তাবৎ রাজ্যের ওলি-গলি ঘুরে সবশেষে শিয়ালদা এষ্টেশনে এসে বুক ভরে বড় একটা দম নিল বুড়ো মোজাম। সফর আর কাকে বলে! প্রথমে টাঙ্গা, পরে রিক্সা, খেয়া নৌকা, বাস, সব শেষে নীলগিরি লোকালের উদরে চেপে সোজা শিয়ালদা। বিরাট বড় সফর। যানের রাজা রেল গাড়ি, তার সাথে আর কোনটার তুলনাই চলে না। ঝিক-ঝিক-ঝা ঝিক-ঝিক-ঝা, গাড়ীর বিরামহীন গানে কি ঘুমটাইনা ঘুমিয়েছে বুড়ো। দেশের বাড়ি বসে গাঁজা টানা ঘুম এর কাছে কিছুই না। চার বছরের মাথায় দেশে ফেরার পথে এই এক ঘুম, আরেক ঘুম দিয়েছিল সে বৈদেশে কাজে আসার পথে, মনে আছে। স্টেশনে নেমে প্রথমে কোমরের বিড়াটা পরখ করলো বুড়ো- গাঁজার দলা, বিড়ির প্যাকেট সব আছে ঠিক মতো। এবার দ্রুত হাতে ঠাহর করার চেষ্টা করে জাইঙ্গার সামনের পকেটে রাখা কড়কড়ে অনেকগুলো নোট- চার বছরের ঘর্মাক্ত কামাই। তাও ঠিক আছে। যেখানকার মাল সেখানেই আছে। ওসব জায়গায় হাত দেয় না কেউ- লাজ লজ্জা চোরেরও থাকে, তাই তো রক্ষে। এই পরবাসী সফরে বুড়ো একা না, তার সাথে আছে তার যুবতী কন্যা। রোজগারী মেয়ে তার, একসাথে কাজ করেছে চারটি বছর একই ইটের ভাটায়। কন্যার বিয়ে ঠিক হয়েছ- দেশে ফিরেই বিয়ে। বিয়ের খোয়াবে কন্যার মাথা হয়ে আছে ‘আউলা’। তাইতো সারা রাস্তা সামাল দিতে হয়েছে বুড়োর, পাছে কোথায় কোন ফ্যাসাদ ঘটে যায়। সেই সফরের শুরু থেকে বুড়োর বকর বকর থেমে নেই- ‘আদা, শোন মা শোন, টাকাগুলো আমার কাছে দে, কোবায় কহন হারায়ে ফেলবি’। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মেয়ের ঐ একটাই কথা- ‘বাজান, তুমারে মায়ই বিশ্বেস করে না। তুমি নেশা কর’। মেয়ের কথায় মনে মনে ব্যাজার হয় বুড়ো। বিড়বিড়য়ে বলে- ‘আজ তোর সাত খুন মাফ। বিয়েটা হয়ে গেলে তোর জারিজুরি সব শ্যাষ হয়ে যাবি’। মেয়ের বোঝা তার বড় বোঝা- কাঁধের বোঝা হালকা হওয়ার স্বপ্নে অন্তরে কেমন এক মুক্তির সুখ অনুভব করে বুড়ো মোজাম।
লক্কড় ঝক্কড় বাসখানা একগাদা মানুষ নিয়ে স্টেশন-শহর-মিনার ছেড়ে, নগর-প্রাসাদ-কোলাহল ছেড়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। তার চলা শেষ হবে সেই সীমান্তের চেক-পোষ্টে। সেটা পেরোলেই ওপারে আরেক বাংলা। বাসের সব যাত্রীরই প্রায় একই দশা- সবাই তারা হাতে পায়ে খেটে খাওয়া সহজ মানুষ। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেছে- সবার চোখ ঢুলু ঢুলু। এই বাসে সহযাত্রি হয়েছে সবার সাথে বুড়ো মোজাম আর তার মেয়েও। তাদের চোখেও ঘুম নেই এক রত্তি। কারও মুখে তেমন কথাও নেই। যেন সবাই ভয়াবহ কোন দুর্যোগের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাস যত এগিয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো ততো বেশী কঠিন আর দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু কি সেই অনাগত দুর্যোগ যা কেউ ভাগাভাগী করছে না আকারে ইঙ্গিতে অথবা সতর্ক শব্দে। এ যেন পুলসেরাত পার হওয়া- যার পার হওয়া তার কাছে। এর ভিতরেও ক্ষুধা লাগে, লাগে পিপাসাও। ক্ষিদের খোচায় টিকতে না পেরে বুড়ো মোজামের হাত ততপর হয়, টোপলা ঘেটে বের করে আনে দুটো ‘বন-রুটি’ আর একজোড়া কলা- বাপ-বেটীর ভর-পেট রাতের গ্রাস। রুটিতে কামড় বসিয়ে ফিরে তাকায় সে মেয়ের দিকে, কিছু একটা বলতে চায় মেয়েকে। বাপের কথা মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলে কন্যা।
-বাজান, এক কথা বার বার কবা না। টাকা ঠিক আছে- কেউ নেয় নাই। বটুয়া তুমার হাতে দিচ্ছি না।
-ঠিক থাকলি ভাল- দেয়া লাগবে না। তোর ভালর জন্যিই কই আর কি।
বুড়ো কথা সংক্ষেপ করে- ফিসফিসায়ে কাজ সারে। কবরের সুনসান নীরবতার ভিতরে উচু গলায় কথা বলতে বড়ই বেমানান লাগে।
চিত্তের মোড়ে এসে থেমে গেল বাস। দশ মিনিটের সাময়ীক বিরতী এখানে। কিছু লোক মোড়ে নেমে গেল, কিছু থেকে গেল বাসে। এই মোড় থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে সোজা চেকপোস্টে, আরেকটা রাস্তা এঁকেবেকে হারিয়ে গেছে গেঁয়ো জনপদের ঠিকানায়। নেমে যাওয়া কিছু লোকের সাথে বুড়ো আর তার মেয়েও নেমে গেল। রাতের শেষ প্রহরের ক্ষীন আলোতে চেকপোস্টের নিবু নিবু বাতিটা দেখা যায়। একটু চেষ্টা করলে লোহার বিরাট ফটকটাও দৃষ্টিতে নিয়ে আসা যায়। কেউ না পারলেও বুড়ো মোজামের মেয়ে দেখতে পায় সব। চোখদুটো তার চকচক করে উঠে চির-অনাহারী জন্তুর মতো। একদলা বাতাস কোত্থেকে এসে তার নাকে লাগিয়ে দিয়ে যায় পরিচিত মাটির গন্ধ। সে গন্ধে চঞ্চল হয় বুড়োর মেয়ের অন্তর- ঘুরে তাকায় বাপের দিকে।
-ঐ যে দেখা যায় বাজান চ্যাকপোষ্ট। ঐ গেট দিয়ে আমরা কবে যাব? তুমি কি আলো দেখতি পাও?
-কোন দিন যাব না।
-ক্যান বাজান?
-অমনি দিয়ে গেলি ক্ষিদে পেটে মরতি হবি।
-ক্যান বাজান?
-চুপ! বাচাল মেইয়ে কোথাকার। খালি সওয়াল, খালি ক্যান ক্যান।
রোজগারী যুবতি মেয়েকে বকা দিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল বুড়ো মোজামের। সেই ভারী মন নিয়ে ব্যস্ত পায়ে বাপ-বেটী অদৃশ্য হয়ে গেল আঁকা-বাঁকা পথের ঠিকানায়, যে পথ চলে গেছে গ্রাম-জংলার প্রান্তিক জনপদে। রাত্রি এখনও যথেষ্ট কালো হয়ে আছে, যদিও পূবের আকাশে শুভ্রতার ইষত প্রলেপ লেগেছে। কুয়াশার একটা হালকা চাঁদর এই মাত্র নেমে এসেছে বহু দূরের আকাশ থেকে, চোখের দৃষ্টিকে করেছে একটু বাধাবিদ্ধ। যে করে হোক ভোর চারটার আগে কাঁটাতারের বেড়ার সেই নিদৃষ্ট জায়গাটাতে পৌছাতে হবে বাপ-বেটীকে ঠিক যেখান দিয়ে তারা এসেছিল এপারে। কঠিন শপথে দুই জোড়া পা মাটি কেটে কেটে এগুচ্ছে তাদের গন্তব্যে। ডান পাশে দুর্ভেদ্য কাঁটাতার হয়েছে তাদের সহযাত্রি। বাচাল কন্যার পেটে আবার নানান প্রশ্ন নাড়াচাড়া করতে শুরু করে। তারই একটা বেরিয়ে আসে শীতের রাতের এই শেষ প্রহরে তার বাপের সামনে।
-বাজান, ডান হাতের এই ব্যাড়া কই শ্যাষ হইছে?
-জানিনে।
-সব দেশে কি এমন ব্যাড়া আছে, বাজান?
-আছে মনে লয়।
মনে মনে বড্ড বিরক্ত হয় বুড়ো। খুব বেশী ত্যাক্ত করছে আজ মেয়েটা। সেই রেলগাড়িতে উঠার পর থেকে শুরু হয়েছে মেয়ের বক-বকানী, বাড়ীর কাছে এসেও তা থামার কথা নেই। কতবার মেয়েকে বলেছে বুড়ো এই দেশের জবানে কথা বলতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! বিপদ ঘটতে সময় লাগে নাকি?
শক্ত পায়ে মাটি ঘসতে ঘসতে একসময় বাপ-বেটিতে পৌছে গেল ঠিক জায়গাটিতে। মূল রাস্তা হতে বা দিকে চলে গেছে পায়ে চলা কাঁচা পথটি বাঁকা হয়ে। তার ঠিক মাথায় কুঁজো ছাপড়াটার সামনে গিয়ে ঝাঁপিতে দুটো টোকা দিলো বুড়ো মোজাম। দরজা না খুলেই ভিতর থেকে আওয়াজ দিলো এক পুরুষ কন্ঠ।
-কেডা! বুরা?
-হ অস্তাদ, আমি বুড়ো।
-তিন’শ টাকা বাইর কর।
-ঠিকাছে ওস্তাদ।
এরও প্রায় দশ মিনিট বাদে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে ছাপড়ার ঝাঁপি খুলল। হাড়ীর তলার মত কালো এক মাঝ বয়সী লোক মই হাতে বাইরে এসে দাড়ালো।
-ল, মইটা ধর রে বুরা। এইটা হইলো সেই ওস্তাদী মই- বহুত পুরান মাল। এইটা ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে তুই চইলা যাবি তোর মঞ্জিলে মকসুদ, আর যদি ব্যবহার না জানস তয় এক্কারে ভবনদী পার হইয়া যাবি না ফেরার দ্যাশে। তোগো দ্যাশের কত মানুষ এই মই বাইয়া মঞ্জিলে মকসুদ পৌছাইছে, রাজা-উজির-মন্ত্রী হইছে তার খবর এই কালীচরন ঠিকই রাখছে। কিন্ত তারা বেবাক কালীচরনরে ভুইলা গেছে। যা তাইলে, ওপার নাইমা ধাক্কা মাইরা মইডারে এপারের আরায় ফালাই দিতে ভুলিস না যেন।
-ঠিক আছে ওস্তাদ, নমস্কার।
বাপ-বেটী অতঃপর গুটি গুটি পায়ে আর ঢিপ ঢিপ বুকে বেড়ার সব থেকে দুর্বল জাগাটায় ওস্তাদী মইটাকে ঠেশ দেয়। সব কাজের ভিতরে এইটাই যা শক্ত- আর সব ফেনা-ভাত। এখানে বেড়াটা একটু নীচু, জায়গাটাও বেশ জংলা।
-আইজকের কুয়াশাডা খুব কাজে দেছে রে আদা।
-হ বাজান। তুমি আগে ওঠো, পরে আমি।
বুড়ো মোজাম তরতর করে বেড়ার আগায় পৌছে যায়- সেখান থেকে ধীর পায়ে নেমে আসে দেশের মাটির উপরে। মাটির উপর পা রাখার সাথে সাথে তার বুক ভরে যায় মায়া গন্ধ-বাতাসে। উপসী বুকে পড়ে শান্ত শীতল করুনা। মন যেন তার পাখীর ডানায় ভর দেয়।
-বাজান, তুমার মই ধরা লাগবে না। তুমি আস্ত আস্তে আগাই যাও। তুমি নীচে দাড়াই থাকলি আমি কিন্ত ওটপো না- আমার লজ্জা লাগে।
-হ মা, আমি তাইলে আগাই আস্তে ধীরে।
এক পা দুই পা তিন পা পড়ে সামনে বুড়ো মোজামের। কয়েকটা গুলির ব্জ্রনাদ, সাথে সাথে একটা মানুষের মরন চিতকার যেন কারও গলা চিরে বেরিয়ে এসে তরাসে কানে ঢুকে পড়ে বুড়োর। গলায় ছুরি চালনো কোরবানীর পশুর শেষ চিতকারের মত সে আওয়াজ। সে আওয়াজ কোন কিছু ভাববার সব শক্তি হরণ করে নেয় তার। সহসা পেছনে একবার তাকিয়ে এক দৌড়ে সে পৌছে যায় সামনের বড় দেবদারু গাছের তলার ছোট্ট জংলাটার ভিতরে। কে যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে সেখানে। জংলার ফাঁক দিয়ে তার চোখ চলে যায় কাঁটাতারের বেড়ার উপরে, যেখনে ঝুলে রয়েছে তার যুবতী কন্যার অসাড় দেহটা। নিস্পলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে কেমন যেন বিভ্রান্তি লাগে ষাট ছুই ছুই বুড়ো মোজামের। স্পষ্ট দেখতে পায় সে- বেড়ার গায়ে বাদুর ঝোলা ঝুলে আছে আর কারও নয়- তারই নিস্প্রান দেহটা। মাথার ভিতরে অন্য রকম এক শূন্যতা তৈরী হয় তার। এক এক করে সহস্র শূন্যতা বাসা বাঁধে তার মাথার ভিতরে। শূন্য ভয়াবহ, শূন্য ভয়ংকর ও অসহ্য। তাতে না আছে জীবন, না আছে মৃত্যু। শূন্যতার অপরিচিত সে অস্তিত্ব সহ্য করতে পারে না বুড়ো বেশী সময়। দ্রুত খিপ্রতায় হাত তার চলে যায় কোমরের বিড়ার নেশার দলায়। নেশার ধোয়ায় ধোয়ায় মাথার সহস্র শূন্যতা পালিয়ে যায়। বেড়ার উপরে তখন আবার সেই মৃত কন্যার দেহটা ভেসে উঠে দৃষ্টিতে। মনের গভীর তলদেশে তার এক অধরা শোক অস্তিত্ব রক্ষায় লড়ে মরে। হাতের কাছে সহজেই বড় হয়ে ধরা পড়ে কন্যার কাছে থেকে যাওয়া অতগুলো টাকা হারানোর কষ্টটা, যার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে জীবনের ছোট ছোট অসংখ্যা মুহুর্তের করুন অপমৃত্যু।
নেশার ঘোরে বিড়বিড় করে বকে বুড়ো মোজাম- ‘আমি আর বাড়ী যাব না রে আদা। আমার বুড়ীরে কি কয়ে আমি বুঝ দিবানে। বাড়ীত গেলি তোর মা আমার নেশার ঘোর ছুটায় দেবে বিষ-কাঁটার ঘায়ে। তখন আমার মাথা আবার শূন্য হয়ে যাবি। তাই আমি আর বাড়ীত যাবো না- এই জংলায়, নেশার তাজা ধোয়ার মধ্যিখানে থেকে যাব তোর কাঁটাতার-কব্বরের সামনে’।
সন্তান হারানোর শোক বড্ড বেশী ভারী। এত ভারী জিনিস কিভাবে বইবে বুড়ো মোজাম। তাই ভারে ভারে তা তলিয়ে যায় এক্কেবারে মন-পুকুরের তলায়। শেষবিচারে ভেসে থাকে শুধুই ঘামের কড়ি হারানোর শোক। একটু একটু করে জীবনকে নীংড়ে মেরে যে কড়ি জমা হয়েছিল সেই জীবনকেই বাচিয়ে রাখতে- অনেকগুলো জীবন ধরে রাখতে। তাই এক রাশ অভিমান বুকে চেপে নেশাখোর বুড়ো বসে থাকে জংলায় আর বিড়বিড় করে ভুল বকে যায়- ‘নালায়েক ব্যাক্কল মেইয়েডারে কত করে কলাম টাকাগুলো আমার কাছে দে। কিন্তু কথা শুনার মানুষ কি সে? এহন দ্যাখ কি হয়ে গেল- টাকাগুলো সব গেল কুমিরের পেটে’।
এক দুই করে সময় গড়ায়। নেশার ধোয়ায় ভর করে বুড়োর প্রলাপ ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থাকে গ্রামান্তরে। সবার কানে কানে ফেরে- বাপ-বেটী ওপারে ডাকাতি করে পালাবার সময় বুড়ো বাচলেও বুড়োর মেয়ে সীমান্ত রক্ষীদের গুলি খেয়ে মরে। তা না হলে এইভাবে একটা মেয়েমানুষ গুলি করে কেউ ঝুলিয়ে রাখে?
ভাল লেগেছে। (Y)
সুন্দর গল্পের গাঁথুনি। বর্ডার নিয়ে আমাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। বিশেষ করে যারা সীমান্তবর্তী এলাকায় বাস করেন তাদেরকে বিশেষ ভাবে সচেতন করা উচিৎ। আগে তো আমাদের ঘর সামলাতে হবে।
বিজিবি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এ বিষয়টির দিকে নজর দেয়া উচিৎ। প্রয়োজনে মোক্ষম জবাব দেয়া যেতে পারে। বাংলার বাঘের কাছে কোন হায়নাই পেরে উঠবে বলে মনে করি না।