ফেব্রুয়ারি মাস আসতে থাকলে বাংলা ভাষার নানা সমস্যার কথা শোনা যায়। কখনো শুনতে পাই ভাষার বহতা নদীকে দূষিত করা হচ্ছে [১]। কখনো শোনা যায় ভাষার শুদ্ধতা ও পবিত্রতাকে নষ্ট করা হচ্ছে।
কখনো কখনো সরকার বা তার সহচর বাংলা একাডেমী আমাদের হয়ে নিজেই সমস্যাগুলো খুঁজে দেয়। বা তাদের সহযোগী বুদ্ধিজীবীগণ সেই সেবাটা প্রদান করেন। সমস্যার কথা শুনে আমরা সচেতন হই। আমরা তখন সমাধানের আশায় সরকারের পাণে চেয়ে থাকি। সরকার একটা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করে। কখনো ভাষা পবিত্রতা রক্ষা কমিটি গঠনের কথা শোনা যায় [২]। কখনো গণমাধ্যমের একাংশকে ঘোষণা করা হয় বাংলা ভাষার শত্রু হিসেবে [৩]।
সমস্যা বের করে তার সমাধান দিয়ে দেয়াটা অবশ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এতোটা সহজ নয়। সকল গণতান্ত্রিক সরকারকেই তার নীতিমালার পেছনে একটা নূ্যনতম জনমতের তৈরি করে নিতে হয়। যেমন, বর্তমান সরকার নতুন যেকোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে যে এক প্রকার একমুখী জাতীয়করণ করতে সক্ষম হয়েছে [৪], তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে বিগত বছরগুলোতে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের অবদান অঢেল [৫]।
বেসরকারি উদ্যোগে করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপর নিষেধাজ্ঞাটি নিয়ে খোদ শিক্ষা-জাতীয়করণের পক্ষরাই আশঙ্কিত। এতে আমাদের ঠিক কী লাভ হলো তা প্রশ্নসঙ্কুল। যেমন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম রায় উদ্বেগের সাথে বলছেন [৬] –
জাতীয়করণের ঘোষণার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী যত্রতত্র বিদ্যালয় স্থাপন করলে অনুমোদন দেয়া হবে না বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ই স্থাপিত হয়েছে ‘যত্রতত্র’। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী তরুণরা এসব বিদ্যালয় নিজ উদ্যোগে স্থাপন করেছে। আজকে যতোগুলো বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় এসেছে, তার অধিকাংশই ‘যত্রতত্রভাবে’ গড়ে তোলা। এভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও কিছু আছে। দেশের কোন জায়গায় কীভাবে কয়টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, সরকারের, বিশেষত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেরকম গাইডলাইন আছে। সরকারের আর্থিক সক্ষমতার অভাবের কারণে অনেক জায়গায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সেসব জায়গায় বিদ্যানুরাগী তরুণরা যদি বিদ্যালয় গড়ে তুলে, তাহলে ক্ষতি কী?
এরপর অবশ্য সরকারের নীতিমালার প্রতি আস্থাবশতঃ তিনি বলছেন –
তবে দেখতে হবে, সেসব বিদ্যালয় যেন গাইডলাইন মেনেই তৈরি করা হয়। যদি গাইডলাইন মেনে বিদ্যালয় তৈরি করা না হয়, তাহলে সেটি চালুর অনুমতি না দিলেই তো হয়! কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ তো আর বিদ্যালয়ের কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারবে না!
রাজাকে বারংবার আশ্বস্ত করা জরুরি যে তার আজ্ঞাই সবশেষে শিরোধার্য।
কোনো উচ্চাভিলাষী সরকারই অস্বীকার করতে পারবে না যে শিক্ষার এই প্রকারের সর্বগ্রাহী জাতীয়করণে তার অঢেল রাজনৈতিক লাভ আছে। শিক্ষার উপর দখলদারি ক্ষমতাগোষ্ঠির একটা জরুরি অভ্যাস। সরকার পরিবর্তন হলেই পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস পুনর্লিখনের যে চর্চা দেখা যায় তা থেকে সেই অভ্যাসটা সম্পর্কে বারংবার আমরা নিশ্চিত হবার সুযোগ লাভ করি। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার আমাদের উপায় নেই যে সরকারের বর্তমান এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে একটা জনমত বিগত কয়েক বছর ধরে তৈরি হয়েই আসছিলো। এমন অসাধারণ রাজনৈতিক সাফল্যের কারণে সরকারকে আমরা সাধুবাদ জানাতে পারি। এখনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন [৭] থেকেও সরকার যদি আগামীতে অন্যকোনো আজ্ঞা বা দখলদারির ফসল তুলে নিতে পারে তখনও কারো কিছু বলার থাকবে না। সেটাও হবে সরকার চাতুর্য্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচয়। পেপার স্প্রে প্রয়োগের রাজনৈতিক ক্ষতি [৮] তখন সুদে আসলে উসুল হয়ে আসবে।
বিডিনিউজ২৪-এর তৌফিক খালিদীও অনেকদিন ধরে দায়িত্বশীল ব্লগ ও সাংবাদিকতার কথা বলে বলে [৯] উচ্চমূল্যের লাইসেন্সসম্বলিত নিয়ন্ত্রিত ও ‘দায়িত্বশীল’ গণমাধ্যম তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন সরকারকে [১০, ১১]। এখন কেউ যদি বলে সরকার মানুষের অমতে তার উপর নীতিমালা চাপিয়ে দিচ্ছে, তাহলে কি হবে? খালিদী সাহেব তো অন্তত এক বছর আগে এ নিয়ে উচ্চস্বর হয়ে একটা ছোটখাটো জনমত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সরকার যে খালিদী সাহেবের তৈরি করা এই সুন্দর ক্ষেত্র থেকে ফসল তুলবে সেটা এক বছর আগে তখনই আমি জানান দিয়েছিলাম [১২]। সরকার যা করার কথা তাই তো করেছে।
নতুন যেকোনো আন্দোলন ও দাবিদাওয়ার কথা শুনতে পেলেই তাই আমি মনে মনে ভাবি, প্রজ্ঞাময় সরকারের আরেকটি সুনিপুণ কৌশল দেখার সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে। মানুষ শত্রুরও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে। আর সরকার তো অন্নদাতা। তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে থাকি কী করে?
বুদ্ধিমত্তা যেমন প্রশংসনীয়, বোকামি তেমন নিন্দনীয়। মানুষ যখন বিভিন্ন সমস্যার জন্যে সরকারের কাছে হাজির হয় সমাধানের আশায়, তখন আমি অগাধ বোকামির নমুনা দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই যে ইঁদুর বানরের কাছে গেছে তার পিঠা ভাগ করিয়ে নিতে। একজন বোকামি করলে বুদ্ধিমানের তখন দায়িত্ব হয়ে পড়ে বুদ্ধির পরিচয় দেবার। এজন্যে সরকারের বারংবারই সাধুবাদ প্রাপ্য।
এবারের ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালেও একুশে বইমেলা নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হই হই করছে। এবারের সমস্যাটা অবশ্য সরকার তৈরি করে নি নিশ্চিত। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে ভারতের আনন্দ প্রকাশনী বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় ঢুকবার অভিপ্রায় প্রকাশ করায়। হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণে একুশে বইমেলায় জনপ্রিয় লেখকের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণের সুযোগকে আনন্দ প্রকাশনী কাজে লাগাতে চায়।
ভারতে ছাপানো বই যে বইমেলায় বিক্রয় করা যায় না তা আমরা সবাই জানি। আনন্দ প্রকাশনী তাই দেশীয় প্রকাশনী সংস্থার সাথে চুক্তি করে তাদের দেশের লেখকের বই বাংলাদেশে প্রকাশ করে একুশে বইমেলাতে বিক্রয়ে আগ্রহী। কিন্তু একটা সমস্যা রয়ে গেছে এতে। বই মেলা সম্পর্কিত ১৯৮৪ সালে তৈরি নীতিমালা ও নিয়মাবলীর ৬.১ ধারায় বলা হয়েছে –
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকরা কেবল বাংলাদেশে মুদ্রিত ও প্রকাশিত বাংলাদেশের লেখকদের মৌলিক/ অনূদিত/ সম্পাদিত/ সংকলিত বই বিক্রি করতে পারবেন।
অর্থাৎ বাংলাদেশে ছাপানো বাংলা বই হলেই কেবল চলবে না, বাংলাদেশের লেখকও হতে হবে। এ নিয়ে মাহবুব মোর্শেদের একটা লেখায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সাতচল্লিশপূর্ব লেখকদের বই একুশে বইমেলায় বিক্রয়ের কথা আলোচিত হয়েছে [১৩]। সমরেশ মজুমদার আনন্দ প্রকাশনীর হয়ে ঢাকায় তদবির করতে এসে “বইমেলায় রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হচ্ছে” জাতীয় কথা প্রচার করেছেন এমনটা মাহবুব মোর্শেদের লেখায় উঠে এসেছে। তিনি তা করে থাকলে বেশ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন বাংলা ভাষার রাজনীতিতে বৃহৎ এক মানদণ্ড। যে নীতি মানদণ্ডকে নিষিদ্ধ করে, সেই নীতি ধোপে টিকবে না এমন উপলব্ধি করেই তিনি এই চাল চেলেছেন। তার কথা অবশ্য আমলে নিয়েছে কেবল বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি [১৪]। বাংলা একাডেমী অথর্ব একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে, বুদ্ধিহীন যে নয়, তার পরিচয় দিয়েছে অবিলম্বে বাংলাদেশ প্রতিদিনের লেখার প্রতিবাদ ছাপিয়ে [১৫]। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে মানদণ্ড খোয়ানোর কোনো অভিলাষ যে তাদের নেই সেটা জানিয়ে দিয়েছে তারা। ফলে আনন্দ প্রকাশনীর এই চালটাকে আপাতত প্রতিহত করা গেছে। কিন্তু এর মোট ফলটাকে ঠেকানোটা দূরূহই হবে।
আনন্দ প্রকাশনী যে প্রশ্নটা আমাদের সামনে ছুঁড়ে দিয়েছে, সেটার মুখোমুখি আমাদেরকে এখন হতেই হবে। বইমেলায় বাংলাদেশের লেখক নন এমনদের বই ছাপানো হবে কি হবে না এই প্রশ্নের উত্তর এখন আমাদের খুঁজতে হবে। এখানেই চলে আসে সরকারের সমাধান প্রদানের তথা বুদ্ধিমত্তার খেল প্রদর্শনের আরেকটি সুযোগ।
কেউ বলতে পারেন যে একুশে বইমেলা উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। সকল মতের বৈচিত্র্যই কাম্য। কিন্তু ব্যাপারটা এতোটা সহজ নয়। উন্মুক্ত ব্যবস্থা মাত্র একটা আয়োজন দ্বারা নিশ্চিত করা যায় না। মুক্ত ব্যবস্থায় মতের বৈচিত্র্যের উপস্থিতি কিন্তু কোনো একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠানের কারণে সৃষ্টি হয় না। বরং সৃষ্টি হয় অজস্র ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের সমারোহে। যেমন ইন্টারনেট। সরকার হাত দেবার আগ পর্যন্ত ইন্টারনেটকে বেশ উৎকৃষ্ট রকম মুক্ত ব্যবস্থা বলা যায়। এখানে বিজ্ঞানের কথা আছে, ধর্মের কথা আছে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কথা আছে, কোয়ান্টাম হাতুড়ে বিদ্যার কথাও আছে, মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের কথা আছে, রাজাকারপন্থীদের কথাও আছে, আছে বর্ণবিদ্বেষীদের মতের প্রকাশ, নারীবিদ্বেষীদের মতের উপস্থিতি, আছে নোয়াখালির মানুষের সুখদুঃখের কথা, আছে বলিয়াদি জমিদার পরিবারের ভাষ্য। সব মতের এই সমারোহের মাঝখান দিয়েই আমরা আমাদের পছন্দের প্রয়োজনের তথ্য ও মতটা নিয়ে এগিয়ে চলার অফুরন্ত সুযোগ পাচ্ছি। এ নিয়ে আমাদের তেমন অভিযোগও কিন্তু নেই। যা প্রমাণসম্বলিত ও কাজের, তা নিজবলেই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ও পাবে, ইন্টারনেটের এই ডাইনামিক উন্মুক্ত চরিত্রটার ব্যাপারে কিন্তু আমরা যথেষ্টই আস্থাশীল।
ইন্টারনেটের এই বৈচিত্র্য কিন্তু কোনো একক ওয়েবসাইট প্রদত্ত নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ব্লগ, সংবাদপত্রের মন্তব্য বেশ ভালোভাবেই মডারেট করা হয়। প্রত্যেক ওয়েবসাইটের নিজস্ব ঢঙ/মত/রাজনীতি আছে, সে সেটা বজায় রাখে। ভিন্ন ঢঙ/মত/রাজনীতি যার, তার নিজের ব্লগ খোলায় কোনো বাধা নেই, এটাই ইন্টারনেটে বহু মতের সমারোহ তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। এর জন্যে সকল ওয়েবসাইটে সকল কথা বলার অধিকারের কিন্তু প্রয়োজন নেই। সেটা হাস্যকরও।
বাক স্বাধীনতার অর্থ সর্বত্র যা খুশি বলার অধিকার নয়, বরং নিজের অর্জিত মাধ্যমে (যেমন নিজের বাড়িতে, ছাপানো বইতে, ওয়েবসাইটে) যা খুশি বলার অধিকার হলো বাক স্বাধীনতা। এর সাথে কেবল সরকারের দ্বন্দ্ব, আর কারো নয়। এ কারণেই সরকার হাত দিলে আমরা বাকস্বাধীনতা হরণের অভিযোগ করি, মুক্তমনা ওয়েবসাইটে কোনো মন্তব্য বা লেখা মডারেট করা হলে সেই অভিযোগ আমরা করি না। মুক্তমনায় সবমতের প্রচার হতে না পারাটা একটা আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু সরকারি আদেশে কোনো বিশেষ মতের প্রচার হতে না পারাটা নিতান্তই একটি অভিশাপ। মুক্তমনায় যে কথা বলা যায় না, সে কথা বক্তা তার খুশি মতো কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই বলতে পারবে। কিন্তু সরকার নিষেধ করে দিলে সেই কথা কোথাও বলার আর সুযোগ থাকে না।
বইমেলার ক্ষেত্রে মাত্র একটা আয়োজনের কাছে উন্মুক্ত ব্যবস্থার আবদারটা অনেকটা মুক্তমনায় সকল মতের মন্তব্য করতে দেয়ার মতোই দাঁড়িয়ে যায়। উন্মুক্ত ব্যবস্থা চাইলে সেটা এমন হতে পারে যে সারা বছরের যেকোনো সময়ে যেকেউ তার নিজের বইমেলার আয়োজন করতে পারে। কেউ করলো বিদেশি ভাষার বইয়ের মেলা। কেউ চাইলে করলো ভারতীয় লেখকদের বইয়ের মেলা। কেউ করলো ইসলামি বইমেলা। তাদের মধ্যে নানান ভাগ হয়ে গিয়ে মওদুদী বইমেলা আর সুফিপন্থী বইমেলার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু অন্যের বইমেলায় গিয়ে আমি নিজের খুশি মতো বই বিক্রয়ের আবদার করবো, সেটা সাজে না। মওদুদীরা মুক্তিযুদ্ধপন্থী বা সুফিপন্থীদের বইমেলায় গিয়ে যদি বলে মওদুদী সাহেবের বইও বিক্রয় করতে দিতে হবে, তেমন আবদার কী করে রাখা যায়? অধিকারীর অমতের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ ছাড়া সেটা কার্যকর করার তো আর উপায় থাকে না।
সরকারি উদ্যোগ আর বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ফারাক আছে। বেসরকারি উদ্যোগ জনমতের রাজনীতির বাইরে থাকতে পারে। আপনি একটা হলরুম ভাড়া করে জুলাই মাসের প্রথম এক সপ্তাহ কেবল আপনার পছন্দের পণ্য বিক্রয় করবেন ঠিক করলেন, সেখানে অন্য কোনো পক্ষের পছন্দের পণ্য বিক্রয় করতে আপনি বাধ্য নন। সেই পছন্দ যতোই গণপছন্দ হোক। গণপছন্দকে তোয়াক্কা করবেন কি করবেন না সেটা শেষ বিচারে আপনার – অর্থাৎ ব্যক্তিগত উদ্যোক্তার – বিবেচনার বিষয়।
সরকারি উদ্যোগের সুযোগ নেই বেসরকারি উদ্যোগের মতো জনমতের রাজনীতির বাইরে থাকার। সরকারি উদ্যোগ হলো সরকারি মাল। সে জনগণের সম্পত্তি। ফলে তাকে জনগণের মতামতের সাতপাঁচ দেখতে হয়। সেখানে চলে আসে সরকারের চাতুর্য্য প্রদর্শনের সুযোগ।
বইমেলার স্বরূপ কেমন হবে সেটা সরকারকে সাতপাঁচ বিচার করে নির্ধারণ করতে হবে। এখানে বিদেশি ভাষার বই বা বিদেশে ছাপানো বাংলা বই বা বিদেশি লেখকের দেশে ছাপানো বই বিক্রয় করা যাবে কি যাবে না সেটা বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আবার জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা মাথায় রেখে, আবার যুক্তিসঙ্গত ন্যায়বিচার ও নৈর্ব্যক্তিক মঙ্গলের কথাও মাথায় রেখে। ব্যাপারটা শুনতে খুব নৈয়ায়িক মনে হলেও এটা প্রকৃতপক্ষে একটা অসম্ভব ব্যাপার। এতোকিছুকে একসাথে সামাঞ্জস্য করে সিদ্ধান্ত নেয়া যে অসম্ভব সেটা সরকারের পাণে চেয়ে থাকা মানুষেরা না বুঝলেও বুদ্ধিমান সরকারের পেছনের কলাকুশলীরা ঠিকই বোঝেন। কিন্তু সরকারকে ঠিক একটা সিদ্ধান্তই নিতে হয়। ফলে সিদ্ধান্তটা সাধারণত সেটাই হয় যেটাতে অন্তত সিদ্ধান্তকারীদের রাজনৈতিক লাভটা অটুট থাকে, বা আরো ভালো যদি সেটা বাড়ন্ত হয়।
বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা এখন আনন্দ প্রকাশনীর রাজনীতি ঠেকাতে সরকারের দ্বারস্থ হচ্ছে। ফলে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি বুদ্ধিমান সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তটা কী হয় সেটা দেখার জন্যে। এই ব্যাপারটা ঘিরে অতি অবশ্যই একাধিক মতের রাজনীতি তৈরি হবে। একপক্ষ সকল ভারতীয় লেখকের দেশে ছাপানো বই একুশে বইমেলায় বিক্রয়ের পক্ষে যাবে। আরেকপক্ষ যেকোনো প্রকারে জনপ্রিয় কিংবা প্রতিশ্রুতিশীল ভারতীয় লেখকের বইকে একুশে বইমেলায় বিক্রয় করা থেকে ঠেকিয়ে দিতে একাট্টা হবে। মাঝখানে থাকবে নানা ভ্যারিয়েশন। এতো সব মতের ভিড়ে সরকার বা তার সহচর বাংলা একাডেমীর দায়িত্ব পড়বে যেকোনো একটা মত বেছে নেওয়ার। কোনটা বেছে নিবে সে? কমনসেন্স কী বলে? যেটার পক্ষে জনমত সবচেয়ে বেশি (ভোট তো হবে না, জানবে কী করে, আর জানা গেলেও সংখ্যালঘু মতধারীদের উপর এতে যে অন্যায় হচ্ছে তার কী হবে)? যেটা জাতির বৃহত্তর মঙ্গল করে সেটা (সেটা কে নির্ধারণ করবে, আনিসুজ্জামান প্রমুখ)? নাকি যে নিয়ম আরোপে নীতিপ্রণেতা ও তার বন্ধুদের স্বার্থবৃদ্ধি ঘটে সেটা?
মাহবুব মোর্শেদ নিজে দুই চরম মতের কিছুটা মাঝখানে আছেন। তিনি বলছেন,
বাংলা একাডেমির উচিত হবে ‘কেবল বাংলাদেশে মুদ্রিত ও প্রকাশিত’ রেখে ’বাংলাদেশের লেখকদের’ কথাটা তুলে দেওয়া। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন, কেউ আনন্দ প্রকাশনীর এজেন্ট হিসেবে কাজ না করে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রকাশকরা যদি আনকোরা প্রকাশ করতে পারেন। তবে, প্রকাশকরা কোন বই করবেন তা তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভাল।
একটা ব্যালেন্সের আশা নিয়ে তিনি যে ধরনের পরামর্শ দিলেন, এ ধরনের পরামর্শ বাস্তবায়নের ফলস্রুতিটা সুখকর নয়। যেমন, উনি বললেন – “খেয়াল রাখতে হবে।” বই তো একুশে বইমেলায় ছাড়াও বিক্রয় হয়। কেবল একুশে বইমেলার কারণে হরে দরে দেশের কোনো প্রকাশককেই আনন্দ প্রকাশনীর এজেন্ট হতে না দেয়ার পেছনে কী যুক্তি? আর খেয়াল যদি রাখতেই হয়, সেই খেয়ালটা রাখবে কে? নজরদারি বা খবরদারির আবদার জানালে সরকার যে একলাফে সেটা লুফে নিবে সন্দেহ নেই। আর খবরদারি শুরু হলে সেটা ব্যবহার হয় খবরদারি যে করে তার লাভের খাতিরেই। শেষে আনন্দ প্রকাশনীর বইও বিক্রয় হবে, কিছু প্রকাশক তাদের এজেন্টেও পরিণত হবে, মাঝখানে বাড়তি প্রাপ্তি হবে কেবল সরকারের খবরদারিটাই। যেমন, বাংলা একাডেমী হয়তো নীতিমালা সংশোধন করে ঘোষণা দিলো যে বাইরের লেখকদের দেশে প্রকাশিত বই একুশে বইমেলায় বিক্রয় করা যাবে, কিন্তু সেটা হতে হবে আনকোরা প্রকাশ, পুনঃপ্রকাশ নয়। সেটা তদারকির জন্যে একটা কমিটি গঠন করা হলো, যার প্রতিনিধিরা দেশের প্রতিটি প্রকাশনার উপর নজরদারি করবে। সকল কমিটির মতো এখানেও নজরদারির ক্ষমতা, তার অপব্যবহার আর দুর্নীতির বিস্তারটাই ঘটবে, উদ্দেশ্যের সাধন হবে না। এভাবেই আমাদের নির্দোষ পিঠাভাগ সমস্যাগুলো সরকারকে তার নানা বুদ্ধিদীপ্ত কলাকৌশল প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়।
নীতিমালা ও বিধি আরোপ সরকারের পছন্দের কর্মকাণ্ড। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার জনমতের বিরুদ্ধে কাজ করে না। ফলে সরকার যেকোনো সামাজিক আন্দোলনের সুযোগকে লুফে নেয়। কিংবা প্রয়োজনে তার বন্ধুদের দিয়ে জনমত তৈরি করিয়ে নিয়ে তারপর এগোয়। কেউ সমস্যায় আছে মানে সরকারের সেখানে বাহাদুরির সুযোগ আছে। এটাই সরকারের জনমতের রাজনীতির সারাংশ। আসুন আমাদের আগামী যেকোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধানের জন্যে আমরা সোৎসাহে সরকার মহানের দ্বারস্থ হই।
:line:
[১] সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, “ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী“, প্রথম আলো, ১৬-০২-২০১২
[২] “‘রেডিও-টিভিতে বাংলা ভাষার বিকৃতি নয়’“, বিডিনিউজ২৪, ১৬-০২-২০১২
“ওই আদেশে আদালত বলে, আমরা আদেশ জারি করছি যে, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে হবে। … এই ভাষার ওপর আজ বলাৎকার চলছে। আমাদের জাতি সত্ত্বার অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্যই অনতিবিলম্বে এটা রোধ করতে হবে। ”
“বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ, সঠিক শব্দ চয়ন না করা এবং বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে বাংলা একাডেমীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি করারও আদেশ দিয়েছে আদালত।”
[৩] “বাংলার বিকৃত উচ্চারণের জন্য গণমাধ্যমের একাংশ দায়ী“, ডিডাব্লিউ, ০৯-০১-২০১২
“বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছেন যারা গণমাধ্যমে বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলছেন তারা বাংলা ভাষার শত্রু।”
[৪] “২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি হলো“, প্রথম আলো, ১০-০১-২০১৩
“প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন সরকারীকরণের আশায় নতুন করে যত্রতত্র বিদ্যালয় করলে অনুমোদন দেওয়া হবে না। প্রয়োজন হলে সরকারিভাবেই বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। তবে যে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো এখন আছে, সেগুলো থাকবে।”
[৫] “চাকরি সরকারীকরণের দাবিতে শিক্ষকদের অবস্থান ধর্মঘট“, প্রথম আলো, ২৩-১২-২০১১
[৬] গৌতম রায়, “জাতীয়করণ হলো, এরপর কী?“, বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইট, ১৩-০১-২০১৩
[৭] “মাধ্যমিকের সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে চান“, ইত্তেফাক, ১১-০১-২০১৩
[৮] “পেপার স্প্রেতে মৃত্যু হয় না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী“, বিডিনিউজ২৪, ১৬-০১-২০১৩
[৯] “দায়িত্বহীন মুক্তমত নয়“, বিডিনিউজ২৪, ২০১১
তৌফিক খালিদী বলেন, “মত প্রকাশের নামে যা ইচ্ছা তাই প্রকাশের আমি বিরোধিতা করি। এটা এক ধরনের অপরাধ, আর এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সরকারকে অবশ্যই নতুন আইন করতে হবে।”
“তার মতে, কোনো ব্যক্তির নামে কল্পকাহিনী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো কথা ব্লগ কিংবা ফেইসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ অনুচিত।”
তৌফিক খালিদীর বিডিনিউজ২৪ ওয়েবসাইট পরিবর্তনের পর সংবাদটি গায়েব হয়ে গেছে। এটা কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় নাকি দায়িত্বহীনতার পরিচয় নিশ্চিত নই।
[১০] “অনলাইন গণমাধ্যম লাইসেন্স ফি পাঁচ লাখ টাকা“, জনকণ্ঠ, ১৩-০৯-২০১২
“অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা-২০১২-এর প্রাথমিক খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়া অনুযায়ী অনলাইন গণমাধ্যমের লাইসেন্স নেয়ার জন্য এককালীন পাঁচ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এছাড়াও দুই লাখ টাকা ফেরতযোগ্য আর্নেস্ট মানি জমা দিতে হবে। প্রতিবছর ৫০ হাজার টাকা ফি দিয়ে এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। তবে সকলের মতামত নিয়ে আগামী অক্টোবরের মধ্যে এই প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। … এতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের স্যোশাল এ্যাফেয়ার্স এডিটর বেবী মওদুদ, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন, পিটিবি নিউজ ডট কমের প্রধান সম্পাদক আশীষ কুমার দে, প্রাইম খবর ডটকমের প্রধান সম্পাদক এসএম মেজবাহ উদ্দিনসহ বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ”
[১১] মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, কাজলী সেহরীন ইসলাম, সাইফুল হক, শাওন্তী হায়দার, এস এম শামীম রেজা, ফাহমিদুল হক, কাবেরী গায়েন, রোবায়েত ফেরদৌস, গীতি আরা নাসরীন, “অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা নয়“, প্রথম আলো, ১৯-০৯-২০১২
“নিয়ন্ত্রণের কঠোরতা ফুটে ওঠে এ নীতিমালার ৯(ঘ) ধারায়; যেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারের অন্য কোনো নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সরকার লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।’ তা ছাড়া ১৪(ঘ) ও (ঙ) ধারায় বর্ণিত হিংসাত্মক, সন্ত্রাসী ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। এ অস্পষ্টতার বলে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যেকোনো প্রচারিত বা প্রকাশিত বিষয়কে নিজের স্বার্থে সংজ্ঞায়িত করে সেন্সর আরোপ করতে পারবে।”
[১২] ধ্রুব বর্ণন, “মানুষের মুক্তিকামিতার (আধুনিক বিরোধিতার) একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস“, সচলায়তন, ২৬-১২-২০১১
[১৩] মাহবুব মোর্শেদ, “কস কী মমিন, বই মেলায় রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ!“, ফেইসবুক নোট, ১৯-০১-২০১৩
[১৪] “একুশে গ্রন্থমেলায় নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সুনীল সমরেশের বই“, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭-০১-২০১৩
[১৫] “প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমীর বক্তব্য“, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৮-০১-২০১৩
এবং যে-সব প্রতিষ্ঠানের ‘পর ভর করে, সরকার, তাকে ছারেখারে পাঠাতে, কী ধরণের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, নির্মাণ আবশ্যক, আসুন জনগণের দ্বারস্থ হই।
হা হা হা।
পণ্য উৎপাদিত হয়েই তার মালিককে খুঁজে বেড়ায়। মালিক কাকে খুঁজে? ক্রেতাকে? ক্রেতা কাকে খুঁজে? সরকারকে? সরকার কাকে খুঁজে? রাষ্ট্রকে?
রাষ্ট্র খুঁজে বেড়ায় দ্রোহীদের?
ধন্যবাদ।
বিদ্যালয় জাতীয়করনের পেছনে আপনি যেমন ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র বা মতলব যাই বলি পেলেন সেটা খুব একটা যৌক্তিক মন হল না এই কারনে যে, ইতিহাস বিকৃত করতে বিদ্যালয় জাতীয়করনের প্রয়োজন নাই। ইতিহাস বিকৃতির সাথে স্কুল জাতীয়করনের কোন সংযোগ নাই এই কারনে যে জাতীয় পাঠপুস্তক বোর্ড কতৃক প্রণীত পুস্তক কিন্তু প্রত্যেকটা স্কুলেই অবশ্য পাঠ্য সরকারী, অসরকারী ব্যাতিরেকে।
বইমেলায় বিদেশি বই প্রকাশের ব্যাপারে আপনার মতামত খুব একটা পরিষ্কার বুঝতে পারি নাই। তবে আমি এই নিয়মের পক্ষে না থাকার কোন কারন দেখি না। নিয়মটা যেহেতু শুধুমাত্র বইমেলার জন্য প্রোযোজ্য সুতরাং কোন ঝামেলা দেখছি না আসলে। কারন এটা বাঙলাদেশের বই মেলা।
বহুত ভদ্রভাষায় কতা কইছি, এখন কন থাকেন কই? এত কম লিখেন কেন? :))
@সাইফুল ইসলাম,
ইতিহাস বিকৃত করতে জাতীয়করণ দরকার সেটা কিন্তু বলি নাই, বলেছি যে শিক্ষার উপর হেজামনি বজায়ে রাখায় সরকারের রাজনৈতিক লাভ যে আছে এর আলামত ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রতিযোগিতায় দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্যপাঠ্য জাতীয় পাঠপুস্তক বোর্ড কতৃক প্রণীত পুস্তক সেই হেজামনিরই উপকরণ। আর সর্বগ্রাহী জাতীয়করণ সরকারি হেজামনির চূড়ান্তরূপ। ধরি বিদ্যালয়ের জাতীয়করণে মধু আছে। তাহলে সেটা কি এমনি মধু যে হিটলার করলেও আছে, বা তালেবান করলেও আছে? হিটলার আর তালেবানের কথা তুললাম এটা বোঝাতে যে এটা এমন কোনো কাজ না যেটা করলেই ভালো হয়, এখানে কর্তা ও তার মতলব গুরুত্বপূর্ণ। এটা যদি সাধু কাজও হয়, তথাপি করাটাই সাধুতা নয়। কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য বুঝতে হবে। খেয়াল করুন, দাবি ছিলো বর্তমান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ। চান্সে আগামি সকল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পথ রুদ্ধ করা হলো, যেটা দাবির অংশ ছিলো না। এই পদক্ষেপগুলো ক্রিটিকালি দেখা দরকার।
একুশে বইমেলা নিয়ে পরিষ্কার অবস্থান দেই নি। বরং সরকারি সিদ্ধান্তের সমস্যা আর ন্যায়ের অসম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করেছি। আর বইমেলা কিন্তু একটা না, একাধিক হতে পারে, হয়ও, কিন্তু আনন্দ প্রকাশনীর আগ্রহ একুশে বইমেলা নিয়ে। এটা কোনো ব্যক্তি উদ্যোগে করা ব্যবসায়ী আয়োজন তো না। ধরুন আমি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজের একটা বইমেলা দিলাম যেখানে খালি দক্ষিণ আমেরিকার অনুবাদ বিক্রয় করবো। আনন্দ প্রকাশনী এসে যদি বলে সমরেশের উপন্যাসও বিক্রয় করতে দিতে হবে, এখন সেটা আমার বিনা অনুমতিতে কি করা যাবে, যেহেতু বইমেলাটার উদ্যোক্তা আমি? ব্যক্তি উদ্যোগে করা আয়োজনে এসব আবদার ব্যবসায়িক চুক্তিতে পরিণত হতে পারে। সেটাকে বলা যায় স্বেচ্ছা বিনিময়। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে করা আয়োজনে জনমতের রাজনীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যবসায়ী চুক্তিতে যাওয়াটা স্রেফ ক্রনি ক্যাপিটালিজমের জন্ম দিবে, ওর্স্ট অব দ্য টু ওয়ার্ল্ড। এর চেয়ে বেটার বলা যায় জনমতের রাজনীতি করা। কিন্তু সেটাতেও সামাজিক ন্যায়ের যে অসাম্ভব্যতাটা – সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করলাম। আমার মতে সামাজিক ন্যায় বিচার, জনমতের রাজনীতি এইসব শেষে গিয়ে পিঠাভাগের মতো দাঁড়ায়। বিশ্লেষণ এখানেই শেষ। কোনো পরিষ্কার পথ করে দেই নাই। পরিষ্কার পথ জানা আছে সেরকম সরকারি আস্থাও দেবার চেষ্টা নাই। 🙂
লেখি তো! আপনে লেখেন না কেন? 🙂