গতকাল রাতে উত্তরায় মুক্তমনা ব্লগার এবং অনলাইন এক্টিভিস্ট আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কমপক্ষে ৭ টা গভীর স্টেপ, যার ২ টা ঘাড়ে। বুকে আঘাত করেছে, গলায়ও একটা কোপ দেয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনক্রমে তেমন গভীরভাবে লাগেনি। কোন কিছু নেয়ার চেষ্টা করেনি, মোবাইলও না। ছিনতাই উদ্দেশ্য ছিল না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছুরিকাঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যাওয়া, ছুরিকাঘাতের ধরণ- সব কিছু মিলে বুঝা যায়- এটা প্রফেশনালদের কাজ। এবং এদেরকে আনাই হয়েছিল আসিফকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে।

আসিফ মহিউদ্দিন ছুরিকাহত অবস্থায়, নিজেই প্রথমে উত্তরার ১১ নং সেক্টরের মনসুর আলী হাসপাতালে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা ওখানেই দেয়া হয়। খবর পেয়ে আসিফ মহিউদ্দিনের আত্মীয়রা এবং বাকি বিল্লাহ, সেলিম আনয়ারসহ আরও ব্লগার, আনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা পৌঁছে যায়। পরে রাতেই তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। গভীর রাতে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয় এবং আজ ভোর পর্যন্ত, ৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অস্ত্রোপচার করা হয়। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে এখন আসিফ মহিউদ্দিন আশংকামুক্ত।

কারা মেরেছে? কেন মেরেছে? কোন কিছুই জানা যায়নি। আসিফ মহিউদ্দিন কাউকে চিনতে পারেনি। প্রফেশনাল খুনি ভাড়া করা হয়ে থাকলে – আসল হোতাদের আসিফের চেনার কথাও না। মোটা দাগে দাবী তুলি, সবাই তুলছেও- ঘৃণ্য এই হত্যা প্রচেষ্টার দ্রুত বিহিত হোক, হামলাকারীদের দ্রুত সানাক্তকরণ, গ্রেফতার ও বিচার হোক।

আসিফ মহিউদ্দিনের উপর কার/ কাদের এত রাগ? কেন এই রাগ? ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল কারো সাথে? স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন বিরোধ? নাকি ব্লগে, ফেসবুকে আসিফের সরব উপস্থিতি ওদেরকে এমন খেপিয়েছে? জানা দরকার। এমন কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরোধের কথা আসিফের জানা নেই, আসিফের বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন পরিচিতজনেরা জানে না। কিন্তু আসিফ মহিউদ্দিনকে নিয়ে তার কাছের লোকেরা ভয়ে থেকেছে বরাবরই। ফেসবুকে, ব্লগে আসিফের সমর্থক / ভক্তদের চেয়ে আসিফ বিরোধী গ্রুপ কম শক্তিশালী নয়। অসংখ্যবার প্রকাশ্য হুমকি ধামকি খেতে দেখেছি আমরা। ধর্মান্ধদের চক্ষুশূল সে। জামাতি- আওয়ামি পেইড গ্রুপেরও সমান গাত্রদাহের কারণ আসিফ মহিউদ্দিন। তাদের কারো টার্গেট এই আসিফ? জানি না, কিন্তু জানা দরকার। আসিফের পরিবারের লোকেরা কিন্তু ভয়ে থেকেছে। এর আগেও ২০১১ সালের অক্টোবরে আসিফ মহিউদ্দীনের বাসায় ডিবি পুলিশ খুঁজতে যায় ও থানায় রিপোর্ট করতে বলে, পরে থানায় রিপোর্ট করতে গেলে তাকে আটক করে রাখে, ফেসবুক/ব্লগে সরকারবিরোধী ও ধর্মবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত না থাকার ব্যাপারে অঙ্গীকার করতে বলা হয়, এতে রাজী না হলে তাকে দীর্ঘ সময় আটক করে রাখা হয়। কোন যোগসূত্র আছে কি? জানি না। কিন্তু, এটা তো অস্বীকার করার জো নেই যে- এই আসিফকে আটক রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়, এই আসিফকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করা হয়। সরকারের উদ্দেশ্যে বলছি- হামলাকারীদের অবিলম্বে সনাক্ত, গ্রেফতার ও বিচার করতে না পারলে- এর দায় তার ঘাড়েই বর্তাবে বৈকি। অবশ্য সরকাররে নতুন করে আর কি দায় দেয়ার আছে- মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্সি নেয়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রেতা ও ভন্ড এই সরকার – জান মালের নিরাপত্তা দিতে অপারগ তো বটেই- সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মীয় ফ্যানাটিকদের আরও উসকে দিতেও সিদ্ধহস্ত। (রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র কিংবা এই সংবিধানের কোন বিধান সম্পর্কে নাগরিকের মনে অনাস্থা সৃষ্টি করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবেঃ সংবিধানের ৭-ক অনুচ্ছেদ)।

আমরা যারা সহব্লগার, আমাদের কি করণীয়? ভয় পেয়ে যাব? আজই একজন চায়ের দোকানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা ওঠায় আমাদের থামিয়ে একটু আড়ালে যেতে বলল- আসিফ মহিউদ্দিনের মত দশা যাতে আমাদের না হয়- তার জন্য কিছুটা বাড়তি সতর্কতা নিতে চাইল। আমি নিশ্চিত আন্দাজ করতে পারি- আমাদের কেউ কেউ তার পরিবার থেকে, বন্ধু বান্ধব, পরিচিত জন থেকে, প্রেমিক/প্রেমিকা থেকে সাবধানবানী উপহার এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। আমি বলছি না যে, এই কাজ ধর্মান্ধরাই করেছে- ধর্মান্ধদের অন্যতম সম্ভাবনা হিসাবে রাখি যদিও, আমি জানি না- কারা কোন উদ্দেশ্যে এ জঘন্য কাজটি করেছে- আমি জানতে চাই; কিন্তু এটা জানি যে- এই কাজে কেউ কেউ খুশি হয়েছে, যারা হুমায়ূন আজাদের উপর একি রকম আক্রমণে উল্লাস করেছিল, যারা তসলিমার মাথার দাম ঘোষণা করে তাকে দেশ ছাড়া করেছে, যারা আমাদেরকে বিভিন্ন সময়ে যুক্তিতে না পেরে উঠে এইরকম পরিণতি বরণ করার হুমকি-ধামকি দেয়। তাদের অট্টহাসিতে কি আমরা কি ভয় পেয়ে যাব তাহলে? কুঁকড়ে যাব, ইদুরের গর্তে লুকিয়ে যাব? নিশ্চয়ই না। ভয় পেলে আরও আগেই আমরা পেতাম। হুমায়ুন আজাদের উপর নির্মম হামলার পরেও তো আমরা সংখ্যায় কমিনি, মুক্তমনা ব্লগ সহ বাঙলা বিভিন্ন ব্লগে আজ আমাদের সচল পদচারনা, ফেসবুকে ও এর নানা গ্রুপে আমাদের কার্যকলাপ প্রমাণ করে- আমরা ভয় পাইনি। ফলে, নতুন করে গর্তে ঢুকার প্রশ্নই আসে না। বরং, এখন দরকার- সামনে বের হবার, আমাদের কণ্ঠস্বর জানান দেবার।

ব্লগে, ফেসবুকে- অনলাইনেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকার আর কোন অপশন খোলা নেই বলে মনে করি। চলুন বেরিয়ে পড়ি। আসিফের পাশে ফিজিকালি দাঁড়াই- তাকে জানান দেই যে, সে একা নয়; প্রতিবাদে- প্রতিরোধে রাজপথে সমবেত হয়ে আওয়াজ তুলি- অবিলম্বে হামলাকারীদের সনাক্ত- গ্রেফতার-বিচার কর; আওয়াজ তুলি – আমাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার আয়োজন বন্ধ কর।