সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সম্মানিত চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক এর ব্যক্তিগত স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেইল হ্যাকিংকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাপ্রবাহ তার সাথে বাংলাদেশের অনেকেই ইতোমধ্যে বোধ করি অবগত হয়েছেন। গত কয়েকদিনে ইকনমিস্টসহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে আমার সাথে এবং আইসিটির বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার জন্য আরও যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের অনেকের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি ট্রাইবুনালের বিচারাধীন থাকায়, এবং এ বিষয়ে ট্রাইবুনালের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় আমরা সচেতনভাবেই কোনো মন্তব্য দেয়া থেকে বিরত ছিলাম। এখনও আমরা এই বিচারাধীন বিষয়ের কনটেন্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। কিন্তু গত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকায় এবং সংবাদ মাধ্যমে কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথা আমাদের গোচরে এসেছে।

“আমার দেশ” নামের চিহ্নিত পত্রিকাটি আদালতের সুনির্দিষ্ট আদেশের লঙ্ঘন করে, সমস্ত ধরণের শিষ্টাচার ও সভ্যতার নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এই অপরাধের মাধ্যমে গৃহীত তথ্যসমূহ অনেক রঙ চড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে থাকে। তার সাথে যোগ দেয় অনলাইন প্লাটফর্মের চিহ্নিত কিছু জামাতপন্থী গ্রুপ। এমনই কিছু বিভ্রান্তির ওপর আলোকপাত করতেই আমার আজকের এই লেখাটি।

বিচারপতি নিজামুল হক এর সাথে আমার কথিত কথোপকথন এবং ইমেইল হ্যাকিং এর ঘটনাটি আমি প্রথম জানতে পারি “ইকনমিস্ট” এর একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে, যখন তিনি এই বিষয়ে আমার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। এই কথিত কথোপকথনে আরও যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের আরও কয়েকজনের সাথেও যে ইকনমিস্ট পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, তাও জানতে পারি। এর পরের ঘটনা সবার জানা। ইকনমিস্ট এর সাংবাদিক যখন বিচারপতির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন, তার পরের দিন, অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে একটি আদেশ জারী করা হয় ইকনমিস্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে। সেখানে উম্মুক্ত আদালতে ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে বিচারপতি হক স্পষ্টভাবে তার আদেশে উল্লেখ করেন যে – হ্যাকিং এর মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত ইমেইলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা হয়েছে। অবৈধভাব তার ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ডিং এর কথাও তিনি সে আদেশে দেশবাসীকে অবগত করেন। সাথে তিনি উম্মুক্ত আদালতে এটাও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন কেন, কী পরিস্থিতিতে, এবং কী প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে ট্রাইবুনাল বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের বিষয়ে আমিসহ অন্যান্যদের পরামর্শ ও গবেষণা সহায়তা গ্রহণ করেছেন। আমার সাথে বিচারপতির খোলামেলা আলোচনায় আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন নিয়ামক, এই জাতীয় বিচারের রায়ের আান্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত কাঠামো/ বিন্যাসসহ ব্যক্তিগত নানান কথাও উঠে আসতো মাঝে মধ্যে। আমাদের কথোপকথনে আমি সবসময়ই দেখেছি বিচারপতি হক তাঁর নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, বিচারের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়গুলোর ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকতেন। তাতে তাঁর প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়েছে বই কমেনি। আমার সৌভাগ্য যে বিচারপতি হক এর মতো একজন নির্ভীক এবং সৎ মানুষের সাহচর্যে আসতে পেরেছি। এই বিচারটিকে বিশ্বের দরবারে কিভাবে আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়, কিভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে সব ধরণের চাপের উর্ধ্বে রাখা যায় – সে বিষয়ে বিচারপতি হকের সবসময়ই খুব সজাগ দৃষ্টি ছিল।

আজকে এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার চক্রটির পক্ষ থেকে করা একটি দাবী আমার চোখে পড়েছে যা এক কথায় হাস্যকর। বলা হচ্ছে যে – এই মামলার চূড়ান্ত রায় (conviction and sentencing) নাকি আগেই লেখা হয়ে আছে, আর আমিই নাকি সেটা লিখে দিয়েছি। রায় যদি লেখা হয়ে গিয়েই থাকে তাহলে সে রায় এতদিনে দিয়ে দেয়া হয়ে যেতো নিশ্চয়ই। আর সে রকম কোনো রায়ের কপি যদি থেকেই থাকতো, তাহলে ট্রাইবুনালের তথাকথিত গোপন দলিলের তথাকথিত “লিক”(leak)-কারীরা নিশ্চয়ই বিশ্ববাসীর কাছে তা তুলে ধরতো। তারা যেহেতু তুলে ধরতে পারেনি, তাতে এও প্রমাণিত হয় যে যে চক্রটি দাবী করছে যে রায় ইতোমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে – সেটি কতখানি অসার এবং ভিত্তিহীন!

আমি বিচারকের হয়ে রায় লিখে দেবো – এমন হাস্যকর কৃতিত্ব আমি দাবী করি না। যদি সত্যিই লিখে দিতাম, তাহলে নিশ্চয়ই এই কৃতিত্বের ভাগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার কোনো কারণ ছিল না। আমি এবং আরও যারা শুরু থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে জরুরী সাহায্যটুকু করবার চেষ্টা করে এসেছি ট্রাইবুনালেরই অনুরোধে – আমাদের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই একটি বিষয় স্পষ্ট করেছিলাম। সেটি হলো – এই সহযোগিতা আমরা করবো সম্পূর্ণ pro bono ভিত্তিতে, অর্থাৎ কোনো ধরণের পদ বা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে না। আমরা যারা এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো প্রক্রিয়াটিকে দেখেছি, তারা জানি কী পরিমাণ কষ্ট এবং ত্যাগের বিনিময়ে এই দেশটি স্বাধীন হয়েছে। সেই দেশের মানুষের বহু প্রতীক্ষিত বিচারের প্রক্রিয়ায় যদি সামান্যতম সাহায্যও করতে পেরে থাকি, তবে তাকে আমরা নিজেদের সৌভাগ্য বলেই গণ্য করি।

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেখানেই এ ধরণের অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেখানেই বিচারকদের গবেষণা এবং ড্রাফটিংসহ অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। উদাহরণ হিসেবে হেগ এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), রুয়ান্ডা ট্রাইবুনাল, ইউগোশ্লাভিয়া ট্রাইবুনাল এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের দেশ গরীব দেশ, সাধ্য এবং সামর্থ্য দু’টোই অত্যন্ত সীমিত। তাই সরকারের ইচ্ছে থাকলেও, জনগণ এবং নাগরিক সমাজের নানান আকাঙ্খা ও আশাবাদ থাকলেও বাস্তবতা অনেক সময়ই তাতে বাধ সেধেছে। অথচ আমাদের ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে আইনটি যেমন নতুন, প্রক্রিয়াটিও তেমনি একেবারেই নতুন, এমনকি বিচারকদের জন্যও – সুতরাং সাহায্য গ্রহণের বাস্তব পরিস্থিতিটুকু সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। একথাগুলো বিচারপতি হকের আদেশেও স্পষ্ট হয়েছে।

ট্রাইবুনালের ওপর ইতিহাসের সব চাইতে গুরু দায়িত্বটি ন্যস্ত। ১৯৭১ সালে সংঘটিত সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসের তুলনাহীন আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার, চার দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিরসন, লক্ষ লক্ষ ভিকটিমসহ দেশবাসীর দীর্ঘদিনের বিচারের প্রত্যাশা পূরণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এই গুরু দায়িত্বের অংশ। অন্যদিকে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের নানান ধরণের সীমাবদ্ধতাকে মাথায় নিয়ে এই ট্রাইবুনালকে কাজ করতে হচ্ছে প্রতিদিন। তেমনই এক পরিস্থিতিতে ট্রাইবুনালের পাশে দাঁড়িয়ে যতটুকু সম্ভব অভাব পূরণে এগিয়ে আসা আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব ছিলো বলে আমি মনে করি। এর ফলে কোনো আইন ভঙ্গ হয়নি, যা এমনকি ইকনমিস্টও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ইকনমিস্টের গত ১২ ডিসেম্বর তারিখের বিশদ প্রতিবেদনের শেষাংশে এসে স্পষ্টই বলা হয়েছে – “We do not believe he (Ahmed Ziauddin) has broken any laws and cannot be held responsible for the actions of others” কোনো নৈতিকতার মানদণ্ডেরও লঙ্ঘন হয়নি, বরং নৈতিক দায়িত্ব পালিত হয়েছে।

এখন বিচারপতি হক এর স্বেচ্ছা পদত্যাগ এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহের ধুয়া তুলে যারা দাবী করছেন আবার গোড়া থেকে বিচার শুরু করতে হবে, তারা একেবারেই সঠিক বলছেন না। ১৯৭৩ সালের আইটির ধারা ৬(৬)-তে স্পষ্ট বলা আছে যে – “যে কোনো কারণে” ট্রাইবুনালের কোনো বিচারপতির পরিবর্তন হলেও ট্রাইবুনাল পুনরায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য গোড়া থেকে শুনতে বাধ্য নয়। বরং আইনে বলা রয়েছে – ইতোমধ্যেই মামলাগুলো সাক্ষ্যগ্রহণের যে পর্যায়ে রয়েছে ঠিক তার পর থেকেই বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কোনো ধরণের ছেদ ছাড়াই। এই প্রকাশে সম্প্রতি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় আইন কমিশনের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শাহ আলম এর বিশ্লেষণটি আমার কাছে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং সঠিক মনে হয়েছে।

নানা জনে নানান কথা বলেছেন। এদের মধ্যে কিছু কথা বলেছেন এমন কিছু মানুষ যারা শুরু থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের কথার জবাব দেয়া সময়ের অপচয়মাত্র। কিন্তু আমি খুব দুঃখ নিয়ে লক্ষ্য করছি যে কিছু বিভ্রান্তি বিচারের পক্ষের মানুষদের অনেকের মধ্যেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। গত ১৫ ডিসেম্বর বিডিনিউজ২৪ডটকমের মতামত-বিশ্লেষণ শাখায় প্রকাশিত শ্রদ্ধাভাজন শাহরিয়ার কবিরের একটি মন্তব্য আমাকে খুবই ব্যাথিত করেছে। তিনি লিখেছেন: “আমি মনে করি, এখানে জিয়াউদ্দিন নামের যে-বিচারক ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি আইন জেনে-বুঝে আমাদের ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এই জিয়াউদ্দিন সাহেব নিজেকে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের ধারক বলে দাবি করেন। কিন্তু কোন সাহসে তিনি আমাদের বিচারপতির সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন? আমি বলব, এ নিয়ে জোর তদন্ত হওয়া উচিত।”

তিনি আমার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন অনুভব করছি না। কোথা থেকে আমি এমন “সাহস” পেয়েছি, তিনি তেমন প্রশ্নও করেছেন। আমার বিনীত মতামত – বিষয়টি “সাহস” এর নয়, বিষয়টি সদিচ্ছার এবং সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি দায়িত্ববোধের। আমার সে দায়িত্ববোধ বা সাহায্য করার অধিকারের উৎস কী, তা বিচারপতি হক এর ৬ ডিসেম্বর দেয়া আদেশে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। শাহরিয়ার কবির আরও বলেছেন, এর মাধ্যমে নাকি জামাত-শিবির চক্রের হাতে “একটি সুযোগ তুলে দেয়া হল”। অন্য সমস্ত কিছু বাদ দিলেও, শুধুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করে আশা করি এতটুকু যে কারও পক্ষে অন্তত অনুধাবন করা সম্ভব যে নিজেদের ব্যক্তিগত সুনাম এবং পারিবারিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে, নিজেদেরকে এভাবে জড়িয়ে – আমি বা বিচারপতি হক নিশ্চয়ই সেটা করবো না। এক অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যার বাড়িতে চুরি হয়েছে, তাকেই পাল্টা দোষী সাব্যস্ত করার নামান্তর এটি! আমি আরও আশ্চর্য্য হয়ে খেয়াল করেছি যে তার এই দীর্ঘ লেখাটির কোথাও তিনি হ্যাকিং অপরাধের নিন্দা জানিয়ে একটি শব্দও লেখেননি!

‘ইকনমিস্ট” পত্রিকার হঠাৎ (!) অবস্থান পাল্টানোর বিষয়ে প্রশ্ন তুলে শাহরিয়ার কবির লিখেছেন অতীতেও যুদ্ধাপরাধ বিষয় নিয়ে নাকি তারা প্রতিবেদন করেছে, তিনি নিজেও নাকি সে সবে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সে সব প্রতিবেদন নাকি এমন সমালোচনামূলক ছিল না। আমি জানি না তিনি সাম্প্রতিককালে ইকনমিস্ট পত্রিকাটি নিয়মিত পড়ছেন কি না। তবে তাদের সাম্প্রতিক কালের প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকার এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে সমালোচনামুখর। জামাতের যে লবিইং প্রতিষ্ঠান ক্যাসিডি এন্ড এসোসিয়েটসের কথা তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তাঁর হয়তো জানা নেই ওয়াশিংটনের বহু লবিইং ফার্মের কাছেই এখন ইকনমিস্ট পত্রিকাটিই লবিইং উদ্ভুত তথাকথিত সাংবাদিকতার একটি পছন্দের ভেন্যু, যা আমরা অতীতে ব্যারী শুমাখ্যার এর বক্তব্যেও জানতে পেরেছি। তবে শাহরিয়ার কবিরের সাথে যদি ইকনমিস্ট পত্রিকার ভালো যোগাযোগ থেকে থাকে আমি অনুরোধ করবো তিনি যেন অবশ্যই তাদের সাথে যোগাযোগ করে এই ইমেইল হ্যাকিং এবং তথ্য ফাঁসের উৎসের ব্যাপারে খোঁজ নেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি অনেক বেশী সাহায্যে আসবে মনে করি।

শ্রদ্ধেয় শাহরিয়ার কবির দীর্ঘদিন ধরে এই বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সময় সময় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর উদ্বেগ বা সমালোচনাগুলো বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। কিছু সমালোচনা করা হয়ে থাকে একটি প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, আবার কিছু সমালোচনা হল “একজন সুহৃদের সমালোচনা”। শাহরিয়ার কবিরের সমালোচনাগুলো আমি শেষোক্ত ধারার বলেই ধরে নিতে চাই। বিচারকদের একান্ত গোপনীয় বিষয়গুলো অবৈধভাবে যখন কোনো মতলবী মহল সংগ্রহ করে প্রচার করে, সেটা সকল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের জন্যই নিঃসন্দেহে খুব হতাশার বিষয়। বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরির অপচেষ্টা সবার কাছেই নিশ্চয়ই উদ্বেগের। আর আমাদের কারও কারও জন্য, যাদের নাম ধাম উঠে এসেছে ইতোমধ্যে, তাদের জন্য সেটা নিছক হতাশার চাইতেও আরও বেশী কিছু। কারণ, ইতোমধ্যেই ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কারও কারও কাছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাছ থেকে মৃত্যু-হুমকি পাঠানো হয়েছে, অত্যন্ত মানহানিকর প্রচারণাও চলছে পাশাপাশি। আর এর থেকে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও বাদ দেয়া হয়নি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এবং সামাজিক মিডিয়ায় তাদেরও ছবি তুলে দেয়া হয়েছে। সে সব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমরা ইতোমধ্যেই অবগত করেছি।

এই কথাগুলো উল্লেখ করলাম কয়েকটি কারণে। মূল কারণটি হল, আমরা মনে করি এখানেই এর শেষ নয়। বিচারকের একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং পত্র বিনিময়ের তথ্যাদি যখন বিচার প্রক্রিয়ার সাথেই জড়িত একটি বিশেষ মহলের হস্তগত হয়, তখন তা আমাদের ব্যক্তিগত হতাশা, কিংবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসির বাইরেও আরও বড় ক্ষতির ইঙ্গিত বহন করে। যেমন: (১) লিক করা ফাইল থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে শুধু বিচারপতি হকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্যাদিই হ্যাকারদের হাতে পড়েনি, তার সাথে অন্যান্য বিচারকদের যোগাযোগের সমস্ত গোপনীয় তথ্যও যে এখন হ্যাকারদের হাতে তার আলামত স্পষ্ট; (২) বিচারকগণ সাক্ষী সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার কাস্টডিয়ান, এক পক্ষের সাক্ষীদের তথ্যাদি তারা অন্য পক্ষের কাছ থেকে গোপন রাখেন। বিচারকের নিজের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হওয়ার মাধ্যমে সাক্ষীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত সকল গোপনীয়তাই এখন হুমকীর সম্মূখীন; (৩) শুধু যে বিচারকের কম্পিউটারেই হ্যাকিং বা আড়িপাতা হয়েছে, সেটা মনে করলেও কিন্তু ভুল হবে। ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই যে এমনটি অতীতে করা হয়নি বা এখনও করা হচ্ছে না সেটার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ করে একের পর এক সাক্ষীরা (যারা ছিলেন অত্যন্ত গোপনীয় সাক্ষী সুরক্ষা-ব্যবস্থার আওতায়) কেন ট্রাইবুনালের সামনে সাক্ষ্য দিতে হঠাৎ এতো ভীত হয়ে পড়লো বা সাক্ষ্য প্রদানে অসম্মত হল, বা হঠাৎ আসামী পক্ষের হয়ে সাফাই দেয়া শুরু করলো – সে বিষয়গুলোর প্রতিটিরই এখন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, গোপনীয়তা ভঙ্গের, এবং আড়িপাতার এই চর্চার মূল যে আসলে কতখানি গভীর এবং কতখানি বিস্তৃত তা জানাটা এই বিচারের স্বার্থেই জরুরী। এখনই সে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উম্মোচন না করতে পারলে আগামীতে আরও বড় ধরণের ষড়যন্ত্রের পথ বিস্তৃত হবে।

২০০৯ থেকে দেশ এবং প্রবাসের একদল নিবেদিত প্রাণ ছেলেমেয়ে মিলে আইসিএসএফ (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম) নামের একটি নেটওয়ার্ক বা কোয়ালিশন শুরু করে। খুব দ্রুতই বিশ্বের প্রায় ৩৮ শহরের তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংগ্রামী কিছু তরুণ-তরুনীদের মধ্যে এই সংগঠনটি ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এই সংগঠনটিতে কোনো তথাকথিত স্তরবিন্যাস নেই। রাজনৈতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতাহীন এই সংগঠনটিতে একে একে জড়ো হয়েছে ১৩টি সংগঠন, যার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নেতৃত্ব দেয়া সবচেয়ে প্রভাবশালী বাংলা ব্লগগুলোও। ব্যক্তি হিসেবে এসে এখানে যুক্ত হয়েছেন অক্সফোর্ড-কেমব্রীজ-হার্ভার্ডসহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রখর মেধাবী দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়েরা। ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও রয়েছেন দেশ-বিদেশের নাম করা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, রয়েছেন আইনজীবি, সাংবাদিক এবং নানা পেশাজীবিরা, রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এদের সবাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে বাড়ি ফিরে যে সময়টুকু পান তা ব্যয় করেন আইসিএসএফ এর সামষ্টিক কর্মযজ্ঞে। বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস করে এই ছেলেমেয়েদের বুকের ভেতর। এই নেটওয়ার্কের ভেতর কাজের সংস্কৃতিটিই একেবারে আলাদা, যা আমি আমার অভিজ্ঞতায় কখনো আর কোথাও দেখিনি। এরা কেউ নিজের ব্যক্তিগত নাম বা যশের জন্য কাজ করেন না। প্রচলিত ধারার কমিটি, সাব-কমিটি নির্ভর বিবৃতি সেমিনার এবং প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে ওরা নিভৃতে গড়ে তুলেছে একের পর এক আর্কাইভ যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় বর্তমান এবং আগামীর জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সব ধরণের অপ-প্রচার এবং ষড়যন্ত্র এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা মোকাবিলা করে আসছে সবল হাতে। দরকারের সময় এরাই টোবি ক্যাডম্যান, স্টিফেন র্যাপ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বা গ্রেগ হার্টলিদের নানা বিভ্রান্তিমূলক বিবৃতি এবং রিপোর্টগুলোর সমুচিত জবাব দিয়ে এসেছে। যে কারণে আসামী পক্ষের বিদেশী আইনজীবি এবং লবিইস্টদের বিষোদগারের শিকারও হতে হয়েছে আইসিএসএফ এর সদস্যদের বহুবার। নিরবে নিভৃতে এই সংগঠনটি বিচারের পক্ষে যে কী পরিমাণ প্রয়োজনীয় কাজ করেছে তা তাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করলেই যে কোনো সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হবে।

গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার ভয়াবহ লঙ্ঘন হয়েছে এখানে, সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। পরিতাপের বিষয় হলো, ইমেইল এবং স্কাইপ কথোপকথনগুলো ফাঁস হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিলো পুরো বিষয়ের যথাযথ তদন্ত, কারণ অন্য সব অপরাধের মতো সাইবার-অপরাধের আলামতও সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যায়। এই অবস্থায় এটি নিশ্চিত যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সবিস্তার পরিকল্পনার পর এই আক্রমণে হাত দেয়। আমি এবং বিচারক হক এই আক্রমণের ভুক্তভোগী। শুধু আমরা নই, হয়তো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাও এই ধরনের আক্রমণের শিকার হয়ে থাকতে পারেন, যা উপরেই উল্লেখ করেছি। কিছুটা দেরীতে হলেও এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ এসেছে ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে। এই উদ্যোগকে আমরা আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।

প্রাসঙ্গিক ডিজিটাল তথ্যগুলো যথাযথ প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ইতোমধ্যেই যাচাই করানো হয়েছে, এবং আমাদের প্রাপ্ত সমুদয় তথ্য খুব সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে ইমেইল হ্যাকিং বা অডিও-রেকর্ডিং আসলে কোথা থেকে হয়েছে। এ বিষয়ে ঘটনার শুরু থেকেই যারা এমনকি আমার দেশ বা ইকনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশের আগে থেকেই বিভিন্ন ইন্টারনেট প্লাটফর্মে কথিত আলোচনার অংশবিশেষ নিয়ে মন্তব্য করেছে বা প্রকাশ করার হুমকি দিয়েছে, আমাদের কাছে সে সবেরও তথ্যপ্রমাণ এবং তালিকা রয়েছে। আমরা মনে করি সে সব বিশ্লেষণ করলে কারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত রয়েছেন সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যাবে। আমরা আমাদের প্রাপ্ত সব তথ্য এবং বিশ্লেষণ তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছি। আশা করি দ্রুতই এই বিষয়ে সবাই একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দু’জন মানুষের আলোচনার রেকর্ডকে নানাভাবে বিকৃত করা যায়। কোনো আলোচনাকে নিজের সুবিধার্থে পরিপ্রেক্ষিত বহির্ভূতভাবে উদ্ধৃত করে, কথার অংশবিশেষকে আগুপিছু জোড়া লাগিয়ে, কিছু প্রয়োজনীয় অংশকে সুপরিকল্পতভাবে বাদ দিয়ে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে উপস্থাপন করা যায়। আইসিএসএফ এর তদন্তে অডিও-ফাইলগুলোর ওপর কারিগরি সম্পাদনা বা কাটাছেঁড়া করার সুস্পষ্ট আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। আর প্রকাশিত তথাকথিত ইমেইলগুলোর ক্ষেত্রে সে কথা তো আরও বেশী প্রযোজ্য। কারণ, আগুপিছু আলোচনার বা পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে কিছু না উল্লেখ করে মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একটি ইমেইলের স্ক্রিনশট তুলে ধরা হলে তা তো বিভ্রান্তি তৈরি করবেই। এ কারণে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র এভাবে অবৈধভাবে যখন কিছু সংগৃহীত হয়, এবং তা অসম্পূর্ণভাবে প্রচারের জন্য তুলে ধরা হয় – তার নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে বিশেষ সন্দেহ পোষণ করেন সবাই। এবং এ জাতীয় তৎপরতাকে উন্নত বিশ্ব এবং বাংলাদেশেও গুরুতর অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এ ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত পত্রিকাগুলোকে চরম মূল্য দিতে হয়, যেমনটি আমরা দেখেছি ব্রিটেনের ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্লড’ এর ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক “লেভিসন তদন্তের” পর এই বিষয়ে সংশয়ের আর কোনো অবকাশই নেই।

আমি বা আমরা কোনো আইন ভঙ্গ করিনি, কোনো অন্যায় করিনি। বরং প্রয়োজনে আমাদের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে এই বিচার প্রক্রিয়াকে যতভাবে সম্ভব সহায়তা দানের চেষ্টাই করে গেছি এবং যাবো। এই সময়ে সবার কাছে আমার একটি মাত্র বিনীত অনুরোধ থাকবে। এই বিচারের দিকে পুরো দেশ এবং নতুন প্রজন্ম অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, ১৯৭১ সালের ভিকটিম এবং তাদের পরিবারেরাও তাকিয়ে আছেন। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের প্রগতির শিবিরে যদি কোনো বিভেদ বা ব্যক্তিগত মনোমালিন্য থেকেও থাকে তা যেন আজকের এই নতুন প্রজন্মের আশাটিকে পদদলিত না করে; আমরা যেন ওদের কাছে নিজেদের বিভেদ দিয়ে নিজেদের আর ছোটো না করি। এই বিচারটি শুরু করতে এমনিতেই ৪১ বছর দেরী হয়ে গেছে, সেটি আমাদের প্রজন্মেরই ব্যার্থতা, আমরা যেন সেটা ভুলে না যাই।

বিঃ দ্রঃ লেখাটি লিখেছেন বেলজিয়াম প্রবাসী আহমেদ জিয়াউদ্দিন যিনি একজন আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্রেটিজিক ফোরাম ( আইসিএসএফ) এর সদস্য। উল্লেখ্য যে লেখাটি বিডিনিউজওপিনিয়নে প্রকাশিত এবং মুক্তমনায় প্রকাশের জন্য অনুমোদিত।