ করি! যেখান থেকে আমাদের বোকা বানানোর মতো বিবিত্র সব ব্যবস্থা আর কাণ্ডকাহিনী জন্ম নিতে থাকে। দেশের হালফিল সংকট যেন এরকম কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রতীকী রচনা তাদের জন্য যারা এখনো কনফিউজ। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার প্রশ্নে দেশে পক্ষে-বিপক্ষ দুটি শক্তি-বলয় তৈরি হলো দেখে ভীত এবং বিভ্রান্ত। সেইসব কনফিউজদের উদ্দেশে বলছি, আপনারা “বুরিদানের গাধা”র নিয়তি বরণ করতে চান কিনা সেটি নিয়ে ভাবার এটাই হয়তো শেষ সুযোগ। আশা করি বাকিরাও ভাববেন।
পুনশ্চ : অরেকটি কথা, ঘটনার বিবরণ সংগ্রহের কালে উইকি থেকে ধার করা একথানা ছবি ইষৎ সম্পাদনা সহকারে সংযুক্ত করেছি। ছবির মমার্থ ছবির মধ্যেই প্রকাশিত। বুরিদানের গাধা সংক্রান্ত প্রশ্নকে সেই আলোকে ভাবা যেতে পারে। বাকিটুকু আপনাদের বিবেচনা…
আপনি বিভ্রান্ত গাধার একপাশে রেখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা’ অন্যপাশে ‘ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনা’। অন্য কথায় আপনি বোঝাতে চাইছেন জনগন বিভ্রান্ত তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাকি ধর্মীয় বিশ্বাস কোনটা বেছে নেবে। আমার মনে হয় আস্তিক, নাস্তিক-সহ দেশের বেশীরভাগ মানুষই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া আর ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করার মধ্যে কোন দ্বন্দ আমার চোখে ধরা পড়ছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর ধর্মীয় বিশ্বাসকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছে জামাত-শিবির। কারন তারা জানে যে এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ সৃস্টি হলে আখেরে লাভ হবে তাদেরই।
আপনার লেখা বেশ আকর্ষণীয়। লেখার শেষাংশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে আসলেই কোন সংঘাত আছে কিনা এসম্পর্কে আপনার অভিমত জানালে আরো ভাল লাগতো। ধন্যবাদ।
@মনজুর মুরশেদ,
একেবারে যথার্থ বলেছেন। (Y)
চমৎকার লেখা। ধন্যবাদ
সুন্দর লেখাটার জন্য প্রথমেই শুভেচ্ছা। (F)
বুরিদানে গাধাটা গাধা হোক আর যাই হোক না কেন আমরা বাঙ্গালীরা যে ওই বুরিদানের গাধার চেয়ে কম গাধা না। সেইটা এইবারের নির্বাচন আসলেই প্রমাণ পাবেন, সবুর করেন। :-s
বিষয়টা নিয়ে ভাবা খুব জরুরী হয়ে পড়েছে।
শাহবাগের পরাজয়ের অর্থ দাড়াবে দেশটি আর একটি শারিয়া শাসিত ভয়ংকর দ্বিতীয় পাকিস্তান অথবা তালেবান শাসিত শারিয়া ভিত্তিক ভয়ংকর আফগানিস্তানে পরিণত হয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনই পথ না থাকা। জনগন যদি সেইটাই চায় তাইই হবে!!
@আঃ হাকিম চাকলাদার,
হুম, কেনো জানিনা আমার মনে ও একটা ভয় দানা বাদছে কদিন যাবত।
জালিয়ালোয়ালা হত্যাযজ্ঞের কথা মনে পড়ে গা শিউরে উঠে।
ওটা হবে
জালিয়ানওয়ালা হত্যাযজ্ঞ
দেশের মানুষকে কনফিউজড করা হয়েছে। এপ্রকৃয়ার যবনীকা টানতে হলে শাহবাগের বিজয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তার পরেও অনেকদূর পাড়ি দিতে হবে।
গাধার মতই একদল মানুষ সংশয়ে আছে। আশেপাশে কথা বললেই বুঝা যায়,তবে গাধার মত তাদের মরণ না হলেও দেশটার তেরোটা বাজাচ্ছে।