বছর দেড়েক আগে, পুরুলিয়া জেলার মানবাজার ও বরাবাজার থানা অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলিতে পরপর কিছুদিন ধরেই ডাইনি সন্দেহে অনেকের ওপর নেমে আসছিল নির্মম অত্যাচার। সিন্দ্রি, শশাংডি, জিলিং গ্রামের পর একদিন কপড়রা গ্রামে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। সেখানের সীতারাম মান্ডির ছেলে এবং স্ত্রী এর জ্বর দীর্ঘদিন ধরে ছাড়ছেনা। গ্রামবাসীদের অনেকেই এর পেছনে কোনো ভুত-প্রেত বা ডাইনির অশুভ নজর কে দায়ি করতে শুরু করেছে। একদিন সকালে গ্রামের মাতব্বররা গ্রামবাসীদের নিয়ে বিচারসভা বসালো। দিনটি ছিল ১৯ জানুয়ারি, ২০১১। ততক্ষণে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যদের কাছেও কপড়রা গ্রামের উত্তেজিত পরিস্থিতির খবর চলে এসেছে। তারা ডাইনিপ্রথা বিরোধী প্রচারে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, ডাইনি অপবাদে অত্যাচারিতদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাই বিচারসভা বসার খবর পেয়ে তারাও হাজির। এসেছে পুলিশ। সেই বিচারসভায় পুরুলিয়ার এক অন্য রূপ দেখা গেল। গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ-মহিলা জ্বর-জ্বালা, অসুখ-বিসুখের জন্য ডাইনি বলে কাউকে চিহ্নিত করার বিরুদ্ধে মত দিলেন। গ্রামের মহাদেব টুডু, বুদ্ধেশ্বর মুর্মু, স্বপন টুডুরা একথাও বলেছিলেন, শরীর খারাপ হলে কাউকে ডাইনি অপবাদে অত্যচার করা বন্ধ হওয়া উচিৎ, প্রয়োজন ডাক্তারের। ডাইনিপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন রেবতী টুডু, গুণমণি মুর্মু, সতীশ হাঁসদা সহ অনেকেই। পুরুলিয়ার এ হেন পট পরিবর্তনের খবর পরদিন প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতাতেই জায়গা করে নেয়। থানার দারোগা বাবু, বিডিও সাহেব সহ প্রশাসনিক কর্তাব্যাক্তিরা সাংবাদিকদের গদগদ গলায় বাইট দেন।
এরপর কেটে গেছে দেড় বছর। ২৮ মে, ২০১২। সন্ধ্যের দিকে যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়ার শাখা সম্পাদক মধুসূদন মাহাতোর কাছে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বস্ত সূত্র থেকে খবর আসে যে, মানবাজার থানার কপড়রা গ্রামে এক মহিলাকে ডাইনি সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং রাতের দিকে একটি বিচারসভার আয়োজন করা হবে যেখানে ওই মহিলাকে বিরাট অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হবে, অনাদায়ে মহিলাকে হত্যাও করা হতে পারে। ঘটনাচক্রে এই দিনগুলোতে বিবিসি চ্যানেলের ভারতীয় প্রতিনিধিরা যুক্তিবাদী সমিতির কুসংস্কার দূরীকরণের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মানে হাত দিয়েছিলেন এবং ওই ২৮ মে তারিখটিতে তারা পুরুলিয়াতেই ছিলেন। বিবিসির এই টিমের প্রধান সাংবাদিক ছিলেন কল্পনা প্রধান। হাতে সময় অল্প, মহিলার প্রাণ বাঁচাতে হবে, তাই বিবিসির গাড়িতেই মধুসূদন মাহাত তার সঙ্গীদের নিয়ে কপড়রার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তারা গ্রামে পৌছন রাত ১১ টা নাগাদ। গ্রামে তখন উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। এদিকে সন্ধ্যে থেকেই যুক্তিবাদী সমিতির আর একটি দল ঐ মহিলাকে হত্যার হাত থেকে বাঁচাতে প্রশাসনিক স্তরে কড়া নাড়তে শুরু করে। রাত ৮ টা নাগাদ কাশিপুর থানার সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং মানবাজার থানার ওসিকে হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের জেলা গনমাধ্যম সম্পাদক মনীশ কুমার বিষয়টি সম্বন্ধে প্রথম অবহিত করেন। এই হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশন হল যুক্তিবাদী সমিতিরই সিস্টার কর্ণসান। হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি অজয় সিং রাত ৮ টা ২০ তে জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর কে বিষয়টি জানান। পুলিশ সুপার সমস্ত রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। রাত ৯টা নাগাদ সমিতির তরফে রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা হয়।
ওদিকে যুক্তিবাদী সমিতি এবং বিবিসির দলটি প্রচন্ড বিপদের ঝুঁকি নিয়েই রাত এগারোটা থেকে ভোর পর্যন্ত কপড়রা গ্রাম এবং মানবাজার থানাতে নানা ঝামেলার মধ্যে কাটায়। মানবাজার থানা তাদের সাথে মোটেও ভাল ব্যবহার করেনি। দোষীদের গ্রেপ্তারের কথা বললে থানার ওসির চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয়। তারা পরদিন অর্থাৎ ২৯ মে সকাল ১১ টা নাগাদ পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করে লক্ষীমণি কিসকুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি উত্থাপন করে, তারই ফলস্বরূপ ওই দিন বিকেল ৪ টে নাগাদ মানবাজার থানার পুলিশ যুক্তিবাদী সমিতি এবং বিবিসির উপস্থিতিতে লক্ষীমণি কিসকুর পরিবারকে বোরো থানার ঝগড়ুডিহ গ্রামে আত্মীয় বাড়িতে সাময়িক ভাবে স্থানান্তরিত করে। সেদিনই সন্ধ্যে ৬ টাতে ডাইনি অপবাদটি মীমাংসা করতে যুক্তিবাদী সমিতি ফের কপড়রা গ্রামে যায়। এই দুদিনের ঘটনাটিই পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়।
স্বভাবতই এই পুরো ঘটনাটিতে স্থানীয় কোনো রাজনৈতিক নেতার সাহায্য পাওয়া যায়নি। সত্যি বলতে কি আদিবাসীদের ডাইনিপ্রথা দূর করতে কোনো দিনই সিপিএম, কংগ্রেস, তৃ্নমূল কংগ্রেস কোনো দলেরই দেখা মেলে না। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারা হয় নিজেরাও এই কুকর্মে জড়িত থাকেন অথবা আদিবাসী সেন্টিমেন্টে ঘা পড়ার ভয়ে নিজেদের ভোটবাক্সের কথা ভেবে চুপ থাকেন। দীর্ঘ বছরের ডাইনিপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের এই সাক্ষ্যই দেয়। গত ৩৪ বছরেও যা ছিল, সমস্যাটি আজও তাই আছে।