গ্রামের নাম রূপগ্রাম। এই গ্রামের একটি সচ্ছল পরিবার। রহিম মিয়া এই পরিবারের গৃহকর্তা। স্থানীয় বাজারে তার দুটি ফার্মেসি ও দুটি মুদি দোকান আছে। এছাড়া জমি-জিরাত আছে যথেষ্ট। তার স্ত্রীর নাম রাহেলা। তাদের চারটি সন্তান। ছেলেমেয়েদের মধ্যে শাকিলা সবার বড়। সচ্ছলতায় বেশ সুখেই তাদের দিন কেটে যায়। শাকিলার মেট্রিক পরীক্ষা সামনে। সে দিনরাত পড়াশোনা নিয়ে পড়ে থাকে। পৃথিবীর আর কোনোদিকেই তার এখন দেখবার সময় নেই। শুধু জান-প্রাণ দিয়ে পড়া। তাকে খুব ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। মা তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, সে পড়তে থাকে। কয়েক বছর ধরে শাকিলা একটি স্বপ্ন লালন করছে মনে মনে। মেট্রিক পাস করে সে শহরে গিয়ে ভাল কলেজে ভর্তি হবে। জীবনে সে অনেক অনেক পড়ালেখা করবে, অনেক বড় হবে। সে বাবা-মাকেও জানিয়েছে নিজের ইচ্ছা এবং স্বপ্নের কথা। তারা বলেছে, আগে ভাল ভাবে পাস কর তার পরে দেখা যাবে।

শাকিলার পরীক্ষা শেষ হল কিছুদিন পর। বেশ ভালই হল পরীক্ষা। রেজাল্ট বেরুল সময়মত। শাকিলা এপ্লাস পেয়েছে। ওর আরো কয়েকজন সহপাঠীও পেয়েছে এপ্লাস। ওর প্রতিবেশী এবং আবাল্য-বন্ধু সত্যেন, চেয়ারম্যানের মেয়ে মিলু ওরাও পেয়েছে এপ্লাস। ওরা শহরের কলেজে পড়তে চলে গেছে। শাকিলা তার বাবা-মার কাছে কাকুতিমিনতি করতে লাগল, আমার বন্ধুরা সবাই ভাল ভাল কলেজে পড়তে চলে গেছে। আমাকেও যেতে দাও, পড়তে দাও ভাল কোনো কলেজে। আমি অনেক পড়তে চাই, অনেক বড় হতে চাই। বাবা-মা বলল, এত বড় মেয়েকে চোখের আড়াল করে আমরা কি আমাদের জীবন-যাপন হারাম করে ফেলব নাকি? তুই শহরে পড়ার নাম করে কী করে বেড়াবি তার কোনো হিসেব আছে? কোন কেলেঙ্কারি হয়ে গেলে শেষে মান সম্মান সব পানিতে ভেসে যাবে না! শাকিলা বলল, কেলেঙ্কারি করতে কি শহরে যাওয়া লাগে? তা ত সব জায়গাতেই হতে পারে। আর আমাকে পড়ালেখা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে বা করতে দেখেছ কি কখনো? মা বলল, বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলিস না। মেট্রিক পাস করেই এত চোপা বাজাচ্ছিস বাপ-মায়ের সাথে। শহরে পড়তে গিয়ে না জানি আরো কত বেয়াদব হয়ে যাবি! শেষ পর্যন্ত বাবা-মার কথাই রইল। শাকিলাকে গ্রামের কলেজে ভর্তি করান হল। ওর সব যুক্তিতর্ক অনুনয়-বিনয় বাতাসে ওড়ে গেল। এত বছরের লালিত সাধ-স্বপ্নের ইমারত চোখের জলে প্লাবিত হতে লাগল নীরবে। স্বপ্নভঙ্গের মনোবেদনা ও চোখের জল নিয়েই সে কলেজের পড়া চাপিয়ে যেতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে আবারও সে বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দেখতে লাগল। ভালভাবে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পাড়ার স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখা ছাড়া কোনো মানুশ কি বেঁচে থাকতে পারে? কোনো জীবন কি সামনে এগোতে পারে? স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক বা না হোক, মানুশ স্বপ্ন দেখে। কারণ স্বপ্ন মানুশকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়।

এর পরের বছর শাকিলার ছোটভাই অঞ্জন মেট্রিক পাস করল। তাকে শহরের কলেজে ভর্তি করান হল। ছেলেরা বড় হয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরবে এটাই ত নিয়ম। মেয়েদের একটু কিছুতেই জাত যায়। বংশে চুনকালি পড়ে। ছেলেদের জন্য সে সব চিন্তা নেই। শাকিলার শহরে পড়ুয়া বন্ধুরা ছু্টি পেলে বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখন ওরা শাকিলার সাথে দেখা করতে আসে। কলেজের গল্প করে। কত বড় কলেজ, কত বড় বিদেশী ডিগ্রীধারী শিক্ষক, কত জায়গা থেকে আসা কত যে ছাত্রছাত্রী, কত পড়ালেখার প্রতিযোগিতা, কত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরো কত যে কি তার কোনো হিসেব নেই। শাকিলা তন্ময় হয়ে বড় বড় কলেজের গল্প শোনে, আর নীরবে দীর্ঘশ্বাস ও কিছুটা দুঃখ গোপন করে। সত্যেন আর মিলুর সাথেই ওর বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওরা গ্রামে আসলেই আগে শাকিলার কাছে ছুটে আসে। তাছাড়া ফোনে এবং চিঠিতেও যোগাযোগ আছে। মিলুকে শাকিলার মা-বাবাও খুব স্নেহ করে। ও এলেই বেশ আদর আপ্যায়ন করে। তবে সত্যেনের সাথে বন্ধুত্ব তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। শাকিলার মায়ের সাথে সত্যেনের দেখা হলে সে বলে, নমস্কার মাসিমা কেমন আছেন। মাসিমা কথার জবাব না দিয়ে একহাত ঘোমটা টেনে দিয়ে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চলে যায়। শাকিলা খুব লজ্জা পায় সত্যেনের প্রতি মায়ের এহেন আচরণে। সে ব্যাপারটা ঢাকা দেয়ার জন্য বলে, তুই কিছু মনে করিসনি ত, আমার মা খুব লাজুক। সত্যেন বলে, কী যে বলিস না তুই; কিছু মনে করব কেন? পড়তে এত ভাল লাগে শাকিলার! কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই এনে সব সময় পড়ে সে। তাদের পাড়ায়ও একটা লাইব্রেরি আছে। সেখান থেকেও বই এনে পড়ে। দেখতে দেখতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা কাছে চলে এলো। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে শাকিলা। ওদের বাড়ির পেছনে একটা আমগাছ আছে। দিনের বেলায় সেই আমগাছের ছায়ার নিচে বসে বসে শাকিলা পড়ে আর স্বপ্ন বুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। পরীক্ষা শেষ হল এক সময়। ফলাফল বের হল। শাকিলা ভাল ফলাফল করল। এবারও অবস্থা এবং দৃশ্যপট একই রকম। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য শহরে যেতে দেয়া হল না। তার সমস্ত আহাজারি মিনতি মা-বাবা নাকচ করে দিল। তাদের কথা হচ্ছে মেয়ে যদি তাদের চোখের আড়ালে গিয়ে অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে কোনো অপকর্ম করে বসে! নিজের হাতে বংশের মুখে চুনকালি লেপনের ব্যবস্থা করবে নাকি তারা! তাছাড়া শাকিলার জন্য বিয়ের প্রস্তাবও আসতে শুরু করেছে। পছন্দমত ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে। শহরে গেলে কি এই মেয়ে আর বাধ্য থাকবে?

এবারও শাকিলার অনেক সাধের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হল। তার একটি সাধও কি পূরণ হবে না! সে কেবল স্বপ্ন বুনে যাবে আর সবাই তার অতিযত্নে বোনা স্বপ্ন বারে বারে ভেঙে খান খান করে দেবে! কী আর করবে সে। অগত্যা ভর্তি হল গ্রামের কলেজে বিএ ক্লাসে। সত্যেন চান্স পেল মেডিকেলে। মিলু ফিজিক্সে অনার্সে ভর্তি হল। সত্যেন ও মিলু ছুটিতে বাড়ি এসেছে বেড়াতে। শাকিলার সাথে দেখা করে গেছে দুজনেই। আজ বিকেলে সত্যেন আবার এসেছে শাকিলার সাথে গল্প করতে। শহর থেকে সে কিছু বই এনেছে শাকিলার জন্য ওগুলো দিল। এবং জানাল দু’দিন পরে ও চলে যাবে। সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শাকিলা সত্যেনকে এগিয়ে দিতে গেল বাড়ির সামনে পুকুরপার পর্যন্ত। ওদের দুজনার সম্পর্ক সাধারণ বন্ধুত্বের চেয়ে একটু গাঢ়তর হচ্ছিল দিন দিন। সত্যেন বাড়ি থেকে চলে গেলে শাকিলার চারদিক শূন্য লাগে। সত্যেনেরও লাগে তদ্রূপ। ওদের দুজনেরই মনে হত, বন্ধুত্ব থেকে কি ভালবাসা হতে পারে না! বন্ধু কি প্রণয়ী হতে পারে না! তবে কেউ কারো কাছে এখনো মনোভাব প্রকাশ করেনি। দুজনের মাঝেই লজ্জা ও জড়তা। বাল্যবন্ধুকে কিভাবে প্রণয়ের কথা বলবে। সমাজ সংসার ত আছেই। আজকের সন্ধ্যাটা এত সুন্দর! ঝিরঝির বাতাস বইছে শরতের। ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। আকাশে হালকা জোছনা। কয়েকটা তারা জ্বলছে মিটিমিটি। ওরা কথা বলছিল পুকুরপারে দাঁড়িয়ে। সত্যেন দুরুদুরু বক্ষে হুট করে শাকিলার হাত ধরে বলল, শাকিলা আমাদের বন্ধুত্ব কি ভালবাসায় পরিণতি লাভ করতে পারে না? শাকিলা শুধু লাজরাঙা স্তব্ধ হয়ে সত্যেনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওরা কেউই আর কিছুই বলছে না। কেবল তাকিয়ে আছে দুজন দুজনার পানে। আর মনে মনে বলছে, এই ক্ষণ শুধু আমাদের দুজনার। এই ক্ষণ যেন কভুও শেষ না হয়। ওরা ভুলে গেল সমাজ সংসারের কথা। ভুলে গেল সমস্ত পৃথিবীর কথা। কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পান করতে লাগল। এই মহেন্দ্রমুহূর্তেই ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ওদের পাড়ার কয়েকজন লোক। লোকগুলি বলতে লাগল, ছি ছি এ কি বেহায়াপনা। প্রকাশ্যে ব্যভিচার! এবার সত্যেন ও শাকিলার চৈতন্য হল। ওরা লজ্জা পেয়ে গেল।দুজন দুজনের বাড়িতে চলে গেল। বাড়ি ফিরে এলে শাকিলার মা রান্নার কাঠি নিয়ে তেড়ে এলো তার দিকে। বলতে লাগল, এত বড় মেয়ে তুই; ওই হিঁদুর ছেলের সাথে এত কীসের ফুসুরফাসুর শুনি! তুই কি লজ্জা শরমের মাথা একেবারেই খেয়ে ফেলেছিস? শাকিলা চুপ করে রইল। আজ রাতে সত্যেন শাকিলা কারুরই ঘুম এলো না। রঙিন স্বপ্নে বিভোর ও নির্ঘুম হয়ে রইল দুজনেই। ভোর হতে এখনো দেরী আছে। শাকিলাদের বাড়ির সামনে খুব হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। বাবা-মার ঘুম ভেঙে গেল। গ্রামের অনেক লোক জড়ো হয়েছে ওদের উঠোনে। ওরা বলছে, সত্যেন ও শাকিলাকে ব্যভিচাররত দেখা গেছে। এমন প্রকাশ্য ব্যভিচারের বিচার হতেই হবে। না হলে সবার ছেলেমেয়েই নষ্ট হয়ে যাবে। শাকিলার বাবা-মা লজ্জায় অপমানে বাকরহিত হয়ে গেল। বিক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থী জনতা চলে গেলে তারা একত্রে বিকট ভাবে বিস্ফোরিত হল।ঝাঁপিয়ে পড়ল শাকিলার উপরে।শুরু হল মার এবং গালি। হতভাগী জাহান্নামী কুলটা এজন্য তুই শহরে যেতে চেয়েছিলি? শাকিলাকে মেরে আধমরা করে, নিজেরা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে কপাল চাপড়াতে লাগল। সত্যেনের বাড়িতেও একই অবস্থা।

চেয়ারম্যানের কাছে সবাই বিচারের দাবি জানিয়েছে। শুক্রবার আছরের পরে বিচার বসবে মসজিদের সামনে। শাকিলার বাবা, চ্যায়ারম্যান ও ঈমামের হাতেপায়ে ধরল। এবারের মত মাপ করে দেন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব। তার সকল কাকুতিমিনতি নাকচ হয়ে গেল। উনারা ন্যায়পরায়ণ মানুশ। মাইকিং করে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল আজ বিচার হবে। আশেপাশের গ্রাম থেকেও দলে দলে নারী পুরুশ আসতে লাগল সকল কাজকর্ম ত্যাগ করে, বিচার দেখার জন্য। অগণিত দর্শক উপস্থিত। বিচারকমণ্ডলি উপস্থিত। বিচারকেরা হচ্ছেন চেয়ারম্যান, মসজিদের ঈমাম মুয়াজ্জিন ইস্কুলের হেডমাস্টার আরো কয়েকজন গণ্যমান্য লোক। আজ পূর্ণিমা। চাঁদ গলে গলে জোছনা পড়ছে ধরায়। আজও সেদিনের মত ঝিরঝির বাতাস বইছে। ফুলের গন্ধ ভাসছে। সেই দিন সেই ক্ষণে ওরা প্রথম যখন দুজনার হাত ধরেছিল তখন কী অপূর্ব সুধা বইছিল দুজনার মনে! আর আজ এই ক্ষণে কী বইছে সেই একই দুটি মনে! সত্যেনকে গাছের সাথে বাঁধা হয়েছে। শাকিলাকে ধরে রেখেছে দুজনে। এ ক’দিনে শাকিলার উপর অনেক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে ওর বাবা-মা। ওর আহার-নিদ্রা নেই। চিন্তাশক্তি নেই। পৃথিবীটা ঘুরছে ওর সামনে। আল্লার নাম নিয়ে কোরান তিলাওয়াতের মাধ্যমে বিচারকার্য আরম্ভ করা হল। সূরা নূর পাঠ করে তর্জমা করলেন ঈমাম। “ব্যভিচারিণী ব্যভিচারী প্রত্যেককে এক’শ দোররা মারবে, আল্লার বিধান প্রতিপালনে তাদের প্রতি যেন তোমাদের দয়া না জাগে, যদি তোমাদের আল্লার ও পরকালের উপর বিশ্বাস থাকে, মুমিনদের একটি দল যেন শাস্তিদানকালীন উপস্থিত থাকে।“ ২৪ঃ২। চেয়ারম্যানের মেয়ে মিলু গিয়ে বাবার কাছে ফরিয়াদ করতে লাগল। বাবা, শাকিলার জায়গায় যদি আমি হতাম তুমি কি পারতে আমার সাথে এমন করতে? ওরা দুজনেই প্রাপ্ত বয়স্ক। ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। ভালবাসা ত কোনো পাপ নয়। এদেরকে এভাবে লোকারণ্যে অপমান করছ কেন? চেয়ারম্যান অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, দুই কলম লেখাপড়া করে খুব বেয়াদব হয়ে গিয়েছিস। তোর পড়ালেখা বন্ধ, যা এখান থেকে। চেয়ারম্যান সত্যেনকে বললেন, আল্লার আইনে বিচারের পর তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করে শাকিলাকে বিবাহ কর তাহলে তোমরা গ্রামে থাকতে পারবে। না হলে তোমার চুল কামিয়ে মাথায় ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হবে। সত্যেন দৃঢ়ভাবে বলল, আমরা কোন অন্যায় করিনি। আমাদেরকে নিয়ে এখানে নাটক করা হচ্ছে কেন? আমাদের এখনো বিয়ের সময় হয়নি। আমরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার পরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেব। কারো ভীতি প্রদর্শনে আমি ধর্মান্তরিত হব কেন? ধর্ম ত যার যার নিজের ব্যাপার। চারদিক হতে গালি বর্ষিত হতে লাগল সত্যেনের উপর। শালা মালাউনের বাচ্চার সাহস কত! মার মার মেরে ফ্যাল শালাকে। বিচার শুরু হয়ে গেল। দুজনকেই দোররা মারা শুরু হল। সত্যেন হুংকার দিয়ে উঠল, খবরদার কেউ শাকিলার গায়ে হাত দিলে তার হাত ভেঙে আমি গুঁড়ো করে দেব। এবার চারদিক থেকে ইট পাটকেল জুতা ছোঁড়া শুরু হল সত্যেনের উদ্দেশ্যে। সত্যেনের বাবা-মা ভাইবোন উন্মাদের মত দিগ্বিদিক ছুটছে, হাউমাউ করে কাঁদছে, বিচারকদের পায়ে লুটিয়ে পড়ছে। ওকে মেরে ফেলল, ওকে বাঁচান দোহাই আপনাদের। বিচারকগণ পাথরের মূর্তির মত নির্বিকার। অভুক্ত দুর্বল দেহ শাকিলার। মানসিক ভাবেও পর্যদুস্ত। ওর মনে হচ্ছে ও এই পৃথিবীর কেউ নয়। চারদিকের উত্তেজিত মানুশগুলিকে ওর কাছে কীটের মত লাগছে। দৃষ্টি ঝাপসা। মাথার মগজ ঘুরছে। উত্তেজনা ও গালিগালাজগুলি ওর কাছে মনে হচ্ছে কীটগুলি অর্থহীন কিছু চোঁচোঁ চিঁচিঁ শব্দ তৈরি করছে। দোররার আঘাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে ওর শরীর হতে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি যেন খুব বেড়ে গেল। সে শুনতে পাচ্ছে ভোঁ ভোঁ শব্দ। কয়েকটি দোররার পরেই কর্তিত বৃক্ষের মত, ছিন্ন লতার মত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শাকিলার সংজ্ঞাহীন রক্তাক্ত দেহ। মিলু দৌড়ে গেল তার সখির অচেতন দেহের দিকে। ঈমাম এখনো ওর অচেতন দেহে চাবুক চালিয়ে যাচ্ছে। মিলু তার হাত থেকে চাবুক কেড়ে নিয়ে বলল, হারামি আর একবার চাবুক চালালে তোকে খুন করে ফেলব। ঈমাম বলল, এক’শ দোররা এখনো হয়নি। মিলু নিজের গায়ের উড়না দিয়ে সখির গায়ের রক্ত মুছে দিচ্ছে, ধুলোবালি মুছে দিচ্ছে। শাকিলার বাবা-মা চেঁচিয়ে বলছে, ওই কুলটাকে আপনারা মেরে ফেলুন। চাই না এই পাপিষ্ঠাকে। মিলু এবং আরো কয়েকজনে মিলে ধরাধরি করে শাকিলাকে বাড়ি নিয়ে গেল। মিলু ডাক্তার আনল। সে নিজে সেবাযত্ন করছে সারাক্ষণ। দুদিন পরে শাকিলার জ্ঞান ফিরল।

ওদিকে সত্যেনকে মেরে ওরা তার হাতপা ভেঙে ফেলেছে। মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। ওকে শহরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। ওর বন্ধুরা মামলা করেছে সত্যেন ও শাকিলার উপর এই বর্বরতার জন্য। রূপগ্রামে পুলিশ গেছে ঘটনার তদন্তের জন্য। মিলুর ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে। তবুও সে যাচ্ছে না শাকিলাকে এভাবে ফেলে রেখে। সে শাকিলাকে বলেছে, আমি তোকে সাথে করে শহরে নিয়ে যাব। তুই ইউনিভার্সিটিতে পড়বি। টিউশানি করে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করবি। সত্যেনের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইলে রাখতে পারবি। শাকিলা শুধু নির্জীবের মত পড়ে থাকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সত্যেন ও শাকিলাদের পরিবারকে গ্রামে একঘরে করা হয়েছে। কেউ ওদের সাথে কথা বলে না। শাকিলার বাবার দোকান ও ফার্মেসিতে কেউ সওদা করতে আসে না। আয়-রোজগারের পথ একেবারেই বন্ধ। এই পাপী মেয়েটাই ত দায়ী সব দুরবস্থার জন্য। জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে তাদের। বাবা-মা অনুক্ষণ শাকিলাকে গালিগালাজ করে যাচ্ছে। হতভাগী জাহান্নামী মরতে পারিস না? পুকুরে জল আছে, ঘরে দড়ি আছে, ইঁদুর মারার রেটম আছে। তবুও মরিস না কেন? শাকিলা একটু সুস্থ হয়ে উঠেছে। কাল সকালে মিলু শাকিলাকে নিয়ে শহরে চলে যাবে। ও সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। ভোরে ভোরে এসেছে মিলু, শাকিলাকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে। লোকজন উঠার আগেই ওরা বেরিয়ে পড়বে। শাকিলা বিছানায় নেই। মিলু ওকে চারিদিকে খুঁজছে আর তাড়া দিচ্ছে। শাকিলা তাড়াতাড়ি কর, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখে শাকিলা আমগাছ তলে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। কিরে শাকিলা কথা বলছিস না কেন? শাকিলা তবুও চুপ। মিলু গিয়ে শাকিলাকে মৃদু ধাক্কা দিল। কী ব্যাপার শাকিলা দুলছে কেন? এবার সে আরো জোড়ে ধাক্কা দিল। শাকিলা আরো জোরে দুলতে লাগল। শাকিলা আম গাছে ঝুলে আছে। যেই আমগাছের ছায়ার নিচে বসে বসে সে পড়ত। মিলু মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল শাকিলার ঝুলন্ত পায়ের নিচে। শাকিলার মা চিৎকার দিল, কী করলি রে পোড়াকপালি; ইহকাল পরকাল সবই খেলি? লোকে লোকারণ্য হল শাকিলাদের বাড়ি। গ্রামের সবাই পরিত্যাগ করেছিল ওদের। আজ সবাই এলো জোয়ারের মত তামাশা দেখতে। পুলিশ এসে শাকিলার লাশ ময়না তদন্তের জন্য থানায় নিয়ে গেল। সন্ধ্যায় শাকিলার কাটাছেঁড়া লাশ ফিরিয়ে আনা হল বাড়িতে। ওদিকে সত্যেন ও শাকিলার উপর যারা অবিচার করেছিল তাদেরকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে আজ। সত্যেন কিছুটা সুস্থ হয়েছে। ও গ্রামে এসেছে শাকিলাকে দেখতে। সত্যেন শাকিলাদের বাড়িতে এসে দেখে শাকিলার নিথর দেহ পড়ে আছে উঠোনের কোণে চাটাইয়ের মধ্যে। বাড়িতে জনস্রোত। সবাই বলছে কুলটার মরণ এভাবেই হয়। সত্যেন বলছে, আমায় ছেড়ে স্বার্থপরের মত চলে গেলি শাকিলা? আমাদের উপর যারা অন্যায় করেছে, পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেছে। তুই দেখে গেলি না? তোর না অনেক পড়াশোনা করার সাধ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বি না তুই? ভাল ত আমরা দুজনেই বেসেছিলাম। তবে আমায় এ যুদ্ধক্ষেত্রে একা ফেলে কোথায় গেলি? তার পর সত্যেন গগনবিদারী কণ্ঠে হাসতে লাগল। কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে গেল মুহূর্তে। তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেল। কতটুকু ভালই না সে বেসেছিল শাকিলাকে!
মৃত্যুর আগে শাকিলা একটি চিঠি লিখে রেখেছিল তার জামার ভেতরের দিকে সেফটিপিন দিয়ে গেঁথে। সে লিখেছে, “ আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি সজ্ঞানে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করলাম। সমাজের কাছে আমি ব্যভিচারিণী আত্নহননকারিণী পাপী। এই পাপীর মৃতদেহ কেউ সৎকার করতে চাইবে না। তাছাড়া আমিও চাই না, যে ধর্ম আমার ও সত্যেনের সাথে এমন অন্যায় করেছে সেই ধর্মের ছোঁয়া আমার মৃতদেহেও লাগুক। আমার দেহ আমি মেডিকেল কলেজে দান করে গেলাম।“ ইতি শাকিলা
ঢাকা থেকে এম্বুলেন্স এসে শাকিলার মরদেহ নিয়ে গেল। শাকিলার বাবা-মা মাটিতে পড়ে রোদন করছে, কী করলি, কী করলি। আমাদেরও ডুবিয়ে গেলি, জাহান্নামী করে দিয়ে গেলি। সবাই বলতে লাগল, পাপীর কপালে একটু মাটিও জুটল না। ব্যভিচারিণী আত্নহত্যাকারিণীর ত এমনই হবে। সত্যেন উন্মাদ হয়ে পথে পথে ঘুরছে। মুহূর্তে হাসছে, মুহূর্তে কাঁদছে, ছুটে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীন। একটি বিচার একজন দুর্দান্ত মেধাবী ছেলেকে উন্মাদ করে দিল। একটি মেধাবী মেয়ে যে অনেক পড়তে চেয়েছিল, প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল তাকে মরতে বাধ্য করল।