কৈফিয়ত: ব্লগে পড়েছিলাম “অন্তত দুটি ঘটনার জন্য বাঙালিকে চিরকাল ইতিহাসের সামনে মুখ নিচু করে পায়ের নখে মাটি খুঁটতে হবে। এক,মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা। দুই,ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আত্মহত্যা।” ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে উৎসাহিত হই – “সুভাষকে মানুষ ভারতের প্রথম, বিশ্বের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবির স্রষ্টা বলে জানে”। সে সাথে একজন বাংগালি হিসেবে ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়। বাংগালির দায় থেকে এই গল্প লেখার চেষ্টা।
হাতে একগাদা রিপোর্ট নিয়ে ঢাকার একটা ফার্টিলিটি এন্ড ইমপ্লানটেশন সেন্টারে বসে আছে শ্রেয়সী। এখানে সে বেশ কয়েকবার এসেছে। বলতে গেলে প্রায়ই আসতে হয় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। চারিদিক তাকিয়ে পরিচিত এক দম্পতি দেখতে পায়। হালকা হাসিতে উষ্ণ সম্ভাষণ। এদের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে শ্রেয়সীর। কোনদিন কথা বলা হয়ে উঠেনি। মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি। ওর তুলনায় বেশ কম বয়েসি বলে মনে হয়। মেয়েটার সমস্যা নাকি পাশে বসা স্বামীর কাল্পনিক একটা ছবি আঁকবার চেষ্টা করে সে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কেন জানি, মন সায় দেয় না। দেখলে বেশ মিশুকে মনে হয় মেয়েটাকে। আজ কি কথা বলবে? জানতে চাইবে? না থাক, কেমন জানি বাঁধো বাঁধো ঠেকে ব্যাপারটা।
চোখ ঘুরিয়ে নেয়। বেশ বড় সাইজের একটা ওয়ালমাউন্ট এলসিডি সামনে। লতার পুরোনো দিনের হিন্দি গান চলছে। আজকালকার ক্লিনিকগুলো আগের মতো নেই। বিনোদনের একগুচ্ছ ব্যবস্হা থাকছে কোন না ক্লিনিকে। ক্লিনিক না হোটেলের লবি – বোঝা দায়। প্রতীক্ষার প্রহর যেন ক্লান্তিকর না ঠেকে, সেজন্য নতুন ব্যবস্হা। বেশ কেটে যায় রোগীদের সময় । ডাক্তার দেখাতে এসেও বিনোদন! ক্ষণিকের কষ্ট ভুলানো! বাচ্চা কাঁদলে কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে কান্না থামানোর মত। দুর ছাই! ক্লিনিকগুলোর এ পলিসি ওর কাছে বেশ বিদঘুটে মনে হয়।
পাশে খালি চেয়ারে অপরিচিত একজন ঝুপ করে শরীরটাকে নামিয়ে দেয়। ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিতে চায় লোকটি। অসংযত কনুই গুঁতো মারে। সরি,বলে হালকা হাসিতে লঘু করার চেষ্টা করে। লোকটার চেহারা দেখে একটা কিছু আন্দাজ করবার চেষ্টা করে। কিছুদিন ধরে এ অভ্যেসে পেয়েছে তাকে। চেহারা দেখে কি মানুষের সব কষ্ট বোঝা যায়? কি জানি!
অপেক্ষা আর ভালো লাগে না। হাঁফিয়ে উঠে শ্রেয়সী। ডাক্তার এখনো আসেনি। বাইরের কল এটেন্ড করতে গেছেন। কবে ফিরবেন তাও জানা যাচ্ছে না। ব্যাগের ভেতরে ফোনটা বিপ বিপ করে যাচ্ছে। এক দংগল মানুষের মাঝে ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডানদিকে স্ক্রল করে ময়ূখের ফোনটা রিসিভ করে। আধ ঘন্টার মধ্যে এসে পড়বে জানায়। ময়ূখটা যে কি? কোন চিন্তা নেই,ভাবনা নেই। বিন্দুমাত্র টেনশান নেই। একেবারে হাত পা ঝাড়া স্বভাবের। কোনদিন নিজে থেকে জানতে চাইনি ওর ব্যাপারটা। কেউ কিছু না বললে,যেচে পড়ে কিছুই জানতে চাইবে না। ওটা ওর স্বভাব। রাগ বাড়ে,সাথে অভিমান। অথচ,এক সময় ময়ূখের এ স্বভাবটাই পছন্দ করেছিলো,ভালোবেসেছিলো শ্রেয়সী। সময়ের সাথে সাথে সব পাল্টায় বুঝি? এক সময়ের ভাললাগার কোন পরিবর্তন কি আসে দীর্ঘ বিরতিতে? উত্তর খুঁজে ফেরে মন।
একই ইয়ারে পড়া ময়ূখের সাথে প্রথম পরিচয় এক দুপুরে মধুদার ক্যান্টিনে। ময়ূখের সাবজেক্ট আইআর। শ্রেয়সীর ইংরেজী। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে ময়ূখের অনর্গল বলে যাওয়া অবাক করেছিলো তাকে। রেমব্রেন্ট থেকে ভ্যনগঁগ,বোদলেয়ার থেকে টিএসএলিয়ট,রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ,ইবসেনের নোরার সাথে শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মিল আর কোথায় গড়মিল,স্যুরেয়ালিজম থেকে পোষ্ট মর্ডানিজম! কি নেই সে আলোচনায়! অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিল, চোখে মুখে যেন ঘোর লাগা। ময়ূখের সাহিত্য সমালোচনা,আধুনিক মতামত,চিন্তা-চেতনা শ্রেয়সীকে মুগ্ধ করেছিল। দীর্ঘ আলাপে বন্ধুত্ব বাড়ে, বাড়ে অলস সময়ের আড্ডা,ঘোরাঘুরি- টিএসসি,ফুলার রোড,নীলক্ষেত,কাটাবন,শাহবাগ। এভাবে ময়ূখের জানার এবং চিন্তার পরিধিতে নিজেকে ধীরে ধীরে ব্যপ্ত করে শ্রেয়সী। এতদিনের সেসব স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়,ভালো লাগে নস্টালজিয়ায়। অতীতের নৈকট্য বর্তমানকে মূর্ত করে তোলে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ধরতে চাওয়া যেন! স্মৃতির আবেশ সুগন্ধ ছড়ায় চোখে মুখে।
– ম্যাডাম, আপনার সিরিয়াল।
ডাক পড়ে শ্রেয়সীর। ময়ূখ কে সাথে নিয়ে চেম্বারে ঢোকে। ডাক্তার এক এক করে সব রিপোর্ট দেখতে থাকেন। উৎকন্ঠায় উসখুস করে। বিচলিত হয়ে উঠে মন। অল্প সময়কে সুদীর্ঘ হয় রিলেটিভিটির সূত্র ধরে। পাশে বসা ময়ূখের হাত ধরে একটা হৃদস্পন্দন অনুভব করে।
আইভিএফ (ইন-ভিটরো ফার্টিলাইজেশন) বা টেস্ট টিউব পদ্ধতি হচ্ছে মানবদেহের বাইরে গর্ভ ধারণ করার পদ্ধতি। পরিপক্ব ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় এবং নারীদেহের বাইরে একটি পাত্রে বা টেস্ট টিউবে পুরুষের শুক্রকীটের সঙ্গে মেশানো হয়। এরপর নিষিক্ত ডিম্বাণুকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ইনকিউবেটরের মধ্যে কয়েক দিনের জন্য রাখা হয়। তারপর পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয় ভ্রূণগুলো সঠিকভাবে বেড়ে উঠছে কি না। এরপর এখান থেকে সর্বোচ্চ তিনটি ভ্রূণকে নারীর গর্ভাশয়ে স্থানান্তর করা হয়- কাউন্সেলিংয়ে একথাগুলো বহুবার শুনেছে। শুনতে শুনতে একথাগুলো মুখস্হ হয়ে গেছে শ্রেয়সীর। কেবলি কল্পনায় এক কাংখিত সময়ের নানা স্কেচ মনের ভেতরে খেলা করে। পরম মমতায় সে স্কেচ উল্টে পাল্টে দেখা হয় নির্জনে,নিজের একাকীত্বে। কখনো সখনো সে স্বপ্নের ফাঁক-ফোঁকর গলে বেরিয়ে আসতে চায় অন্য মুদ্রা। উঁকি মেরে বারংবার জানাতে চায় অব্যক্ত হৃদয়ের হাজারো ক্রন্দন।
ময়ূখের সাথে প্রায় আট বছরের সংসার। এত বছরের সংসারে,মাঝে মাঝে এ ব্যাপারটা কেন জানি শ্রেয়সীর ব্যক্তিত্বকে নিজের অজান্তেই খাটো করে দেয়। অপূর্ণতা ওর সমস্ত শরীর ঘিরে এক অবশ করা বোবা অনুভূতির জন্ম দেয়। সবকিছুই ম্লান ঠেকতে ঠেকতে কিছু লোনা জল ঠোঁটে জমে। ধীরে ধীরে,কাল্পনিক এক শূন্যতার খোলসে ঢুকে পড়ে মন,শরীর,সংসার। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজনের অযাচিত প্রশ্ন, বাড়াবাড়ি রকমের উৎসাহ, আর কথার ফাঁকে আত্মীয়-অনাত্মীয়ের খোঁচা, এ সব শ্রেয়সীকে মুখ বুঁজে সয়ে যেতে হয়েছে। কষ্ট আর যন্ত্রণার একটা বোবা কান্না সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দূর্বিসহ করে তুলেছে ওর জীবন। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে গ্রাস করা শূন্যতায় পাশে থেকে ময়ূখ যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে,উষ্ণতায় ভরিয়েছে। অথচ ময়ূখ কোনদিনই শ্রেয়সীর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। শুধু প্রথম প্রথম চিকিৎসা নিতে আপত্তি করেছিল ময়ূখ। পরে একেবারে বাধ্য ছেলের মত শ্রেয়সীর সব কথা শুনেছে। বিস্তর খরচাপাতির যোগান দিয়েছে দু’হাতে,বিনা প্রশ্নে।
হরমোন ইনজেকশান নেয়া হয়েছে শ্রেয়সীর নিয়ম করে। শরীর পুরোপুরি তৈরী। তৈরী শরীরে এখন শুধু বীজ বপনের অপেক্ষা। দিন কয়েকের মধ্যে এমব্রায়োলজিস্ট আর ডাক্তার মিলে পরিপক্ব ভ্রূণকে গর্ভে প্রতিস্হাপন করবে। সে সংবাদে সমস্ত শরীর-মন এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে উঠে। একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কের নিউরনে। অনাগত মাতৃত্বের আকাংখা আর কিছু কল্পনা শ্রেয়সীকে হত-বিহ্বল করে তুলে।
ময়ূখের পাশে এসে ধীরে ধীরে বসে শ্রেয়সী। কিছুটা গা ঘেঁষে। ময়ূখের হাতটা তুলে নেয় ওর হাতে। অব্যক্ত একটা ভালোলাগা আর স্বচ্ছ প্রতীতি নেমে আসে সমস্ত শরীর জুড়ে। অনাগত একটি কচি মুখ স্বপ্নরেখায় উদ্ভাসিত হয়ে আরক্তিম হয়ে উঠে ওর সমস্ত মুখ। কুচি কুচি করে কেটে নেয়া স্বপ্নে জোড়া লাগা শুরু করে। এতদিনের জমানো বিষাদকে দুরে ঠেলে ভিড় করে মায়াবি এক স্বপ্ন। সে স্বপ্নের উজ্জ্বলতা আলো করে তোলে শ্রেয়সীর দু’চোখ। এক উজ্জ্বল আভা ক্রমশঃ পাক খেতে খেতে ঘুরতে থাকে কাঁচ তোলা গাড়িতে। ছুঁয়ে যায় ময়ূখের হাত,মুখ আর শরীর।
”একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ,প্রাণেশ হে,
আনন্দ বসন্ত সমাগমে।”
লো ভলিয়মে রবীন্দ্র সংগীত চালিয়ে লাল টয়োটা এগিয়ে চলে ভিআইপি রোড ধরে।
ভালো লাগলো।
@প্রদীপ দেব, দাদার ভালো লাগা মানে আমার কাছে অন্যকিছু। ভালো থাকবেন প্রদীপদা।
ভাইয়া প্রথম অংশটুকু বেশ ভাল, মাঝ খানের অংশ টুকু কষ্টদায়ক, আর শেষের অংশ টুকু আনন্দ দায়ক।
অল্পের মধ্যে বেশ সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছন।
এর জন্য ধ্যনবাদ
(Y) (Y)
@NETWORK, ধন্যবাদ আপনাকেও।
দুর্দান্ত- মানে, আর কোনো শব্দ পাই নাই। স্যালুট। কৈফিয়তের অঙশটুকু পড়ে বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম, বিষয়টা জানা ছিলো না তাই। গল্পের চোখ-নাক-ওষ্ঠ-অধর বেয়ে নেমে যেতে থাকি; তারপর এইখানে
মানে, গল্পের বুকে, মানে- অন্য কোনো অর্থ করবেন না যেনো; একেবারে নস্টালজিয়ার মতো ঠেকে; তখনও বুঝি নাই, গল্প কোনদিকে এগুবে- আরও গভীরে, যেখানে অর্জিত সুখ- অধরার মতো ঠেকে, সেইখানে কীসের যেনো উত্তেজনা টের পাই, বিনিদ্র রজনীর উত্তেজনা…আরও যখন গভীরে শ্রেয়সী যখন স্বপ্ন দেখছে- তখন বিষণ্নতার ছায়া একটা কোত্থেকে যেনো উড়ে এসে জুটে বসে…তবুও এগোই…শেষে এসে ভিআইপি রোডে ছুটে চলা টয়োটা দেখে আদ্যোপান্ত মনের সাথে রিভিউ করি- “যতোই গভীরে যাই মধু, যতোই উপরে যাই নীল”।
লেখককে ধন্যবাদ, অজস্র ধন্যবাদ।
@শনিবারের চিঠি, ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য সত্যিই মূলবান। আসলে শুধু একটি মেয়ের মাতৃত্বের হাহাকার কেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলাম গল্পে। ভালো থাকবেন।