মানুষের জ্ঞানের উন্মেষ যবে থেকে হয়েছে, রাতের আকাশ ও নক্ষত্র তার সঙ্গী হয়েছে। অন্ধকার রাতে উন্মুক্ত প্রান্তরে রাতের আকাশ ও তার নক্ষত্রমালার যে নান্দনিক ও বৌদ্ধিক আবেদন, তা কোনো হোমো-স্যাপিয়েন্সের পক্ষেই উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আজকের আলোক দূষণ, নগরের ধূলিকণা ও হোম এন্টারটেইমেন্টের যুগে রাতের আকাশের আবেদনটা ঠিক বোঝা মুশকিল। কিন্তু প্রাচীন মানুষের কাছে তা ছিল সাক্ষাৎ বাস্তবতা যার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল না। মানুষ লক্ষ করেছে, রাতের আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ চলাচল করে, রাতের তারারা একেক ঋতুতে একেক জায়গায় অবস্থান করে। মানুষ তার সমাজ-বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক অভ্যাসকে আকাশে তারাদের মধ্যে প্রতিফলিত দেখেছে। ঠিক এভাবেই তারা বিভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডলীর কল্পনা করেছে, তাতে ছবি আরোপ করেছে, নামকরণ করেছে। ফলে রাতের আকাশমণ্ডলীর কল্পনা, তাদের নামকরণ, তাদের আকৃতির প্রতীক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা বিজ্ঞানের ইতিহাসবেত্তাদের কাছে একটি প্রিয় বিষয়।
প্রাচীন মানুষের কাছে জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন গুরুত্ব বহন করে। বুদ্ধিমান মানুষ লক্ষ করে থাকবে, ঋতু পরিবর্তনের সাথে আকাশের তারকারাজির পরিবর্তন সম্পর্কিত। স্বাভাবিক কার্যকারণ বুদ্ধিতেই সে ঐসব তারকারাজিকে তার পারিপার্শ্বিকতার নিয়ন্তা হিসেবে চিহ্নিত করবে। যৌথ সমাজ জীবনে পালা-পার্বণ, উৎসবাদি, জরুরি বিষয় এবং দেখা যায় সেসব ঘটনা ঋতু-নির্ভর। তাছাড়া কৃষির আবিষ্কারের ফলে দেখা গেল কখন কোন শস্য বুনতে হবে, কখন বন্যা হবে, কখন অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি হবে এসব জানা জরুরি। দেখা গেল, এইসব ঘটনাও আকাশের তারারাজির সাথে সম্পর্কিত। তাছাড়া দৈনন্দিন সূর্যের উদয়-অস্ত, চাঁদের ক্ষয়প্রাপ্তি-পূর্ণতা প্রাপ্তি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি ঘটনাবলিও প্রাচীন মানুষের মননকে প্রভাবিত করেছে। স্বভাবতই, প্রাচীন মানুষ এসব ঘটনাকে অলৌকিকতার মোড়কে ঢেকে ফেলে। সমাজে পুরোহিত শ্রেণী দেখা দেয়, যারা আকাশের ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করে এদের প্রপঞ্চ বোঝার চেষ্টা করেছে। এই প্রোটো-বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দিয়ে এই শ্রেণী প্রাকৃতিক ঘটনাবলির আগাম খবর দেবার চেষ্টা করেছে। এভাবে সমাজের কর্তৃত্ব তারা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়াসী হয়েছে। আকাশের দৈব ঘটনাবলিকে তাদের ভাগ্য-নিয়ন্তা হিসেবে চিনে নিয়ে মানুষ তাদের পুরোহিতদের চাহিদামতো মন্দির নির্মাণ করেছে, যুদ্ধ করেছে, ফসল বুনেছে। অর্থাৎ, একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে নিয়মতান্ত্রিক কর্মচাঞ্চল্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সামাজিক বিকাশের এসব পর্যায়গুলোর সাথে সাথে রাতের আকাশ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানেরও পালাবদল ঘটেছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটেছে। প্রথমে হয়ত আকাশের প্রকট জ্যোতিষ্কদের নিয়ে কিছু প্রাথমিক কল্পনা চালু হয়েছে, তারপর একাধিক তারকারাজির কোনো সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়েছে, সহজে স্মরণযোগ্য নামকরণ করা হয়েছে যাতে মুখে মুখে এই জ্ঞান পরম্পরায় রক্ষিত থাকে। তারপর জগৎ-মডেল খাড়া করা হয়েছে – অর্থাৎ অমুক অমুক তারকারাজির সমাবেশে তমুক দৈবশক্তির সমাবেশে অমুক ঘটনা ঘটবে। যুগে যুগে এগুলোর পরিমার্জন ঘটে, এসব জগৎ-বীক্ষা উন্নত হয়। ক্রমান্বয়িক এই ধাপগুলোতে আমরা সমাজের প্রভাব খুঁজে পাই। যে সভ্যতার মানুষ এসব করতে সক্ষম হয় তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে আমার তাদের সংস্কৃতির চিহ্নগুলোকে আবিষ্কার করি। এভাবে আমরা দেখি কীভাবে ধাপে ধাপে রাশিচক্র বা zodiac গড়ে ওঠে – রাশিচক্রের ১২টি তারামণ্ডলী ৩টি ধাপে ৪টি করে মণ্ডলী (চতুষ্টয় বা কোয়ার্টেট) নিয়ে গঠিত হয়েছে। দুটি মণ্ডলীর সমসাময়িক উদয়-অস্ত দেখে আমরা দিক-নির্দেশনার ব্যবস্থার উন্মেষ লক্ষ করি। এভাবে বিজ্ঞানীরা মানবসমাজে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিকাশের ছয়টি ধাপ চিহ্নিত করেছে – পুরাকালীন চিন্তাভাবনা, মানবকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, স্থানকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, পৃথিবীকেন্দ্রিক, সূর্যকেন্দ্রিক এবং সবশেষে কেন্দ্রবিমুখী চিন্তাভাবনা। এই প্রতিটি ধাপেই রাতের আকাশের চালচিত্র বদলেছে। অর্থাৎ মানুষের কল্পনা যেমন বদলেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বদলেছে তারামণ্ডলীর চেহারা। তারামণ্ডলীর চেহারা বদলের সাথে মানুষের চিন্তার ও সামাজিক পরিবর্তনের এই ধাপগুলোর ব্যাপারে বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চাকারী সকলের ঐক্যমত নাও থাকতে পারে। তবে তারামণ্ডলীর কল্পিত ছবিকে প্রতীক ধরে নিয়ে মানুষের মানস-সামাজিক রূপান্তরের এ ব্যাপারটি যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। অন্তত সেরকমই মনে করেন রুশ চিন্তাবিদ অ্যালেক্স গুর্শটিন ও তাঁর অনুসারীরা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ নিজেকে নিয়ে কী ভেবেছে এবং তার আশপাশের প্রকৃতি সম্পর্কে কী ভেবেছে কিংবা প্রকৃতিকে যেভাবে দেখেছে, তার একটা প্রতিফলন মানুষের কল্পনায় অবশ্যই থাকবে। এই ছাপকেই প্রকারান্তরে দেখা যাবে মানুষ তার দৈনন্দিন ব্যবহৃত তৈজস, পোড়ামাটির খেলনায়, মূর্তিতে, আকাশের কল্পিত চিত্রে, গল্পে-গাথায়-মিথে ব্যবহার করেছে। এভাবে বলা যায়, একেক ধাপে মানুষ যেভাবে তারামণ্ডলীতে ছবি কল্পনা করেছে সেটা আসলে তার সেইসময়কার প্রচলিত সামাজিক চিন্তার প্রতীক। এভাবে মানব সভ্যতার কোন দশায় সে কীভাবে চিন্তা করছে এবং কী প্রতীক ব্যবহার করছে সেটা সেই সময়কার আকাশচিত্র দেখলে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
প্রতীক বিশ্লেষণের এই পুরো ব্যাপারটা বেশ ‘কোয়ালিটেটিভ’, অঙ্ক কষে উত্তর মেলানোর মতো নয়। কিন্তু তবুও এই বিশ্লেষণের একটা অন্তর্নিহিত আকর্ষণ আছে যেটা ফেলনা নয়। মানুষের সামাজিক বিকাশের ব্যাপারটাতো সংখ্যার হিসাবে মেলানো মুশকিল। সেজন্যই আমরা দেখি, রাশিচক্রের চতুষ্টয়গুলো ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে এবং এই গড়ে ওঠার মধ্যে মানুষের ঐ সময়কার সমাজের একটা গাঢ় প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
সামাজিক বিকাশের সবচেয়ে প্রাচীন ধাপে, যেটাকে কেউ কেউ বলেন পুরাকালীন চিন্তাভাবনা (প্রি-অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক এরা), মানুষ নিজেকে প্রকৃতির সন্তান বলে চিহ্নিত করে। সে প্রকৃতিকে কেবল বুঝতে শিখেছে, তখনো তার অহং জেগে উঠেনি, তখনো নিজেকে কেন্দ্র করে সবকিছু ভাবনার প্রয়াস সে পায়নি। মানব সমাজের এই ধাপটা গুর্শটিন ও তাঁর দল ধরেছেন পুরাপলীয় যুগ থেকে নবোপলীয় যুগের শেষাবধি। অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ে আদিপুরুষের ধারণা জন্মে, মানুষ মনে করতে শুরু করে তারা কোনো আদি পিতা ও আদি মাতার উত্তরসূরী। সম্ভবত এ সময়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছিল। কারণ, ঐ সময়ে বিভিন্ন জায়গায় মাতৃদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়। মানুষের প্রকৃতি জগৎ এ সময়ে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায় – আকাশ, মাটি ও পানি। তারার জগৎ, চন্দ্র, সূর্য, খেচর – এসবই আকাশের অন্তর্ভুক্ত হয়। আকাশের নিচে ও পানির ওপরে যা কিছু – মাটি, ফসল, জন্তু, শস্য – সবই মাটির জগতের বাসিন্দা। প্রকৃতির এই ত্রিধা বিভক্তি আকাশের তারামণ্ডলীর কল্পনায়ও দেখা যায়। চাঁদের গতিপথ পর্যবেক্ষণ থেকে ‘সাতদিনে’ সপ্তাহের ধারণা উপ্ত হয়, তারামণ্ডলীতেও ‘সাতটি’ তারার গ্রুপ বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়। যেমন সপ্তর্ষিমণ্ডল, কৃত্তিকা ইত্যাদি। বিশেষ করে সপ্তর্ষিমণ্ডলীটির কথা বলতে হয়, এটি উত্তর গোলার্ধের মধ্য-অক্ষাংশ থেকে প্রায় সারাবছরই দেখা যায়। এই মণ্ডলীতে একটি ভালুকের কল্পনা করা হয় যেটা অনেকের মতে আরো বহু পুরনো একটি ঘটনা। কারো মতে এটা চতুর্দশ সহস্রাব্দেরও আগের ঘটনা। প্রতীকবাদীরা বলেন, তুষার যুগের শেষের দিকে মধ্য ও উত্তর অক্ষাংশে ভালুক একটি নিয়মিত প্রাণী ছিল। একটি বিশালদেহী ভালুক দুপায়ে ভর দিয়ে মানুষের মতো খাড়া হয়ে চলছে – এটা আদিম মানুষের কাছে এক বিস্ময়কর আকর্ষণ ছিল। ফলে ভালুক ছিল আদিম মানুষের জন্য কল্পনার এক দারুন বিষয়। এজন্য মানুষ-ভালুক বন্ধুত্ব নিয়ে নানা গল্প ও মিথ প্রচলিত আছে, বাচ্চাদের একটি কার্টুনও (‘মোগলি’) আছে যা আসলে ঐ সময়কার সমাজ বাস্তবতার একটি প্রতিফলন। ফলে পুরাপলীয় মানুষের কাছে ভালুক ‘পরম আদিপুরুষ’ হিসেবে বিবেচ্য ছিল। বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকান রেড-ইন্ডিয়ানদের মিথেও আমরা ভালুক-রূপী সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখি। এই জন্য গিংরিচ বলেছেন,
“খুব সম্ভবত বহুকাল আগে আকাশে ভালুকের আইডিয়াটি প্রাচীন আদিবাসীদের সাথে বেরিং প্রণালী পার হয়েছিল, বিশেষ করে যখন সাইবেরিয়ার প্রায় সর্বত্রই এই আইডিয়াটি দেখা যায়, যা আমাকে আলেকজান্দার মার্শাক জানিয়েছেন। এই রকম একটি সুপ্রাচীন ধারণা ইউরোপের গুহাবাসী মানুষের হাত ধরে সারা পৃথিবীতেই সম্ভবত ছড়িয়ে পড়ে।”
এরকম আরো দুয়েকটি তারামণ্ডলীর বর্ণনা এবং কল্পনা আমরা পেয়েছি সুদূর বরফযুগ থেকেই। তারামণ্ডলীর পাশাপাশি সপ্তাহে দিনের সংখ্যাও ‘সাত’ বলে ধার্য হয় এই সময়ে। ৭-সংখ্যাটির প্রতি এই সময়ে বা নবোপলীয় যুগে বিশেষ মনোযোগ দেখা যায়। তাছাড়া নবোপলীয় যুগে ‘দিগন্ত জ্যোতির্বিদ্যা’ বিশেষভাবে উন্নত হয়। বছরের বিভিন্ন সময় দিগন্তের কোনদিকে সূর্য ওঠে বা ডুবে যায়, কোন নক্ষত্র কখন ওঠে ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে স্টোনহেঞ্জ-জাতীয় মন্দির বা মানমন্দির তৈরি হয়। দিগন্তের জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণ এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। ফলে নক্ষত্রের heliacal rising ও setting, বিশেষ করে বিভিন্ন ঋতুতে সূর্যের উদয়-অস্ত, মোটামুটি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষিত হয়। তখন তো আর লেখার ব্যবস্থা ছিল না, লেখনি তখনো আবিষ্কৃতই হয়নি! তাই সহজ পদ্যে-কবিতায়-শ্লোকে এসব বিষয়াদি মুখে মুখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হতো। এই পরম্পরাই পরবর্তী কালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে লিখিত উপাত্ত সংরক্ষণের ঐতিহ্য (সুমেরু-আক্কাদ-ব্যবিলনে) গড়ে তোলে।
এই সময়কার চিন্তাভাবনার একটি উত্তরসূরী হিসেবে নিওলিথ সময়ের শেষের দিকে ‘টুইন কাল্ট’ বা ‘যমজ পূজা’ বা ‘জোড়া পূজার’ ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন ঘটে। যখনই একজন আদিম পূর্বসূরীর ধারণা তৈরি হয় এবং আদিম মানুষ দেখে প্রায় সবই জোড়ায় জোড়ায় আসে কিংবা বিপরীত ধর্মবিশিষ্ট দুটি অস্তিত্বের প্রবল উপস্থিতি প্রকৃতিতে বিদ্যমান, এসব থেকেই আদিম মানুষের এই বিশেষ সংস্কারটি তৈরি হয়। বৃষ্টি-বজ্র, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, আবাদী-অনাবাদী ভূমি, নারী-পুরুষ – এইসব বৈপরীত্যের একত্র সমাবেশ আদিম মানুষের মধ্যে যমজপূজার ঐতিহ্য সৃষ্টি করে। তবে প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠির মানুষের মধ্যে এই যমজ পূজার সাথে অশ্ব-সংক্রান্ত উপাসনার একটা স্পষ্ট সংযোগ দেখা যায়। এটা কি শুধু ইন্দো-ইউরোপীয়দের বিশেষত্ব ছিল নাকি সার্বজনীন লক্ষণ ছিল, সেটা বোধহয় স্পষ্ট করা মুশকিল। আরো একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, এই যমজ পূজা এবং অশ্ব উপাসনার বিষয়টির সাথে সূর্য-পূজার একটা ঘনিষ্ঠ অন্বয় দেখা যায়। সূর্যোপাসকদের মধ্যে অশ্বের বিষয়টা খুবই উল্লেখযোগ্য আর তাই দেখা যায় প্রাচীন বিভিন্ন সংস্কৃতির মিথে সূর্যের রথ চালিয়ে আনে অশ্বই, বলদ কিংবা সিংহ নয়। ইন্দো-ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত জোরালো সত্য। ঋগ্বেদ ও আবেস্তায় এর প্রচুর প্রমাণ দেখা যায়। সূর্যের উপাসনার সাথে সূর্যের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণও ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেইসাথে ‘দিগন্ত জ্যোতির্বিদ্যার’ উন্মেষ এবং নিওলিথিক মানমন্দিরের (স্টোনহেঞ্জের পূর্বসূরী) ছড়াছড়ির একটা ব্যাখ্যা মেলে। ফলে সূর্য যে নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে সেই ক্রান্তিবৃত্ত (সূর্যপথ, ভূ-কক্ষ, রবিমার্গ বা ecliptic) সম্পর্কে মানুষ প্রাথমিক ধারণা নিতে শুরু করে। এই ক্রান্তিবৃত্তের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানে খুব জরুরী একটি বিষয়।
দ্বিতীয় ধাপে পুরাকালের অগোছালো রহস্যময় চিন্তাভাবনার উত্তরসূরী হিসেবে, আমরা পাই মানবকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার ধাপ। এই পর্যায়ের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ থেকে ৪০০০ সাল। এই সময়ে আদিম মানুষ অনেকখানি থিতু হয়ে আসে, কৃষিভিত্তিক গ্রাম-ব্যবস্থার প্রচলন হয়, কৃষির আবিষ্কার হয়। কৃষির আবিষ্কারের ফলে ঋতু সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা গুরুত্ব পায়: কোন ঋতুর পর কোনটি আসবে, কখন ফসল বুনতে হবে, কখন তুলতে হবে, বর্ষার আগমন ইত্যাদির আগাম খবর জরুরি হয়ে পড়ে। ঋতু পরিবর্তন সূর্যের সাথে সম্পর্কিত। ফলে এই সময়ে সূর্যপূজার একটা সাধারণ চল দেখা যাবে। পূজার কারণে হোক কিংবা কৃষির কাজে, সূর্য পর্যবেক্ষণ এই সময়কার একটা বড় অবদান। এই সময়ে বছরের চারটি বিশেষ দিন মানুষ সহজেই চিহ্নিত করে রাখতে শেখে। বছরের এই চারটি বিশেষ দিন অন্যান্য দিনগুলোর থেকে আলাদা। এরা হলো –
১/ মহাবিষুব (দিন ও রাত সমান)
২/ উত্তর অয়নান্ত বা কর্কট সংক্রান্তি (সামার সলস্টিস; দিন সর্বাধিক, রাত ক্ষুদ্রতম)
৩/ জল বিষুব (দিন ও রাত সমান)
৪/ দক্ষিণ অয়নান্ত বা মকর সংক্রান্তি (উইন্টার সলস্টিস; দিন ক্ষুদ্রতম, রাত দীর্ঘতম)
– এই চারটি দিগ্বিন্দু বা কার্ডিনাল পয়েন্টস বছরের ৪টি উল্লেখযোগ্য দিন। এই ৪টি দিন বছরকে ৪টি ভাগে ভাগ করে – একেকভাগে একেক ঋতুর সমাগম আর সেই অনুযায়ী কৃষি ও অন্যান্য পর্বাদির শুভাগমন সূচিত হয়। গুর্শটিনের মতে, এই সময়কালেই রাশিচক্রের প্রথম চতুষ্টয়ের আবির্ভাব হয়। এর নাম মিথুন চতুষ্টয় বা ‘জেমিনি কোয়ার্টেট’ (জেমিনি বা মিথুন, ভার্গো বা কন্যা, স্যাজিটারিয়াস বা ধনু, এবং পিসিস বা মীন); এই চিন্তাবিদদের মতে, যেহেতু এই সময়েই মানুষের সমাজে মানবকেন্দ্রিক বা অ্যানথ্রোপোমর্ফিক চিন্তাভাবনার বীজ প্রোথিত হয় এবং যমজ পূজার ব্যাপারটা থাকেই, কাজেই এই সময়ে বছরের ঐ চারটি বিশেষ দিনকে বা ক্রান্তিবৃত্তের ৪টি দিগ্বিন্দুতে চিহ্নিত করার জন্য উক্ত সামাজিক প্রতীকগুলোর ব্যবহারই বাঞ্ছনীয়। আর ঠিক তাই আমরা দেখি, এই চারটি মণ্ডলীতে – মিথুনরাশিতে সাধারণত একজোড়া নারী-পুরুষ, ধনুরাশিতে ধনুর্ধারী এক মানুষ (কিংবা অশ্ব যা পরে সেন্টরের আকৃতি নেয়), কন্যারাশিতে দন্ডধারী এক মহিলা। কেবল মীন রাশিতে জোড়া মাছের কল্পনা দেখা যায় যা মানবকেন্দ্রিক নয়, তবে আকাশে ‘পানির ভাগটি’ নির্দেশ করে। এটা মৃত্যু ও জীবনকেও প্রতীকায়িত করে থাকতে পারে। অর্থাৎ, যে সমাজের মানুষেরা প্রথম ঐ দিগ্বিন্দু চারটিকে সনাক্ত করেছে, তারাই তাদের সমাজে প্রচলিত প্রতীক দিয়ে ঐ মণ্ডলী চারটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে – এই হলো মোদ্দাকথা।
যাহোক, মানব ইতিহাসে ক্রান্তিবৃত্তের চারটি বিন্দুকে সনাক্ত করা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট পঞ্জিকা সৃষ্টির ঐতিহ্যের সৃষ্টি করে। অবশ্য চান্দ্রপঞ্জিকা আরো প্রাচীন আবিষ্কার। যা-হোক, এই ধাপে রাশিচক্রের ৪টি মণ্ডলী চিহ্নিত করা, বিশেষ করে যথাক্রমে মীন-মিথুন-কন্যা-ধনুতে ৪টি দিগ্বিন্দু স্থিরীকরণের ঘটনা অনেকেই স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, এই স্থিরীকরণের বিষয়টি অতিমাত্রায় প্রতীক-নির্ভর হয়ে যায়, এবং পুরো ব্যাপারটার কোনোই প্রমাণ নেই। একমাত্র ইন্দো-ইউরোপীয়দের মৌখিক শ্রুতি-নির্ভর গাথা (ঋগ্বেদ ও আবেস্তা) এবং তাদের কিছ বস্তু-সংস্কৃতির ভিত্তিই এর প্রধানতম সমর্থন। গুর্শটিনের এই মতবাদ একেবারে যুক্তিহীন নয়, এবং এতে বেশ চিন্তার খোরাক আছে, যদিও এর সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রায় সবই অপ্রত্যক্ষ। ফলে এই সিদ্ধান্ত একটু বেশীমাত্রায় ‘কোয়ালিটেটিভ’ পর্যায়ের হয়ে যায়, যেটা বিজ্ঞানীদের কষ্টিপাথরের অনুপযুক্ত। আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, যেটি গুর্শটিনের মতবাদকে কিছুটা ভিত্তি দেয়, ইন্দো-ইউরোপীয়দের অধিকাংশ প্রতীকেই দ্বৈততা বা ‘ডুয়ালিজম’ লক্ষ করা যায়। রাশিচক্রের এই চতুষ্টয়েই এরকম দ্বৈতসত্তার বহিঃপ্রকাশ একটু যেন বেশী। যেমন মিথুন তো সৃষ্টির মূল (নারী ও পুরুষ) জোড়াকেই রূপায়িত করছে। এরা মানবজাতীর আদিমতম সেই প্রথম নারী ও প্রথম পুরুষেরই প্রতীক যেন-বা। অন্যদিকে মীনরাশিতে দুটি মাছ দেখা যায়। ধনুরাশির যে ছবিটি আমরা আজকাল দেখি তাতে অশ্বারোহী এক ধনুর্ধর পুরুষকে দেখা যায়। সেন্টরের এই রূপটি কিন্তু অপেক্ষাকৃত নবীন। মেসোপটেমিয়ায় প্রাপ্ত (কাসাইট যুগের) ব্যাবিলনীয় সীমানা-প্রস্তরের একটি ছবিতে অশ্বারোহীটির দুটি মাথা, দুটি লেজ ও দুটি ডানা সম্বলিত কিম্ভূত এক মূর্তি দেখা যায়। আর কন্যারাশির মহিলাটি একদিকে মাতৃতান্ত্রিক কৃষিসমাজের প্রতীক, অন্যদিকে তার হাতে গমের শীষ শোভা পাচ্ছে যা হলো উর্বরতার প্রতীক।
মানবকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার স্তরে মানুষ কৃষি আবিষ্কার করে, থিতু হয়ে আসে এবং এই পর্বের শেষে লেখনির আবিষ্কার করে। অবশ্যই এই লেখনি আজকের মতো বর্ণমালা ভিত্তিক ছিল না, ছিল সংকেত ও চিত্র নির্ভর। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ফলে মানবসমাজে নতুন বিন্যাস দেখা গেল। যখন অনেক অনেক গ্রাম ও বসতি স্থাপন হতে লাগল, তখন কোনো কোনো গ্রামবাসী বা কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষ আরো খানিকটা প্রত্যাশী হয়ে উঠল – তারা নগর স্থাপন করল। এই নগরকে ঘিরেই কিছু সময় পরে দানা বাধে রাষ্ট্রের ধারণা এবং সাম্রাজ্যের বীজ। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ ভাগ, তৃতীয় সহস্রাব্দের পুরোটা এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগ (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ২০০০) নিয়ে মানবসমাজের এই তৃতীয় ধাপ শুরু হয়। এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য ও মিশরে সভ্যতার উন্মেষ হতে দেখা যায়। সুপ্রাচীন এলাম সংস্কৃতির বিকাশ হয় এই সময়ে, এখানে উইলি হার্টনার কথিত ‘সিংহ ও ষাঁড়ের সংস্কৃতি’ (লায়ন অ্যান্ড বুল মোটিফ) বিকাশ পায়। মিশরীয় সংস্কৃতি বিকশিত হতে শুরু করে, ফারাও ইমহোটেপ (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৫০) রাজত্ব করেন, বৃহৎ পিরামিড ও স্ফিংস নির্মিত হয়। এই সময়ে দিগন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞান পূর্ণতা পায়, মেগালিথিক কাঠামোগুলোর ব্যাপ্তি বাড়ে। স্টোনহেঞ্জের নির্মাণ কয়েক ধাপে শুরু হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০-এর আগেই তার পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ আকার পায়, খ-বিষুব ও খ-ক্রান্তিরেখাসমূহ সম্পর্কে ধারণা পাকা হয়। এই কাঠামোগুলো খুবই কৌতূহলৌদ্দীপক। এরা একই সময়ে ক্যালেন্ডার, মন্দির, ঘড়ি ও মানমন্দির হিসেবে কাজ করত। আগেই বলেছি, এসব কাঠামোর নির্মাণ দিগন্ত জ্যোতিবির্দ্যার সার্থক প্রয়োগ নির্দেশ করে। সূর্য ও চন্দ্র কোথায় কখন ওঠে-ডোবে, মহাবিষুব ও কর্কট সংক্রান্তির দিন নির্ধারণ – এসবই এই কাঠামোগুলো চিহ্নিত করেছিল। অনেকে বলেন, এসব কাঠামো থেকে গ্রহণ-সংক্রান্ত বিস্ময়কর ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণীও করা যেতো হয়ত। অন্যদিকে, ব্যাবিলনে গ্রহ পর্যবেক্ষণ পরিপূর্ণতা পেতে শুরু করে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০তে শুক্রগ্রহ পর্যবেক্ষণের হদিস পাওয়া যায়। এই সময়টি সৌর উপাসনার মধ্য-গগন। যেহেতু সাম্রাজ্যের ধারণা এই সময়ে শুরু হয়, তাই আমরা মানুষের চিন্তার জগতে মানবকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার জায়গায় স্থানকেন্দ্রিক ধারণা (টপোসেন্ট্রিজম) দেখতে পাই। একই জিনিস দেখা যায় আকাশচিত্রের ক্ষেত্রেও। পৃথিবীর অক্ষের অয়নচলনের ফলে ক্রান্তিবৃত্তের দিগ্বিন্দুগুলো বদলে গেছে। ফলে আগের ধারণায় যেখানে মিথুন-চতুষ্টয়ে এই চারটি দিন চিহ্নিত ছিল (অবশ্য যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে!), তা এখন ঐ চারটি মণ্ডলীতে আর হয়না। পৃথিবীর অক্ষ ২৬,০০০ বছরে একটি পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে, ফলে প্রতি ৭২ বছরে দিগ্বিন্দুগুলো ১০ সরে যায়। এভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, ৩০০ পরিসরের একটি মণ্ডলী থেকে পরবর্তী মণ্ডলীতে ঘুরে যেতে সময় লাগে ২১৬০ বছর। কাজেই এই তৃতীয় ধাপে এসে নতুন চারটি মণ্ডলী চিহ্নিত করতে হলো যেখানে ক্রান্তিবৃত্তের চারটি দিগ্বিন্দু পড়ে। এই চতুষ্টয়টির নাম ‘টরাস কোয়ার্টেট’ বা বৃষ-চতুষ্টয়। এই চতুষ্টয়ের ক্রম (মহাবিষুব-উত্তর অয়নান্ত – জলবিষুব-দক্ষিণ অয়নান্ত) যথাক্রমে বৃষ (টরাস), সিংহ (লিও), বৃশ্চিক (স্করপিও), কুম্ভ (অ্যাকুয়ারিয়াস); এই চতুষ্টয়ে কুম্ভ ছাড়া আর কোথাওই মানুষের মূর্তি নেই। এখানে ষাঁড় ও সিংহের যে ছবিটা আসে, উইলি হার্টনারের মতে তার বিশদ ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে। এখানে সিংহের বিক্রম সাম্রাজ্যের শক্তির বহিঃপ্রকাশ আর বৃষ উর্বরতার বা নবান্নের। এখানে কুম্ভের ছবিতে মানুষের হাতে কলসিদ্বয় থেকে পানির পতনশীল স্রোত কল্পনা করা হয়। লক্ষণীয়, এই দক্ষিণ অয়নান্ত বিন্দুতে আগে যেখানে মীন কল্পিত ছিল, এখন সেখানে কুম্ভ, এবং দুটোই পানির সাথে সম্পর্কিত। তাই পাতাল সংক্রান্ত পানির ধারণা এই দুই মণ্ডলীতেই থাকছে। মীনরাশিতে দুটি মাছ, কুম্ভে দুটি কলস – একটি জীবনের একটি মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে লাগসই। এই বৃষ চতুষ্টয়ের কল্পনায় দেখা যায় প্রতীক হিসেবে এই সময়ে মানুষের কল্পনায় আরো বিমূর্ত চিন্তা ব্যবহৃত হয়েছে। এই সময়ে মানুষ স্থানকেন্দ্রিক কল্পনাশ্রয়ী প্রতীক ব্যবহার করতে শুরু করে। কারণ এই সময়ে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, মানুষ কিছুটা জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছে। এখানে একটি প্রশ্ন আসে, দিগ্বিন্দুর পরিবর্তনের ব্যাপারটা কি মানুষ লক্ষ করেছিল, সে কি অয়নচলন বুঝতে পেরেছিল? মনে হয় না, কারণ অয়নচলন ঠিকভাবে বুঝতে হলে মৌখিক শ্রুতি নির্ভর তথ্যের নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য, অথবা লিখিত পর্যবেক্ষণের ধারাবাহিকতার প্রয়োজন। এর কোনোটিই এই সময়ে ছিল না। হিপার্কাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০) অনেক পরে নিশ্চিতভাবে অয়নচলন ধরতে পেরেছিলেন। কারণ, তাঁর কাছে এমন এক কবিতা এসে পড়ে যাতে বহুপূর্বের আকাশের বর্ণনা নিখুঁতভাবে লেখা ছিল। তিনি একে ভুল ও বাচালের বর্ণনা ভেবে ফেলে না দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে এই পরিবর্তনের ব্যাখ্যা করা যায়।
নক্ষত্রমণ্ডলীতে বৃষ ও সিংহের কল্পনা নিয়ে উইলি হার্টনারের গবেষণা দেখায় যে, এই প্রতীকদ্বয়ের ব্যবহার প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই বারবার এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের এলামাইট সিলমোহর থেকে শুরু করে সুমেরিয় আর্ট এবং শেষের দিকে পারস্যের মিনিয়েচার আর্টেও এই মোটিফের দেখা মেলে। হার্টনারের মতে, এই মহাজাগতিক মোটিফের উৎস নিহিত বসন্ত (যা উর্বরতার সময় ও প্রতীক) থেকে গ্রীষ্মের (প্রচণ্ড দাবদাহের প্রতীক) আগমন সংক্রান্ত ঋতু পরিবর্তনের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনায়। তবে সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে সিংহ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় – ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে, মাইসিনীয় নগরের দ্বারে জোড়া সিংহের মূর্তিতে, পাইল্সের সিংহাসনের দুপাশে দুটি সিংহীর ছবিতে, হারকিউলিসের গল্পে, হেটিক ও লুবিয়ান চিত্রে। অন্যদিকে বৃষ প্রতীকের উপস্থিতি দেখা যায় ইন্দো-ইউরোপীয় ও সেমিটিক সংস্কৃতিতে, আসিরিয় ও মিশরীয় মূর্তিতে, ক্রিটদ্বীপে মিনোটরের গল্পে। অনেকে বাইবেলোক্ত ‘স্বর্ণ-বাছুরের’ বা বকরির কল্পনায় এই প্রাচীন বৃষকে দূর-কল্পনায় দেখতে পান। তবে ঘোড়ার পোষ মানার আগে এই বৃষই ছিল মানুষের আমিষের অন্যতম উৎস, ভারবাহী ও কৃষিসহায়ক পশু – মানুষের অনেকদিনের সঙ্গী। নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যে বৃষের মোটিফের ছড়াছড়ি একথাই প্রমাণ করে। জলবিষুবে বৃশ্চিকের কল্পনা শীতের আগমন ও মৃত্যুর প্রতিধ্বনি জানায়, যেমন একই কাজ করে ধনুর কল্পনা বা সূর্যকে ‘আহত’ করে পাতালে পাঠিয়ে ‘শীতকাল’ বা মৃত্যুর আগমন ঘটায়।
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষে একাধিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য ও নৌবানিজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এক দেশের গল্প-গাঁথা, আকাশের কল্পনা, ব্ল্যাক-ম্যাজিক, জাদু-টোনা, ছবি, গান ও সংস্কৃতি আরেক দেশের মানুষের সংস্পর্শে এসে নতুন অর্থ পায়। মানুষের কল্পনা বিস্তৃত হয়। এভাবে মানুষের চিন্তায়, খ-গোলাকের ধারণা স্পষ্ট হয়, গ্রহদের সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ নিখুঁত হয়, চাঁদের গতিপথকে চিহ্নিত করতে তারামণ্ডলী নির্ধারিত হয়, রাশিচক্রের ১২টি মণ্ডলী সুচিহ্নিত হয়। এই সময়ে শেষে হিপার্কাসের হাতে অয়নচলন আবিষ্কৃত হয়। এই সময়কালটি তাই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ও অ্যাডভেঞ্চারের – এই সময়টি খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে খ্রিষ্টাব্দ প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে মানুষের কল্পনা মানবকেন্দ্রিক ‘আমি-তুমি’, স্থানকেন্দ্রিক বিমূর্ত চিন্তা থেকে আরো বিমূর্ত ভূকেন্দ্রিক কল্পনায় উন্নীত হয়। এই কল্পনার সর্বোচ্চ প্রতিফলন এই সময়ের শেষভাগে টলেমির রচিত ‘আলমাজেস্ট’ বইয়ে। এই সময়ে পুরো জগৎ সম্পর্কে এক সাথে কল্পনা করতে শেখে মানুষ, ভৌতজগৎ সম্পর্কে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা (থেলিস-অ্যানাক্সিমান্ডার-পিথাগোরাস-ইউক্লিড-সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল প্রমুখ) শুরু হয়, এমনকি মহাশূন্যে পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি নিয়েও মডেল তৈরি হয়। আকাশে নক্ষত্রের গতিপথ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মানুষ যখন খ-গোলকের মতো বিমূর্ত ধারণা তৈরি করতে শিখল, স্বভাবতই সে দেখল খালিচোখে সারা বিশ্বজগৎ পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। এভাবেই ভূকেন্দ্রিক কল্পনার গোড়াপত্তন হয়। আকাশের বিভিন্ন তারামণ্ডলীর গতিপথ যে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকেই মানুষ ভালোই রপ্ত করেছিল তা এখন আমরা জানতে পেরেছি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৫-এ লিখিত আরাতুসের কবিতার বিজ্ঞানসম্মত বিনির্মাণ থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকেই পঞ্জিকার প্রয়োজনে, সাম্রাজ্যের পরিচালনা ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে, সমুদ্রে নৌবাণিজ্য চালানোর স্বার্থে দিক-নির্দেশনার কার্যে রাতের আকাশের ‘মানচিত্র’ বা তুলনীয় বর্ণনাত্মক বিবরণী তৈরী করা হয়। এর অর্থ ঐ সময় থেকেই জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক নিয়মিত পর্যবেক্ষণ শুরু হয় এবং মেসোপটেমিয়ায় দীর্ঘ আট শতকের নিরবচ্ছিন্ন লিখিত উপাত্তের হদিস পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আকাশের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ঐ সময়কার মানুষ অনেক ভালো করেই জানত। যদিও, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই জানাটা একদল দক্ষ মানুষ ও পুরুত-সম্প্রদায় নিজেদের ভেতর কুক্ষিগত রাখে। যেমন লেখার কাজটা একদল মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গোপন রাখত, যাতে বাইরের কেউ এই কৌশলটা শিখতে না পারে। এইভাবে কালদীয়দের হাতে আমরা জ্যোতিষশাস্ত্র, কোষ্ঠীবিচার ও ভাগ্যগণনার উৎপত্তি হতে দেখি।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সময় থেকে মেষ চতুষ্টয়ে ক্রান্তিবৃত্তের দিগ্বিন্দুগলো দৃষ্ট হয়। ‘এরিস কোয়ার্টেট’ বা মেষ চতুষ্টয়ের অন্তর্ভুক্ত হলো মেষ (এরিস), কর্কট (ক্যানসার), তুলা (লিব্রা) ও মকর (ক্যাপ্রিকর্নাস); এই চারটি মণ্ডলীর রাশিচক্রের সর্বশেষ সংযোজনী। মকর রাশির ছবিটি বহু পুরাতন মোটিফের সাথে মিলে যায়, প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০-এ এক অদ্ভুত ছাগ-মৎস্য সংকরের কল্পনা দেখা যায় ব্যাবিলনীয় সীমানা প্রস্তরে ধনুরাশির ছবির পাশাপাশি। মিথুনের পাশাপাশি কর্কট ও তুলার ছবি ব্যাবিলনের ‘ত্রি-তারা তালিকা’ ও ‘মুল-আপিন’ ট্যাবলেট দেখা যায়। মেষের কল্পনাও প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও মিশরে দেখা যায়, যদিও আকাশে তখনো এর স্থান হয়নি। মকর ছাড়া এই চতুষ্টয়ের অন্য তিনটি তারামণ্ডলীতে তেমন কোনো উজ্জ্বল তারা নেই। কেবল ক্রান্তিবৃত্তের চারটি অবস্থানের সাথে মিলে যায় বলেই মনে হয় রাশিচক্রে এদের স্থান হয়েছে। বৃষের সাথে মেষও প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের সঙ্গী, মেষের চামড়া ও ভেড়ার লোম দিয়ে শীত-নিবারণী পোষাক বানানোর চল বহুদিনের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ অব্দ থেকেই মহাবিষুব ঘটছে মেষ রাশিতে। মনে হয় মেষ, কর্কট ও তুলা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি প্রতীক ছিল। ব্যবসায়ীর তুলাদন্ড, জলাভূমির আপদ কাঁকড়া এবং যোগালির (আজকের দিনের দৈনন্দিন ভাড়ায় খাটা মজুর) কল্পনা সাধারণ মানুষের হাত ঘুরে রাজকীয় সিলমোহরে দৈব ভিত্তি পায়। যোগালির জায়গায় পরে মেষকে কল্পিত হয়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ তাদের সাধারণ গেরস্থালীর প্রতীক দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করত। যখন পুরনো মণ্ডলীগুলো অয়নচলনের ফলে স্থানান্তরিত হলো এবং রাজকীয় দৈব-প্রতীক সম্বলিত কোনো মণ্ডলী ঐ চারটি দিগ্বিন্দুকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলো, তখন ঐ সাধারণ প্রতীকগুলোতেই রাজকীয় সিল পড়ল। আর মকর তো ছিলই প্রাচীন ছাগ-মৎস্য তথা ‘পানির’ বা পাতাল জগতের বাসিন্দা। সেই খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ থেকে মেষরাশিতে মহাবিষুব হতো, তাই একে ‘ফার্স্ট পয়েন্ট অব এরিস’ও বলে। বর্তমান কালে মীনরাশিতে মহাবিষুব সংঘটিত হয়, কিন্তু খবরের কাগজের রাশিচক্রে এই কথা কেউ বলে না।
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কোনো ধৈর্যশীল পর্যবেক্ষক যদি রাতের আকাশ নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তবে সে দেখবে আকাশের স্থির তারার সাপেক্ষে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহদের একটি নিয়মিত গতি আছে। স্বাভাবিকভাবেই তার কাছে মনে হবে পৃথিবী স্থির, এবং পুরো মহাকাশ তাকে ঘিরে ঘুরছে। সে আরো লক্ষ করলে দেখবে, সূর্য একেক ঋতুতে একেক জায়গায় থাকে, এবং দিগন্তে সূর্যের উদয়-অস্তও ঋতুভেদে বদলায়। ভোরে সূর্যোদয়ের ঠিক আগে আকাশে যে নক্ষত্রগ্রুপটি উঠতে দেখা যায়, ঋতুভেদে তা-ও বদলায়। এইভাবে পেছনের স্থির তারার সাপেক্ষে সূর্য যেসব তারার গ্রুপের ভেতর দিয়ে চলাচল করে তাদেরকে বিভিন্ন মণ্ডলীতে ভাগ করে নেওয়া যায় সুবিধে মতো। তবে এখানে একটা ব্যাপার আছে। দেখা যায়, বছরের ৪টি দিন অন্য দিনগুলো থেকে আলাদা। এগুলো হলো মহাবিষুব (ভার্নাল ইকুইনক্স, মার্চ মাসে সংঘটিত হয়), উত্তর অয়নান্ত (সামার সলস্টিস, জুন মাসে হয়), জলবিষুব (অটামনাল ইকুইনক্স, সেপ্টেম্বরে হয়), এবং দক্ষিন অয়নান্ত (উইন্টার সলস্টিস, ডিসেম্বরে হয়); এই চারটি দিনে যথাক্রমে দিন-রাত সমান হয়, উত্তর গোলার্ধে দীর্ঘতম দিন হয়, দিন-রাত্রি সমান হয় এবং উত্তর গোলার্ধে ক্ষুদ্রতম দিন হয়। কাজেই সারা বছরের মধ্যে এই চারটি দিন আলাদাভাবে চোখে পড়ে। তাছাড়া ঋতু পরিবর্তনেও এরা জরুরি – কারণ এরা বছরকে গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই চার প্রধান ঋতুতে ভাগ করে। ফলে এই চারটি দিন সূর্য কোন মণ্ডলীতে অবস্থান করে সেটা জেনে রাখা জরুরি। এইভাবে ক্রমশ রাশিচক্রের উদ্ভব হয়েছে। প্রথমে সূর্য পর্যবেক্ষণ চলছে, সূর্যের উপাসনা হয়েছে। কারণ সূর্য আলোকদায়ী এবং ঋতুর নিয়ন্তা। তারপর বছরের ঐ চারটি বিশেষ দিগ্বিন্দু (পেছনের স্থির তারার সাপেক্ষে দিগন্তের যে বিন্দুতে ঐ দিন সূর্যোদয় হয়) চিহ্নিত হয়। ক্রমান্বয়ে রাশিচক্রের অন্য মণ্ডলগুলোও চিহ্নিত হয়। সূর্য পর্যবেক্ষণের ফলে পেছনের স্থির তারার সাপেক্ষে সূর্যের বাৎসরিক গতিপথও চিহ্নিত হয়। একে একলিপ্টিক বা ক্রান্তিবৃত্ত বলে। আদিম মানুষ বহুকাল ধরেই চাঁদের কলা পরিবর্তন দেখছে। সে দেখেছে যে, প্রায় ১২টি চান্দ্রমাসের পর সূর্য আবার আগের জায়গায় (দিগন্তের সাপেক্ষে) ফিরে আসে, তাই সূর্যের গতিপথকেও ১২টি ভাগে ভাগ করেছে। তারপর প্রথম দফায় ৪টি, দ্বিতীয় দফায় আরো ৪টি এবং শেষ দফায় ৪টি দিগ্বিন্দুর জন্য ৪টি মণ্ডলী স্থির করেছে। এরাই রাশিচক্র বা Zodiac। এটি গ্রিক শব্দ Zodiakos kyklos থেকে উদ্ভূত হয়েছে যার অর্থ প্রাণিদের চক্র। যদিও রাশিচক্রের ১২টি তারামণ্ডলীর ৫টিতে কোনো জন্তুর ছবিই নেই (মিথুন, কুম্ভ, কন্যা, ধনু, তুলা); রাশিচক্রের সবচেয়ে পুরনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যাবিলনের ‘মুল-আপিন’ ট্যাবলেটে (খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০); এখানে রাশিচক্র অসম্পূর্ণ ছিল। সম্পূর্ণ রাশিচক্রের ছবি পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০তে পাওয়া কিউনিফর্ম লিপিতে। সুমেরীয় লিখনের আবিষ্কার খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে এবং গৃহপালিত প্রাণীর প্রচলন ও দানাশস্যের চাষের বিক্ষিপ্ত প্রমাণ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ৯ম থেকে ৫ম সহস্রাব্দের ভেতরে। এই সময়ে কৃষি সংস্কৃতিগুলির আবির্ভাব ঘটে। মনে হয়, এই কৃষির সাথেই জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রথাবদ্ধ পর্যবেক্ষণও শুরু হয়। এখন প্রশ্ন হলো, নক্ষত্ররাজিতে ছবির কল্পনা কীভাবে এবং কেন শুরু হয়? প্রাচীন মানুষ একইসাথে আকাশের উজ্জ্বল তারাদের একেকটি গ্রুপে ফেলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে, আবার বিশেষ দিক চিহ্নিত করতেও বিশেষ তারার গ্রুপে বিশেষ ছবির কল্পনা করেছে। সেইজন্যই দেখা যায়, এমন অনেক মণ্ডলী আছে যাদের তৃতীয় বা চতুর্থ উজ্জ্বলতার উর্ধ্বে কোনো তারা নেই, কিন্তু যেহেতু এরা রাশিচক্রের অন্তর্গত এই বিশেষ কারণেই এদেরকে নিয়ে মণ্ডলী কল্পনা করা হয়েছে। রাশিচক্রের মণ্ডলীগুলো সবাই ৩০০ পরিমাণ জায়গা দখল করে। এভাবে শুধু ছবির কল্পনা নয়, স্থানচিহ্ন ঠিক করতেও তারামণ্ডলীর কল্পনা হয়েছে।
তারামণ্ডলীতে সে কেমন ছবি কল্পনা করেছে? এটি একটি জটিল সমস্যা। এটি সরাসরি তার সংস্কৃতি, তার দৈনন্দিন জীবন, তার পূজো-আর্চা, বিশ্বাস-কুসংস্কার, তার কল্পনাশক্তি – এসবের উপর নির্ভর করে। তাই তারামণ্ডলীর কল্পনায় শুধু তার বাইরের প্যাটার্নই নয়, তার অবস্থান, তার গুরুত্ব – এসবও প্রাধান্য পেয়েছে। এভাবে তারামণ্ডলীর নামকরণ ও প্রতীক বিশ্লেষণ করে তারামণ্ডলীর নির্মাতাদের সংস্কৃতি, বাসস্থান, অভ্যেস আন্দাজ করা যায়। এই কর্মটি দুরূহ, এটি বিশ্লেষণধর্মী, শ্রমসাপেক্ষ, এবং মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাসের ওপর জবর দখল রাখা চাই। কিন্তু তবুও শেষ বিচারে এটি ‘কোয়ালিটেটিভ’। এটি পরিসংখ্যানসম্মত নয়, অঙ্ক কষে এর সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলবে না। তাই এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। কিন্তু তারপরও প্রাচীন যুগের ইতিহাসের পর্যালোচনায় মগজের একটা ভালো ব্যায়াম হয়। সেই স্বাদও ভোলার নয়।
যাহোক, ক্রান্তিবৃত্তের ওপর যে ৪টি দিগ্বিন্দুর উপস্থিতির কথা বলা হলো, সেগুলো কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। কয়েকশত বছরে হয়ত এদের কোনো পরিবর্তন হয় না, কিন্তু হাজার-দু’হাজার বছরে এদের বদলে যেতে দেখা যায়। তার কারণ, পৃথিবীর অক্ষের অয়নচলন বা প্রেসেশন। পৃথিবী যেহেতু সুষম গোলক নয় একটা, একটি অবলেট স্ফেরয়েড, তাই সূর্য-চন্দ্র সিস্টেমের আকর্ষণ এই দৃঢ় বস্তুটির ঠিক কেন্দ্রে কাজ করে না। ফলে পৃথিবী তার হেলানো অক্ষের চারদিকে ঘুরপাক খাওয়ার পাশাপাশি অক্ষটি নিজেও একটি বৃত্ত বরাবর ঘুরে আসে। প্রায় ২৬,০০০ বছর পর একটি পূর্ণ চক্র সম্পন্ন হয়। এই ঘূর্ণনের ফলে পৃথিবীস্থ যেকোনো দর্শকের জন্য প্রযোজ্য উত্তর খ-মেরুটি স্থির থাকে না। এর ফলে ক্রান্তিবৃত্তের ওপর অবস্থিত চারটি দিগ্বিন্দুও ২১৬০ বছর পরপর বদলে যায়। এই জন্য রাশিচক্র গঠনের ধাপগুলো ছিল এরকম – প্রথম ধাপে ৪টি বিন্দুর জন্য ৪টি মণ্ডলী এবং পরপর একাদিক্রমে আরো দুটি ধাপে মোট ১২টি তারামণ্ডলী চিহ্নিত হয়:
খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬০০-৪৪০০* খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪০০–২২০০ খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০–খ্রিস্টাব্দ ৫০০ বর্তমান
মহাবিষুব মিথুন বৃষ মেষ মীন
উত্তর-অয়নান্ত কন্যা সিংহ কর্কট মিথুন
জলবিষুব ধনু বৃশ্চিক তুলা কন্যা
দক্ষিণ-অয়নান্ত মীন কুম্ভ মকর ধনু
*তারিখ প্রশ্নবোধক, সম্ভাব্যতা যাচাইযোগ্য।
উইলি হার্টনারের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে দিগ্বিন্দুর চিহ্ন হিসেবে কৃত্তিকা, মঘা (regulus)ও জ্যেষ্ঠার helical rising ব্যবহৃত হতো। ঐ সময়ে প্রত্ন-এলামাইট আর্টে ‘আইবেক্স’ (এক ধরনের পাহাড়ি ছাগ) মোটিফ খুব ব্যবহৃত হতো। সেই সুবাদে হার্টনারের দাবী, এই আইবেক্সসহ ঐ চারটি তারা নিয়ে রাশিচক্রের বৃষ-চতুষ্টয়টি গঠিত ছিল। তবে এর কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ~৩২০০ সাল নাগাদ ষাঁড় ও সিংহ, এবং খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ থেকে পানি-ঢালা দেবতা, বৃশ্চিক ও বিছে-মানবের আর্ট-ফর্ম লক্ষিত হয়েছে। ষাঁড়কে আক্রমণকারী সিংহের ছবি বা তার প্রত্ন-আকৃতি দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকেই এবং এর চরম রূপটি দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের পার্সিপোলিসের (তখ্ত-ই-জামশীদ) প্রবেশদ্বারে। বৃষ-চতুষ্টয়ের প্রতিটি মণ্ডলীতেই প্রথম শ্রেণীর উজ্জ্বল তারা দেখা যায় – রোহিণী, মঘা, জ্যেষ্ঠা ও মৎস্যমুখ। এই চারটি তারা দিগ্বিন্দুর কাছাকাছি অবস্থিত থাকায় পারস্যে এদের রাজকীয় তারকা বলা হতো। অন্যদিকে, মিথুন-চতুষ্টয়ের কন্যা ও ধনুর কল্পনা সম্ভবত উর্বরতার দেবী ও শিকারী দেবতার কল্পনামতে, যাদের ছবি মেসোপটেমিয়ার দেয়ালগাত্রে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ~২৫০০ থেকে। মকরের ছবি সীমানা-প্রস্তরে খ্রিষ্টপূর্ব ~২০০০ থেকেই পাওয়া যায়। মীন ও মেষ মনে হয় পরবর্তী সংযোজন, অন্তত তারামণ্ডলী হিসেবে, যদিও দেয়ালগাত্রে এদের সমতুল্য ছবি দেখা গেছে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকেই।
কাজেই আমাদের সুপরিচিত রাশিচক্রের উদ্ভব হয়েছে ধাপে ধাপে, প্রতিটি ধাপ মানব সমাজের বিবর্তনের একেকটি অধ্যায় সূচিত করেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৯ম থেকে ৫ম সহস্রাব্দের মধ্যে কৃষি আবিষ্কৃত হওয়ায় সমাজে ঋতুর সালতামামি নেওয়া জরুরি হয়ে দেখা দিল, মানুষ সূর্যকে মহাদিদেব জেনে তার উপাসনা শুরু করল, আকাশে সূর্যের পরিক্রমা লক্ষ করল, ক্রান্তিবৃত্ত চিনল, দিগ্বিন্দু মনে রাখল। এসবই সে করল রাতের আকাশে তারামণ্ডলীর সাহায্যে। তারামণ্ডলী চেনার জন্য উজ্জ্বল তারাদের যেমন সে ব্যবহার করেছে, অবস্থানের গুরুত্ব ভেদে অনুজ্জ্বল তারাদেরও সে ব্যবহার করেছে। হয়ত কোনো যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষ (সম্ভবত ইন্দো-ইউরোপিয়) তাদের সূর্য উপাসনা, মাতৃকাদেবীর আরাধনা, শিকারী সত্তার দেবতা, পাতাল বা ‘পানির’ জগতের রহস্য নিয়ে প্রতীক গঠন করে আকাশে স্থাপন করেছে। কিন্তু এই মণ্ডলীগুলি স্থায়ী হয়নি। পৃথিবীর অক্ষের অয়নচলন এদেরকে বদলে দিয়েছে। তখন আরেক সামাজিক প্রেক্ষিতে দেখা যায় ঋতু পরিবর্তনের মোটিফ হিসেবে সিংহ ও ষাঁড়ের আক্রমণ দৃশ্য আকাশে স্থান পায়। এই একই চিত্র সাম্রাজ্যের শৌর্যবীর্যও নির্ধারণ করে, তাই আমরা এই ছবিই দেখি দোর্দন্ডপ্রতাপ সম্রাটের প্রাসাদগাত্রে। এভাবেই মানুষ তার বিভিন্ন সময়ের ভাবনা-চিন্তাকে মূর্ত করেছে আকাশচিত্রে। এ কাজ সে অন্ধভাবে করেনি। তার সমাজ ও প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণ তাকে প্রতীক যুগিয়েছে। সেখান থেকেই সে আকাশচিত্র নির্মাণ করেছে। তার সম্পর্কে গল্প ও মিথ রচনা করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এইসব ছবি-প্রতীক–নামকরণ হাজার হাজার বছর বাদে আজো টিকে আছে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার এই চরম উদাহরণ মানব সংস্কৃতির অন্য উপাদানগুলিতে এতো সার্থকভাবে নেই।
তথ্যপঞ্জি:
১/ আলেক্স গুর্শটিন, “অন দ্য অরিজিন অব দ্য জোডিয়াকাল কনস্টেলেশন্স”, ভিস্টাস ইন অ্যাস্ট্রনমি, খণ্ড ৩৬, পৃ.১৭১-১৯০, ১৯৯৩। ২/ এ.ভি. কুজমিন, “দ্য সেলেশ্চিয়ান ম্যাপ,” অ্যাস্ট্রনমিক্যাল অ্যান্ড অ্যাস্ট্রফিজিক্যাল ট্রানজ্যাকশন, খণ্ড ২০, পৃ.১০৪৫-১০৬৪, ২০০১। ৩/ জন রজার্স, “অরিজিনস অব দ্য এনশেন্ট কনস্টেলেশন্স: পার্ট ওয়ান”, জার্নাল অব দ্য ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল অ্যাসোসিয়েশন, খণ্ড ১০৮, সংখ্যা ১, পৃষ্ঠা ৯-২৮, ১৯৯৮। ৪/ বিমান নাথ, “আকাশের তারায় মহিষাসুরমর্দিনী”, দেশ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ৪২-৪৭, ১৭ই অক্টোবর, ২০০৫।
Nice one ! পিডিএফ কৈরা আমার ইবুক রিডারে সেইভ কৈরা ফেললাম যদি পুনরায় আবার পড়তে ইচ্ছে হয় !
সেই আদ্যিকাল থেকেই তারামণ্ডলি নিয়ে কৌতুহল রয়েই গেছে আমার। এ বিষয়ক বইও খুঁজতাম, বিশেষ করে আকাশের তারাগুলোর সাথে পরিচিতিমূলক বই।
সেই ঘাটতিটা এবার ধীরে ধীরে অপশম হবে মনে হচ্ছে। এই ফাঁকে এবার ভাবছি ফারসীম ভাইকে হাতটাও একবার দেখিয়ে নেবো। আগামীতে কোন অমূর্ত প্রাপ্তি লক্ষণ আছে-টাছে কিনা ! হা হা হা !
নিঃসন্দেহে ভালো পোস্ট। তৃষ্ণা বাড়ছে কিন্তু !!
অত্যন্ত সুন্দর ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ। লেখককে অভিনন্দন।
অসাধারণ একটা লেখা ফারসীম ভাই। খুব ভালো লাগলো।
ফারসীম
এই যে দাদা, আগের বার তো কোন মন্তব্যের উত্তর না দিয়াই ভাগলেন, আমরা তো ভয়ই পেয়ে গেলাম যে আমাদের মত নাদান পাঠকদের হয়তো আপনার পছন্দই হয় নাই। এইবার কী আমাদের মন্তব্যের উত্তর দিবেন? সাহস দিলে কয়েকটা প্রশ্ন ট্রশ্ন করতাম…
@বন্যা আহমেদ, আফা
আমি আপনার ভাই হই, দাদা না।
প্রতিটি প্রশ্নের জন্য আমি হাদিয়া হিসেবে রুচি ঝাল চানাচুর (৫টাকা) গ্রহণ করি। এই নিয়া বিভাগে নানান কথা রটসিল, কিন্তু মুমিন মুসলমানের এক কথা – উত্তর চাও ত রুচি ঝাল ফেল।
@ ঝাল চানাচুর, তাও আবার ৫ টাকা! দ্যাটস ইট? আপনি তো বেশ ‘লো মেইন্টেনেন্স’ মনে হচ্ছে 🙂 ।
ওহহো ‘মুক্ত’ মুমিন বলে না কথা, আর তো ‘দাদা’ ডাকা যাবে না :-Y । নাকি বয়স নিয়া চিন্তিত?
ফারসীম ভাই,
আপনার লেখা খুব ভালো লাগলো। আমার খুবই প্রিয় একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। আরো লিখুন…আমাদেরকে বাঙলায় নতুন কিছু দিতে চেষ্টা করতে থাকুন।
যদি কিছু মনে না করেনঃ-
আপনি কি “ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী” নামেই আপনার বই প্রকাশ করেন? আমার মনে হয় “ফারসীম মোহাম্মদী” নামে আপনার লেখা উচিৎ। এতে করে আপনার নামের তেঁজটা বেশ বৃদ্ধি পাবে। লেখকের নাম তিন শব্দের হলে একটু কেমন যেনো শোনায়।
ধন্যবাদ।
@আদনান,
বাইসাব, বাবাকে একদম ঝেড়ে দিতে বলতেসেন, তাতে কি ক্ষাত্রতেজ বাড়বে?
বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও … ফারসীম লেখায় ছবি পোস্ট করতে পারছে! 🙂
এপার্ট দ্যান ফাইজলামি … লেখাটা জোশ! অনেক কিছু জানা গেল। আরো লিখেন এমনে …