লিখেছেন – জহিরুল ইসলাম তুষার

“শাহবাগ” সম্ভবত বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ। পত্রিকার পাতা, টিভি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেইসবুক, টুইটার সহ জনমানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছে “শাহবাগ” কিন্তু কেন এবং কোন কারনে আজকে শাহবাগের এই “শাহবাগ” হয়ে ওঠা? আর একজন বাঙালি, বাংলাদেশী সর্বপরি একজন মানুষ হিসেবে কেনইবা আমি তাকে সমর্থন করি অথবা করব?


সময়ঃ ২৫শে মার্চ ১৯৭১

তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা রাতের আধারে অস্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে এদেশের ঘুমন্ত নিরস্র মানুষের উপর। “অপারেশন সার্চলাইট” নামের ঐ ভয়াল রাত্রি শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ দিয়ে। রাতের পরে যে সকাল আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়ার কথা সেই সকাল এলো কালো ধোয়ায় ঢাকা ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে। মুহূর্তেই শোককে শক্তিতে পরিনত করে জেগে ওঠে মানুষ। সমস্ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, স্বজন হারানোর বেদনা এমনকি মহামূল্যবান প্রানের মায়া একপাশে সরিয়ে রেখে অস্র হাতে তুলে নেয় এদেশের শান্তিপ্রিয়রা। জাতি হিসেবে একাত্ম হওয়া সেদিন রুখতে পারেনি ধনি-গরিব, মতাদর্শ,আঞ্চলিকতা এমনকি ধর্মও! কৃষক,শ্রমিক,শিল্পী,বিজ্ঞানী, চোর, ডাক্তার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, আদিবাসী সবাই হয়ে যান একই মায়ের সন্তান। সেদিনের সেই বীরেরা অস্র ধরেছিলেন বাংলা মায়ের সম্ভ্রম বাচাতে। তারা অস্র ধরেছিলেন স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য, আত্মপরিচিতির জন্য, তাদের সন্তানদের জন্য, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। শুরু হয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের যুদ্ধ। কিন্তু কে জানতো যে এই মহৎ স্বপ্ন দেখা যোদ্ধাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার সন্তান! যারা বদর যুদ্ধকে কলঙ্কিত করে নিজ দলের নাম রেখেছিলো আল-বদর, যারা নাম ধারন করেছিল রাজাকার অর্থাৎ সাহায্যকারী কিন্তু সাহায্য করেছিল খুনি পাকিস্তানী জান্তাদের! যারা গঠন করেছিল আল-শামস, শান্তিকমিটি নামের খুনি বাহিনী। শুধুই তারা পবিত্র ধর্মের নাম দিয়ে অথচ স্বীয় স্বার্থ লাভের জন্য হাত মিলিয়েছিল পাকিস্তানী জান্তাদের হাতে। যারা শান্তির ধর্ম ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে চালাতে শুরু করে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের মত ধর্মবিরুদ্ধ এবং মানবতবিরোধী অপরাধ। সেদিন তাদের কালো হাত থেকে যেমনি রেহাই পায়নি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তেমনি রেহাই পায়নি নিজ ধর্মের অনুসারীরাও। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি চিনিয়ে দেয়া, তাদের ঘরের স্ত্রী, মা, বোনদের পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়া অথবা গণিমতের(যুদ্ধলব্ধ) মাল হিসেবে স্বশরীরে তাদের উপর পাশবিক শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা, দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিজ হাতে গুলি অথবা জবাই করে হত্যাই ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। এমনকি তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু-কিশোর-কিশোরীরাও। কি পাশবিক! কি পৈশাচিক!

কিন্তু তাদের কোন বাধাই রুখতে পারেনি বীরমুক্তিযোদ্ধা সূর্যসন্তানদের। জয় হয়েছে সত্যের, সততার, স্বাধীনতার।

সময়ঃ ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর পরে সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের ধর্ম ব্যাবসায়ী, হত্যা, ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের একজন আবদুল কাদের মোল্লার রায় দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের(যার মধ্যে ছিল ধর্ষণ, গণহত্যার মত অভিযোগ) মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হওয়ার পরও কোন এক অজানা কারনে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশে দণ্ডিত করা হয়। স্বভাবতই তা মেনে নিতে পারছিলনা সাধারন মানুষ। এরই প্রেক্ষিতে কিছু তরুন শুধু তারুণ্য আর আবেগকে সম্বল করে নেমে আসে শাহবাগে। দাবি একটাই, সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই। একই দাবিতে দলে দলে এসে শাহবাগে একাত্মতা প্রকাশ করে সর্বসাধারন। বিয়াল্লিশ বছরের যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমা হয়ে ছিল মানুষের মনে তাতে শুধু দরকার ছিল একটা স্ফুলিঙ্গ, তারুণ্যের স্ফুলিঙ্গ। বাকিটা তো বর্তমান আর ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাস।

(তারপরও কিছু মানুষের মনে সংশয় সন্দেহ দেখা যাচ্ছে এই শাহবাগকে নিয়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা ১৯৭১ এর চেয়েও ভয়ংকর। বিভ্রান্ত, উদ্ভ্রান্ত মানুষ দেয়ালে দেয়ালে ঠোকর খাচ্ছে শুধু সরলতা আর ধর্মভিরুতার কারনে। ঘ্যৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বচ্চ শাশ্তি যেখানে প্রতিটি মানুষের দাবী হওয়ার কথা সেখানে কিছু মানুষ উলটো সাফাই গাইছে তাদের পক্ষে!!! এরচেয়ে লজ্জাজনক একটি জাতির জন্য আর কি হতে পারে? এর মধ্যে আছে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বিভ্রান্ত ছড়ানো কিছু গোষ্ঠীর সাথে কিছু ছাপোষা সাধারন মানুষও! এই ব্যর্থতা কার? এই ব্যর্থতা সমগ্র জাতির। আমরা আমাদের ইতিহাসে শিক্ষিত হতে পারিনি। বারবার আমাদের ভোলানো হয়েছে ভুল ইতিহাস দিয়ে। বিজ্ঞান আর আর্টকে আমরা দেখেছি ভুলভাবে। যে কারনে এই একবিংশ শতাব্দিতেও চাঁদে কোন এক ধর্মগুরুর ছবি ভেসে উঠেছে বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারি। আমাদের প্রশ্ন করা শেখানো হয়নি। তাই ভুল তথ্যকেই আমরা বিশ্বাস করি অন্তর থেকে। কুসংস্কার এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। অথচ সেইসব ধর্মব্যবসায়ীরা কিন্তু ঠিকই জানে যে তারা মিত্থ্যে বলছে ধর্মের দোহাই দিয়ে কিন্তু যারা বিশ্বাস করছে সত্য ভেবে তারা জানেনা সেটা কি বা কত বড় মিথ্যা। কি আশ্চর্য! মানুষ একবারও নিজেকে জিগ্যেস করে না যে, একটা দেশের জন্মপরিচয় যদি তুলে ধরতে হয় তবে সেখানে জন্মের সময় বিরোধিতাকারীরা থাকতে পারে কি না? যদি থাকে তবে সে পরিচয়ে নিজেকে পরিচিতি করানো যায় কি না? নিজেকে প্রশ্ন করুন যারা ১৯৭১এ গনহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ করেছে তাদের কাছে আপনি, আপনার পরিবার, আপনার সন্তান, আপনার ভবিষ্যৎ কি নিরাপদ? এখানে ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ কোন প্রশ্ন বা বাধা নয়। কারন যেকোন ধর্মই এরকম অপরাধীদের কঠিন শাস্তির বিধান আছে সেখানে অপরাধী যেই হোক না কেন।)


কেন আমি?

যারা সেইসব পৈশাচিক অপরাধ করেছে, যারা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হয়েও বিয়াল্লিশ বছর হেঁটেছে এই বাংলার মুক্ত বাতাসে, দম্ভভরে ঘুরে বেরিয়েছে জাতিয় জাতীয় পতাকা সম্বলিত গাড়িতে, পুনর্বাসিত হয়েছে রাজনৈতিক ভাবে, ঘুনেপকা হয়ে খেয়ে নিচ্ছে আমাদের মেরুদণ্ড, ধর্মের নামে সহজ সরল মানুষকে নিয়ে করছে ব্যাবসা, সর্বোপরি দেশকে পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা প্রতিনিয়ত করছে ঐ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। খুব সহজ ভাবে বললে যারা ১৯৭১ এ এই বাংলাদেশকে চায়নি তাদের এই দেশের প্রতি কোন প্রেম, মায়া, মমতা আছে তা আমি বিশ্বাস করিনা। যাদের হাতে ১৯৭১ এ আমার মা,বোন,ভাই,বাবা নিরাপদ ছিলনা তাদের হাতে আমি বা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদে থাকবে এ কথা আমি কোনভাবেই বিশ্বাস করি না। আমার কাছে ঐ দেশদ্রোহী বিশ্বাস ঘাতকদের এই দেশে ঠাই দেয়া আর আমার দেশকে, আমার মাকে, আমার স্বাধীন সত্ত্বাকে অস্বীকার করা একই কথা। ওদের মুক্ত বাতাসে ছেড়ে দেয়া আর স্বাধীনতাকে অপমান করা একই কথা। ওদের ফাঁসি না দিলে অপমান করা হবে সেইসব বীরদের যারা তাদের সাজানো সংসার ছেড়ে, মায়ের হাতের মাখানো ভাত না খেয়ে, বাবার সাথে লাঙ্গল না ধরে, গীটার তবলা পিয়ানো একতারা ছেড়ে, স্নেহের ভাইকে বোনকে দূরে সরিয়ে, সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুকে কোলে না নিয়ে অস্র তুলে নিয়েছিলেন শুধুই আমার মত অচেনা অজানা অজস্র মানুষ তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক টুকরো ভূখণ্ড আর স্বাধীনতার স্বাদ তথা মুক্তবাতাসে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার জন্য। অপমান করা হবে সেই বিরঙ্গনাদের যারা নিজেদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দিয়েছেন আজকের এই স্বাধীনতা। অপমান করা হবে সেই বাবাদের যারা তাদের প্রিয় সন্তানদের লাশ কাধে করে বয়ে এনেছেন আজকের স্বাধীনতার রুপে। অপমান করা হবে জাহানারা ইমামের মত সেইসব শহীদ জননীদের যারা নিজ হাতে প্রিয় সন্তানদের তৈরি করে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন শুধু অনাগত ভবিষ্যৎ সন্তানদের স্বাধীনতা উপহার দেয়ার জন্য।

আমি তা হতে দিতে পারি না, আমি হতে দেব না। আমি দেবনা আমার সাজান বাগান আবার তছনছ হতে। আমি পারবনা আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে এমন একটি দেশ তুলে দিতে যেখানে ধর্মের নামে চলে অধর্ম, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি আর ধর্মান্ধতা এক বলে মানুষকে শেখান হয় শুধু ধর্মব্যাবসায়ীদের স্বার্থে, যেখানে শুধু ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার কারনে চলে পাশবিকতা, যেখানে ধর্মের নামে চলে রাজনীতি, যেখানে নেই শিক্ষা আর অশিক্ষা অথবা কুশিক্ষা পার্থক্য করার উপায়। আমি পারব না সেই ১৯৭১ এর মত দেশদ্রোহী, নিজ মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতক, হত্যাকারী ঘৃণ্য নরপশুদের পক্ষে সাফাই গাইতে। আমি এতবড় কুলাঙ্গার হতে পারব না। না, আমি পারব না।

আমার এই চাওয়া আর না পারার আকুতিগুলোই আজ ধারন করছে শাহবাগ। শাহবাগ আমার কাছে কোন বিক্ষিপ্ত আন্দোলন নয়। মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে বুঝতে চেষ্টা করেছি কি ছিল সেই উদ্দীপনা যা ১৯৭১ এ যোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিল সম্মুখযুদ্ধে? মনের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম সেই বীর ও বিরঙ্গনাদের চোখ; যেগুলো জ্বলছিল সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে। যেই আলোয় ভেসে গিয়েছিল সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত অন্যায়, সমস্ত বিশ্বাসঘাতকতা। শুনেছি তাদের হৃৎপিণ্ডের কম্পন যা বেজেছিল মুক্তির গান হয়ে। কল্পনার চোখে দেখা সেই সূর্যদীপ্ত যোদ্ধাদের চোখ দেখি আজ শাহবাগে। শাহবাগের স্পন্দনে যেন অনুরণিত হয় ১৯৭১ এর বীরযোদ্ধাদের হৃৎকম্পন। শাহবাগের স্লোগানে কান পাতলেই যেন শুনি মুক্তির গান। ভবিষ্যতের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাক আজকের শাহবাগ। শাহবাগ আমার কাছে আমার জন্য, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সৌন্দর্যের, সাহিত্যের, কলার, বিজ্ঞানের, শিক্ষার রূপক বীজক্ষেত্র। তাই আমি শাহবাগে একাত্ম। তোমরাও জেনো হে ভবিষ্যৎ, আমরা এসেছিলাম তোমাদের জন্য।

জয় শাহবাগ