একজন  ব্লগারের মৃত্যু এবং …

গত কয়েকদিন ধরেই একটি খবরে তোলপাড় সাড়া দেশ। তরুণ ব্লগার এবং স্থপতি রাজীব হায়দারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যিনি শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণআন্দোলনে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। কয়েক মাস আগে  এমনি আরেকটি খবর হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েছিল। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনও অনেকটা একই কায়দায় ছুরিকাহত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশে দাঙ্গা, খুন, রাহাজানি, মারামারি, কাটাকাটি, নির্যাতন এতটাই গা সওয়া হয়ে গেছে যে এই ঘটনাগুলো হয়তো আলাদা করে কারো নজরে পড়ার কথা না।  কিন্তু তারপরেও এটা নজরে কেবল পড়েছে তা নয়,  বহু মানুষের উষ্মার কারণ ঘটিয়েছে। বিশেষ করে কাদের মোল্লা সহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যখন দেশ উত্তাল, সে সময় রাজীবের ওপর আঘাতে ঘটনাপ্রবাহে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। আমরা যারা লেখালিখির সাথে জড়িত, তাদের জন্য এ ব্যাপারটা উদ্বেগের – কারণ হল, যতটুকু বোঝা গেছে, ব্লগার রাজীব কিংবা আসিফকে কোন ব্যক্তিগত কারণে আক্রমণ করা হয়নি, এমনকি টাকা পয়সার জন্যও না। ঘটনায় প্রকাশ, আততায়ীরা কারো থেকেই সেলফোন, মানিব্যাগ কিছুই ছিনতাই করেনি।  বোঝাই যায়, ছুঁচকো চুরি বা ছিনতাই এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল তার বাক-স্বাধীনতা হরণ এবং সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিভাজন তৈরি করার।  তারা এ যাত্রা কতটুকু সফল হলেন তা সময়ই বলে দেবে।  আপাতঃ দৃষ্টিতে রাজীব হত্যার শোক পরিণত হয়েছে শক্তিতে। আন্দোলন হয়েছে আরও বেগবান, আরও তেজোদীপ্ত। রাজীব হত্যার বদলা তথা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর না দেখে ঘরে ফিরবেন না বলে কফিন ছুঁয়ে ওয়াদা করেছেন তার সহযোদ্ধারা।

 

ধর্মানুভূতির উপকথার প্রাসঙ্গিকতা আবারো

রাজীব হত্যার ব্যাপারটা আমাদের অনেককেই ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর ধর্মান্ধগোষ্ঠির আক্রমণের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্যাপারটা আমার জন্য আরো বেশি আবেগময়, কারণ সেসময় হুমায়ুন আজাদ আমার প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’ ফোরামের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ ব্যাপারটার স্মৃতিচারণা করে আমি কয়েকবছর আগে ব্লগে একটা লেখা লিখেছিলাম  ‘স্মৃতিতে হুমায়ুন আজাদ’ শিরোনামে। সে লেখাতে বর্ণনা করেছিলাম আমার সাথে এবং সর্বোপরি মুক্তমনা সাইটের সাথে তাঁর যোগাযোগের প্রেক্ষাপট। লেখায় বলেছিলাম – হুমায়ুন আজাদের সাথে আমার যোগাযোগ হয় আমি দেশের বাইরে এসে মুক্তমনা তৈরি করার পরে।  হঠাৎ তিনি একদিন আমাদের ইমেইল করেন তার বিখ্যাত ‘ধর্মানুভূতির উপকথা’ প্রবন্ধটি সংযুক্ত করে। অনুরোধ করেন মুক্তমনায় প্রকাশের জন্য। আমরা হই আনন্দিত এবং সেই সাথে আপ্লুত। আমরা লেখাটিকে পিডিএফ আকারে আমাদের সাইটে রেখে দেই। পরে অধ্যাপক আজাদ এই প্রবন্ধটিকে নিজের বইয়ে সংকলিত করেন যে বইটির শিরোনামও ছিল ‘ধর্মানুভূতির উপকথা’  সে লেখাটিতে অধ্যাপক আজাদ বলেছিলেন,  ‘ধর্মানুভূতি নামক জুজুর উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন যেন সারা বিশ্ব কাঁপছে’। সেই ক্ষিপ্ততার ফলাফল নিজের জীবন দিয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে প্রমাণ করতে হয়েছে। তার লিখিত পাক সার জমিন উপন্যাসটি ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায়  ছাপা হবার পর থেকে মৌলবাদীরা তার জীবননাশের হুমকি দিচ্ছিলেন। সেটা জানিয়ে তিনি মুক্তমনা ফোরামের মডারেটরদের কাছে ইমেইল করেন ২০০৪ সালের জানুয়ারির ৬ তারিখে।  মৌলবাদীদের আস্ফালনের কিছু ছবি ইমেইলে সংযুক্ত করেছিলেন তিনি সেই ইমেইলে। যে কেউ ইন্টারনেটে সার্চ করলেই সেগুলোর হদিস পাবেন।

তারপরের ঘটনা সবারই জানা। ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বই মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদকে নির্মমভাবে কোপানো হয়। অনেকেরই হয়তো মনে আছে হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগে মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী সংসদে ব্লাসফেমী আইন বাস্তবায়ন করে হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উস্কানি দিয়েছিলেন।

 

হুমায়ুন আজাদ, কিংবা হাল আমলের আসিফ মহিউদ্দীন কিংবা রাজীব হায়দার – এরা  সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নিঃসন্দেহে। রাজাকার আলবদর সহ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনবরত লিখেছেন। কিন্তু এর রাইরে এদের তিনজনেরই আরেকটি বিষয়ে মিল রয়েছে। এরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছেন বা এখনো করছেন। হুমায়ুন আজাদ তো সারা জীবন ধরেই  ধর্মীয় রূপকথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন,  ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কারের বিপরীতে প্রগতিশীলতার জয়গান গেয়েছিলেন। ব্লগার আসিফ এবং প্রয়াত রাজীব – যিনি ‘থাবা বাবা’ নামে বিভিন্ন জায়গায় ব্লগ করতেন (মুক্তমনাতেও তিনি মন্তব্য করেছেন এ নামে), তাদের লেখা থেকেও  কিন্তু আমরা বুঝি যে তারা সেই পক্ষেরই।  কেন কেবল এদের মতো লোকই আক্রান্ত হয়ে চলেছেন? আমি এ নিয়ে বাংলাদেশনিউজ২৪ পত্রিকায় একটি লেখা লিখেছি আজ – কেন কেবল তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন? শিরোনামে।

 

বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখকদের অরক্ষিত জীবন 

বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখকদের জীবন হাতে নিয়ে লেখালিখি করতে হয়। লেখালিখি তো অনেকেই করেন, এবং বহু বিষয়েই, কিন্তু আমরা দেখছি ক্রমাগতভাবে আক্রান্ত হচ্ছে তারাই যারা ধর্মীয় কুসংস্কারকে ক্রিটিকালি দেখছেন, কিংবা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছেন। বাংলার কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্ববরকে ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি লেখার কারণে শাসক শ্রেণীর গ্রেফতারী মামলা ও মত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও কম  নিগৃহ তাকে পোহাতে হয়নি। কবীর চৌধুরী, আলি আসগর, আহমদ শরীফ দের একসময় মুরতাদ আখ্যা পেতে হয়েছে, তসলিমাকে ফতোয়া দেয়া হয়েছে,তার মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে, এমনকি ফতোয়াবাজ আমিনী এও বলেছিলেন – তসলিমা নাসরিনের কোন লেখা আমি পড়িনি, তবে তার ফাঁসি চাই’। তসলিমাকে অতঃপর  দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে,  হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে চলে যেতে হয়েছে, আর আজ আসিফ মহিউদ্দীনদের হতে হচ্ছে ছুরিকাহত, আর রাজীবকে তো জবাই করেই মেরে ফেলা হল। অথচ ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর আর্টিকেল-১৯ এ পরিষ্কার বলা আছে –

“Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.”

বাংলাদেশের সংবিধানেও (অনুচ্ছেদ ৩৯ দ্রঃ) কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্রে নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুরক্ষিত’ থাকার উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবেই। অথচ তারপরেও মুক্তচিন্তার লেখকেরা তাদের মতপ্রকাশের কারণে আক্রান্ত হন, নির্যাতিত হন, কিংবা বিপন্ন-বোধ করেন।

 

অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না।  এধরণের লেখালিখিতে যারা আক্রান্ত বোধ করেছেন, তাদের বোঝা উচিৎ, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই  যার সমালোচনা হয় না। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে  কোন ঐতিহাসিক ভয় পান না এই ভেবে যে, চেঙ্গিস খানের সমালোচনা করা যাবে না, পাছে ‘চেঙ্গিসানুভূতি’ আহত হয়! কেউ ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ভাবেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের অত্যাচারের কথা কিংবা জাপানী বর্বরতার কথা অথবা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নৃশংসতার কথা বলা যাবে না।  কেউ বলেন না, এতে করে কারো ইতিহাসানুভূতিতে আঘাত লাগছে, মামলা করে দেবে!  দেশের পত্রিকায় মাঝে মধ্যেই বিজ্ঞানের খবর বা বিশ্লেষণ ছাপাতে গিয়ে অনেক ভুল তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ পরিবেশন করা হয়, আমরা বলি না আমরা আদালতের শরণাপন্ন হব, আমাদের বিজ্ঞানুভূতি বিপন্ন।  একটি ‘বিখ্যাত’ বাংলা পত্রিকা যেটি কিছুদিন আগে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ধর্মীয় সুড়সুড়ি জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় ছিলেন, সেখানে মিরাজ রহমান নামে এক ‘লেখক’ বিজ্ঞানী জন ডালটন, জেমস্ ওয়াটসন, স্যামুয়েল মোর্স, আলবার্ট আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন সহ বড় বড় বিজ্ঞানীকে ‘চোর’ বানিয়ে দিয়েছেন, কারণ এই সব বিজ্ঞানীরা সবাই নাকি একটি ধর্মগ্রন্থের  আয়াত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের নিজস্ব তত্ত্বগুলো নির্মাণ করে বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন। এ সব লেখা আমাদের হাস্যরসের খোরাক যোগায়, হয় বিনোদনের আদি অকৃত্রিম উৎস। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে লাইন বাই লাই সমালোচনাও করেন। কিন্তু কখনোই লেখককে শারীরিকভাবে হেনস্থা করার কথা চিন্তাও করেননা।  হুমায়ুন আজাদ কিংবা রাজীব বা এ ধরণের লেখা যদি কারো অপছন্দ হয়, তবে তার উত্তর লেখার মাধ্যমেই দেয়া যেত।

 

আমার দেশের আস্ফালন:

রাজীবের হত্যাকারীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে, দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি লেখকদের দিতে হবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও। না কেবল ’১৯ জন ব্লগারের’ মৌখিক সরকারী নিরাপত্তা যথেষ্ট নয়। যারা জীবন বিপন্ন করে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লিখছেন, প্রগতির চাকাকে সচল রাখছেন, তাদের নিরাপত্তাই জরুরী আগে। আমরা সবাই এখন জানি, রাজীবকে হত্যার চার দিন আগে সোনার বাংলা ব্লগে ‘থাবা বাবা’ তথা রাজীবের নামে উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়া হয়েছিল। এমনকি রাজীব মারা যাবার পরেও  ফারাবী সাফিউর রহমান সহ কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী তাদের স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘যেই ইমাম থাবা বাবার (রাজীব) জানাজা পড়াবে, সেই ইমামকেও হত্যা করা হবে’। ফারাবীকে যে পুলিশ খুঁজছে তা এমনি এমনি নয়।

 

ফারাবীর হুমকির পাশাপাশি আজ দেখলাম আরেক নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে। বিএনপি জামাতের মুখপত্র এবং মৌলবাদী গোষ্ঠির ফ্যানাটিক অর্গাজমের ‘সেক্স টয়’ আমার দেশ মুক্তমনা সাইটের নামে নতুন করে বিষেদগার শুরু করেছে। গুনে মানে আর মেধায় আমার দেশের অবস্থান ফারাবির মতোই, যার মানসিক সুস্থতা নিয়ে তার কাছের বন্ধুটিও সন্দিহান। অবশ্য আমার দেশ এটা না করলেই আমি বরং অবাক হতাম। ভাবতাম, মুক্তমনার প্রভাব তাহলে এখনো জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছয়নি। মাহমুদুর রহমানের তুর্কি নাচ দেখে বুঝলাম জায়গা মতোই আঘাত করা হয়েছে।  সরকার ও দেশবাসীর প্রতি শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফীর  খোলা চিঠি শিরোনামের লেখাটির ভেতরের দিকে  ‘অন্তরালে ইসলাম অবমাননাকারী ‘অনলাইন চক্র’ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে।  আধাপাতার দুই প্যারাগ্রাফের প্রতিটি লাইন মুক্তমনার প্রতি নৈবদ্য আকারে খিস্তি আকারে প্রকাশ করেছেন আমার দেশের প্রতিবেদক। যদিও নির্ভীক প্রতিবেদক নিজের নামটি প্রকাশ করেননি সেই প্রতিবেদনে।  আমরা ধরে নিতে পারি, নামহীন এই ‘গরলামৃত’ উপাদেয় খিচুড়ি নীলকন্ঠী মাহমুদুর রহমানেরই কণ্ঠনির্গত।

লেখাটির নীচে ‘জিহাদী জোশে’ আক্রান্ত আমার দেশের ভক্তকূল ব্লগারদের হত্যার ফতোয়া দিচ্ছেন এভাবে –

যে সময় একজন ব্লগারকে জবাই করে হত্যা করেছে জামাত শিবির প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, সেখানে মাহামুদুর রহমান আর তার পালিত শিষ্যরা প্রিয় ধর্মকে বাঁচানোর নামে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আঁকড়ে ধরেছেন। শকুন এবং হায়েনাদের সাথে সহবাস শুরু করেছেন।  প্রতিবেদনের মৈথুনে নির্গত করে চলেছেন বিষাক্ত বীর্য।  হুমকি দিচ্ছেন, ধামকি দিচ্ছেন, প্রেক্ষাপট গড়ে দিচ্ছেন  আর কোন অনাগত তরুণ মুক্তমনাকে হত্যার।

যারা এ ধরনের  হুমকি দেখেও না দেখার ভান করছেন বা চুপ করে আছেন, তাদের বোঝা প্রয়োজন যে, এখানে আসিফ, শফিক, কামাল, পারভেজ বা অনিরুদ্ধ  মুখ্য ব্যাপার নয়। বাক স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় যদি আপনি বিশ্বাসী হন, তবে কেবল লেখালিখির কারণে যদি কাউকে নিগৃহীত, নির্যাতিত  এবং ছুরিকাহত হতে হয়, তবে একটা সময় এর বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হবে, অন্য সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে রেখেই।  হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলে দেখবেন, পরশুদিন হুমায়ুন আজাদ  ঘাতকের চাপাতিতে রক্তাক্ত হয়েছে, আজ  রাজীব হায়দার খুন হয়েছেন, হয়ত আগামীকাল খড়গ নেমে আসবে আপনার কিংবা আমার গলাতেই।

শিবিরের নতুন হিট লিস্ট?

শিবির নাকি তাদের পরবর্তী আঘাত হানার জন্য নতুন হিট লিস্ট বানিয়েছে। এরকম একটি হিটলিস্ট বিভিন্ন হাত ঘুরে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে।  চিঠিটা আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা নয়। হিটলিস্টের তালিকার একজনকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ম্যাসেজে যা বলা হয়েছে তা হবহু তুলে দিলাম (তবে প্রেরকের নাম এবং সোর্সটা তার নিজের নিরাপত্তার কারণে মুছে দিলাম )–

ভাই আপনি আমাকে চিনবেন না । এটা আমার ফেইক আইডি । আমার আসল নাম […]

এই আইডি দিয়ে আমি অনেক জামাত শিবিরের সিক্রেট গ্রুপে আছি । আমি তাদের সাথে গলা মিলাই , তাদের মত ভান করি ।

তারা তাদের হিট লিস্টের প্রথম রাজীব ভাই কে তো হত্যা করেই ফেলেছে । আজ তারা পরবর্তী হিট লিস্ট প্রকাশ করেছে

2. আসিফ মহীউদ্দিন
3. অমি রহমান পিয়াল
4. জাফর ইকবাল (*)
5. শর্মি আমিন
6. ডা ইমরান
7. অভিজিত্‍ রায় (প্রবাস *)

আপাতত এগুলো । জাফর স্যারকে কেন স্টার দিয়ে রেখেছে জানি না । জানার চেষ্টা করব ।

পরবর্তী হত্যা হবে তাদের প্ল্যান অনুসারে সাঈদীর রায়ের দিন । টার্গেট আপনি

আপনাকে আগে ভাগে জানিয়ে দিলাম । অনেক অনেক সতর্ক থাকবেন । তারা অনেক বেপরোয়া হয়ে যাবে রায়ের দিন ।

আর এইসব ব্যাপার কাউকে বলবেন না । আমার সমস্যা হবে । আমি শাহবাগে আছি , থাকব । আপনি ব্যক্তিগত ভাবে নিরাপদে থাকবেন , এক যাওয়া আসা করবেন না , থানার একটি জিডি করে রাখুন ,

আপনার সাথে আর কথা হবে না । জয় বাংলা

জয় আমাদের হবেই

স্ক্রিন শট এখানে :

ব্যক্তিগতভাবে নিজের নামটি হিটলিস্টে দেখে কিছুটা হলেও অবাক হয়েছি।  আমি শাহবাগে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে আন্দোলন করিনি, সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি, তারপরেও আমার নামটি তারা তালিকায় স্থান দিয়েছেন, ব্যাপারটা কৌতুহলোদ্দীপক।  আমি নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত নই, দেশে না থাকায় আমার টিকি পর্যন্ত পৌঁছানো তাদের জন্য সহজ ব্যাপার হবে না, কিন্তু শাহবাগের অগনিত ব্লগার যারা শিবিরের টার্গেট হয়ে অরক্ষিত অবস্থায় জীবন যাপন করছেন, মৃত্যুভয়ে ভীত না হয়ে লাগাতার শ্লোগান দিয়ে চলেছেন,  আমার চিন্তাটা মূলতঃ তাদের নিয়েই। আমি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তাদের নিরাপত্তা দাবী করছি।

পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে

আরো একটা জিনিস মনে হল এ লেখাটি লিখতে গিয়ে। যারা ভাবেন বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদ বিষয়ক জিনিস নিয়ে যখন থেকে লেখকেরা লেখা শুরু করেছেন, তারা জেনে গিয়েছেন তারা অনেকটা জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছেন। জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোরা সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জেনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেড়ে ওঠার সময়গুলোতে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম খবরের কাগজে উঠে আসেনি।  আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই  আহত হয়েছে। আদিল মাহমুদ যে কথাটি মুক্তমনা ব্লগে মন্তব্যে বলেছেন, সেটা স্মর্তব্য – স্বাধীনতা-উত্তোর জামাত শিবিরের নৃশংসতার আসল চেহারা বর্তমান নতুন প্রজন্ম তেমন কিছু দেখেনি, আমরা কিছুটা দেখেছি। হাত পায়ের কোন্‌ কোন্‌ রগ কাটা গেলে চিরজীবনের মত পঙ্গু করা যায়, গলার কোন জায়গায় কিভাবে কোপ দিলে সহজেই মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া যায় – এমন শিক্ষা এদের কোচিং আকারে দেওয়া হত শিবিরের আস্তানায়। নারায়ে তকবির বলে জ্যান্ত মানুষের কব্জি কেটে সে কাটা কব্জি নিয়ে তারা আনন্দ মিছিল করেছে তারা তালিবানী কায়দায় – এমন অজস্র খবর আশি এবং নব্বইয়ের দশকে পত্র-পত্রিকায় দেখা যেত।  এগুলো চোখের সামনে দেখেই আমরা বড় হয়েছি।

 

রাজীবের  মর্মান্তিক খবরে আমি ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, উন্মত্ত, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এক ফোঁটা বিচলিত নই। জামাত শিবির সহ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সময় যে শেষ এ থেকে খুব ভাল করেই আমি বুঝতে পারছি। অতীত সাক্ষী – এরা সব সময়ই মরার আগে শেষ কামড় দিতে চেষ্টা করে। ৭১ এ বিজয় দিবসের দুই দিন আগে কি তারা কেন বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেনি?  কিন্তু পেরেছিল কি তাদের সম্ভাব্য পতন ঠেকাতে? মনে আছে স্বৈরাচারের পতনের ঠিক আগে কি ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল ডাক্তার মিলনকে? এগুলো আলামত। তাদের অন্তিম সময় সমাগত। ‘পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে’!

আর বিজয় আমাদের অবশ্যাম্ভাবী।