মার্কিন মাস্তানি -ডমিনিকান রিপাব্লিক আর একাত্তরের বাংলাদেশ
-ইরতিশাদ আহমদ
‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’
পেশাগত কাজে গত মাসে (নভেম্বর, ২০১২) আমাকে বেশ কয়েকবার যেতে হলো ডমিনিকান রিপাব্লিকের রাজধানী সান্তো ডমিঙ্গো-তে। মায়ামি থেকে আকাশ পথে মাত্র দুইঘন্টার ফ্লাইট। দেশটা সম্পর্কে আগ্রহ জাগলো মনে। টুকটাক জেনে নিলাম ইন্টারনেট ঘেটে। যতই ঘাটি ততই মনে হয় ‘চিনি উহারে’।
দেশটা সম্পর্কে যতই নতুন নতুন তথ্য জানতে পারি, ততই মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলেও অবাক হই না। ডমিনিকান রিপাব্লিকের ইতিহাসে যা ঘটেছে আমার জানা এই অঞ্চলের এবং ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইতিহাসের সাথে তার তেমন কোন অমিল নেই।
হিস্পানিওলা
সেই পঞ্চদশ শতকের গোড়া থেকে সাম্রাজ্যবাদের লিপ্সার শিকার ডমিনিকান রিপাব্লিকের মতো ক্যারিবিয়ান-ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলো। হেইতির প্রতিবেশী এই দেশটা ছিল স্পেনের উপনিবেশ (১৪৯২ থেকে)। হেইতি পরে (১৬৬৮ থেকে) চলে যায় ফ্রান্সের হাতে। দুই দেশ মিলে এই অঞ্চলকে বলা হয় হিস্পানিওলা। ক্রিস্টোবাল কোলোন (ক্রিষ্টোফার কলম্বাসের স্প্যানিশ নাম) ক্যারিবিয়ান এই দ্বীপে ১৪৯২ সালে ঘাঁটি গাড়ার পরে নাম দিয়েছিলেন, লা ইসলা এস্পানোলা ইংরেজিতে যার মানে দ্য স্প্যানিশ আইল্যান্ড। সংক্ষিপ্ত হয়ে পরে এস্পানোলা এবং অবশেষে হিস্পানিওলা। এদের দূর্ভাগ্যের শুরু সেই সময় থেকে ।
কলম্বাস আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা নির্মিত বিশালাকৃতি দূর্গসদৃশ বাড়িগুলো এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান সান্তো ডমিঙ্গোতে। পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থান, যাদুঘর আর মহাকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে। ‘আলকাজার দ্যে দিয়েগো কোলোন’ নির্মিত হয়েছিল ১৫১৫ তে। ক্রিস্টোবালের ছেলে দিয়েগো কোলোন, সান্তো ডমিঙ্গোর গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে বানিয়েছিলেন এই প্রাসাদটা।
কতশত স্থানীয় আর আফ্রিকার কালো মানুষের অশ্রু, ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এই শহর কেউ তার হিসেব আর নেয় না এখন।
ডমিনিকান রিপাব্লিক ‘স্বাধীন’ একটা দেশ। এখন আর উপনিবেশ নয়। কিন্তু উপনিবেশ না হলেও সত্যিকার অর্থে স্বাধীন কি? এ যুগে ‘স্বাধীন দেশ কি ও কত প্রকার’ এই প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সহজ-সরল নয়। স্বাধীন দেশ অনেক, ‘স্বাধীনতাও’ অনেক রকমের। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী এই দুনিয়ায় তেমন নেই আর – থাকলেও আছে প্রতীকী নখদন্তহীন দু’একজন। তবে সাম্রাজ্য আছে, আরো বেশি করে আছে সাম্রাজ্যবাদ। সেকালের উপনিবেশ আর নেই, তীব্রভাবে আছে এখনো ঔপনিবেশিকতা।
হিস্পানিওলার ইতিহাস এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণির মানুষের জঘন্য নির্মমতার ইতিহাস। অর্থ আর প্রতিপত্তির লোভে মানুষ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে, আর নিজেরাও পরিণত হয় জানোয়ারে । কলম্বাসের আবিষ্কৃত সেই স্বর্গভূমিকে নরকে পরিণত করতে বেশি সময় লাগে নাই সেই মানুষরূপী জানোয়ারদের।
উপনিবেশবাদের রোগ শুধু নয়, ইউরোপিয়ানরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলো আক্ষরিক অর্থেই রোগের জীবানু। স্থানীয় ‘তাইনো’ (Taino) নামে পরিচিত অধিবাসীরা অচিরেই আক্রান্ত হলো হাম আর গুটিবসন্তে। মারা গেলো অনেকেই। যারা বেঁচে ছিল তাদের ওপরে স্প্যানিশ হানাদারেরা চাপিয়ে দেয় বর্বর দাসপ্রথা।
চিপে রস বের করে নেয়ার পরে আঁখের ছিবড়া যেভাবে পরিত্যক্ত হয় হিস্পানিওলাও তাই হয়ে গেল স্প্যানিশদের কাছে। আসলেই, শেষের দিকে শুধু চিনি উৎপাদনের জন্য আঁখ চাষ আর মাড়াইয়ের কাজটাই হতো হিস্পানিওলায়। তাই ১৬৬৮তে ফ্রান্স যখ্ন হিস্পানিওলার পশ্চিমাংশ দখল করে নেয়, স্পেনীয়রা খুব একটা গা করে নি। অবশেষে ১৮০০ সালে হেইশিয়ান বিপ্লবী ভূতপূর্ব দাস তুসো ল’ওভেরতুরের নেতৃত্বে স্প্যানিশদের হটিয়ে পুরো হিস্পানিওলাকে এক দেশে রূপান্তরিত করেন। ল’ওভেরতুরের ক্ষমতা স্থায়ী হয় নি। দুইবছরের মাথায় ফ্রান্স তাঁকে ধরে নিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়। পরে ১৮০৪ সালে ল’ওভেরতুরের সাথী জাঁ-জাক দেসালিন-এর নেতৃত্বে হেইতি স্বাধীনতা ঘোষনা করে। হিস্পানিওলার পূর্বাংশে (ডমিনিকান রিপাব্লিক) থেকে যায় ফ্রান্সের কর্তৃত্ব। পরে এই কর্তৃত্ব ফ্রান্স ছেড়ে দেয় স্পেনের হাতে। হেইতির প্রেসিডেন্ট জাঁ-পিয়ের বয়ার ১৮২২ সালে আবারো দুই দেশকে একীভূত করেন। পরবর্তী বাইশ বছর পুরো হিস্পানিওলা হেইতির নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ডমিনিকান রিপাব্লিক
ডমিনিকান রিপাব্লিকের স্পেনীয়রা হেইতির এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয় নি। হুয়ান পাবলো দুয়ার্তে-র নেতৃত্বে হেইশিয়ানদের হটিয়ে পূর্ব হিস্পানিওলার দুই-তৃতীয়াংশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৮৪৪ এর সাতাশে ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই এই দেশের নাম ডমিনিকান রিপাব্লিক।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চিনি শিল্প আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে ডমিনিকান রিপাব্লিকে। আমেরিকানদের (যুক্তরাষ্ট্রের) অনেকেই তখন বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এই শিল্পে। ১৯১৬ সালে মার্কিনীরা (US Marines) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ‘রক্ষাকর্তা’র ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দখল করে নেয় ডমিনিকান রিপাব্লিক আর হেইতি। উদ্দেশ্য আর কিছু না, চিনি শিল্পের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ‘মুক্ত-বাজার অর্থনীতি’ শুধু নিজ দেশে কেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও চালু না করলে কি চলে!
ডমিনিকান সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে তাঁবেদার সরকার বসায় আমেরিকা সান্তো ডমিঙ্গোতে। জবরদখলকারী মার্কিন মেরিন কমান্ডারদের নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিল তারা। আমেরিকার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে প্রায় আট বছর।
স্বৈরশাসক ট্রুহিও
ডমিনিকান রিপাব্লিক আর হেইতি ছেড়ে আসার আগে আমেরিকানরা তাদের বশংবদ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে দুই দেশেই। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় বেসামরিক রাজনীতিকদের হাত থেকে মিলিটারীর বন্দুকে। ডমিনিকান রিপাব্লিকে এই প্রক্রিয়ার ফলে একনায়ক হয়ে বসেন সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার সাবেক টেলিগ্রাফ কেরানি রাফিয়েল লিওনিদাস ট্রুহিও। অপহরণ, নির্যাতন, খুন অবাধে চালিয়ে যেতে থাকেন ট্রুহিও তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার প্রয়াসে। যথারীতি, ‘বিশ্ব গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুগিয়ে যেতে থাকে মদদ। এই স্বৈরশাসক চারশো বছরের পুরনো শহর সান্তো ডমিঙ্গোর নামও বদলে দেন – নতুন নাম হয় ট্রুহিওনগর (Cuidad Trujillo বা Trujillo City)।
একটানা ত্রিশ বছর দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করার পরে ট্রুহিও’র দিনও শেষ হয়ে এলো। ততদিনে তার অন্ধ সমর্থকরাও বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ তার ওপরে। ট্রুহিওকে আর প্রয়োজন নেই আমেরিকারও। ১৯৬১-র মে মাসে তখনকার দিনে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রপ্রধান ট্রুহিও নিহত হন আততায়ীর হাতে। অনেকেই মনে করেন সিআইএ’র লম্বা হাত সক্রিয় ছিল এই হত্যাকান্ডের পেছনে। পাঠক, চেনেন নিশ্চয়ই এই করিতকর্মা মার্কিন এজেন্সীটাকে!
মার্কিন আগ্রাসন -১৯৬৫
এরপর থেকে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে ডমিনিকান রিপাব্লিক। কিন্তু বেরোতে পারে নি আমেরিকার প্রভাববলয় থেকে। পারবেই বা কি করে! কয়েক বছর না যেতেই ১৯৬৫ –র এপ্রিল মাসে মার্কিন বীর পুঙ্গবেরা (প্রেসিডেন্ট জনসনের আমলে) আবারো পদধুলি দেন সান্তো ডমিঙ্গোতে। অজুহাত, সে দেশে অবস্থানরত আমেরিকানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান।
আসল কারণ, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ‘আরেকটা কিউবা’র উদ্ভব ঠেকানো। সমাজতন্ত্রের জুজু আর সোভিয়েত-ভীতি তখন আমেরিকাকে ভালোই নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে।
আমেরিকার অজুহাতের অভাব নাই। সেই বাঘ আর মেষের গল্পের মতো। ‘উজানের পানি তুই ঘোলা না করলেও তোর বাপ করেছে!’ কিউবার সাহায্য নিয়ে নিজেদের পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য বিমানবন্দর নির্মান করছিলো ক্যারিবিয়ান ছোট্ট একটা দ্বীপদেশ, গ্রেনাডা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ব্যবহারের জন্য বানানো হচ্ছে এই এয়ারপোর্ট, এই ভয়ে রিগ্যান প্রশাসন দখল করে নিয়েছিল গ্রেনাডা, ১৯৮৩ সালে। আমি যে বছর আমেরিকা আসি সে বছর। এর আগে আমি গ্রেনাডা নামে যে একটা দেশ আছে তাই জানতাম না। এহেন গ্রেনাডাও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের লোভের থাবা থেকে নিস্তার পায় নি। পরে অবশ্য আমেরিকাই গ্রেনাডার বিমানবন্দরটা বানিয়ে দেয়, পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য! ভাবখানা যেন, ‘এয়ারপোর্ট লাগবে? আমাকে বললেই তো পারতে!’ মাস্তানি ছাড়া একে আর কি বলা যায়?
যাক, ফিরে যাই ডমিনিকান রিপাব্লিকে। ১৯৬৩-তে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হুয়ান বশ। সমাজতন্ত্রের সমর্থক বশকে কম্যুনিস্ট আখ্যা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচিত হওয়ার মাত্র আট মাসের মাথায় তাঁকে এক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে ডানপন্থী সামরিক অফিসারেরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মিলিটারি। কিন্তু আবার গোল বাধলো ১৯৬৫-তে। বশ-সমর্থকরা, তারাও মিলিটারির একটা ফ্যাকশন, কন্সটিটিউশনালিস্ট হিসাবে খ্যাত, ডানপন্থীদের হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেয় জনগণের ব্যাপক অংশের সমর্থনের জোরে। পাল্টা আঘাত হানে বশ-বিরোধীরা, সেনাবাহিনীর লয়্যালিস্ট অংশ। ব্যর্থ হয় তারা। মাঠে নামে আঙ্কল স্যাম। ১৯৬৫-র আটাশে এপ্রিল চল্লিশ হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা আক্রমণ করে ডমিনিকান রিপাব্লিক। এই হামলার নায়ক ছিলেন এডমিরাল জন এস. ম্যাককেইন – স্বনামধন্য রিপাব্লিকান সিনেটর ২০০৮-এর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইনের বাবা। পাঠক, সিনিয়র জন ম্যাককেইনের নামটা মনে রাখবেন। তার প্রসঙ্গ আবারো আসবে এই আলোচনার শেষের দিকে।
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন কি নতুন কিছু? সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসানো হয় জোকিন বালাগের-কে। বলা বাহুল্য, আমেরিকার স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছিল তার কাছ থেকে আগেই।
আমেরিকার আধিপত্য
গত কয়েকদিনে স্থানীয় যাদের সাথে আমার পরিচয় হলো তাদের দুয়েকজনকে জিগ্যেস করেছিলাম ডমিনিকান রিপাব্লিকের এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। কিছুদিন আগে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপরে গুলি চালানো হ্য়। মারা যায় একজন ছাত্র। বিক্ষোভের কারণ – সরকার দেশের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টাকে প্রাইভেটাইজ করতে চাচ্ছে। সোজা কথায়, ‘লাভজনক’ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টাকে ব্যাবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে।
তিনটা প্রধান রাজনৈতিক দল আছে এখন ডমিনিকান রিপাব্লিকে। জানতে চেয়েছিলাম, যে দলটা এখন ক্ষমতায় তারা কি মার্কিনপন্থী? পরিহাস মিশ্রিত সহাস্য জবাব, “কি যে বলেন! দল তিনটাই মার্কিনপন্থী”। প্রতিযোগিতা কে কত বেশি মার্কিনপন্থী তা নিয়ে। সেই জানা কাহিনি!
যে দেশটা পরিচিত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র নামে, তার সম্রাট নাই – তবে যেমনটি বলছিলাম – আছে সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের বিস্তার ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, সেন্ট্রাল আমেরিকা ছাড়িয়ে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যেও। ডমিনিকান রিপাব্লিকে আমেরিকার আধিপত্যের ইতিহাস তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, এই অঞ্চলে মার্কিন মাস্তানির একটা সাদামাটা ধারাবাহিক উদাহরণ হিসেবেই একে ধরা যেতে পারে। তাই বলছিলাম মন খারাপ হলেও আমি অবাক হই নি। কারণ, ‘চিনি উহাকে’।
ক্যারিবিয়ান-ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলোতে মার্কিন হামলার ফিরিস্তি দেখতে চাইলে গুগলে টাইপ করুন, ‘ইউএস ইনভ্যাশন্স ইন ল্যাটিন আমেরিকা’। বারো মিলিয়নের ওপরে রেজাল্ট দেখে আমারতো চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্য করবেন, আমেরিকান সরকার-প্রভাবিত মিডিয়া এবং সরকারী মুখপত্রগুলো আমেরিকার মাস্তানিগুলোকে ইনভেশন বা আক্রমণ (invasion) বলার চেয়ে ইন্টারভেনশন বা হস্তক্ষেপ (intervention) বলাটা বেশি পছন্দ করে।
অ্যান্ডারসন পেপারস’
বিশেষ কোন কারণ ছাড়াই, মায়ামি থেকে সান্তো ডমিঙ্গো যাওয়া-আসার পথে পড়ার জন্য আমি তুলে নিয়েছিলাম যে বইটা তার নাম ‘অ্যান্ডারসন পেপারস’, জ্যাক অ্যান্ডারসন-এর লেখা। অ্যান্ডারসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিন্ডিকেটেড কলামিস্ট। দেশে দেশে মার্কিন মাস্তানির কথা সবিস্তারে লিখেছেন অ্যান্ডারসন তার বইতে। ডমিনিকান রিপাব্লিকের কথা এসেছে, এসেছে বাংলাদেশের কথাও। পুলিতজার পুরষ্কার পাওয়া (১৯৭২) এই সাংবাদিককে অনেকেই ‘ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমে’র জনক মনে করেন। বিতর্কিত এই সাংবাদিক মার্কিন প্রশাসনের অনেক জারিজুরি ফাঁস করে দেন।
তাঁর বই-এর শেষ অধ্যায়টা বাংলাদেশকে নিয়ে, ‘বাংলাদেশঃ বার্থ বাই ফায়ার’। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ঘটা দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলী আর তার পরিপ্রেক্ষিতে নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভুমিকাই মূলত আলোচ্য বিষয় এই অধ্যায়ের।
বই-এর এই অধ্যায়টা পড়ার আগে আমার ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্র একাত্তরের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে তার প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত সপ্তম নৌবহর পাঠালেও, আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সৈন্য পাঠানোর কোন পরিকল্পনা তাদের ছিল না। ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটু ঝাড়ি দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। তাই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের হাওয়া খেয়েই ফিরে গিয়েছিল। এখন আমার মনে হয় আমার ধারণা ভুল ছিল। শুধু হাওয়া খেতেই তারা যায় নি। (অবশ্য আমার ভুল ধারণার পেছনে আমার পড়া অন্য কিছু বই-যেমন, সিসন আর রোজ-এর লেখা ‘ওয়ার অ্যান্ড সেসিশন’-এর প্রভাব ছিল।)
চীন আর রাশিয়াকে নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল আমেরিকা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে তখন আমেরিকার কাহিল অবস্থা। পুরো এশিয়া কম্যুনিষ্টদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাকে যে করেই হোক ঠেকাতে বদ্ধপরিকর নিক্সন প্রশাসন। এই লক্ষ্যে পাকিস্তান তখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহযোগী আমেরিকার। ওদিকে ভারতের ঘাড়ে ভর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্ত অবস্থান নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। নিক্সন-কিসিঞ্জার চীনকে যতটা পারা যায় নিউট্রালাইজ করতে সচেষ্ট। তার পাকিস্তানকে খুব দরকার চীনের ওপরে প্রভাব বিস্তারের জন্য। ভারতের সাথে চীনের দা-কুমড়ো সম্পর্কটাকেও কাজে লাগাতে হবে।
সপ্তম নৌবহর – টাস্ক ফোর্স ‘ও-ক্যালকাটা’
বৈশ্বিক রাজনীতির এই পটভুমিতে সপ্তম নৌবহরের ‘টিএফ ৭৪’ নামে একটা টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন যুদ্ধবিমানবাহী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ছিল এই বহরে। পঁচাত্তরটা বিমান, পাঁচটা হেলিকপ্টার আর পাঁচ হাজারেরও বেশি সৈন্য ধারণ করতো এন্টারপ্রাইজ। ওই টাস্ক ফোর্সে, যার নিক-নেইম ছিল ‘ও-ক্যালকাটা’, আরো ছিল, তিনটা গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, চারটা গান ডেস্ট্রয়ার আর ছিল ট্রিপলি (হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ) পঁচিশটা ‘মেরিন এসল্ট’ হেলিকপ্টারসহ। এন্টারপ্রাইজ আর ডেস্ট্রয়ার চারটা ভিয়েতনামের উপকূল ইয়াঙ্কি স্টেশন থেকে যাত্রা করে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে, ট্রিপলি আর গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারগুলো ফিলিপাইনের সুবিক বে থেকে। হাওয়াই-এর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড, ওয়াশিংটন আর নৌবহরের জাহাজগুলোর মধ্যে ছিল সার্বক্ষণিক রেডিও যোগাযোগ সেই কটা দিন।
ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে, বিজয় দিবসের একদিন আগে, টাস্ক ফোর্স বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। ঢাকা থেকে মাত্র একহাজার নব্বই মাইল দূরে।
এই টাস্ক ফোর্সের তত্বাবধানে ছিলেন সেই জন ম্যককেইন, আশা করি পাঠকের মনে আছে তাঁর কথা, ১৯৬৫-তে ডমিনিকান রিপাব্লিক আক্রমণ করে যে মার্কিন মেরিন বাহিনী, তার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। হয়তো কাকতালীয়। (‘অ্যান্ডারসন পেপারস’ থেকে আরো জানতে পারলাম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন জোসেফ ফারল্যান্ড। ফারল্যান্ডের সাথে ইয়াহিয়ার সম্পর্ক ব্যাক্তিগত বন্ধুত্বে পরিণত হয়। গ্লাসের দোস্ত যাকে বলে! এই ফারল্যান্ডই ১৯৫৭-তে ডমিনিকান রিপাব্লিকে রাষ্ট্রদূত ছিলেন – আর ছিলেন ট্রুহিও-র বিশেষ বন্ধু। সন্দেহ নাই, স্বৈরশাসকদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বেশ পারদর্শী ছিলেন এই ভদ্রলোক। )
তবে সান্তো ডমিঙ্গোতে যেমন, ঢাকার ক্ষেত্রেও তেমনি অজুহাত ছিল, আমেরিকানদের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্যই এই কষ্টস্বীকার। বলা হচ্ছিল ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য সপ্তম নৌবহরের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজের বঙ্গোপসাগরে আগমন। সেই পুরোনো অজুহাত।
শ’খানেক মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন! মশা মারতে কামান দাগা বোধহয় একেই বলে! তার আগে নয়মাস ধরে যে একটা জনগোষ্ঠীর ওপরে নির্বিচারে হত্যযজ্ঞ চালানো হলো, যাকে জেনোসাইড ছাড়া আর কোন ভাবেই বর্ণনা করা যায় না, তা নিয়ে এই পরাশক্তি ছিল নির্বিকার। উপরন্তু ব্যস্ত ছিল হত্যাকারী পাকিস্তানের সাফাই গাওয়াতে।
গ্রেনাডায়ও মার্কিন মেডিকেল ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য আমেরিকা আগ্রাসন চালিয়েছিল। মার্কিন প্রশাসন এই প্রোপাগান্ডাগুলো আসলে করে নিজ দেশের শান্তিকামী জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। বিশ্ব জনমতের থোড়াই কেয়ার করে আমেরিকা! কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি, বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের সময়ে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সহ অনেকেই আমেরিকার পাকিস্তান-প্রীতির কড়া সমালোচক ছিলেন। আমেরিকার সাধারণ জনগণও বাংলাদেশের সমর্থক ছিলেন। মনে পড়ছে একাত্তরের অগাস্টে নিউ ইয়র্কে আয়োজিত সদ্যপ্রয়াত রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা। হাজার হাজার মানুষ গিয়েছিল শুনতে আর সমর্থন জানাতে।
বিজয় দিবস, ১৫ই ডিসেম্বর?
সময় ও সুযোগ আমেরিকার পক্ষে ছিল না একাত্তরের বাংলাদেশে। কিন্তু সেই সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না। অ্যান্ডারসন-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের মুহূর্তটাকে একুশ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়ার জন্য দায়ী মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
নইলে বাংলাদেশের বিজয় দিবস হতো ১৫ই ডিসেম্বর, ১৬ই ডিসেম্বর নয়। হয়তো তাহলে বেঁচে যেতেন আমাদের হতভাগ্য শহীদ বুদ্ধিজীবিরা, যাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ তারিখ রাতে।
সেই কাপুরুষ হত্যাকারীরা রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে খুন করার ওই স্পর্ধা আর সময়টুকু পেত না, যদি মার্কিন দূতাবাস সময়মতো এ.এ.কে নিয়াজির আত্মসমর্পণের বার্তাটা জগজিত সিং অরোরার কাছে সেই দিনই কালক্ষেপন না করে পৌঁছে দিতেন।
ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নিয়াজি ঢাকায় আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসে যান সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিতে চান, কিন্তু পারছেন না। কারণ তার নিজের রেডিও ট্রান্সমিটারটা ভারতীয় বোমার আঘাতে ধ্বংশ হয়ে গেছে। আমেরিকার কন্সাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক প্রটোকল রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর ব্যাপারটা তার কাছে তেমন গুরুত্ব পেল না। স্পিভাক নিয়াজির আবেদনটা পাঠিয়ে দিলেন ওয়াশিংটনে, লাগলো ঘন্টাখানেক। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) নিয়াজির যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন রাষ্ট্রদূত ফারল্যন্ডের কাছে ইসলামাবাদে আর বলে দিলেন জেনে নিতে ইয়াহিয়া এই প্রস্তাবে রাজি আছে কিনা। ঢাকায় সময় তখন ১৫ই ডিসেম্বর রাত সাড়ে তিনটা।
হয়তো ঠিক সেই সময়েই আলবদরেরা সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় তাদের জঘন্য কাজে।
সেই একাত্তরেও মার্কিন সরকারের রেডিও ট্রান্সমিটার টেকনলজি ছিল বেশ উন্নত ও শক্তিশালী। ইচ্ছে করলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে বার্তা পাঠাতে সক্ষম ছিল তাদের সিস্টেম। কিন্তু কি এক রহস্যজনক কারণে তারা অবলম্বন করলো দীর্ঘসূত্রিতার পথ। পরিহাসপ্রিয় অ্যান্ডারসন-এর ভাষ্যানুযায়ী এই বার্তাটা যেন মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল কূটনৈতিক অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পৌঁছে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার।
জাতিসঙ্ঘের মার্কিন প্রতিনিধিদের পাঠানো হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে খুঁজে বের করার জন্য। কাউকে না পেয়ে শেষতক বার্তাটা পৌঁছে দেয়া হয় নয়াদিল্লিতে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং-এর কাছে। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় একটা বাজে। আরো ঘন্টা দুয়েক লাগলো বার্তাটাকে তর্জমা করতে আর উপযুক্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ খুঁজে বের করতে আর শেষমেশ পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং অরোরার হাতে পৌঁছে দিতে।
বাকীটুকু বহুলপঠিত ইতিহাস। নতুন করে লেখার কিছু নাই।
তবে পাদটীকায় এটুকু না বললেই নয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্রান্তিলগ্নে যে দেশের এমন গর্হিত ভূমিকা ছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই ১৯৭৪-এর মধ্যভাগ থেকে সম্পর্ক উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সাহায্যদাতায়। তবে এজন্যে তাজুদ্দীন আহমদকে হারাতে হয় মন্ত্রীত্ব। ‘মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য নেবো না’, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে এমন দম্ভোক্তি করেছিলেন তিনি।
তাজুদ্দীন আহমদ, শহীদ বুদ্ধিজীবি আর মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।
ডিসেম্বর ১৫, ২০১২।
তথ্যের উৎস ওয়েবসাইট আর বইএর তালিকা। ওয়েবসাইটগুলো দেখা হয়েছে নভেম্বর ২০১২-র শেষ দুই সপ্তাহে।
ডমিনিকান রিপাব্লিক হিস্ট্রি, http://dr1.com/articles/history.shtml
হিস্ট্রি অফ দ্য ডমিনিকান রিপাব্লিক, http://www.hispaniola.com/dominican_republic/info/history.php
ডমিনিকান রিপাব্লিকঃ গভর্ণমেন্ট এন্ড পলিটিক্স,
http://www.mongabay.com/reference/country_studies/dominican-republic/GOVERNMENT.html
হিস্ট্রি অফ ইউএস ইন্টারভেনশন্স ইন ল্যাটিন আমেরিকা,
http://www.yachana.org/teaching/resources/interventions.html
দ্য ইনভেশন অফ গ্রেনাডা, http://www.pbs.org/wgbh/americanexperience/features/general-article/reagan-grenada/
Anderson, J., The Anderson Papers, Ballantine Books, New York, 1974.
Sisson, R. and Rose, L.E., War and Secession – Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh, University of California Press, Berkeley, 1990.
Gurtov, M., The United States and the Third World, Antinationalism and Intervention, Praeger Publishers, New York, Washington, 1974.
আর হ্যাঁ, আমি একচোখা সরলরৈখিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আমার দুচোখা বা দুমুখো, বক্ররৈখিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়ার কোন পরিকল্পনা নাই। তবে পয়েন্ট আনতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন, বিতর্কযোগ্য মনে হলে অংশ নেব। :clap :lotpot:
@িশল্পভবন,
এসব বই পুস্তকের ইউটোপিয়ান আবেগ 🙂 পৃথিবীর সব দেশই সব – জাতিই কম – বেশি সাম্রাজ্যবাদী…… কেউ বেশি এবং কেউ কম, পার্থ্যক্য এতুটুকুই। সুযোগ পেলে বাংলাদেশও কম যায়না যেটা একজন বাংলাদেশী হিসেবে এর আলোচনা করা আমার স্কোপের বাহিরে।
“সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী” জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় দেশের তালিকা দেখলে কৌতুক চেপে রাখা যায়না 😀
হ্যাঁ, আমি আসলেই স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পরাশক্তি হবে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে এটা দেখার আমার তীব্র ইচ্ছা 🙂
@সংবাদিকা,
ঠিক বলেছেন (Y) । আমি একমত এই ব্যাপারে আপনার সাথে পুরোপুরি একমত।তবে আলোচনা বাড়াতে চাইনা এই বিষয়ে। কারণ লেখক খুবই সংবেদনশীল বলেই মনে হচ্ছে।কাজেই সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমার মনে হচ্ছে। 🙂
ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নিয়াজি ঢাকায় আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসে যান সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিতে চান, কিন্তু পারছেন না। কারণ তার নিজের রেডিও ট্রান্সমিটারটা ভারতীয় বোমার আঘাতে ধ্বংশ হয়ে গেছে।
– বোল্ড করা অংশটুকু ডাহা মিথ্যা কথা। নিয়াজীর সেনা সদরের রেডিও যোগযোগ ভারতীয় বোমায় ধ্বংস হয়ে যায় কিভাবে? তেমন কোন রেকর্ড নেই, তার সেনা সদরে তেমন কোন বোমাও পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, ১৬ই ডিসেম্বর সকালে সারেন্ডারের শর্ত নিয়ে আলাপ করতে কাদের সিদ্দিকী, জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল নাগরা যখন নিয়াজীর সদর দফতরে যান তখন সে সদর দফতর থেকেই পাক কমিউনিকেশন ব্যাবহার করে জেনারেল জ্যাকব কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে যোগাযোগ করেছিলেন। পাক সেনা সদর থেকেই পুরো বাংলাদেশে ১৫ই ডিসেম্বর থেকে সিজ ফায়ারের বেতার বার্তা প্রচার করা হয়। তারা যে কোন সময় চাইলেই ভারতীয় ফ্রিকোয়েন্সীতে যোগাযোগ করতেই পারত, আন্তর্জাতিক কিছু খোলা ফ্রিকোয়েন্সী সবসময়ই আছে। এমনকি ভারতীয় পক্ষ থেকেও নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সী দেওয়া হয়েছিল। আমি কিভাবে বুঝব কোনটা সত্য ? লিঙ্ক দিন।
২। হয়তো তাহলে বেঁচে যেতেন আমাদের হতভাগ্য শহীদ বুদ্ধিজীবিরা, যাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ তারিখ রাতে।
আদিল দা লিখেসেন,বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয় মূলত ১৪ই ডিসেম্বর ভোররাতে, ১৫ই ডিসেম্বরে নয়। বুঝলাম না ।
৩।আরেকটি ছোট তথ্য, ‘৭১ সালে মার্কিন প্রশাসন পাক বাহিনীর গডফাদার ছিল, তবে অন্যদিকে সেই একই প্রশাসন আবার ভারতীয়দের হাতে বাংগালী শরনার্থীদের খোরপোষ বাবদ বেশ কিছু টাকাও দিয়েছিল, এ মুহুর্তে মনে পড়ে ২০০/৪০০ মিলিয়ন ডলার। যুদ্ধ দেখেনি,তবে বড় হতে হতে দেখেসি মার্কিনীদের চরিত্র,জা এখনও ধরে রেখেসে। ওরা চরিত্রহিন-সবাই জানে,
“ধোঁকা” বিষয়টি আরও হাস্যকর, আমেরিকার মত গণতন্ত্রে তো বটেই। এসব করা হয় আইনি “ট্যাকনিক্যালিটি” বজায় রাখার জন্য যেন “ব্যাড প্রিসিডেন্স” না থাকে কিংবা “অফিসিয়াল লিগ্যাল” ঝামেলা না হয়। এখানে সবচাইতে সাম্প্রতিক উদাহরণ দেওয়া যায় ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে পরিচালিত কম্যান্ডো দলকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে সি-আই-এ তে অস্থায়ী ভাবে নিয়ে আসা।
“শান্তিকামী” / “সাধারণ” জনগণ, এটাও খুব ব্যাপক, অতি সরলীকরণ বোধয় ঠিক হবেনা।
১৯৭১ এ আমেরিকা বাংলাদেশ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তার নিজ বৃহত্তর স্বার্থের জন্য, বাংলাদেশ কে পছন্দ কিংবা অপছন্দের জন্য নয়, সোভিয়েত রাশিয়ার বেলাতেও তাই। ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং পশ্চিমে ৫-৬ টি অঙ্গরাষ্ট্রে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন চলা সত্যেও তারা তৎকালীন পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী অঙ্গরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাহায্য করার ঝুঁকি বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার জন্য করেনি, এখানেও ভারতের স্বার্থ ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া ভারত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশ স্বাধীনতার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন বৈদেশিক ফ্যাক্টর। এটা আসলে অনেকরই হজম করতে কষ্ট হয়।
যাই হোক, যার যে স্বার্থই থাক, আমাদের স্বাধীনতায় যারা আমাদের সাহায্য করেছে সবার কছেই আমরা কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বড়ই জটিল, কেউ কারও চির বন্ধু কিংবা চির শত্রু নয়!
@সংবাদিকা,
যথার্থ বলেছেন। ধন্যবাদ।
এ মুহূর্তে আমি (কয়েক মিনিটের জন্য ) ভগবানে ( কলিম খানের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ অনুসারে ‘ উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিক ) বিশ্বাসী। বিশ্বাসী এ কারণে যে ভগবান ( কিভাবে মিলে যায়) আমাকে কোন একটা লেখায় বিতর্ক চালিয়ে যাবার মত সময় দিয়েছেন।
আপনি বিতর্কে অংশগ্রহণে আগ্রহী, আপনার কাছে আমার প্রশ্নঃ যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হওয়াতে আসলে কার লাভ হয়েছে?
যারা আমেরিকাকে রক্ষা করার জন্য সারা রাত গল্প শুনিয়ে বলে ‘ বলো তো সীতা কার বাপ’? তারা কেমন করে জানবে, খন্দকার মুশকার কার পুত্র, ‘মুজিব বাহিনী কার সন্তান’? কে ছিল তাজউদ্দিন আহমদকে হত্যা করার মূল পরিকল্পনাকারী? তারা কি জানে, কেন পাক-বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো? প্রশ্ন উত্থাপন করার মানে এই নয় যে ‘আমি’ সব জানি।
শেখ মুজিবের আত্মসমর্পণ, তাজউদ্দিনের একটি ভুল সিদ্ধান্ত তাঁকে জনক বা পিতা বা বাবা হয়ে উঠা থেকে বঞ্চিত করতে পারতো? ( মানুষের কথা থাক, আলোচ্য-সূচিতে ওদের না আনাই ভাল)
বিশ্বাসীদের মত মুক্তচিন্তার ( মানে সবাই শুভবুদ্ধির ধারক-বাহক নাও হতে পারেন) লোকেরাও মুক্তভাব-ভঙ্গিতে, কোন পংক্তিতে বসতে গিয়ে, কোন পাখায় ভর করে কোন পক্ষ নিতে গিয়ে, কোন পক্ষী হয়ে ওঠে; চোখ-কান খোলা না-রাখলে সুপারভিশন হয়, দেখা-শুনা হয় না।
আপনি দেখতে চান, শুনতেও চান, তাই ভাল না-লাগার সংগত কারণ আছে।
ধন্যবাদ।
ইরতিশাদ ভাই, লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার লেখা থেকে নতুন কিছু জানা হয় সব সময়ই। এটা থেকেও অনেক তথ্য পেলাম, যা জানা ছিল না। লেখার কিছু অংশ নিয়ে বিতর্ক করা গেলেও ( আদিল মাহমুদ এবং সফিক যেটা করেছেন), একাত্তরে মার্কিনদের ভূমিকা ছিল সেরকমই, আপনি যেটা বলেছেন। তাজুদ্দীন আহমদ ছিলেন বাম শিবিরের লোক, তার মত সাহসী ব্যক্তিত্ব শেষদিকে শেখ মুজিবের যে বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন, তার তো কারণ অবশ্যই আছে।
@অভিজিৎ,
ধন্যবাদ। এই লেখাটা নিয়ে আরো অর্থপূর্ণ বিতর্ক হলে আমি খুশি হতাম।
@ইরতিশাদ,অর্থপূর্ন বিতর্ক বলতে কি বুঝিয়েছেন সেটা স্পষ্ট হলো না। আদিল মাহমুদ মন্তব্যে এন্ডারসন এর বই এর তথ্যের দূর্বলতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন করেছেন সেগুলো এড্রেস করাতে তো আপনার কোনো উৎসাহ দেখা গেলো না। আপনার একচোখা-সরলরৈখিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতা নিয়েও অনেক পয়েন্ট আনা যায় কিন্তু আপনি সেই সব পয়েন্ট নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী মনে হয় না। কেবল পিঠ চাপড়ানো মন্তব্যের উত্তর দিয়ে ই যদি লেখকের দায়িত্ব শেষ মনে করেন তবে কিভাবে অর্থপূর্ন বিতর্ক আশা করেন?
@সফিক,
এই লেখায় আমি এখনো বিতর্কোপোযগী কোন মন্তব্য দেখি নি। কিছু মন্তব্য করা হয়েছে সরাসরি আমাকে উদ্দেশ্য করে, সেগুলোর জবাবে প্রতিমন্তব্য করেছি। ওই মন্তব্যগুলোকে পিঠ চাপড়ানো বলে আপনি মন্তব্যকারীদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। আমি আমার লেখায় সেই মন্তব্যকারীদের কাছে আপনার অনাকাঙ্খিত মন্তব্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
আদিল মাহমুদ বা আপনার মন্তব্যে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছুই বলা হয় নি। আর মন্তব্যের কথাগুলোকে আমার বিতর্কপোযগী মনে হয় নি। আমার মনে হয় নি আমার কিছু বলার আছে।
আদিলের মন্তব্যে আ্যন্ডারসনের তথ্য নিয়ে – আপনার কথানুযায়ী – কোন প্রশ্ন ছিল না। শুধু একটা বিষয়ে ওনার মতামত ছিল। বেশ সুস্পষ্ট মত তিনি দিয়েছেন, বিতর্কের কোন অবকাশ না রেখে। আদিলের মন্তব্যের উত্তরে আপনিও তার সমর্থনে সুস্পষ্ট মত দিয়েছেন। আমার মনে হ্য় নি আমার কিছু বলার আছে।
আপনার বর্তমান মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে আমি বিতর্কে আগ্রহী, বাদানুবাদে নই।
কোথায় প্রতিমন্তব্য করতে হবে আর কোথায় করতে হবে নাআমি মনে করি লেখক হিসেবে সেটা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা আমার থাকা উচিত। লেখকের দায়িত্ব সম্পর্কে আমি সচেতন। মন্তব্যকারী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করুন।
আর হ্যাঁ, আমি একচোখা সরলরৈখিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আমার দুচোখা বা দুমুখো, বক্ররৈখিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়ার কোন পরিকল্পনা নাই। তবে পয়েন্ট আনতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন, বিতর্কযোগ্য মনে হলে অংশ নেব।
@ইরতিশাদ,আপনার লেখার একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা পিছিয়ে দিয়ে আমেরিকান সরকার অন্যান্য গুরু পাপের ওপর আরো একটা পাপ করেছিলো সেই বর্ননা। সেই বক্তব্য যখন পুরোপুরি অসাড় বলে কেউ যুক্তি পেশ করেছে তখন আপনার নিদেন পক্ষে উচিৎ ছিলো সেই বক্তব্যকে গ্রহন করে একটা মন্তব্য করা। সেটা না করে দেখা গেলো আপনি যারা আপনাকে কেবল দুই লাইন প্রশংসাই দিয়ে গেছে তাদেরকে উত্তর দিতেই অনেক আগ্রহী।
আপনি আপনার বিরুদ্ধমতকে এড্রেস করবেন না আবার অর্থপূর্ণ বিতর্ক হলো না বলে আক্ষেপ করবেন, এটা আমার কাছে অসামন্জস্যপূর্ন মনে হয়েছে। আপনি বিতর্ক বলতে কি বোঝেন সেটা জানি না, তবে একে অপরের পিঠ চাপড়ানো বিতর্ক নয়।
@সফিক,
আপনার বর্তমান মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে আমি বিতর্কে আগ্রহী, বাদানুবাদে নই।
@ইরতিশাদ,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি যেভাবে আগ্রাসী হয়েছে তাতে তার সমালোচনামূলক লেখা দুই হাতে লিখে যাওয়া কোন ব্যাপার নয়। তার অবশ্যই দরকারও আছে। কথা হল যে সমালোচনামূলক লেখা চেনা ভিলেনকে যেনতেন ভাবেই হোক এক তরফা বিদ্বেষমূলক ভাব নিয়ে সব কিছুতেই ফাঁসিয়ে দেব এই মনোভাবের বশবর্তী হলে। কথাগুলির উদ্দেশ্য অবশ্য আপনি নন।
আমি ডমিনিকানের কথা জানি না, এন্ডারসন সাহেবের কথা সে প্রসংগে সঠিক হতে পারে। কিন্তু পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের দীর্ঘসূত্রিতায় উনি যেভাবে মার্কিন ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তার ভিত্তি অন্যান্য ক্রশ রেফারেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই দূর্বল বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এন্ডারসন সাহেবকে মনে হয়েছে আগে বিচারের রায় ঘোষনা করে পরে শুনানির ব্যাবস্থা করেছেন। আগে যে গ্রস তথ্যগত ত্রুটি কোট করেছিলাম সেটা আপাত চোখে সামান্য মনে হলেও এতই মোটা দাগের ভুল যা প্রমান করে যে এন্ডারসন সাহেব আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাস্তব দলিল পত্র তেমন গবেষনা করেননি। অবরুদ্ধ পাক বাহিনী কিভাবে আত্মসমর্পন করেছিল, তাতে মার্কিন ভূমিকা কি ছিল (সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন ভূমিকা নয়) এসব বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের বেশ কজন ভাল লেখকের লেখায় বিস্তারিত আছে যার কিছুটা সারাংশ আগে বলেছি, একাধিক লেখকের ভার্ষনে একই কথাই এসেছে। সংক্ষেপে আত্মসমর্পনে মার্কিন ভূমিকা ছিল পুরোপুরি দূতিয়ালীর, চালকের নয়, এবং তারা সেধে সেধে সেই ভূমিকা নেয়নি। দীর্ঘসূত্রিতার জন্য মূল দায়ী ততকালীন পাক জান্তার হতবিহবল ছত্রভংগ অবস্থা, সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা; মার্কিন ষড়যন্ত্র নয়।
পাক বাহিনীর গড ফাদার মার্কিন সরকারের আমাদের শরনার্থীদের জন্য অর্থ সহায়তা কিভাবে মূল্যায়ন করেন? সেটা না করলে তাদের কে কি করতে পারত? মার্কিন গনতন্ত্র নিয়ে অনেকে হাসি ঠাট্টা করেন, এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও পাতানো, সবই করোপরেট বিশ্বের খেলা জাতীয় নানান চটকদার তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে অসীম তৃপ্তি পান। মোদ্দা কথা আমেরিকার তো বটেই, গনতন্ত্রেরও আসলে ভাল বলে কিছু নেই। আমার কাছে মনে হয় শরনার্থীদের জন্য অর্থ সাহায্য সেই পাতানো ধনতন্ত্র গনতন্ত্র যাইই বলা হোক সেটারই জয়। সেই পাতানো গনতন্ত্রের কারনেই জর্জ হ্যারিসন রবি শংকররা মার্কিন রাজপথে আমাদের জন্য অনুষ্ঠান করে টাকা তুলেছেন, সরকার কোন বাধার কথা চিন্তাও করেনি, সাধারন মানুষ নৌকা করে রাতের বেলা যুদ্ধ জাহাজ ঘিরে রেখেছিল যাতে পাকিস্তানে অস্ত্রের চালান না যেতে পারে। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশেও রুশ সাহায্যের তূলনায় মার্কিন সাহায্য এসেছে অনেক বেশী। সেটা বাদ থাক, মার্কিন সমালোচনার সাথে সাথে এই দিকগুলিও কি আলোচনায় আসা উচিত নয়? এত হতাশার পরেও তাই গনতন্ত্রেরই জয়গান গাইতে হয়।
@আদিল মাহমুদ,
কেন এর আগের মেক্সিকান-আমেরিকান এবং স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ কি তারা প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত – দখল মুক্ত করতে করেছিল ???? নেটিভ ইন্ডিয়ান যুদ্ধ বাদই দিলাম!!!!
@সংবাদিকা,
ও তারও অনেক আগের কানাডা আক্রমণ????
(যদিও কানাডার মাতৃদেশ, তৎকালীন বিশ্ব পরাশক্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর কাছে মার্কিন জাতীয় ইতিহাসে সবচাইতে শোচনীয় লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছিল, ভিয়েতনামের লজ্জা এর কাছে কিছুইনা 😀 )
@সংবাদিকা,
কানাডার কাছে মার্কিনিদের শোচনীয় পরাজয়ের কাহিনি আমেরিকান সরকার ও মিডিয়া সযতনে এড়িয়ে যায়, এ জন্যে এর কথা বেশি শোনা যায় না। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সার ধরণ পাল্টেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একরকম, পরে আরেকরকম, এখন তথাকথিত গ্লোবালাইজেশনের যুগে অন্যরকম। কিন্তু চরিত্র পাল্টায় নি।
@সংবাদিকা,
আপনি মনে হয় প্রাসংগিতা ঠিক ধরতে পারেননি। এখানে সামগ্রিকভাবে মার্কিন যুদ্ধের খতিয়ান আলোচনা হচ্ছে না।
বর্তমান কালে মার্কিন সমালোচনার উন্মুক্ত দ্বার খোলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবর্তিত মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কারনে। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ, হামলা এসবের কোন কোণ কালেই কমতি ছিল না। মেক্সিকোর সাথে টেক্সান যুদ্ধ, কানাডার সাথে যুদ্ধ সেসব ছিল অনেকটাই উত্তর আমেরিকা কেন্দ্রিক যুদ্ধ, বিশ্ব জনমত সেসব নিয়ে তেমন তাড়িত হয়নি। একই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে আরো বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বিশ্বের বেশ কিছু বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন এনেছে, ব্রিটিশ সূর্য নিভে গিয়ে মার্কিন এবং রুশ দুই পরাশক্তির মেরুকরন ঘটেছে এরপর। আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র।
@আদিল মাহমুদ,
আপনারও কি মনে হচ্ছে এটা ফ্যালাসিয়াস আর্গুমেন্ট অথরিটি 🙂 লক্ষ্য করুন আমি এই পোষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্যব্য নিচে দিয়েছি 🙂
এখানে আমি শুধুই আপনার একটি মন্তব্যর
সাথে দ্বিমত পোষণ করেছি, কেননা এখনো ওটা একটা চলমান প্রক্রিয়া; মাঝে আমেরিকার বড় কোন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়নি 🙂
ধন্যবাদ
@আদিল মাহমুদ,
ওয়েলকাম ব্যাক। দেশে কেমন কাটলো?
আদিল, আপনি কেন ধরে নিয়েছেন যে নিয়াজির মিথ্যা কথাটা এন্ডারসন (বা স্পিভাক)-এর কথা। নিয়াজি অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এই কারণ দেখিয়েছিলেন, এন্ডারসন বলেন নি এটা সত্য ছিল। আর শুধুমাত্র এই একটা পয়েন্টের (যা যুক্তির বিচারে খুবই দূর্বল) ভিত্তিতে আপনি সিদ্ধান্ত টেনেছেন এন্ডারসনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভুল। নিয়াজির মিথ্যাকে আপনি এন্ডারসনের তথ্যগত ত্রুটি আর মোটা দাগের ভুল মনে করছেন কেন আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না।
নিয়াজির মিথ্যা কোন তর্কযোগ্য পয়েন্ট নয়। তাই এ নিয়ে আগে কথা বলি নি। আপনার মূল পয়েন্টটা যা এখন আরেকটু খোলাসা হলো -আমি যেমন বুঝেছি, হচ্ছে – আমেরিকার আচরণে আপনার ভাষায়, ষড়যন্ত্রের আবিষ্কার। এটা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে। পুলিতজার প্রাইজ পেয়েছে বলে এন্ডারসনকে ছাড়া হবে কেন।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসূত্রিতা করে সময় নিয়েছে এই অভিযোগ আপনি মানছেন না। ভাল কথা। আপনার আগের মন্তব্যে (ডিসেম্বর ১৫, ২০১২) অনেক ‘তথ্য’ আপনি হাজির করেছেন, যদিও কোন তথ্যসূত্র দেন নি। কিন্তু আপনার দেয়া কোন তথ্যই বা ক্রস রেফারেন্স (যার কোন উল্লেখ আপনার আগের বা এখনকার মন্তব্যে নাই) এন্ডারসনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে খারিজ করে না। আপনি বলেছেন উচ্চতর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য সময় না নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কোন উপায় ছিল না। এটা আপনার অপিনিয়ন, এটা তথ্যকে রিফিউট করে না। সময় যে নেয়া হয়েছে তা নিয়ে আপনার দ্বিমত নাই বলেই মনে হচ্ছে।
এবারে আমি কিছু ক্রস রেফারেন্স উল্লেখ করি, আপনার উল্লেখিত জ্যাকব, সালিকও আছেন এতে।
জেনারেল জ্যকবের বই থেকে –
The message, however, was not sent to India but to Washington. At around 1700 hours on 14 December, a diplomat in one of the consular offices in Calcutta apprised me of Niazi’s visit to Spivak regarding what he said were cease fire or surrender proposals…………..Apparently, Spivack had sent the message to their Ambassador in Islamabad who in turn sent it to the State Department in Washington. Kissinger later admitted that the State Department decided to hold on to the message for one more day in order to give the Pakistanis more time to take territory in the west before a cease fire came into effect. (Page 138, Surrender at Dacca, Birth of a Nation, Lt Gen JFR Jacob, The University Press Limited, 1997.)
সিদ্দিক সালিকের বই থেকে –
As soon as the draft was finalized, Mr. Spivack said,’it will be transmitted in twenty minutes.’ General Niazi and Farman returned to Eastern Command leaving Captain Niazi, aide-de-camp to wait for the reply. He sat ther e till 10 p.m. but nothing happened. He was asked to check later, ‘before going to bed’. No reply was received during the night.
In fact, Mr. Spivack did not transmit the message to General (later Field-Marshal) Manekshaw. He sent it to Washington, where the U.S. Government tried to consult Yahya Khan before taking the action. (Page 208, Witness to Surrender, Siddiq Salik, The University Press Limited, 1997.)
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি (নভেম্বর ২০১১) কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেখুন এই লিঙ্কগুলোতে, হয়তো আপনার ধারণা কিছুটা পরিষ্কার হবে এতে –
US delayed Pak surrender in 1971: reportThe report published on the online edition of the daily said the papers show that “the US hostility … during the war with Pakistan was far more intense than known until now”.
The documents show that “the Nixon Administration had kept three battalions of marines on standby to deter India, and that the American aircraft carrier USS Enterprise had orders to target Indian Army facilities”.
……।
Pakistan’s military commander for erstwhile East Pakistan Gen A A K Niazi surrendered on Dec 16, 1971 ending the nine-month fight for freedom, and an independent Bangladesh made its mark on the world map.
However, a six-page note prepared by India’s foreign ministry shows that the Pakistani military commander “told the American consul-general in Dhaka that he was willing to surrender.”
“The message was relayed to Washington, but it took the US 19 hours to relay it to New Delhi. Files suggest senior Indian diplomats suspected the delay was because Washington was possibly contemplating military action against India,” the report said.
US forces had orders to target Indian Army in 1971On December 14, Gen A A K Niazi, Pakistan’s military commander for erstwhile East Pakistan, told the American consul-general in Dhaka that he was willing to surrender. The message was relayed to Washington, but it took the US 19 hours to relay it to New Delhi. Files suggest senior Indian diplomats suspected the delay was because Washington was possibly contemplating military action against India.
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ এক দিন ঝুলিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রমুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে আটকে পড়া মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য এই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়েছিল বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু আসলে এটা ব্যবহার করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল ওয়াশিংটনের। ১৪ ডিসেম্বর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান। পাল্টা জবাব পেতে ১৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। ভারতের জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতদের সন্দেহ, হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্যই ওই কালক্ষেপণ করা হয়েছিল।
এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন।
আপনার মন্তব্যের শেষাংশ নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। মন্তব্যের স্বল্প পরিসরে সেটা সম্ভব নয়। তবুও দেখি চেষ্টা করে। প্রথমত, শরণার্থীদের জন্য মার্কিন সাহায্য প্রসঙ্গে। আবারো আমার অবাক হবার পালা। আমেরিকা থেকে সর্বোচ্চ (ডলারের অংকে) সাহায্য পায় যে দুটো দেশ, ইস্রায়েল এবং ইজিপ্ট – দুটো পরস্পরবিরোধী দেশ, কেন? আমেরিকা থেকে পাকিস্তান এবং ভারত, দুটো বৈরীভাবাপন্ন দেশ, সামরিক সাহায্য পায়, কেন? এসবের উত্তর কি আপনি আসলেই জানেন না?
একাত্তরে বাংলাদেশি শরণার্থীদের দু-চারশ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আমেরিকা যদি ইন্দিরা গান্ধীর মুখ বন্ধ রাখতে চেষ্টা করে তাতে আমার অবস্থান পাল্টায় না। আমার মূল্যায়ন বদলায় না। মার্কিন প্রশাসন আমার কাছে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যায় না।
আর একটা কথা, আমার লেখায় সাধারন প্রতিবাদী মার্কিন জনগণের (সিনেটর কেনেডি, ঢাকাস্থ দূতাবাসে কর্মরত আর্চার ব্লাড সহ আরো অনেকেরই) সহানুভূতি ছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি। আপনার মন্তব্যে মনে হচ্ছে এর কৃতিত্বও আপনি মার্কিন সরকারকেই দিতে চাচ্ছেন। আমার কাছে প্রতিবাদী মার্কিন জনগণ আর আগ্রাসী মার্কিন প্রশাসন-সরকার দুটো পরস্পরবিরোধী সত্ত্বা। আপনার যুক্তিটা এখানে ঠিক ধরতে পারছি না। ধনতন্ত্র-গণতন্ত্রের (যদিও দুটো সমার্থক নয়) জয়গান গান, যত খুশি। তবে তন্ত্রমন্ত্রের নামে অনাচার মেনে নেবেন কেন?
অনেক হলো, উইকেন্ডটা আপনার ভাল কাটুক এই কামনায়।
@ইরতিশাদ,
ইরতিশাদ ভাই,
দেশ সফর ভালই হয়েছিল, শুধু জার্নি বড় বেশী টায়ারিং ছিল, আর কিছুটা অসূস্থও ছিলাম যাবার পথে।
এবার আলোচনায় আসি। আপনি আপনার বা এন্ডারসন সাহেবের মূল্যায়নের সমর্থনে যেসব তথ্য সূত্র দিয়েছেন সেসবের সাথে আমিও কম বেশী পরিচিত। তবে বলাই বাহুল্য কনভিন্সড নই, কেন নই তা বিস্তারিত বর্ননা করব। আপনি সূত্রও চেয়েছিলেন, আরো একজন মার্কিন সমালোচক ভাই নীচে দেখি সূত্র দাবী করছেন তাই বিস্তারিত সূত্র দিয়েই কথা বলতে হবে। আমার মূল সূত্র আসলে আপনারই ব্যাবহার করা সূত্র, এসবের খুটিনাটি ব্যাখ্যা (গ্রহন/বর্জন) অন্য দুয়েকটি সূত্রেও হালকার ওপর যেতে হবে।
প্রথমে ইতিহাস, তথ্য সূত্র বাদ দিয়ে খুব সাধারন দুয়েকটি বিষয়ে মতৈক্য দরকার, নইলে আলোচনা অর্থহীন। যে কোন আলোচনা/চুক্তিতে যত বেশী পক্ষ জড়িত হয় দেরী হয় ততই বেশী এটা তো মানবেন? এর নিয়ে কি কোন বিতর্ক হওয়া উচিত? দুই পক্ষের মধ্যে যে আলোচনা সরাসরি শুরু হতে পারত সে ক্ষেত্রে এক পক্ষ যদি তৃতীয় আরেক পক্ষের ভায়া আলোচনা শুরু করে সেক্ষেত্রে দেরী করার মূল দায় মূলত কার ওপর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন? যুক্তিবাদী হিসেবে আগে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিবেচনায় আনা উচিত নাকি এই অতি মৌলিক ভাবনাগুলি মনে আসা উচিত বলে মনে করেন?
আমার ব্যাক্তিগত ধারনা পুলিতজার পাওয়া এন্ডারসন সাহেব, এবং পরে আরো অনেক গবেষক বড় মাছ শিকারের জোশে এই অতি মৌলিক প্রশ্ন ইচ্ছেকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন। তার প্রমান হল নিয়াজীর কমিউনিকেশন ভারতীয় বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে এই হাস্যকর মিথ্যাচার এন্ডারসন সাহেব বিন্দুমাত্র যাচাই করেননি (যাচাই করেছেন কিন্তু মিথ্যাচার সম্পর্কে মন্তব্য করেননি এমনও হতে পারে, বলতে পারি না, পুলিতজার পাওয়া কারো সম্পর্কে আমি ব্লগের আদিল এমন অভিযোগ করে বিপদে পড়তে চাই না)। আপনি বলতে চেয়েছেন যে এই তথ্য এন্ডারসন সাহেবের নিজের নয়, নিয়াজীর কথা। আপনার লেখায় সেটা পরিষ্কার নয়, যদিও পড়ে মনে হয় এটা এন্ডারসন সাহেবের বিশ্লেষন। ১৪ই ডিসেম্বর নিয়াজী ফরমান কি পরিস্থিতিতে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে ধ্বর্না দেয় তার বর্ননা একাধিক সূত্রে আছে। সেসব কোন সূত্রে নিয়াজীর মুখে এই হাস্যকর মিথ্যাচারের রেফারেন্স আমি এখনো পাইনি। আপনি পেলে জানাতে পারেন। নিয়াজীর ভুরি ভুরি মিথ্যাচারের রেকর্ড আছে, তাই বলে এমন ছেলেমানুষী মিথ্যাচার তার পক্ষেও সম্ভব বলে মনে হয় না। বলে রাখা ভাল যে এই এন্ডারসান পেপারের রেফারেন্স আমি এই প্রথম নয়, আজ থেকে ২০ বছরেরও আগে প্রথম দেখি ভারতীয় সাংবাদিক D.R. Mankekar এর Pakistan Cut To Size বইতে। সেখানেও এই লাইনটি আছে যে Gen. Niazi sent the message through US channels, because he had no other ways of communicating with India. পড়লে কি মনে হয় এটা নিয়াজীর ভাষ্য? পরিষ্কারই তো মনে হয় যে এটা এন্ডারসন সাহেবের নিজেরই বক্তব্য। এখানেও নিয়াজীর বা কারো রেফারেন্স নেই, এমনকি according to Niazi গোছের কোন কথাই নেই। একজন পাঠক কিভাবে এক্ষেত্রে বুঝতে পারে এই কথা আসলে নিয়াজীর, এন্ডারসন সাহেবের নিজের নয়?
সে যাক, এই তত্ত্বীয় তর্ক বাদ দিলেও একজন ভাল বিশ্লেষকের কি বোঝা উচিত ছিল না যে এই কথাটা নিরেট মিথ্যাচার? আমরা শখের ব্লগার এক মিনিটে যে মিথ্যাচার ধরতে পারি এন্ডারসন সাহেবের মত ঘাগু কলামিষ্ট সেটা পারেননি? এত বড় হাস্যকর মিথ্যাচার (ধরে নিলাম যে নিয়াজীর কথা, এন্ডারসন সাহেবের কথা নয়) সম্পর্কে সম্পূর্ন নীরবতা পালনের কারন কি? আমার নিজের মনে হয় কারনটি হল এক তরফা মার্কিন পক্ষের ওপর দায়টা চাপানো। কারন ধারনা দেওয়া গেল যে কমিউনিকেশন বিহীন পাক পক্ষ ছিল নিরূপায়, মার্কিন ভায়া যাওয়া ছাড়া বেচারাদের ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগের অন্য কোন উপায় ছিল না। নিয়াজী নিজের ভারতীয়দের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারত এটা প্রকাশ হয়ে গেলে এক তরফা মার্কিনীদের ওপর দায়টা চাপানো মনে হয় তেমন যুত হয় না। আমি এ কারনেই এ কথার ওপর জোর দিয়েছি বেশী, আপনি যা তেমন গুরুত্বপূর্ন বলে মানতে চাইছেন না।
ইতিহাস বলে যে নিয়াজীর কমিউনিকেশন ব্যাবস্থা ছিল সম্পূর্ন অক্ষত যা ব্যাবহার করে এমনকি তারা ভারতীয় কিছু মেসেজও ইন্টারসেপ্ট করতে পারত, এমনকি ১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজীর সদর দফতর থেকে জেনারেল জ্যাকব পাক কমিউনিকেশন ব্যাবহার করে ভারতীয় ইষ্টার্ন কমান্ডের সাথে যোগাযোগ করেন (সারেন্ডার এট ঢাকা- পৃষ্ঠা-১১৮)। আরো মজার ব্যাপার হল যে যুদ্ধ বিরতী বা সারেন্ডার যাইই বলা হোক না কেন সেটা ১৪ই ডিসেম্বরের বহু আগ থেকেই শুরু হয়েছিল। রাও ফরমান আলী আগেই মার্কিন কনসাল এমনকি সরাসরি নিউ ইয়র্কের সাথে সাথে দেন দরবার করেছিল। Farman Ali had already talked to the American Consul General and had even been in touch directly with New York about the prospects of an settlement (Private Life of Yahya Khan – Dewan Berindranath) ফ্যান্টাসী জগতে থাকা নিয়াজী এবং পিন্ডির জান্তারা এতে সম্মত ছিল না বলে এই প্রস্তাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। নিয়াজী এমনকি তার নিজের লেখা “বিট্রেয়াল অফ ইষ্ট পাকিস্তান” বইতে একাধিকবার অভিযোগ করেছে যে ফরমান আলী তার অগোচরে এমনকি ভারতীয়দের সাথেও সরাসরি যোগাযোগ করে। সে যাইই হোক, ফরমানের প্রস্তাবনা আগেই গ্রহন করা হলে যুদ্ধ কি আরো আগেই শেষ হয়ে যেত না? ফরমানের প্রস্তাবনা ঠিক কত তারিখে এটা নিশ্চিত জানা না গেলেও ১২ই ডিসেম্বরের আগের কথা যা সিদ্দিক সালিকের রেফারেন্সে জানা যায়। সিদ্দিল সালিকের Witness to Surrender এর ২০৬ পৃষ্ঠা থেকে (১২ই ডিসেম্বরের বর্ননা), What General Farman opposed….His earlier signal on the same subject had been rejected by Rawalpindi – once bitten, twice shy. এ ছাড়াও গভর্নর মালিককে ইয়াহিয়া সর্বময় সিদ্ধান্ত দেবার ক্ষমতা দেবার পর সে ঢাকায় উপস্থিত ইউএন এসিষ্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারী পল মার্ক হেনরীর মাধ্যমে যুদ্ধবিরতী শুরু করার আবেদন জানায় ডিসেম্বরের ১০ তারিখে, যা যথারীতি পিন্ডি জানতে পেরে ১৩ই ডিসেম্বর অস্বীকার করে প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দেয় (একই বই, পৃষ্ঠা ১৯৯)। ইয়াহিয়া, নিয়াজী, ফরমান, গভর্নর মালিক এদের কারো মধ্যেই আসলে কোন সমন্বয় ছিল না, বাস্তবতা সম্পর্কেও ধারনা ছিল না। স্রেফ গোয়ার্তূমি করে যুদ্ধ বেহুদা বাড়িয়েছে এতে কি তেমন সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ থাকে? ১৪ই বা ১৫ই ডিসেম্বরের অপেক্ষা করার, মার্কিন পক্ষকে মেসেঞ্জার মানার আবশ্যিকতার কি আদৌ প্রয়োযন পড়ত? যুদ্ধ অহেতুক বিলম্বিত করার মৌলিক প্রশ্ন আসলে এসব এড়িয়ে ১৪/১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মার্কিন প্রটোকলের দেরী খুব বেশী গুরুত্বপূর্ন বলে প্রতীয়মান হয়? এন্ডারসন সাহেব আমেরিকান হিশেবে নিজ দেশের সরকারের সমালোচনার স্বার্থে শুধু মার্কিন গলদ বড় করে দেখতে পারেন তাতে দোষ নেই, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে বিলম্বের কারন কোন পক্ষের বলে মনে হয়?
তৃতীয় পক্ষের নিজেদের ভেতর আলোচনার জন্য সময়, তাদের নিজস্ব স্বার্থে নানান দেন দরবার এসব কি সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায় না? সেই তৃতীয় পক্ষ কি ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মত দায় নিয়ে বার্তা পৌছে দেবে এমন আশা করা যায় কিংবা তারা কাছে সে ব্যাপারে দায়বদ্ধ? এটা নিয়াজী ফরমান আলী জানত না? এছাড়া কূটনৈতিক প্রটোকল/ফর্মালিটি এসবের চিন্তা করা উচিত নয় কি? তাদের আত্মসমর্পন (প্রস্তাব দিয়েছিল অবশ্য সমর্পন নয়, বিরতীর) প্রস্তাব ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস কি আদৌ সরাসরি তাদের বৈরী ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছানোর জন্য কূটনৈতিক প্রটোকলে অনুমোদিত? আমার কূটনৈতিক রীতি সম্পর্কে ধারনা নেই তবে যতদুর মনে হয় তারা এমন করার ব্যাপারে অনুমোদিত নয়, দূতাবাস জাতিসঙ্ঘের কোন মিশন নয় যে তারা যার তার সাথে যখন খুশী যা ইচ্ছে আলোচনা করতে পারে। দূতাবাসের ভায়া মানেই নানান ফর্মালিটি, তাদের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের অনুমোদনের প্রশ্ন এসব খুবই স্বাভাবিক নয় কি, বিশেষ করে যে প্রশ্ন নিয়ে বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি সেখানে? যতই পিরামিড বড় হবে দেরীর মাত্রাও বাড়বে। আজকে পাক ভারত যুদ্ধ বাধলে দিল্লীর বাংলাদেশ দূতাবাসকে দুতিয়ালীর প্রস্তাব কোন পক্ষ দিলে আমাদের রাষ্ট্রদূত নিজ থেকে মাতব্বরী করে কূটনৈতিক প্রটোকল বাদ দিয়ে যুদ্ধরত কোন সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ শুরু করে দেবেন নাকি আগে ঢাকার সাথে যোগাযোগ করবেন?
মার্কিন পক্ষকে এক হাত নেওয়া সকলেই খুব জোর দিয়ে এ কথাটি বলে থাকেন As soon as the draft was finalized, Mr. Spivack said,’it will be transmitted in twenty minutes.’…স্পিভাক কি ২০ মিনিটের মধ্যে এটা ভারতীয় সেনা প্রধানের কাছে পাঠাবেন এমন কথা বলেছিলেন? আমার ধারনায় একজন কূটনীতিক হিশেবে তার যা করনীয় তিনি তাইই করেছিলেন, আগে ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। যতটা জানা যায় এই বার্তা ওয়াশিংটনে আরেক দফার সলা পরামর্শের পর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এক কে ঝার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাপ্রধানের কাছে পৌছে। ওয়াশিংটনের ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট কি ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে যোগাযোগ করবে? কূটনৈতিক রীতিনীতির কথা কিভাবে অস্বীকার করা যায়?
এই কথাগুলির সারমর্ম সংক্ষেপে আগেই বলেছিলাম,
আপনার দেওয়া দুই নিউজ মিডিয়ার ১৯ ঘন্টার দেরী বিষয়ক হেডিংগুলি খুবই চিত্তাকর্ষক, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য নেই যেগুলি জানা গেলে হয়ত অতটা আকর্ষনীয় বলে নাও মনে হতে পারে। স্পিভাকের বার্তা ওয়াশিংটনে পৌছার পর কেন কয়েক ঘন্টা দেরী হল? এমনকি জ্যাকবের বইতে আছে যে পরে কিসিঞ্জার বলেছে যে, “ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট বিষয়টি একদিন ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে যুদ্ধবিরতী কার্যকর হবার আগে পাকিস্তানীরা পশ্চীমে আরো কিছু এলাকা দখল করে নিতে পারে”। এই তথ্য দেরী বিষয়ে আপনার সপ্তম নৌবহরের হামলা তত্ত্ব সমর্থন করে না যদিও আরেকটি হাস্যকর রকমের মিথ্যা অজুহাত এটা। কারন ইতিহাস বলে যে ’৭১ সালে পশ্চীম সেক্টরেও পাকিস্তান ভারতের ভূখন্ড দখল তো দূরের কথা নিজেদের ভূখন্ড হারিয়ে বসেছিল যে সিমলা চুক্তির পর উদ্ধার হয়। তার পরিমান নিয়াজীর কথায় ৫ হাজার বর্গমাইল, কোন সূত্রে ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। কিসিঞ্জার সাহেব একদিনের মধ্যে আসমান থেকে ফেরেশতা নামিয়ে ভারতীয় ভূখন্ড দখলের আশায় ছিলেন?
এবার ওয়াশিংটনের দেরীর সম্ভাব্য যৌক্তিক ব্যাখ্যায় আসি। There is also a story told me by a top American diplomat which says that President Nixon wanted badly to get in touch with General Yahya Khan on December 14 to secure an arrangement…..Yahya, however was so drunk and out of his sense that he banged the phone from the American Ambassador saying, “I do not need your bloody good offices to arrange for a surrender” (Private Life of Yahya Khan). একই রকমের কথা সিদ্দিক সালিকের বইতেও আছে, “US Government tried to consult Yahya Khan before taking any action. But Yahya khan was not available. He was drowning his sorrows somewhere. এমনকি আমাদের এম আর আখতার মুকুলের “আমি বিজয় দেখেছি” বইতেও ইয়াহিয়া মদ নারীতে আসক্ত ছিল বলে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলা আছে। দেশ যেখানে ডুবছে সেখানে ইয়াহিয়া মদ নারী নিয়ে মত্ত থাকায় তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না সেই দায়ও মার্কিন হতে পারে? ইয়াহিয়ার পান করা মদ আমেরিকান ছিল তাই? ভিন্ন ভিন্ন তথ্যসূত্র আমিইই বা উড়িয়ে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে মেতে উঠি?
সপ্তম নৌবহর দিয়ে হামলা করার খায়েশ ছিল তাই সারেন্ডারে দেরী করানো হল? তো সেই হামলা আর কেন হল না, দেরী তো করানো হয়েছিলই? সপ্তম নৌবহর কয়টি গোলা ছুড়েছিল ভারতীয়দের ওপর? আরেকটি ডেড আর্গুমেন্ট। সপ্তম নৌ-বহর ছিল আসলে মনস্তাত্তিক চাপের চেষ্টা, আমেরিকার সিরিয়াস যুদ্ধের ইচ্ছে আসলে ছিল বলে ভারতীয়রাও বিশ্বাস করেনি। এটা ঠিক যে ভারতীয়রা চিন্তিত হয়েছিল ঠিকই (যেগুলি ভিত্তি করে আপনার দুই নিউজ লিনক ১৯ ঘন্টা দেরীর পেছনে সপ্তম নৌবহর লেলিয়ে হামলার তত্ত্ব সাজিয়েছে) তবে চুড়ান্তভাবে সপ্তম নৌবহরকে তারা থ্রেট হিশেবে নেয়নি যা জ্যাকবের বয়ানে আছে। জ্যাকবের বই এর ১০৯ পাতায়, “েডমিরাল কৃষ্মন একদিক টাষ্কফোর্সের গতিবিধি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করলে আমি আমেরিকান হস্তক্ষেপের কোন আশংকা দেখি না বলে মত প্রকাশ করি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তাদের এই গতিবিধির উদ্দেশ্য হল আমাদের আমাদেরকে একটু ভয় দেখানো”। জ্যাকবের কথা যে সত্য তাতো ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। ভারত মহাসাগর থেকে সোভিয়েত নৌবহর আসছে এই সংবাদ মার্কিনীরাও ভালই জানত। তাদের সপ্তম নৌবহর দিয়ে হামলা করার জন্য ১৯ ঘন্টা বার্তা পৌছানোর তত্ত্ব খুবই দূর্বল।
এর চেয়ে বরং বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড সঙ্ঘটনে সময় দেবার জন্য মার্কিন ষড়যন্ত্র তত্ত্বও কিছুটা যৌক্তিক মনে হয়।
আমার নিজের ধারনা ইয়াহিয়ার প্রতি ব্যাক্তিগতভাবে কিসিঞ্জার এত দূর্বল ছিল যে ইয়াহিয়ার চারিত্রিক দূর্বলতা বিষয়ক কিছু সে অফিশিয়ালী প্রকাশ করতে চায়নি।
সংক্ষেপে, আত্মসম্পর্ন দেরী করানোতে কি মার্কিনীদের কোনই ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে। তারা যে মুহুর্তে এর অংশ হয়েছে তখন থেকেই ১ ঘন্টা দেরী হলেও মার্কিন দায় পড়ে যায়। কথা হল তুলনামূলক বিচারে পাক এবং মার্কিন, দুই পক্ষের মধ্যে দায় এর বিভাজন কতটা হওয়া উচিত? ১০-৯০, ৫০-৫০, নাকি ৯০-১০? এন্ডারসন সাহেব আমেরিকান, তিনি দায়বদ্ধ তার সরকারের ভুল ত্রুটি ধরানো, সেটা করার স্বার্থে তাকে হয়ত এক তরফা কাজটি করতে হয়েছে কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দায় আমার মনে হয় পাক পক্ষেরই দায় অনেক অনেক বেশী। নানান তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক বা বাদ দিলেও এটা জলের মত পরিষ্কার যে তারা ১৪ তারিখ চাইলে মার্কিন ইনভলমেন্ট বাদ দিয়ে নিজেরা সরাসরি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারত যা তারা করেনি, তাতে করেই সময় কমে আসত নিশ্চিত; এতে কোনই সংশয় প্রকাশ করা যায় না। তারা নিজেদের মান বাঁচাতে এবং দর কষাকষিতে সাহায্যের জন্য মার্কিন ভায়ার প্যাঁচালো প্রসেসে যায়। এটাও পরিষ্কার যে মার্কিনীরা এই দায় নিজেরা সেধে সেধে নেয়নি, নিতে তেমন ইচ্ছুক বলেও মনে হয়নি। স্পিভাক এমনকি সারেন্ডার নেগোশিয়েট করার পাক প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন, কেবল মাত্র বার্তাবাহকের ভূমিকা নিতেই নিমরাজী হন। মার্কিনীদের এত এত ষড়যন্ত্র মনে থাকলে তাদের তরফ থেকেই আগে এই দায় আগ বাড়িয়ে নেবার কথা নয় কি? সপ্তম নৌবহর দিয়ে হামলা চালানোর চিন্ত ১৪ তারিখেই হঠাত তাদের মাথায় আসল এটা সূস্থ মাথায় চিন্তা করা যায়?
শরনার্থীদের মার্কিন সহায়তা বিষয়ে আমার কথা আরেকজনকে বলেছি। মার্কিন তোষন বা নিন্দার প্রশ্ন নয়। এটাই হলে গনতন্ত্রের বিজয়। নীতিগত ভাবে বিরোধী নিক্সন প্রসাশনকেও অন্তত নিজ দেশের মাটিতে সেই ৪০ বছর আগেও জনমতকে শ্রদ্ধা করতে হয়েছে, এটাই ছিল আমার পয়েন্ট, টাকা পয়সার চুলেচেরা হিসেব নয়। মার্কিন দেশ নিয়ে কটাক্ষ, সমালোচনা অনেক করা যায়, তবে প্রাসংগিকভাবে ভাল কিছু থাকলে সেটাও স্বীকার করা দায়িত্ব বলেই মনে করি। বাংলাদেশের বৈরী আরো অনেক দেশই ছিল, আরব চীন কোন দেশে তেমন সম্ভব হত না।
@আদিল মাহমুদ, অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন (Y) ।এটা একটা মন্তব্য না হয় লেখা হতে পারত!অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে।তাহলে বাংলাদেশে এসেছিলেন এই অবসরে!আশা করি সময় ভাল কেটেছে আপনার। 🙂
আচ্ছা এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে, আর তা হল যে, যদি সোভিয়েত নেভী না আসতো তাহলে কি আমেরিকা সপ্তম নৌবহর লেলিয়ে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াত? নাকি সপ্তম নৌবহর আসলে সোভিয়েত কে এক হাত দেখে নেয়ার জন্যই, তথা সোভিয়েত বলয়ে যেন স্বাধীন বাংলাদেশ ঢুকে না যায় সেটার জন্যই আই ওয়াশ মাত্র? ব্যপারটা আমাকে যথেষ্ট ভাবিয়েছে অনেকবার। আপনার কি মনে হয়?আপনার মতামত আশা করি এ বিষয়ে;যদিও অফটপিক হয়ে যাবে হয়ত ব্যপারটা।
@আদিল মাহমুদ,
সময়ের অভাব, তাই আপনার উল্লেখিত সবকিছু আলোচনায় আনবো না। আর মনে হয় তার খুব একটা দরকারও নাই। কারণ এখন বিতর্কটা আর ফ্যাক্ট নিয়ে নয়, ফ্যাক্টের ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে। তবু পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে কয়েকটা কথা বলতে হচ্ছে।
আবারো আপনি সেই একই কথা বলছেন। মার্কিনিরা ভারতীয়দের কাছে বার্তা পৌছাতে আঠারো-ঊনিশ ঘণ্টা দেরি কেন করলো তার জাস্টিফিকেশন দিচ্ছেন। এটাতো আপনার মত। এন্ডারসনের সাহেবের এবং আরো অনেকেরই মত (আমার মন্তব্যে দেয়া রেফারেন্সগুলোতে এটাই পরিষ্কার হওয়া উচিত যে এন্ডারসনের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ তার একার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, অনেকের কাছেই তার তত্ত্বকে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে।) হচ্ছে মার্কিনীরা সময় নিয়েছে ডেলিবারেটলি। আমি এন্ডারসন সাহেবের মতটা গ্রহন করেছি। আপনি বর্জন করেছেন। এ নিয়ে তর্কের তো আর কিছু দেখি না।
তবুও বলি, পাকিস্তানীরা যে দায়ী নয় তা তো বলা হচ্ছে না। বরং এটাই ধারনায় আসা উচিত যে, পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পনে দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন পাকিস্তান আর মার্কিন কর্তৃপক্ষের যোগসাজসেই কার্যকর হয়েছে। আপনি বার বার বলছেন, নিয়াজিকে দোষ না দিয়ে মার্কিনীদের কেন দেয়া হলো। আরে, এখানে তো তারা মাসতুতো ভাই ছিল, এটা কেন বুঝতে চাচ্ছেন না। কোন ভাই কত পার্সেন্ট দায়ী, (আপনার মন্তব্য থেকে, “কথা হল তুলনামূলক বিচারে পাক এবং মার্কিন, দুই পক্ষের মধ্যে দায় এর বিভাজন কতটা হওয়া উচিত? ১০-৯০, ৫০-৫০, নাকি ৯০-১০?”) তাতে আপনার উৎসাহ থাকলেও এপারেন্টলি এন্ডারসন সাহেবের ছিল না।
তা আপনার মনে হতে পারে। তবে এটা মৌলিক কোন প্রশ্ন নয়। এই প্রশ্নটা এড়িয়ে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে যদি অভি্যোগ আনা না যেতো, তাহলে আপনার কথায় যুক্তি আছে মানতে হতো। কিন্তু নিয়াজি মিথ্যা বলেছে এটা এন্ডারসন উল্লেখ করলেও বা মানলেও তার অভিযোগের ভিত্তি দূর্বল হয় না। তাই নিয়জির কথা যাচাই করার জন্য এন্ডারসন সময় নষ্ট করেন নি। সে জন্যই বলছিলাম আপনার যুক্তিটা এন্ডারসনের তত্ত্বকে খারিজ করে না।
কারন হচ্ছে যে, আবারো বলছি, এটা এন্ডারসনের লেখার সেন্ট্রাল পয়েন্ট নয়। সে জন্যই এটা এন্ডারসন বা আমার কাছে গুরুত্ব পায় নি। এটা যে মিথ্যা তা বলাই বাহুল্য। এন্ডারসন লিখেছেন,
এটাকে কি এন্ডারসনের কথা মনে হয়? আমার মনে হয় নি। (আপনি মনে হয় এটা আগে পড়েন নি, এন্ডারসনের কথাটা আরেকজনের বয়ানে পড়েছেন। তবুও আপনার মনে হতে পারে যে কথাটা এন্ডারসনের বানানো। ওই যে বললাম, পার্থক্যটা ইন্টারপ্রিটেশনের।)
এন্ডারসন নিয়াজির কথা সত্য তাও বলেন নি। নিয়াজির কথা সত্য না মিথ্যা তার ওপরে এন্ডারসনের মার্কিন দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ নির্ভরশীল নয়। ধরে নেয়া যায়, কথাটা এন্ডারসন মার্কিন সূত্র থেকেই শুনেছিলেন। তারাই বা যে মিথ্যা বলেন নি, কে জানে? হতেও তো পারে যে, ‘নিয়াজি তোমাদের কাছে আসলো কেন?’ এই কথার জবাবে স্পিভাক বলেছিলেন, তার ট্রান্সমিটার ভেঙ্গে গেছে তাই। মোদ্দা কথা, মার্কিনীরা সময় নিয়েছিল কি না। এটাই হচ্ছে সেন্ট্রাল পয়েন্ট, মৌলিক প্রশ্ন। নিয়াজির মিথ্যা কথাটা নয়।
আপনি এন্ডারসনের একটা মোটিভ আবিষ্কার করেছেন। আপনি ধরে নিয়েছেন, মার্কিনিদের ওপরে দায় চাপালে পাকিস্তানীরা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। অতি সরলীকৃত ভুল ধারণা। আপনার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হলো এন্ডারসনের বই-এর বাংলাদেশ, বার্থ বাই ফায়ার, অধ্যায়টা পড়েন নি, পড়লে বুঝতে পারতেন, পাকিস্তানীদের নিরুপায় প্রমাণ করার কোন অভিপ্রায় নিয়ে তিনি ওটা লিখেন নি। পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ যে আমেরিকার ‘সন অব এ বিচ’ ছিল তা এন্ডারসনের লেখায় খুব ভাল ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ছে।
(‘ইয়েস, হি ইজ আ সন অব আ বিচ, বাট হি ইজ আওয়ার সন অব আ বিচ’, কথিত আছে যে, ডমিনিকান রিপাব্লিকের স্বৈরশাসক ট্রুহিও সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই কথাটা বলতেন।)
আমার দেয়া সাম্প্রতিক রেফারেন্স থেকেও আপনার বোঝার কথা ছিল যে, ভারতীয়দেরই অভিমত হচ্ছে দীর্ঘসূত্রিতা মার্কিনীদের ইচ্ছাকৃত। তারাও কি তাহলে পাকিস্তানীদের দায় থেকে রেহাই দিতে চাচ্ছে?
মার্কিন পক্ষকে এক হাত নেওয়া সকলেই খুব জোর দিয়ে এ কথাটি বলে থাকেন As soon as the draft was finalized, Mr. Spivack said,’it will be transmitted in twenty minutes.’…স্পিভাক কি ২০ মিনিটের মধ্যে এটা ভারতীয় সেনা প্রধানের কাছে পাঠাবেন এমন কথা বলেছিলেন? আমার ধারনায় একজন কূটনীতিক হিশেবে তার যা করনীয় তিনি তাইই করেছিলেন, আগে ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন।
সকলেই? এই কথাটা সিদ্দিক সালিকের, যাকে আগে আপনি সাক্ষী মেনেছিলেন। । আপনার স্পিভাককে ডিফেন্ড করার প্রয়াসটা হাস্যকর। (আগেই বলেছি, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, নিয়াজি বোধহয় ট্রান্সমিটার ভাঙ্গার কথা বলেন নি, ওটা স্পিভাকই মনে হয় বানিয়ে বলেছিলেন সাংবাদিকদের, যেখান থেকে এন্ডারসন পেয়েছেন। আমি সিওর না, তবে এটা প্লসিবল।)
যে তথ্যগুলো আপনার অবস্থানের পক্ষে, সেগুলো হয়তো নেই। আর যে তথ্যগুলোকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন এবং আপনার দীর্ঘ মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন, সেগুলোকে আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি আমার এই আলোচনার প্রেক্ষিতে।
আপনার মতে ‘হাস্যকর রকমের মিথ্যা এই অজুহাত’টা কে দিয়েছিলেন যেন? ভারতীয় জ্যাকব বলছেন, এই কথাটা মার্কিনী কিসিঞ্জারের। কেন তারা এই অজুহাত দিতে গেলেন? পাকিস্তানীদের দায় থেকে অব্যাহতি দিতে? কিছুক্ষণ পরেই আবার এই জ্যাকবেরই কিছু কথা আপনার কাছে সত্য মনে হয়েছে!
সপ্তম নৌবহরের হামলা তত্ত্বটা আমার কাছে গ্রহনযোগ্য। (যদিও আরেকটা ধারণা, যেটাকে মিথ্যা অজুহাত বলছেন, তা দিয়ে এই তত্ত্বটাকে আপনি উড়িয়ে দিতে চাইছেন।) তবে ওটা একটা তত্ত্বই। আপনি না মানেন, ঠিক আছে।
ঘুরে-ফিরে কিন্তু আবারো ওই দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপারটাই এখানে সেন্ট্রাল পয়েন্ট। কেন দীর্ঘসূত্রিতা এ নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেছেন, মার্কিনীরা হামলা করার সুযোগ চেয়েছিল, কেউ বলেছেন, মার্কিনীরা পাকিস্তানীদের পশ্চিমাংশে হামলার জন্য সময় দিতে চেয়ছিল, কেউ বলেছেন, বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্য এটা করা হয়েছিল। এটা ‘অল অব দ্য এবাভ’ ও হতে পারে। বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সময় যে নেয়া হয়েছিল তা নিয়ে তো সন্দেহ নাই।
আর নাই বলেই, আপনি অনেক খাটাখাটনি করে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিলেন তাতে করে এন্ডারসনের অভিযোগ বা তত্ত্ব খারিজ হয় না।
মোদ্দা কথা হলো, মার্কিন কর্তৃপক্ষ সরাসরি মিনিট বিশেকের মধ্যে নিয়াজির বার্তাটা অরোরাকে পৌঁছিয়ে দিতে পারতো। এন্ডারসনের এই ধারণার সাথে আপনি একমত নন, আমি একমত। এখানে পাকিস্তানীরা কি করেছে আর কি করে নি তা আলোচনার বিষয় নয়। তার মানে এই নয় যে, পাকিস্তানীদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। এন্ডারসনের লেখার স্কোপটা বুঝলে আমার মনে হয় আপনি এই অভিযোগটা করতেন না।
আপনার সাথে আলোচনাটা আমি তথ্য এবং তথ্যসূত্রের মাঝেই সীমিত রাখতে চাই। একই তথ্যের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হয় দৃষ্টিভঙ্গীতে পার্থক্যের জন্য। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন কর্তৃপক্ষ যে আঠার-ঊনিশ ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন এই তথ্যটাকে আপনি ডিসপিউট করছেন না। কিন্তু আপনার আর আমার দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা। তাই ঘটনার ইন্টারপ্রিটেশনে পার্থক্য থাকবে। সুতরাং এ নিয়ে আর কথা বাড়াবো না। এ নিয়ে আমার নতুন কিছু বলার নাই।
মার্কিন ভূমিকা নিয়ে আপনার বক্তব্যের সাথে একমত নই। আমার মূল লেখাতেই এই ধরনের উদাহরণ আছে। গ্রেনাডায় মার্কিন আগ্রাসনের পরে আমেরিকানরা এয়ারপোর্ট বানিয়ে দেয়। আপনার মতে মনে হচ্ছে, আমার উচিত ছিল এজন্যে আমেরিকার প্রশংসা করা। এখানেও মনে হচ্ছে আমার লেখার স্কোপটা আপনি ধরতে পারেন নি। আমার লেখার শিরোনাম ছিল মার্কিন মাস্তানি, মার্কিন বদান্যতা নয়।
ওপরের মন্তব্যে এই প্যারাটা উদ্ধৃতির মধ্যে হবে। মডুদের কেউ পারলে একটু ঠিক করে দিয়েন।
@ইরতিশাদ,
– আমার জাষ্টিফিকেশন বিশেষ কোন মতামত নয়। কূটনৈতিক চ্যানেলে এ ধরনের প্রস্তাবনা গেলে যেভাবে ডিল করা হয় মূলত সেটাই আমার জাষ্টিফিকেশন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ২০ মিনিটের মধ্যে খুব সহজবোধ্য কারনেই ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে পারত না এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ফ্যাক্ট, আপনি না মানতে চাইলে সেটা আপনার ব্যাক্তিগত মত। দূতাবাসের পদক্ষেপ ফর্মালিটি প্রটোকল এসব মেনেই চলে এ নিয়ে আগেই বলেছি যদিও এসব কথা খুবই সাধারন।
যে মার্কিনীরা নয় মাস চেষ্টা চালিয়ে গেছে যুক্ত পাকিস্তান বজায় রাখতে তারা বার্তাবাহকের ভূমিকায় নেমে যাবতীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ সুপারসিড করে চট জলদি সারেন্ডার বার্তা পৌছে দেবে এটা আশা করা কতটা যুক্তিসংগত ছিল এ প্রশ্নও তোলা যায়। আমেরিকা শেষ মুহুর্ত পর্যন্তই চেষ্টা চালাবে কোন ভাবে পাকিস্তান টিকে যাক সেটাই স্বাভাবিক। নিরপেক্ষ কোন দেশের তেমন ভূমিকা হলে সেটা অবশ্যই বড় প্রশ্ন আকারে দেখা দিতে পারে। আমার কাছে সারেন্ডার দেরী বিষয়ে এই ঘন্টা আদৌ খুব গুরুত্বপূর্ন কোন আলোচ্য সহজবোধ্য কারনেই মনে হয়নি।
মূল কারন আমার কাছে ১৯ ঘন্টার চেয়ে ৪ দিন অনেক বড়, অনেকের কাছে হয়ত হিসেবটা উলটো কেবল মাত্র জড়িত পক্ষের পরিচয়ের কারনে। পাক বাহিনীর জান্তারা এক একজনা এক এক মতের না হলে গভর্নর মালিক ও রাও ফর্মানের প্রস্তাবনা (যা পিন্ডি জানতে পেরে অস্বীকার করে ভেস্তে দেয়) অনুসারে ১২ তারিখের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারত।
আপনি হয়ত খেয়াল করেননি, আমিও আগে ভেংগে ব্যাখ্যা করিনি যে মার্কিনীরা দীর্ঘসূত্রিতার কারন মূলত পাকিস্তানীদেরই ত্রিভংগ অবস্থা এটাও হওয়া খুবই সম্ভব। এ কারনেই তারা সময় নিচ্ছিল ১৪ই ডিসেম্বরের সারেন্ডারের প্রস্তাব আদৌ কতটা সিরিয়াস সেটা বিবেচনা করতে। কারন এর আগে দুবার এমন প্রস্তাবনা দিয়েও প্রত্যাহার করা হয়েছিল। নিক্সনের তরফ থেকে তাই ইয়াহিয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল, তার ফলাফল তো আগেই বলেছি। পাকিস্তানীদের অবস্থা যে একদল ক্লাউনের মত এটা মার্কিনীরা ভালই টের পেয়েছিল। তারা ভারতের কাছে এপ্রোচ করুক আর পিন্ডি আবার সেটা প্রত্যাহার করুক এটাই বা তারা কেন চাইতে যাবে? আমার কাছে নানান অনুমিত ও বিতর্কিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিবেচনার আগে এসব সরল কথাই বিবেচনার কথা আগে মনে হয়।
এন্ডারসন সাহেব বা অন্যরা ১৯ ঘন্টার ব্যাপারে মিথ্যাচার করেছেন এটা আমি প্রথম থেকেই কখোনই বলিনি। ১৯ ঘন্টা দেরী মার্কিন ভায়ার পাল্লায় গিয়ে অবশ্যই হয়েছে কে অস্বীকার করে? কেবল বলতে চেয়েছি যে ব্যাপারটা তারা মাত্রাতিরিক্ত ড্রামাটাসাইজ করেছেন কেবল মাত্র জড়িত পক্ষ মার্কিন সরকার বলেই। এ কারনেই এদের কারো কাছে সারেন্ডারে দেরী বিষয়ে পাক পক্ষের কোন রকম গলতির কোন গুরুত্ব নেই। মদ্যপ ইয়াহিয়ার সাথে নিক্সন যোগাযোগ করতে পারেনি তারও গুরুত্ব নেই। নিয়াজীর নামে এক হাস্যকর মিথ্যাচারেরও গুরুত্ব নেই। এটা আপনি না মানতে চাইলে কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে বলতে হয় যে ৪ দিন অপেক্ষা ১৯ ঘন্টা বৃহত্তর। আমার মূল কথা এখানে এটাই। বাংলাদেশের পাঠকরাও পত্রিকায় পাক অবহেলায় সারেন্ডার ৪ দিন পিছিয়েছিল (এর স্বপক্ষে বহু সূত্র আগে দিয়েছি) এমন হেডিং দেখার চাইতে মার্কিন (সিআইএ হলে আরো ভাল হয়) কূটচালে ১৯ ঘন্টা সারেন্ডার পিছিয়েছিল হেডিং পড়তেই নিঃসন্দেহে বেশী আনন্দ পাবে বলাই বাহুল্য। আগেই বলেছি যে একজন মার্কিনী যে নিজ সরকারের ভূমিকা সমালোচনা করতে চায় তার কাছে অবশ্যই ১৯ ঘন্টা গুরুত্ব পেতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে ১৯ ঘন্টার গুরুত্ব ৪ দিনের চেয়ে বেশী হতে পারে না।
– বেশ হতাশাব্যাঞ্জক কমেন্ট। কথাটা মোটেই জ্যাকবের নিজের নয়। কথাটা জ্যাকবেই বইতে আছে, কিন্তু পরিষ্কার রেফারেন্স আছে কিসিঞ্জারের বয়ানে যেটা আপনি নিজেই বলছেন এখানেও। যে মিথ্যাচার কিসিঞ্জারের সেটার দায় আমি জ্যাকবকে দিয়ে তার অন্য বক্তব্যে অনাস্থা কেন আনতে যাব সেটা বুঝতে আমি পুরোই অক্ষম। জ্যাকব কেবল কিসিঞ্জারের বক্তব্য কোট করেছেন, নিজে কোন কথা বলেননি। এন্ডারসন সাহেবের মত ধোয়শাও সৃষ্টি করেননি যাতে জ্যাকবের নিজের বক্তব্য নাকি কিসিঞ্জারের বক্তব্য এই ফালতু গোল বাধে।
– আগেই বলেছি যে আমার মার্কিন তক্ত্বাবধনে ১৯ ঘন্টা দেরীতে কোন সংশয় নেই। যদিও আমি দরাদরি করে এটা ১৯ থেকে ১৩/১৪তে নামাতে পারি, তার তেমন দরকার দেখি না। আগেই বলেছি যা আমাকে চমতকৃত করেছে তা হল ৪/৫ দিন থেকে ১৯ ঘন্টার গুরুত্ব বেশী সেটা প্রমানে কিছু ঐতিহাসিকের উতসাহে। এ সম্পর্কে আপনার পরিষ্কার কোন বক্তব্য এখনো দেখলাম না।
নানান তত্ত্ব অনুমানে কোন দোষ নেই। তবে আমাকে এক্ষেত্রে আরো চমতকৃত করেছে “নানান মূনি” রা তাদের অনুমিত তত্ত্বে বড় ধরনের ফাঁক আছে সেসবের কোন গুরুত্ব দেননি। যেমন কিসিঞ্জার সাহেবের ভারতের ভূখন্ড দখলের তত্ত্ব, সপ্তম নৌবহর কয়টা গোলা বর্ষন করেছিল তাও কোন বিতর্কের বিষয় নয়। তেমনিভাবে নিজেদের পছন্দমত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বাইরেও যে আরো সরল তত্ত্ব থাকতে পারে যেমন কূটনৈতিক চ্যানেলের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মদ্যপ ইয়াহিয়াকে হুশে না পাওয়া এসব আদৌ আমলেই না আনার মারাত্মক প্রবনতা এটাই আমার কাছে প্রতীয়মান করে যে জড়িত পক্ষ মার্কিন বলেই ড্রামাটিসাইজেশন মনে হয় বেশীই করা হয়েছে।
– আসলেই বুঝিনি এই কমেন্টটা। আগের পর্বে ব্যাখ্যা করেছিলাম যে কূটনৈতিক চ্যানেলে বার্তার সম্ভাব্য রাউট, সেটা ২০ মিনিটে কিভাবে হতে পারে আমি বুঝতে সরল বুদ্ধিতে অক্ষম। পিভ্যাক সেই বার্তা স্বাভাবিক ভাবে পাঠাবে ওয়াশিংটনে তার ওপর ওয়ালা কিসিঞ্জার গং এর কাছে, ভারতীয় সেনা প্রধান তো পিভ্যাকের ইয়ার দোস্ত না যে সে কূটনৈতিক রীতি ভংগ করে সেখানে ধর্না দেবে। ওয়াশিংটনে এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হবে, বন্ধু পাকিস্তানের সাথেওঁ দরবার হবে, তারপর ভারতীয় দূতাবাসে বার্তা হয়ত যাবে, এরপর সেই বার্তা আসবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে – এটাই স্বাভাবিক কূটনৈতিক পথ। এই প্রক্রিয়া ২০ মিনিটে হতে পারে এমন আশা করাই আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আগে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কল্পিত যুদ্ধের সম্ভাব্য পদক্ষেপের উদাহরন দিয়েছি। আসলে জটিল জটিল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে খুব বেশী চিন্তা করলে অপেক্ষাকৃত সরল কিছু কারন কিছুতেই চিন্তা করতে ইচ্ছে করে না এমন হয়। আপনি এমন কোন কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে বা হাস্যকর মনে হলে সেটা আপনার ব্যাক্তিগত মতামত, তবে আমার সাধারন জ্ঞানে এমনই হয় বলে। বলা ভাল যে নিয়াজী মধ্যস্থতাকারী হিশেবে রুশ চীন দূতাবাসের কথাও চিন্তা করেছিল, নিঃসন্দেহে রুশ ভায়া পথে গেলে প্রক্রিয়াটি আরো দ্রুত হত।
এ নিয়ে আর তেমন কিছু বলার নেই, ভাল থাকবেন।
@আদিল মাহমুদ,
মারকিনিঘেসা আপনার আলোচনা খুবই হতাসাজনক। জামাতও তো অনেক সাহায্য করে আমাদেরকে। জামাতের ৭১-এর ভুমিকার সাথে সাথে কি তাদের বর্তমান দানের কথাও ত বলা উচিত ?
@িশল্পভবন,
িশল্পভবন,
আপনার মূল্যায়নও কিছুটা হতাশাব্যাঞ্জক মনে হল।
আমার কথা কি ভাল করে পড়েছেন? আমি মার্কিন গুনগান গাইনি, গেয়েছি মুক্তকন্ঠের, গনতন্ত্রের।
এ বিষয়ে ইরতিশাদ ভাইকে করে শেষ কথাটা লক্ষ্য করুন,
এখানে আমি কোন ব্যাক্তি বা জাতিকে কৃতিত্ব দেইনি, দিয়েছি গনতন্ত্র নামের একটা সিষ্টেমকে। এখানে মার্কিন তোষন বর্জনের কিছু নেই। মার্কিন ধরে কথা বলা মানে কিছু ব্যাক্তি নিয়ে কথা বলা।
ইরতিশাদ ভাই এর কমেন্টের জবাব পরে দেব, আপাতত ব্যাস্ত আছি। লক্ষ্য রাখবেন আশা করি, ধন্যবাদ।
@আদিল মাহমুদ,
সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়=সৌভাগ্য আমার নেই বলে, ছোট্ট একটা বিষয়কে বেছে নিলাম, চালিয়ে যাবার খুব চেষ্টা করবো।
অনুগ্রহ করে তথ্য-সূত্র দিন। অনুরোধ থাকবে, কে, কাকে বা কার মাধ্যমে কার কাছে এ সাহায্য পৌঁছে দিয়েছিল?
সাহায্যের নমুনা হিসাবে দু’একটি চুক্তি-পত্র দেখানো সম্ভব কি? হলে খুব ভাল হয়।
@সফিক,
আপনার একচোখা-সরলরৈখিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতা নিয়েও অনেক পয়েন্ট আনা যায় কিন্তু আপনি সেই সব পয়েন্ট নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী মনে হয় না।
স্পষ্ট করলে ভাল হত,।
আমি দুঃখিত আপনাদের মাঝে কথা বলার জন্য
শুরু ডমিনিকান রিপাবলিক দিয়ে আর শেষ বাংলাদেশ দিয়ে।প্রথম দিকে পড়ছিলাম nice to learn হিসেবে। পরে মনে হল useful learning। পরিশেষে বুঝলাম আসলে লেখাটি আমার জন্য must learn এর পর্যায়ে্র । আপনার তথ্যবহুল ও ইতিহাসসমৃদ্ধ এ লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
@গীতা দাস,
অনেক ধন্যবাদ, আপনার সুন্দর প্রেরণাদায়ক মন্তব্যের জন্য। আসলে, আমার জানার প্রচেষ্টা থেকেই এই লেখাটা। যতটুকু জানলাম, আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছে হলো এই আর কি! ভালো থাকবেন।
ট্রুহিও যে কি জিনিস ছিলো তা আমি নিচের এই উপন্যাস দু’টি পড়েই বুঝেছিলাম। আপনার লেখা আবার অনেক কিছু মনে করিয়ে দিলো। ধন্যবাদ।
১। The Brief Wondrous Life of Oscar Wao by Junot Diaz
২। In the Time of the Butterflies by Julia Alvarez
@আদনান আদনান,
দ্বিতীয় বইটার অনেক নাম শুনেছি, পড়িনি যদিও। আগ্রহ জাগলো পড়ার। ২০০১ – মুভিও বানানো হয়েছে। সালমা হায়েক অভিনয় করেছেন। যতটুকু জানলাম সত্যি ঘটনা অবলম্বনে জুলিয়া আল্ভারেজের লেখা বইটা। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। তিন বোন যাচ্ছিলেন তাদের বন্দী স্বামীদের দেখতে জেলে, একই গাড়িতে। ট্রুহিও-র লোকেরা তিনজনকে একসাথে মেরে ফেলে। সান্তনা শুধু এখানেই যে, ট্রুহিও-ও প্রায় একইভাবে নিহত হয় বছর খানেকের মধ্যে।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য আর বইগুলোর উল্লেখের জন্য।
খুব গুরুত্বপূর্ণ এ লেখায় ‘মাস্তানি’ শব্দের ভেতরও কেউ কেউ হয়তো প্রণয়ের ছায়া দেখবে। ভাবে-ভঙ্গিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, নিরন্তর একটা লড়াই জরুরী। অভ্যস্ত চিন্তার বিরুদ্ধে।
প্রণয়কারীরা সব সময় একটা ‘বাহানা’ খুঁজে বেড়াবে। আর উজান স্রোতের যাত্রীরা সেই ‘বাহানা’-র উন্মোচন ঘটিয়ে যাবে।
উন্মোচনের নাট-মঞ্চে আপনাকে অভিনন্দন।
@স্বপন মাঝি,
অনেক ধন্যবাদ।
ইরতিশাদ ভাই,
এই লেখাটাতে অনেকগুলো কনসেপ্ট ও তথ্য একসাথে এসেছে, ফলো করতে পাঠকের একটু বেগ পেতে হবে। পর্ব করলে মনে হচ্ছে ভালো হতো, পরেও কিছু যোগ করতে পারতেন। লেখার স্টাইল বরাবরের মতই দারুণ।
এবার আসল কথায় আসি। আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন বিপ্লবী এনরিকে, তাকে নিয়ে আপনি কিছুই উল্লেখ করলেন না। আপনি যেহেতু ওখানে গেছেন, একটা লেখা দেন ওখানকার কালচার নিয়ে, মানুষজন নিয়ে, কথোপোকথন নিয়ে। এই-লেখায় দেয়া তথ্যগুলির বেশিরভাগই ইন্টারনেট থেকেও নেয়া যাবে। অন্য লেখাটাতে এমন কিছু দেন যেটা ইন্টারনেট থেকে পেতে কষ্ট হবে বা পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে বড় কথা, ছবি কই? ছবি দেন। আমি বহুদিন ধরে যাবার প্ল্যআন করছি ডমিনিকান রিপাবলিক, হাইতি আর জ্যামাইকায়। কিন্তু, পুওর স্টুডেন্টদেরকে যে কারণে পুওর বলা হয়, সে কারণে আপাতত সম্ভব হচ্ছে না :)) । কখনো গেলে আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নেব। 🙂
@মইনুল রাজু,
তাই ট্যাগে এটাকে ব্লগাড্ডা বলেছিলাম। আসলেই এই রচনাটাকে ক্লাসিক গরুর রচনা বলা যেতে পারে। নদী থেকে গরু শুধু নয়, আমি বোধহয় ছানার জিলাপিও বানিয়ে ফেলেছি। । তোমার সমালোচনা যথার্থ। আসলে স্বল্পপরিসরে অনেক কথাই বলতে চেয়েছিলাম, এখন দেখছি কিছুই ঠিকমতো বলা হয় নি।
তাই এনরিকে কেন আরও অনেক বিপ্লবীর কথাই আসে নি, যদিও আসতে পারতো। এনরিকে বা এনরিকিও বোধহয় তাইনো ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী আর সফল বিদ্রোহী ছিলেন। স্পেনীয় দখলদারেরা তার সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে মাত্র সপ্তাহ দুয়েক ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে যা জেনেছি তাতে বেশি দূর দৌড়ানো যায় না। এই লিঙ্কটা দেখতে পারো।
আমি সান্তো ডমিঙ্গো কাজে গিয়েছিলাম, বেড়ানোর সুযোগ খুব একটা হয় নি। আর ভ্রমণ কাহিনি আসলেই আমি লিখতে চাই নি। (আর মুক্তমনায় ভ্রমণকাহিনির মান তুমি যে উচ্চতায় তুলে দিয়েছ – আমার ভ্রমণকাহিনি পাঠকের মন ভরাতে পারবে না।) আমি আমেরিকার বিশ্বমাতব্বরির চরিত্রটাকে একটু খোলাসা করতে চেয়েছিলাম, আর কিছু না।
তুমি হেইতি, ডমিনিকান রিপাব্লিক, জ্যামাইকা ভ্রমণে আগ্রহী শুনে খুব খুশি হলাম। আরে ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। আর আমিতো আছিই মায়ামিতে।
সুচিন্তিত আর অকপট মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
@মইনুল রাজু,
ডমিনিকান রিপাব্লিক আর এনরিকে-কে নিয়ে তোমার চমৎকার লেখাটা আজকে আবার চোখে পড়লো, তোমার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে এই লিঙ্কটাতে গিয়ে ।
জানি, তুমি আত্মপ্রচারবিমুখ, তবুওও মুক্তমনার পাঠকদের কথা ভেবে মনে করিয়ে দিলেইতো পারতে এই লেখাটার কথা। দুঃখিত আমার মনে পড়ে নি বলে।
@ইরতিশাদ,
হা হা, ইরতিশাদ ভাই, তাহলে আসলে আমার দুঃখিত হওয়া উচিৎ মনে না করিয়ে দেবার জন্য। আপনাকে ধন্যবাদ তথ্যগুলো এখানে শেয়ার করার জন্য, আমারের প্রচারের কাজটা কিছুটা হলেও হয়ে গেলো। 🙂
গল্প বানাতেও কিছু দক্ষতা লাগে। রেডিও আবিষ্কার হয়েছিলো ১৯০০ সালের দিকে। এটা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় নয় যে সামরিক বাহিনীতে রেডিও ট্রান্সমিটার তেমন ব্যপক প্রচলিত নয়। ১৯৭১ সালে এমনকি পাকিস্তানের মতো তৃতীয় বিশ্বেব্র সামরিক বাহিনীতেও প্রতিটি ডিভিশন, প্রতিটি ব্রিগেড, প্রতিটি ব্যাটেলিয়ন, প্রতিটি কোম্পানীর নিজস্ব ট্রান্সমিটার ছিলো। ভারতীয় বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটা ট্রান্সমিটার পাওয়া গেলো না এই অজুহাত বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব।
@সফিক,
এই রকম হাস্যকর মিথ্যাচার পাকিস্তানীদের পক্ষেই সম্ভব এটা নুতন কিছু নয়।
তবে আমেরিকান এন্ডারসন সাহেবও এত বড় হাস্যকর মিথ্যাচার কোন মন্তব্য ছাড়াই মেনে নিয়েছেন এটাও আজব। কারন মনে হয় মার্কিন প্রশাসনকে দায়ী করার চেষ্টায় কোন রকমের ফাঁক না রাখা।
১৪ই ডিসেম্বর নিয়াজীর বার্তা ভারতীয়দের কাছে যেতে দেরী হয়েছিল কূটনৈতিক কারনও আছে। স্পিভাক নিজে ওয়াশিংটনের সাথে যোগাযোগ না করে নিজ দায়িত্বে সে প্রস্তাব কিভাবে ভারতীয়দের কাছে দিতে পারত? সে সেই বার্তা আগে ওয়াশিংটনে পাঠায়, ওয়াশিংটন চেষ্টা করছিল ইয়াহিয়াকে ধরতে, ইয়াহিয়া তখন বেডরুমে। এটা সিদ্দিক সালিকের বইতে বিস্তারিত আছে।
আজকের পরিবর্তি বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন আগ্রাসনের রূপ বিবর্তিত হয়েছে, কারন এখন আর কম্যুনিউজম জুজু নেই। কোল্ড ওয়ারের আমলে মার্কিন ওয়ালাদের সেই জুজুতে ভোগার কারন ছিল। সোভিয়ের ইউনিয়ন ব্যাবহার করতে পারে এমন কোন সরকার তার বাড়ির পাশে গড়ে উঠুক এটা সে সজ্ঞানে চাইবে মনে করা যায়? আমি ডমিনিকানে মার্কিন হস্তক্ষেপের সাফাই গাইছি না, শুধু বাস্তবতা যা তাই বলছি।
– বোল্ড করা অংশটুকু ডাহা মিথ্যা কথা। নিয়াজীর সেনা সদরের রেডিও যোগযোগ ভারতীয় বোমায় ধ্বংস হয়ে যায় কিভাবে? তেমন কোন রেকর্ড নেই, তার সেনা সদরে তেমন কোন বোমাও পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, ১৬ই ডিসেম্বর সকালে সারেন্ডারের শর্ত নিয়ে আলাপ করতে কাদের সিদ্দিকী, জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল নাগরা যখন নিয়াজীর সদর দফতরে যান তখন সে সদর দফতর থেকেই পাক কমিউনিকেশন ব্যাবহার করে জেনারেল জ্যাকব কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে যোগাযোগ করেছিলেন। পাক সেনা সদর থেকেই পুরো বাংলাদেশে ১৫ই ডিসেম্বর থেকে সিজ ফায়ারের বেতার বার্তা প্রচার করা হয়। তারা যে কোন সময় চাইলেই ভারতীয় ফ্রিকোয়েন্সীতে যোগাযোগ করতেই পারত, আন্তর্জাতিক কিছু খোলা ফ্রিকোয়েন্সী সবসময়ই আছে। এমনকি ভারতীয় পক্ষ থেকেও নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সী দেওয়া হয়েছিল।
এই মিথ্যাটুকু পাক বাহিনীর বানাতে হয়েছে স্রেফ মান রক্ষার্থে এবং মার্কিন প্রভুদের খুশী রাখতে। যে কাফের ভারতীয় বাহিনীকে হেন করবে তেন করবে, একজন মুসলমান পাক সৈনিক ১০ জন কাফের ভারতীর চাইতে বড় বীর, হাতে মেশিনগান নিয়ে হিন্দুস্তান দখল করে ইন্দিরা মানেকশ কে দিল্লীর রাজপথে গলায় রশি পরিয়ে মার্চ করাবে হুমকি দিয়ে আসছিল সেই কাফের ভারতীয় বাহিনীর কাছে মিন মিন করে সারেন্ডার ভিক্ষা করতে মানে লেগেছিল। তাই মধ্যস্থাকারী হিশেবে মার্কিনীদের কাছে ধ্বর্না দিতে হয়েছিল, ছূতা হিশেবে হাস্যকর এক মিথ্যাচার।
আত্মসমর্পনের দীর্ঘসূত্রিতায় মার্কিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছাড়াও অন্য আরেকটি সহজ ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আত্মসমর্পন নিয়ে আসলে ইয়াহিয়া থেকে শুরু করে ফরমান আলী, নিয়াজী এদের সবার মধ্যে তীব্র মতদ্বৈততা চলছিল। প্রথম মার্কিন দূতাবাসে ধ্বর্না দেয় ফরমান আলী যা শুনে নিয়াজী খেপে গিয়েছিল, সে তখনো সারেন্ডারে রাজী ছিল না। ওদিকে পিন্ডিতে আত্মসমর্পনের প্রস্তাবনায় ইয়াহিয়া হ্যা না কিছুই বলছিল না, সে তার বেডরুম আটকে মদ নারী নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। পাক হাই কমান্ড ঢাকা ক্যান্ট এ অধীর আগ্রহে বসেছিল পিন্ডির ক্লিয়ারেন্সের অপেক্ষায়, যা আসছিল না। তাকে ১৬ই ডিসেম্বরেও মদ্যপ অবস্থা থেকে অনেক কায়দা কানুন করে হুঁশ ফিরিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দিতে বেতার ভবনে আনা হয়। মার্কিনীরাও দুতিয়ালীতে এসব কারনেই দেরী করেছিল এটাও আরেক কারন।
বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয় মূলত ১৪ই ডিসেম্বর ভোররাতে, ১৫ই ডিসেম্বরে নয়। তবে ১৫ই ডিসেম্বরেও অনেকে মারা গিয়ে থাকতে পারেন, এমনকি জানুয়ারীর শেষেও আটকে রাখা কিছু বুদ্ধিজীবিকে মীরপুরের বিহারী অধ্যুষিত ও নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকায় সারেন্ডারের আগে কার্ফ্যু দেওয়া হয়েছিল মূলত বুদ্ধিজীবি নিধন নির্বিঘ্নে সারার জন্যই।
আরেকটি ছোট তথ্য, ‘৭১ সালে মার্কিন প্রশাসন পাক বাহিনীর গডফাদার ছিল, তবে অন্যদিকে সেই একই প্রশাসন আবার ভারতীয়দের হাতে বাংগালী শরনার্থীদের খোরপোষ বাবদ বেশ কিছু টাকাও দিয়েছিল, এ মুহুর্তে মনে পড়ে ২০০/৪০০ মিলিয়ন ডলার।
তথ্য বহুল ও দরকারি নোট। বিভিন্ন সময়ে তথ্যসূত্র হিসেবে এই নোটটি বার বার ব্যবহৃত হবে, সন্দহ নেই।
অনলাইনপত্র গুরুচন্ডালি ডটকম-এ “১৯৭১ :: মুক্তিযুদ্ধের কথা ” শীর্ষক সংকলনে চলতি নোটটি সংযুক্ত করা হয়েছে। ধন্যবাদ। চলুক। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
ধন্যবাদ সহৃদয় মন্তব্যের জন্য।