ভারতের ইস্কুলে ইস্কুলে যেভাবে পাখিপড়া করে বাবরের বাবার নাম মুখস্থ করানো হয়, ঠিক একই ভাবে বিজ্ঞানকেও গিলিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্ররা বিজ্ঞান শেখার নামে তা কেবল অস্থায়ী মুখস্থ করে, আত্মস্থ করে না। অঙ্ক-ফিজিক্স-বায়োলজির সঙ্গে তাই তাদের কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে না, এসব সাবজেক্টকে কেবল ভয়ই করে তারা।

আর তাই এদের মধ্যে থেকে যারা বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয়, তারাও বিজ্ঞানকে একটা যন্ত্রের মতই ব্যবহার করে। বিজ্ঞানচর্চা তাদের কাছে আপিসে গিয়ে দশটা-পাঁচটা চাকরি করা মাত্র, বিজ্ঞান তাদের সুখী জীবনের একটা দরকারি tool কেবল, ঠিক যেমন কোনো মেকানিক তার কারখানায় গিয়ে দশটা-পাঁচটা চাকরির সময়টা হাতুড়ি-স্ক্রুড্রাইভার খুটখাট ব্যবহার করে চলে আসে – বিজ্ঞান এদের কাছে কোনো উপলব্ধির বিষয় নয়, নয় কোনো চিন্তাধারা।

আর ভারতে বহুলপ্রচলিত হিন্দুধর্মের যে নরম বা benign রূপ, তা তৈরি হতে দেয় না আমেরিকা বা ইউরোপের মত ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাত। পুজোআচ্চা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়েই হিন্দুধর্ম মোটামুটি সীমিত থাকে, আর তাই কূর্মের পিঠে থালার মত চ্যাপ্টা পৃথিবী ভর দিয়ে রয়েছে এই ধরনের কাহিনীগুলোকে মিথোলজি বলে আমরা এড়িয়ে যাই, বিজ্ঞানের সঙ্গে এর দারুণ অসামঞ্জস্যগুলো খেয়াল করি না কেউ।

এই দুটো দিক মিলিয়ে ভারতে চলে বিজ্ঞান ও ধর্মের এক অদ্ভুত মাখামাখি। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, এক সময়ের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এ. পি. জে. আবদুল কালামের মত হাই-প্রোফাইল লোকজনও প্রকাশ্যে তাঁদের ধর্মানুরাগের কথা বললেও তাতে কেউ অবাক হয় না।

***************************

এপ্রিল মাসের শেষদিকে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো তাদের নতুন স্যাটেলাইটটি কক্ষপথে পাঠানোর জন্য যে রকেটটি লঞ্চ করে, তার সফল যাত্রা কামনা করে ইসরোর বিজ্ঞানীরা দক্ষিণের বিখ্যাত ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে পুজো দিয়ে আসেন। স্বভাবতই, এ নিয়ে মিডিয়ায়, বিশেষত ফেসবুকের আধুনিকমনস্ক জনতার মধ্যে বেশ হইচই পড়ে যায়। এটিকে ব্যঙ্গ করে একাধিক কার্টুনও প্রকাশিত হয়।


(ভারতে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের সামনে কাঁচালঙ্কা-লেবু ঝুলিয়ে রাখা থাকে প্রায়ই, যেমনটি এই কার্টুনে দেখা যাচ্ছে ওই বিজ্ঞানীর হাতে। এতে নাকি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট ইত্যাদি নানা অমঙ্গল থেকে নিরাপদ থাকে।)

খবরে প্রকাশ, ইসরোর বর্তমান অধিকর্তা কে. রাধাকৃষ্ণণ তাঁর অতিধার্মিকতার জন্য আগেও নিন্দিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে, তিনি এই সর্বোচ্চ পদটিতে উন্নীত হতে পারেন এই খবর পেয়েই, তিনি আরেকটি বিখ্যাত গুরুভায়ুর মন্দিরে গিয়ে থানা গেড়ে বসে পড়েন। ওই মন্দিরেই ফ্যাক্সের মাধ্যমে তাঁর নিয়োগের খবর আসে, এবং আনন্দে তিনি সেই শিবি রাজার গল্পের মত নিজের সমান ওজনের কলা 😛 সেই মন্দিরে দান করেন।

বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাফল্য কামনা করে মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার ঘটনা ভারতে মোটেই বিরল নয়, যেমন বিরল নয় তাঁদের আঙুলে মোটা মোটা মণি-ওয়ালা ‘কল্যাণের জন্য’ জ্যোতিষীপ্রদত্ত আংটিস্থাপন, এবং নিজের বা ছেলেমেয়ের বিয়ের সময় কোষ্ঠী মেলানোকে বিশাল গুরুত্ব দেওয়া, অথবা যোগব্যায়ামের মাধ্যমে এইডস-ক্যান্সার সেরে যায় এইসব দাবি করা ভণ্ড বাবা রামদেবকে প্রবল ভক্তি করা। কদিন আগেই একটি পোস্টার বেশ নেটফিরি হচ্ছিল, যেখানে সম্প্রতি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বিজয় মাল্য’র কিংফিশার এয়ারলাইন্সের আগেকার একটি ফোটোকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছিল, যাতে দেখা যায়, নতুন প্লেনের উদ্বোধনে পুরোহিত এনে ঘটা করে যজ্ঞ করা হচ্ছে।

***************************

সদ্য যে হিগস বোসন খুঁজে পাওয়ার সুখবর ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র, তাতে আনন্দবাজারের মত পত্রিকা যে বাঙালি সেন্টু জাগ্রত করতে উঠেপড়ে লাগবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু একে যে ‘গড পার্টিকল’ও বলা হয়ে থাকে, সেই নামের অপব্যাখ্যাতেও ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো মশগুল। একজন ফেসবুকে গুটিকয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের সারসংক্ষেপ করে যা লিখেছেন, তার চটজলদি অনুবাদ:

সার্নের ঘোষণার পর আমি টিভি চালিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কোনো চ্যানেলে এই সংক্রান্ত কোনো খবর বলছে কি না। আমি এই দেখলাম –

১. জি নিউজ: “ইনসান খুঁজে পেল ভগবান”
২. ইন্ডিয়া টিভি: স্ক্রিনের বাঁ দিকে দেবদেবীর ছবি আর ডান দিকে ওই এক্সপেরিমেন্টের একটা অ্যানিমেশন।
৩. নিউজ ২৪: বজ্রপাত, ভূমিকম্প আর দাবানলের ছবির সাথে সাথে শ্লোক আবৃত্তি।
৪. সিএনএন-আইবিএন: কয়েকটা ধর্মবাজকে ধরে এনে টকশোতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে একজন দাবী করছে যে কোনো এক দেবতার পবিত্র পাদ-ই হচ্ছে বিগ ব্যাং (পা নয়, বায়ুদূষণ), যা থেকে হিগস বোসন ছিটকে বেরিয়েছিল, এবং সেসব গুছিয়েটুছিয়েই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়। বিজেপির আরেক বক্তা সেটাকে বিস্তারিত করে বললেন, শিবের প্রলয়নাচনই হচ্ছে হিগস কণার উৎপত্তির মূল।
৫. টাইমস নাউ: লস্কর জঙ্গি আবু জুন্দলের জেরা নিয়ে খবর
৬. এনডিটিভি ২৪X৭: জাস্টিন বীবার গ্রাজুয়েশন করেছেন!
৭. স্টার অর্থাৎ এবিপি নিউজ: সচিন খেলছেন না শ্রীলঙ্কা সফরে।

আমি রেগেমেগে রিমোটখানা ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছি প্রায়, মা আমাকে বললেন, “বাবা, দেখ, এমনকি বিজ্ঞানীরাও প্রমাণ করে ফেলেছেন ভগবানের অস্তিত্ব, আর তুই এখনও ভগবানে বিশ্বাস করতে চাস না?”

আর এইধরনের আমজনতা এবং বিজ্ঞানী, দুই দলকে দেখেই আমি নিশ্চিত, যে শুধু বিবর্তন-বিগব্যাং-বিজ্ঞানশিক্ষা দিয়ে এদের চোখ খোলা যাবে না। তারা যে ধর্মটিকে নেহাতই নিরীহ এবং বিজ্ঞানবিরোধহীন বলে পালন এবং শ্রদ্ধা করে চলেন, এবং যার ফলে এইধরনের প্রবল দ্বিচারিতা কেবলই দেখতে হয় আমাদের, সেই আপদ বিদায় করতে হলে সেই ধর্মেরই জাজ্বল্যমান গাঁজাগুল তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। রণদার মনুর মহান বচন ইত্যাদি সিরিজ, এবং সব মিলিয়ে ধর্মকে ‘তোমার কাপড় কোথায়’ এই ধরনের প্রশ্ন করতে পারা ধর্মকারী জাতীয় কনটেন্ট নেহাতই দরকার।