লিখেছেন – হুতম পেঁচা

স্মৃতিচারণ একটা সহজাত প্রবৃত্তি। সময়ের সাথে সাথে জমতে থাকে হরেক রকম স্মৃতি। জমে থাকা এই স্মৃতিরা খরচ হতে থাকে অফুরন্ত অবসরে অথবা নিঃসঙ্গ কোন নির্জনতায়। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক এই দুটোর কোন একটি হয়তো হবে। আজ কদিন ধরেই ভাবছি আমার পার করে আসা শৈশব দিনগুলো নিয়ে কিছু লিখবো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এক একজনের কাছে , ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আসতে থাকে তার শৈশব বেলা। আবার ঘটনার বর্ণনার পর অনেকের সাথেই মিলে যায় অনেক ঘটনায়। তবে আর যাই হোক শৈশব যে কেটে যাওয়া যে কোন কালের চেয়ে সেরা তা মনে হয় হাতে গোনা গুটিকয়েক ছাড়া বাকি সবার ক্ষেত্রেই বলা যায়। কোন দায়িত্ব নেই, ডানে বামে ভেবে দেখার কোন বালাই নেই , থাকেনা বাড়তি কোন চাপ । একেবারেই পাখির ডানা মেলে শুন্যে ভেসে বেড়িয়ে আবার নীড়ে ফিরে আসা। নিজের কোন চিন্তা নেই তবে আপনাকে নিয়ে করে চলা অন্তহীন চিন্তার লোক আছে ঢের ।

শুরু করবো সেই প্রাইমারি থেকে যখন একটা টিনের বাক্স নিয়ে স্কুলে যেতাম। টিনের বাক্স বলা এ কারণেই যে, বাক্সটি যদিও কেনার সময় স্টিলের তৈরি বলা হত কিন্তু আমার কাছে এটার গঠন দেখে কখনই স্টিল মনে হয়নি। বাক্সের ঠিক মাঝখানে আবার ব্রিফকেসের মত হাতল আর তার ঠিক নিচেই আটকিয়ে রাখার একটা কপাট ছিল।ওই সময় এই বাক্সটি যে কোন সময়ের দামী যে কোন ভালো বাক্সের চেয়ে যে সেরা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাতে ঝোলাতে ঝোলাতে সকাল আট টার ক্লাস ধরার জন্য শশব্যস্ত হয়ে স্কুলের দিকে ছুটে আসতাম। স্কুল কাছেই ছিল তাই একাই আসা হত আর দূরে থাকলেও করার কিছু ছিল না। আমার বাসার অন্যরা চাইতেন আমি একাই যাওয়া আসা করি তাতে নাকি আমার একা একা পথচলার অভ্যাস হবে। ভালোই হয়েছিল তার পর থেকে আর একা পথ চলতে সমস্যা হয়নি।

দুপুর একটা পর্যন্ত এই গতবাদা টাইম শিডিউলের একটা বড় আকর্ষণ ছিল টিফিন ব্রেক। স্কুলের তিন পিরিয়ডের মাথায় একটা টিফিন ব্রেক পেতাম। সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম মেইন গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ চটপটি ওয়ালার ভ্রাম্যমাণ ক্যাফেতে (তিনচাকা যুক্ত ভ্যান আর কি )। এক টাকা দিলেই পাওয়া যেত আমড়া অথবা জলপাইয়ের চাটনি । আর দুই টাকার প্লেটে চটপটি। এই চটপটি ও চাটনির ছিল ব্যাপক চাহিদা তাই দৌড়ে এসে কে আগে সিরিয়াল দেবে এই যুদ্ধটা বেশ ভালোই হত। গায়ে গতরে তখন বেশ ভালই ছিলাম তাই ঠেলা ঠেলি করে আগে যাওয়ার সংগ্রামে কখনই পিছিয়ে ছিলাম না। একেবারে সামনের দুই একজনের পিছনে দাড়াতে পারায় ছিল একরকমের বাহাদুরি। সেটা দেখিয়ে দুই টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলতাম আমাকে আমড়ার চাটনি দেন । কিনে নিয়েই একদৌড়ে স্কুলের এক কোনে আমার বন্ধু সুমনকে নিয়ে ভাগ করে খেতাম। ২০ মিনিটের বিরতি শেষ আবার ক্লাসে যাওয়া। হা করে আমাদের অংকের টিচার রাজ্জাক স্যারের বলে যাওয়া লেকচার মাথার উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া। মাথার উপর দিয়ে কারণ বাসায় যাবার পরেই অপেক্ষা করছে ফুটবল । কখন ছুটি হবে আর বলে আজ কিভাবে লাথি মারবো সে কথা মনের ভিতরে এমনভাবে ঘুরতে থাকতো যে ক্লাসের কোন কিছুই মাথার ভিতরে নেয়ার সময় কোথায়।

তবে বলে রাখা ভালো ক্লাসে মাথায় কিছু না ঢুকলেও ক্লাস নামের বাঘহীন ওই বনে দুই একজন বিড়ালের ভেতর আমিও থাকতাম। সবচেয়ে মজা হত যখন পরীক্ষা আসতো। প্রশ্নের উপরেই লেখা থাকতো যে কোন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দাও। তার মানে সাতটা প্রশ্নের মধ্যে পাঁচটার উত্তর দিতে হবে। আমি একেবারে সাতটার উত্তর লিখে দিয়ে আসতাম। বাসায় মা যখন বলত কয়টার উত্তর দিয়েছি । আমার সরস অভিব্যাক্তি ‘সবগুলোর ‘। এইতো শুরু হত বকা। কেন আমি দুইটার উত্তর বেশী দিলাম। আমারও চটপট উত্তর ‘কেন, আমিতো সবগুলোই পারি তাহলে লিখবনা কেন’? ক্লাস টু থ্রি পর্যন্ত এই ভুল ছিল আমার একেবারেই বেশী বোঝার ভুল। কারণ তখন মনে হত বাসার আর কেউ আমার চেয়ে বেশী বোঝেনা। সবগুলো যখন পারা যাবে তবে সবগুলো লিখতে কেন মানা। আমি এটা ঠিক মেনে নিতে পারতাম না। পরে অবশ্য মেনেছিলাম যখন বুঝতে শিখলাম যে সব লিখলে কিছুটা নাম্বার জরিমানা হয় অর্থাৎ কেটে নেয়া হয় ।

যাহোক যেখানে ছিলাম মানে ক্লাসের পড়া মাথার উপর দিয়ে নিয়ে বাসায় এসে কোনরকম ব্যাগটা রেখেই চলে যেতাম খেলার মাঠে। ফুটবল খেলা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে । কিছুটা দেরী করে ফেলার কারণে ঠিক আমার পছন্দসই দলে খেলা হত না। কাজেই নিয়োগ পেতাম আগে আসাদের ঠিক করে দেয়া দলে। তবে সবচেয়ে মজা হত বৃষ্টির ভিতর খেলা করতে। সারা মাঠে পানি আর কাদার একটা দারুন কম্বিনেশন। খুব বেশী দৌড়াতে হত না কারণ খালি পায়ে খুব সুন্দর স্কেটিং করে বেশ খানিকটা চলে যাওয়া যেতো। ল্যাং মারাতে আমাদের টকি ভাই ছিল একেবারে ওস্তাদ। ওনার কাছে বল যাওয়া মানেই একটানা গোল। বর্ষাকালটা তার জন্য বেশ অন সিজেন। শুকনা মাঠে টকি ভাই কখনও গোল দিয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। কিন্তু বর্ষা এলেই তার পোয়া বারো। বেশ ডিম্যান্ডেড প্লেয়ার হয়ে যেত।তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল পা একেবারে লোহার মত শক্ত আর কাদা মাঠে তিনি কদাচিৎ আছাড় খেতেন। কাজেই বল নিয়ে ছুটেছেন মানেই গোল।

পুকুরে গোসল করা ছিল ছোটবেলার বড় আকর্ষণ। পানিতে নেমে একেবারে চোখ যতক্ষণ লাল না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ডুবানো ছিল ফরজ কাজ। এই কাজটি ঠিকমতো করে তবেই পবিত্র হয়ে বাসায় ফেরা। বর্ষার সময় আর একটু মজা হত। কারন বৃষ্টিতে ভিজে পুকুরে গোসল করলে নাকি জর হয় ( ওই সময়ের বিশ্বাস ) তাই বৃষ্টি আর পুকুর এই দুইয়ের সংমিশ্রণে জ্বর আনা যায় কিনা তার এক নিরন্তর চেষ্টা চলতো । সত্যি বলতে কি রাতে ঠিকই গায়ে জ্বর চলে আসতো।ঠিক যেমন বিশ্বাসে মেলায় বস্তু।

এখন বলি জ্বর কেন আনতে হবে সেই কথা। বাসায় অসুস্থ হওয়া মানে অতিরিক্ত যত্ন। ওই সময়ের জন্য বাসায় আমার খুব দাম। যা চাই তাই পাওয়া যায় ,লেখাপড়া করা লাগে না ,স্কুলে যাওয়া লাগে না আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল বাসায় পড়াতে আসা সামসুর স্যার(প্রাইভেট টিচার ) এর কাছে পড়তে হবে না সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। খুব পেটাতেন আমাদের বাসায় আসা ওই স্যার।তার হাতের মার ছিল রীতিমতো এক ভীতিকর ব্যাপার। তিনি আমাকে একবার বেশ পিটিয়েছিলেন । আমার অপরাধ আমি পড়তে আসতে দেরী করেছি। বেশ কড়া ছিল ভদ্রলোকটি । স্যারের মার খেলে নাকি বিদ্যা বাড়ে তাই অভিভাবকদের কাছ থেকে বেশ বাহবাও পেতেন তিনি।লিকলিকে লম্বা চোখে চশমা পরা এই মানুষটির হাতের মার আজও ভুলতে পারিনি। এক মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন তিনি আমাদের সবার জন্য। তাই একটু কষ্ট হলেও তার পড়া ঠিকই মুখস্থ করে আসতে হত। পড়া ফাকি দেয়া এই আমাকে বেশ ভালোই সাইজ করে ছেড়েছিলেন তিনি।জমের হাত থেকে পালাবার পথ আছে কিন্তু তার হাত থেকে ছোটার কোন পথ তিনি কখনও খোলা রাখতেন না।

এভাবেই কোনরকম তার হাত থেকে ছাড়া পেয়েই বৈকালিক ফুটবল খেলার আয়োজনে বেশ ব্যাস্ত হয়ে যেতাম। খেলা শেষ হতে দেরী হলেও পুকুরের ওই ঝাপাং দিতে মোটেও দেরী হত না। আস্তে আস্তে নেমে আসতো সন্ধ্যা সেই সাথে রাজ্যের যত ঘুম। সাতটা বাজতে না বাজতেই বইয়ের লেখাগুলো একটু ঝাপসা হওয়া শুরু করতো । ঝাপসা থেকে তারপর বড় বড় । অবশেষে অক্ষরগুলো দুই তিন চারটা দেখা শুরু করতাম। মাথা নুয়ে পড়তো খোলা বইয়ের পাতার উপর। এরপর হারিয়ে যাওয়া সেই ঘুমের দেশে। হঠাৎ ঘুম তাড়িয়ে মা নিয়ে যেতেন খাবার জন্যে। খুব বিরক্তি ভরা চাহনিতে শেষ হত খাওয়া আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ঘুমের শহরে সকাল অবধি যাত্রা।

শৈশবে আর একটি খেলা খুব মনে পড়ে তা হল ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা। হালকা ফুরফুরে বাতাসে উড়িয়ে দেয়া ঘুড়ির আকাশের বুকের রাজত্ব দেখলে তখন দিগবিজয়ী মনে হত নিজেকে। কার কতগুলি ঘুড়ি আজ কাটা হল, কার সুতায় মাঞ্জা বেশী এসব চিন্তায় মুখর হয়ে থাকতো ওই সময়। ঘুড়ি উড়ানোর জন্য প্রস্তুতি আর খরচ দুইটাই একে অপরের পরিপূরক । মনে আছে সুতায় মাঞ্জা দেয়ার জন্য উলট কম্বলের পাতা, বরিক পাউডার ,সাগুর দানা , কাচের গুড়া সংগ্রহ করার একটা ধুম পড়ে যেত সেই সময়। এগুলো জোগাড় করে এবার নাটাই কেনার প্রস্তুতি। আমাদের সুতায় মাঞ্জা দেয়ার জায়গা ছিল একেবারে নির্দিষ্ট করা। চৌধুরী বাড়ির নারকেল বাগানের দুই নারকেল গাছ আজও সাক্ষী হয়ে আছে সেই মুঠো ভর্তি আঠালো মাঞ্জা কিভাবে সুতার উপর দিয়ে সুনিপুনভাবে দুই গাছকে প্রদক্ষিণ করতো । মাঞ্জা শুকিয়ে গেলে নাটাই ভরতি হত গন্ধভরা সুতায়। তারপর সেই সুতা দিয়ে চলতো এক একটা সুতা কাটার প্রতিযোগিতা। প্রখর রোদ অথবা ক্লান্তিকর সব মুহূর্তই যেন হার মানত ঘুড়ি উড়ানোর এই উৎসবের কাছে। বাঘের কাছে তার শিকার ধরা যেমন মজার ঠিক তেমনি নিজ হাতে কাটা ঘুড়ি আবার নিজের নাটাইয়ের সুতায় বেধে নিজের কাছে বাগিয়ে নেয়ার মজাও কোন অংশে কম ছিল না।

এভাবেই কাটছিল আমার অনির্দিষ্ট রুটিনের লাগামহিন শৈশব যার প্রতিটা কর্মসূচি ছিল একান্তই আমার নিজের থেকে নির্ধারণ করা। একেবারেই স্বাধীন ছিলাম । কোন ধরাবাঁধা নিয়মের জালে মোটেও বাধা ছিলনা সেই সময়।কখনও প্রখর রোদ আবার কখনও মেঘের বারতা-এই নিয়েই একেবারে দৌড়, ঝাপ আর লাফালাফি করেই প্রাইমারি লেভেল শেষ হয়েছিলো। আজও অম্লান হয়ে আছে সেই সব স্মৃতি , সেই সব নানা রঙের দিনগুলি।

চলবে……