(আগের পর্বের পর…)
…
১.০ : ভারতীয় সাহিত্যে চার্বাক
…
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অন্তরায় হচ্ছে চার্বাকদের নিজস্ব রচনাসম্ভার বা সাহিত্য সৃষ্টির কোন নমুনা আমাদের বর্তমান জ্ঞানজগতের আয়ত্তে না-থাকা। সেগুলো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। ফলে সম্পূর্ণতই অন্যের রচনার উপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে চার্বাক দর্শন সম্পর্কিত আমাদের ধারণার উৎস প্রধানত চার্বাক-বিরোধী তথা চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চার্বাকী মতবাদের সমালোচনা- যেখানে চার্বাক সর্বদাই পূর্বপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত।
.
হয়তো চার্বাকী বক্তব্যের কেবল সেই অংশগুলিই অন্যের মারফৎ প্রচারিত হয়েছে যেগুলির বিরোধিতা বা খণ্ডনের নিমিত্তে অপরপক্ষ নিজ সিদ্ধান্ত স্থাপন করতে যুক্তি-বাণ মোকাবেলায় সক্ষম ছিলেন। ভারতীয় দর্শনের সব ক’টি বিভাগেই চার্বাক মত এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে এখান থেকে আমরা হয়তো চার্বাকী দৃষ্টিভঙ্গিটা অনুমান করতে সক্ষম হই বটে, কিন্তু চার্বাক দর্শনের অবিকৃত পূর্ণাঙ্গ স্বরূপটা দৃশ্যের অন্তরালেই থেকে যায়।
.
ভারতীয় দর্শনমতের যে গ্রন্থগুলিতে কঠোর সমালোচনার সূত্র ধরে চার্বাক মতের অন্তর্ভুক্তি দেখা যায় তার মধ্যে নবম শতকের ন্যায়-দার্শনিক জয়ন্ত ভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’, অষ্টম শতকের দুই বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’, অষ্টম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সুরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’, সপ্তম শতকের অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ ও ব্রহ্মসূত্রের (৩/৩/৫৩-৫৪) শাঙ্করভাষ্য, চতুর্দশ শতকের অদ্বৈত বেদান্তবাদী মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘সর্বমতসংগ্রহ’, চতুর্দশ শতকের বিদ্যারণ্যমুনির ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’, দ্বাদশ শতকের শ্রীহর্ষের ‘নৈষধচরিত’ (সপ্তদশ সর্গ) প্রভৃতি গ্রন্থেও চার্বাক সিদ্ধান্তের কিছু বর্ণনা রয়েছে।
.
এসব গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের যে বিশিষ্ট রূপের প্রকাশ, সেই রূপেরই প্রতিফলন দেখা যায় ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে চার্বাক মতের বর্ণনায়। কোথাও ‘লোকায়ত’, কোথাও বা ‘বার্হস্পত্য’ সংজ্ঞায় পরিচিত, অনেক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট কোন নামের স্বাক্ষর বহন না করেও বর্ণনাগুলি চার্বাকী মতের প্রতিফলন বহন করে। এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও কৃষ্ণ মিশ্র রচিত একাদশ শতাব্দির ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নামক রূপক নাটকে সৃষ্ট চার্বাক চরিত্রের মাধ্যমেও চার্বাক মত সম্বন্ধে কিছুটা পরিচিত হওয়া যায়।
ভারতীয় দর্শন জগতে এই বিশেষ মতবাদ ‘চার্বাক’ সংজ্ঞার মাধ্যমে সুপরিচিত এবং চার্বাক দর্শন হিসেবে তা পরিজ্ঞাত।
.
তবে একটি মাত্র গ্রন্থ পাওয়া যায় যেটাতে চার্বাক মতের সিদ্ধান্ত বিচার উত্তরপক্ষ রূপে করা হয়েছে, তা হলো জয়রাশি ভট্ট (সম্ভাব্য ৭০০ খ্রী.) রচিত ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’। ১৯৪০ সালে বইটি মুদ্রিত আকারে প্রথম প্রকাশ করা হলে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের তৈরি হয়। কেননা অন্যত্র সবখানেই চার্বাক দর্শনের যে ছবি আমরা দেখতে পাই, এ গ্রন্থে তার অন্যরূপ প্রতিফলন দেখা যায়। সমগ্র চার্বাক দর্শনের অংশমাত্রের পরিচায়ক হিসেবে ধারণা করা হয় বইটি হয়তো চার্বাকের কোন বিশেষ এক শাখার সিদ্ধান্ত, যাদেরকে কেউ কেউ বৈতণ্ডিক চার্বাক নামে আখ্যায়িত করেন।
.
কিন্তু কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি আদৌ চার্বাকী মতবাদী নয় বরং সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ভারতীয় প্রতিটা দর্শনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রমাণের নিমিত্তে নিজস্ব যুক্তির অনুকূলে ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রীয় চর্চাটাকে খুবই গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এবং এসব যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চের আমদানি ঘটালেও প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে অতীব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ন্যায়দর্শনেই প্রমাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে বলে ন্যায়দর্শন নামান্তরে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ- অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। অন্যদিকে দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে দাবি করেন যে, লোকায়ত বা চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অথচ জয়রাশি ভট্ট প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ বলে আসলে কোনো প্রমাণই হতে পারে না। অর্থাৎ এক তূণে তিনি সকল তত্ত্ব বা দর্শনকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বইটির নাম ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ এর অর্থ হচ্ছে সোজা বাংলায়- সিংহের মতো দর্পে তত্ত্বমাত্রকে- অর্থাৎ সবরকম দার্শনিক মতকে- উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি।
.
দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-বাদী, সর্বপ্রমাণ-বিরোধী নয়। সর্বপ্রমাণ-বিরোধী হিসেবে যাঁরা ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ তাঁরা আসলে চরম ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নন। এই চরম ভাববাদী দর্শনগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটো হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রীস্টাব্দ) শূন্যবাদ এবং অদ্বৈত-বেদান্তী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রীস্টাব্দ) মায়াবাদ। এদিক থেকে দেখলে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-এর জয়রাশির অবস্থান আসলে বস্তুবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অদ্বৈত-বেদান্ত ও বৌদ্ধ-শূন্যবাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে থাকার কথা। তাই জয়রাশি ভট্টের উদ্দেশ্য নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে অস্পষ্টতা ব্যাপক।
এ প্রেক্ষিতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য।
‘মনে রাখা দরকার, বইটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে সম্পাদকরা এটিকে প্রসিদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে দাবি করেননি। করা সম্ভবও নয়। শুরুতেই গ্রন্থকার বলছেন, সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধি আছে যে মাটি, জল, আগুন, বাতাস- এগুলিই মূল সত্য। কিন্তু দার্শনিক বিচারের ধোপে তাও টেকে না ! তার মানে প্রসিদ্ধ চার্বাক মত বর্জন থেকেই বই-এর শুরু। গ্রন্থশেষে জয়রাশি আস্ফালন করে বলেছেন, স্বয়ং দেবগুরু বা বৃহস্পতির মাথাতেও যা আসেনি তা এই পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের বইতে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃহস্পতি-মতের কোনো প্রকৃত সমর্থকের পক্ষে এমন আস্ফালন সহজবোধ্য নয়, কেননা গুরুমারা বিদ্যের স্থান আর যেখানেই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে থাকতে পারে না। বরং, প্রতিটি দার্শনিক মতের প্রকৃত প্রবক্তারা পরের যুগে কোনো নতুন কথা বলার সময়ও যেন-তেন-প্রকারেণ কথাটা সম্প্রদায়-প্রবর্তকের প্রকৃত অভিপ্রায় বলেই প্রচার করতে চান। পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে প্রচলিত রকমারি গালিগালাজের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পাষণ্ড আখ্যা দিয়ে সন্তোষ লাভ করলেও, ব্রাহ্মণ-বৌদ্ধ উভয়ের পক্ষেই চার্বাককে সমস্বরে পাষণ্ডশিরোমণি হিসাবেই দেখবার কথা।
তাহলে বইটিতে চার্বাক-প্রবণতার পরিচয় শুরুতেও নেই, শেষেও নেই। আরো বড় কথা হলো, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য-বিষয়ের মধ্যেও নয়। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ অবশ্যই সহজপাঠ্য বই নয়; যুক্তিতর্ক-কণ্টকিত রীতিমতো কঠিন বই। তবুও সাধ্যমতো সহজ করে এবং সংক্ষেপে তার সারমর্ম বলে রাখা দরকার।
জয়রাশি কী করে দেখাতে চান যে কোনো রকম দার্শনিক মতই স্বীকারযোগ্য নয় ? সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য এই : যে-কোনো দার্শনিক মত বা তত্ত্ব হোক না কেন, স্বীকারযোগ্য হতে গেলে তার পক্ষে তো প্রমাণ থাকা দরকার। অথচ বিচার করলে বোঝা যায় যে, কোনো রকম তথাকথিত প্রমাণেরই প্রামাণ্য- বা প্রমাণ করার যোগ্যতা থাকতে পারে না। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ, অনুমান, প্রভৃতির প্রমাণ হিসেবে প্রসিদ্ধি আছে। কিন্তু জয়রাশি দেখাতে চান, সে-প্রসিদ্ধি আসলে অলীক, কেননা নামে প্রমাণ হলেও এগুলি সবই আসলে অসার; কোনোটিকেই প্রমাণ বলা যায় না। আর প্রমাণ বলেই যদি কিছু না থাকে তাহলে কোনো রকম দার্শনিক মত বা তত্ত্ব স্বীকার করার কারণও থাকতে পারে না। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’- সিংহদর্পে সর্বতত্ত্বের উপপ্লব বা উৎখাত।’ (সূত্র : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-২৯)।
.
অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থটিকে চার্বাক মতের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা তা প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে হয়তো।
.
এছাড়া কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’র মতো কিছু প্রাচীন গ্রন্থে এবং প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাথায় চার্বাক মতের বিশেষ বিশেষ দিক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই চার্বাকমতের একটা পুনর্গঠিত রূপের ধারণা পেতে আমাদেরকে মূলত যেসব সাহিত্য-উপাদানের উপর নির্ভর করে আগাতে হয়, তা হলো-
(১) প্রামাণিক বিবেচনায় প্রাচীন গ্রন্থাবলি,
(২) সম্ভাব্য প্রামাণিক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাথা, এবং
(৩) প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের চার্বাক বিরোধী পক্ষের রচনায় পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাক বা লোকায়ত বর্ণনাগুলি- যেখানে পরমত খণ্ডনের প্রথা অনুযায়ী প্রথমে পূর্বপক্ষ হিসেবে সে মতটা আসলে কী তা ব্যাখ্যা করে পূর্বপক্ষের সমর্থনে সম্ভাব্য সব যুক্তি দিয়ে তা যথাসম্ভব স্থাপন করে নেয়া হয়, যাতে পরবর্তীতে তা উত্তরপক্ষের যুক্তিবিস্তারে খণ্ডন করা হলে কেউ যেন ওটার সমর্থনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
.
উল্লেখ্য, চার্বাকদের নিজস্ব রচনা বিষয়ক কোন বিশ্বস্ত দলিল প্রামাণ্য হিসেবে সুনির্দিষ্ট না থাকায় বিভিন্ন উপাদান নির্ভর অনুমানগুলোও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে দেখা যায়। ফলে বিভিন্ন বিদ্বান ও দার্শনিকদের মধ্যেও চার্বাক নিয়ে মতান্তরের অন্ত নেই। আর এতোসব মতান্তরের কারণেই হয়তো চার্বাক দর্শন নিয়ে কোন কালেই কৌতুহলি গবেষকদেরও আগ্রহের কমতি দেখা যায়নি। রহস্যময় বিচিত্র বিভ্রমের তুঙ্গে থেকে সেই প্রাচীন কাল থেকে আজতক মুক্তচিন্তক ভাবুকদের জন্য চার্বাক দর্শন এক অনন্য সাধারণ দর্শন হিসেবে দার্শনিক চিন্তা জগতে ক্রমাগত ঢেউ তুলে যাচ্ছে। এই ঢেউগুলো তো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজার এক দীর্ঘ ধারাক্রম। আর এই একই ধারায় এগিয়ে যেতে যেতে আমাদেরকেও জেনে নিতে হয় চার্বাক সংশ্লিষ্ট বেশ কতকগুলো বিষয়ে আপাত সিদ্ধান্তে— উপনীত হওয়ার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ও এর রূপরেখাসমূহ।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব: ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য] [*] [পরের পর্ব: চার্বাক নামের উৎস]
…
SIR.সংস্কৃত কেন প্রাচীন আদিবাসি সাহিত৽েও তো লোকায়ত বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেতে পারে?
প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সাহিত৽ বলতে শুধু সংস্কৃত কেন?আদিবাসি ভাষা সাহিত৽িক দর্শন বলতে পারি না কেন?
@কাজী রহমান ভাই, আপনার সর্বশেষ মন্তব্যটির নিচে জবাবের কোন অপশন দেখছি না, তাই এখানে মন্তব্য করছি। তবে আপনাকে উৎপাত করছি বলে বিরক্ত হবেন না যেন। আসলে এই মন্তব্য প্রতিমন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমিও বিষয়টা সম্পর্কে পরিষ্কার হচ্ছি।
বিজ্ঞানের কোন দর্শন আছে কিনা এর জবাবে আপনার বক্তব্যটি কিন্তু বিজ্ঞানও যে একটি দর্শন মেনে চলে তারই প্রমাণ হচ্ছে। আর শুধু বিজ্ঞানকেই তত্ত্ব নির্ভর বলছেন কেন ! দর্শনও কি তত্ত্ব নির্ভর নয় ? আসলে প্রত্যেকটা বিষয়েরই একটি দর্শন থাকে। এর বাইরে কিছুই নেই। বিজ্ঞানেরও একটি দর্শন আছে, আর সেটা হলো বস্তুবাদী দর্শন। তবে শুধু বস্তুবাদী দর্শন বললে অন্য দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে বলেই আমি একটু ঘুরিয়ে বিজ্ঞানের দর্শন বলেছি মাত্র। সে যাক্, আপনার প্রদত্ত তালিকাটা মন্তব্যসমেত এখানে ফের উদ্ধৃত করি বোঝার সুবিধার্থে।
খেয়াল করলেই বোঝা যায়, প্রথম পাঁচটি আসলে সর্বশেষ ষষ্ঠ ক্রমের প্রমাণ নির্ভরতার বৈশিষ্ট্য মাত্র। মূলত বিজ্ঞান প্রমাণ নির্ভরই। মজার বিষয় হলো, প্রতিটা দর্শনও নিজেদেরকে প্রমাণ নির্ভর হিসেবে ঘোষণা করে। তাহলে আমরা চলে এলাম মূলত প্রমাণের অনিবার্যতায়। এই প্রমাণের চলকগুলো একেক দর্শনের জন্য একেক রকম, যা আমি আগের মন্তব্যগুলোতেও বলতে চেয়েছি। কেবল চার্বাকই প্রত্যক্ষণকে একমাত্র প্রমাণ মানে। অন্যান্য দর্শনগুলো প্রত্যক্ষণ ছাড়াও আরো কিছু বিষয় যেমন অনুমান, শব্দ, উপমান, উপমিতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। তবে প্রত্যক্ষণকে কেউ বাদ দেয় নি। এই প্রত্যক্ষণের ব্যাখ্যা দর্শন ভেদে কিঞ্চিৎ তারতম্য হয়। এখন যদি আমরা বিজ্ঞানের দর্শনকে বিবেচনায় আনি, বিজ্ঞানও কেবল প্রত্যক্ষণকেই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে বলে আমি মনে করি। বিজ্ঞানের এই প্রত্যক্ষণের প্রক্রিয়াটা ভারতীয় দর্শনের প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন, এবং তা-ই স্বাভাবিক। বিজ্ঞান জ্ঞান থেকে পিছিয়ে থাকা সেকালের দার্শনিকদের সম্বল ছিলো কেবল নিজস্ব প্রাকৃতিক ইন্দ্রিয়গুলোই। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের এই ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রযুক্তি আর অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী করেছে। ফলে বিজ্ঞান পদ্ধতির প্রত্যক্ষণের পরিধি এখন অনেক বিশাল ও গভীর। এই প্রত্যক্ষণকে প্রমাণিত সিদ্ধান্তে উপনীত করার আগে বিজ্ঞান তার সবকটি উপায় দিয়ে নিশ্চিত হবার লক্ষ্যে তার যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল থেকে সম্ভাব্য কিছু অনুমানকে পরীক্ষণের প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রত্যক্ষণে না আসা পর্যন্ত বিজ্ঞান কোন কিছুই আমলে নেয় না। অর্থাৎ বিজ্ঞান হলো ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক বস্তুবাদী দর্শন, যাকে আমি বলি বিজ্ঞানের দর্শন।
জানি আমি আমার বক্তব্যটা আপনাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম কিনা। তবে মুক্তমনায় যাঁরা বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর চর্চা করেন তাঁরা হয়তো বিষয়টাকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন।
আপনাকে আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি, এই বিজ্ঞান ও দর্শনের আন্তসম্পর্কের বিষয়টাকে আলোচনায় আনার জন্যে।
সবগুলো পর্ব পড়লেও কখনও বলা হয়নি যে, চোখ রাখছি। যদিও দর্শন তেমন একটা বুঝি না, তবে এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করছি। এখন পর্যন্ত প্রতিটা পর্বেই চার্বাক দর্শন নিয়ে একরকম ইতিবাচক কথা বলে এসেছেন, নেতিবাচক দিকও কিছু আছে নিশ্চয়, সেই গল্পগুলোও শুনতে মন চায়।
@প্রতিফলন, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
কিছু নয়, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে চার্বাক সম্পর্কে যা আছে সবই নেতিবাচকভাবেই উপস্থাপন করা আছে। চার্বাকদের নিজস্ব সাহিত্য বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই তা আগেই উল্লেখ করেছি। সবগুলো আস্তিক দর্শন, এমনকি বৌদ্ধ ও জৈনদর্শনের মতো নাস্তিক দর্শনও জড়বাদী চার্বাকদের বিরোধিতায় মত্ত ছিলো। ইতিবাচক অর্থে চার্বাককে এক বিন্দুও উপস্থাপন করা হয় নি। ভাববাদী ধর্মবাদী দর্শনের উদ্দেশ্যও তো তা-ই ! ফলে সেই নেতির আকরিক পাহাড় থেকে যাচাই বাছাই করে চার্বাকরা যে ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে এক ইতিবাচক অবস্থানে শেষপর্যন্ত শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই নিজেদেরকে দাঁড় করিয়েছিলো সেটা খুঁজে বের করাই তো এ লেখার প্রতিপাদ্য !
আপনার যদি প্রাচীন সাহিত্যের কোথাও চার্বাকদের নিয়ে ইতিবাচক কোন মনোভাবের নিদর্শন চোখে পড়ে থাকে, দয়া করে সেই সূত্রটা উল্লেখ করলে আমার কাজের জন্য খুবই সহায়ক হবে। তবে তেমন কোন নমুনা আদৌ পাওয়া গেছে বলে কেউ বলেননি আজতক। এ সিরিজে সেসব নেতিবাচক উপাদানের নমুনা প্রচুর পাবেন বলেই আশা করি। তা থেকে ভালোটুকু খুঁজে বের করতে হয়রান হয়ে যেতে হবে। হা হা হা !
ভালো থাকবেন।
@রণদীপম বসু,
আসলে ভারতীয় দর্শনে আকৃষ্ট না হয়ে পারা যাচ্ছে না। যেখানে আছে আপনার শক্তিশালী লেখা।
চলতে থাকুক- (Y)
@আফরোজা আলম, আপা, ভারতীয় দর্শনে আকৃষ্ট হয়েছেন মানে মাথা নষ্ট ! হা হা হা !!
আমার কাছে কিন্তু জটিল লাগল, রণদীপমদা! আসলেই কি প্রমান বলে কিছু আছে? প্রত্যক্ষ, অনুমান, যুক্তি – সবই অসাড় এবং অসার। অলীক। একে কি ভাববাদ বল্বেন? তবে কথাগুলা মনে ধরেছে!
এই সেরেছে! আপনি চার্বাক খুঁজতে আবার সাহিত্যের ইতিহাসে হাত বাড়িয়েছেন নাকি? পাতিহাস হয়ে যেতে হবে যে তাহলে!
লেখা চলুক! (F)
@কাজি মামুন, ধন্যবাদ।
ভারতীয় প্রমাণশাস্ত্রে একেক দর্শনের প্রমাণের চলকগুলো ভিন্ন ভিন্ন। এর মধ্যে কিছু কমন চলকও আছে, যেমন প্রত্যক্ষ, অনুমান এগুলো। এর বাইরে একেক দর্শনে নিজেদের স্বমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের প্রমাণের সিদ্ধান্ত হাজির করেছে। ন্যায়দর্শনে অতিরিক্ত উপমান, উপমিতি। এগুলোর আবার বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। সাংখ্য ও যোগ দর্শনে আবার প্রত্যক্ষ, অনুমানের সাথে শব্দ বা আগম প্রমাণ নামে আরেকটি যুক্ত হয়েছে। মীমাংসা দর্শনে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ ছাড়াও অর্থাপত্তি ও অনুপপত্তি নামে আরো দুটো প্রমাণ হাজির করা হয়েছে, এরকম। তবে আদি চার্বাক দর্শনে প্রমাণ কেবল একটাই- প্রত্যক্ষ। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়কেই কেবল প্রমাণ হিসেবে চার্বাকরা স্বীকৃতি দেন। কেননা ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়কে প্রমাণ হিসেবে মানতে গেলে ঈশ্বর, পরকাল, জন্মান্তর, স্বর্গ, নরক ইত্যাদি তাবৎ বিষয় এসে হাজির হয়ে যাবে।
কিন্তু আপনার ভালো লাগলেও প্রত্যক্ষকেও যদি প্রমাণ হিসেবে না মানেন, তাইলে এই দৃশ্যমান জগত ও বাস্তবতা সবই অলীক হয়ে যাবে। সেখানে আপনি আমি মুক্তমনা কম্পুটার, বাংলাদেশ, আমেরিকা, গরু, ছাগল ইত্যাদি সবই যে উধাও হয়ে যায়। অর্থাৎ এগুলো সব মায়া হয়ে যায়। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত-বেদান্ত দর্শন তা-ই বলে। সেখানে কেবল ব্রহ্মই সত্য, আর সবই মায়া ! অতএব সর্ব-প্রমাণবিরোধী মতবাদের উদ্দেশ্যটা কি বুঝতে পারছেন ?
আর চার্বাককে খুঁজতে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ছাড়া আর কোন সম্বল তো নেই ! তবে এখানে সাহিত্য বলতে গল্প কবিতা উপন্যাস বুঝলে সমস্যা। কেননা তখনও এসবের জন্ম হয়নি বলা চলে। যা ছিলো তা হয় দর্শন-সাহিত্য, নয়তো মহাভারত, রামায়ণ ইত্যাদির মতো শাস্ত্রবিহিত নাট্য-কাব্য ইত্যাদি। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য মানে এসব সংস্কৃত সাহিত্যই। আশা করি আঁৎকে উঠার কারণ নেই। তবে সমুদ্রে ডুবুরি হবার ঝামেলা প্রচুর।
দেখা যাক শেষপর্যন্ত কী দাঁড়ায় !!
আপাতভাবে আপনি যা বললেন তা ঠিক, বেশীরভাগ সময়েই হয়তো এই ‘যুক্তিটাই’ সঠিক। কিন্তু এই যুক্তিটি বা ভারতীয় যুক্তিবাদের এই ব্যাপারটা অবস্থা ভেদে ভীষণভাবে অবৈজ্ঞানিক বা ভাববাদী হয়ে উঠতে পারে। কোন কিছুর স্বপক্ষে বা বিপক্ষে প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ (প্রাচীন সময়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলতে বোধ হয় চাক্ষুষ প্রমাণকেই বোঝানো হত। আপাত দৃষ্টিতে যাকে যৌক্তিক বা সঠিক বলে মনে হয় তা সঠিক বা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নাও হতে পারে। যেমন ধরুন, পৃথিবী যে ঘোরে এটা আপাত দৃষ্টিতে বা তথাকথিত প্রাচীন ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ’ এর যুক্তি দিয়ে বোঝানোর কোন উপায় ছিল না) দেওয়া যাচ্ছে বলেই যে সেটা সঠিক হবে এমন কোন কথা নেই। অনেকেই ‘যুক্তি’কে বিজ্ঞান বা ‘সাইন্টিফিক রিসনিং’ এর সাথে মিলিয়ে ফেলেন। প্রাচীনকালে এ দুটোর মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকলেও বা এক সময় ‘যুক্তি’র ছায়ায় বিজ্ঞানের সূচনা ঘটলেও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে তা কিন্তু সবসময় সঠিক নাও হতে পারে।
@বন্যা আহমেদ, ধন্যবাদ।
ভারতীয় প্রমাণশাস্ত্রে প্রত্যক্ষ বলতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকে বোজানো হয়। এখানে অক্ষির সম্মুখে বলতে প্রত্যক্ষ বুঝে থাকি আমরা, তা নয়। অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যেকোনটির গ্রাহ্য হলেই তা প্রত্যক্ষ। চক্ষু তো কেবল একটা ইন্দ্রিয়- দর্শনেন্দ্রিয়।
তবে এটা আদি চার্বাকদের সিদ্ধান্ত। চার্বাকদের মধ্যে আরেকটা গোষ্ঠি অবশ্য লৌকিক অনুমানকেও প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এখানে অলৌকিক অনুমানকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। অতএব আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে তা সাংঘর্ষিক হওয়ার কথা নয় বলেই তো মনে হয় !
আমি কি বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি আপা ?
@রণদীপম বসু, আপনি কী তাহলে perception এর বাংলা প্রত্যক্ষ করছেন? প্রথম দুটো পর্বে মনে হয় এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন।
@বন্যা আহমেদ, দিদি, দর্শন মূল সূত্রগ্রন্থগুলোতে সংস্কৃতে দার্শনিক পরিভাষায় প্রত্যক্ষই বলা আছে যা বাংলায়ও একই রাখা হয়েছে। আর এই প্রত্যক্ষর দার্শনিক অর্থটাকে যথাযোগ্য ইংরেজি ভাষান্তর করা হয়েছে perception হিসেবে।
আগের পর্বগুলিতে সবার প্রশ্নেরই একই উত্তর দিয়েছিলাম- দার্শনিক পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে।
@রণদীপম বসু,
এটাও একটু শুনুনঃ
চার্বাকদের মতে, প্রত্যক্ষ দু’ভাবে হতে পারে। বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ (J. N. Sinha: History of Indian Philosophgy. Vol 1, Calcutta, Sinha Publishing House, 1956, Pg 235 এবং Cowell E.B. and Gough A.E [Tr]: Sarva Darsana Samgraha, London. Kegan Paul. Trench, Trabner and Co Ltd. 1908, Pg 6)
এবং,
বাহ্য বস্তুর সাথে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে বাহ্য প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। যেহেতূ অতীত বা ভবিষ্যতের বাহ্য প্রত্যক্ষ সম্ভব নয় সেহেতু সার্বিক জ্ঞানও সম্ভব নয়। ( S. Radhakrishnan and C. A. Moore: A sourcebook in Indian Philosophy, New Jersey, Princeton, 1967. Pg 231)
তারপর আরো অনেক ব্লা ব্লা আছে।
যাই হোক আসল কথা প্রত্যক্ষকে বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ বলে বলা হয়েছে যে ‘বাহ্যিক’ ইন্দ্রিয় দিয়ে যা কিছু প্রত্যক্ষ করা হয় তা ‘আভ্যন্তরীণ’ প্রত্যক্ষে, মানে মনকে পাঠানো হয়। অথচ মন বহিরিন্দ্রিয়ের উপর নির্ভরশীল হওয়াতে তা স্বতন্ত্র ভাবে বাহ্য বস্তুর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে না। এইভাবে বলা যায় যে আভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ বাহ্যিক প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভরশীল পরের ধাপ। এই ভাবে আরো অনেক ক্যাচাল প্যাচাল আছে। সবশেষে ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটার উপর নির্ভর করে খুব শক্ত ভাবে বৈজ্ঞানিক যুগে তেমন করে খুব একটা দাঁড়ানো যেতে পারা যাবে না। অথচ ভারতীয় প্রমাণতত্ত্বে চার্বাক শুধুমাত্র, একমাত্র এবং একমাত্র ‘প্রত্যক্ষ’ এর ওপর দাঁড়িয়ে।
ওহ, আমার মন্তব্য নির্ভর করেছে কালী প্রসন্ন দাসের ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা চার্বাক দর্শন ও হিউম, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪ বইখানার ওপর।
@কাজী রহমান, ধন্যবাদ। আসলে চার্বাক দর্শনের জ্ঞানতত্ত্বের যে আলোচনাটা আরো বহু পরে আসার কথা, মন্তব্যক্রমে সেটাই চলে এসেছে। যাক্, এখানে চার্বাক মতে প্রত্যক্ষণ দুই প্রকার ঠিকই আছে। বাহ্য প্রত্যক্ষণ ও মানস প্রত্যক্ষণ। পরেরটাকে আপনি অবশ্য আভ্যন্তরীন প্রত্যক্ষণ বলছেন। শব্দে সমস্যা নেই, দার্শনিক পরিভাষায় যা বোঝানোর তা বোঝালেই হলো।
বাহ্য প্রত্যক্ষণের ব্যাখ্যা তো দিয়েছেনই। আর মনের সাহায্যে সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থার যে সাক্ষাৎ জ্ঞান হয় তাকে মানস প্রত্যক্ষণ বলা হয়। এখানে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, চার্বাক মতে যা ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায় না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অর্থাৎ যে বস্তুকে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায় একমাত্র সেই বস্তুরই অস্তিত্ব স্বীকার করা যায়। চার্বাক মতে অনুমানকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করা চলে না। যতসব ব্লা ব্লা এখানেই। কেন অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা চলে না তা নিয়ে বিস্তর আলাপ করা যাবে যথাস্থানে যথাসময়ে। কিন্তু আপনি যে বললেন কেবল প্রত্যক্ষের উপর ভিত্তি করে এই বৈজ্ঞানিক যুগে খুব একটা দাঁড়ানো যাবে না, বিষয়টা আলোচনার দাবি রাখে। আমি তো মনে করছি যে, বিজ্ঞানের দর্শনটাই এই প্রত্যক্ষের উপর দাঁড়িয়ে। চার্বাকদের যুগে তাঁরা যেটুকু প্রত্যক্ষ করতে পারেননি, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নানান প্রযুক্তির সহায়তায় আমাদের সেই প্রত্যক্ষের বিস্তৃতি বেড়েছে ব্যাপকভাবে। চার্বাকদের দ্বারা দেখা সম্ভব না হলেও আমরা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ফেলে ভাইরাসগুলোকে প্রত্যক্ষের আওতায় নিয়ে এসেছি। অসুখ বিসুখ যে কোন আধ্যাত্মিক পাপের ফল নয় তা আমরা জোর দিয়েই বলতে পারি এখন।
আমরা খেয়াল করলে দেখবো যে, বিজ্ঞান যেটুকুকে অনুমানের ধারণায় রাখে সেটাকে স্বতসিদ্ধ করে না, বরং হাইপোথিসিস হিসেবে পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে রাখে। যেটুকু আমরা প্রযুক্তির চোখে স্পষ্ট দেখি না, কিন্তু গাণিতিক ফর্মুলায় দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যায় বলে সিদ্ধান্তের আসতে পারি, সেটাকে কি বৈজ্ঞানিক প্রত্যক্ষণের আওতায় ফেলতে পারি না আমরা ? যদি গণিতের ফর্মুলা কোন অজ্ঞাত রাশির সহায়তায় মিলাতে হয়, সেই অজ্ঞাত রাশি তো অনুমানই। বিজ্ঞান সেখানে শর্ত আরোপ করে দেয়। অর্থাৎ সেই শর্ত মিললে বিষয়টা বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষণের আওতায় চলে আসবে। অর্থাৎ সংক্ষেপে আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিজ্ঞান প্রত্যক্ষণের উপরই স্বতসিদ্ধ সিদ্ধান্ত দেয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এই প্রত্যক্ষণের পরিধিটা বাড়তেই থাকে। অনুমান কোন বৈজ্ঞানিক সূত্রের স্বতসিদ্ধতায় আসে না। অতএব প্রত্যক্ষের উপর শক্তভাবে দাঁড়ানো যাবে না এ মতের সাথে আমি একমত নই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চোখে প্রত্যক্ষের সীমাটা বাড়তে থাকবে। সৌরজগতের বাইরে খালি চোখে অপ্রত্যক্ষ হলেও বিজ্ঞানের চোখে তা অপ্রত্যক্ষ নয়। অতএব যতটুকু প্রত্যক্ষের মধ্যে চলে এসেছে ততটুকুর বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
@রণদীপম বসু,
উত্তর দেবার জন্য আপনার সময় বের করেছেন, অনেক ধন্যবাদ সেজন্য।
সন্দেহ নেই যে চার্বাক সে সময়কার মুক্তমনা প্রক্রিয়াকে এগুবার জন্য সাহায্য করতে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তারকারী একটি দর্শন। তবে এই সময়টা বিজ্ঞানের।
বিজ্ঞানের দর্শন, এটা বুঝতে পারছি না।
এবং
দেখুন বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমি যা বুঝি তা হোল বিজ্ঞানসিদ্ধান্ত পরীক্ষালব্ধ প্রমানের ওপর দাঁড়িয়ে রয়। পরীক্ষা বার বার করা যাবে এবং ভুল বা অসম্পূর্ণ প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তই দাঁড়িয়ে থাকবে। ভুল বা অসম্পূর্ণ প্রমান হলে নতুন পরীক্ষালব্ধ প্রমানভিত্তিক সিদ্ধান্তই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। এভাবেই এগুতে থাকবে বিজ্ঞান। এখানে অন্য কোন ব্যাপার নেই। গোঁড়ামি নেই, শেষ কথা বলেও কিছু নেই, ‘প্রত্যক্ষ’ নামক একমাত্র মূল শব্দ নিয়ে একেবারে অটল হয়ে যাবারও কোন ব্যাপার নেই।
আপনি অনেক খেটে যে সব সারকথা আমাদেরকে অনায়াসে পাইয়ে দিচ্ছেন তার কোন তুলনা নেই। কৃতজ্ঞ সে জন্য। অকৃপণ হাতে মন্তব্য করার সুযোগ আছে, নিচ্ছি সেটাও; আমাদের সবার জন্য। ভালো থাকুন (C)
@কাজী রহমান ভাই, ধন্যবাদ নিরন্তর মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে আমাকে সতেজ ও প্রাণিত করার জন্য। আপনার সাথে আমিও সহমত পোষণ করি যে,
এই যে প্রমাণের উপর বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে থাকার কথা বলছেন, প্রতিটা দর্শনও কিন্তু এই প্রমাণকেই ভিত্তি হিসেবে মানে। তাহলে বিভেদটা কোথায় ? বিভেদ হচ্ছে আসলে এই প্রমাণের ভিত্তির তারতম্যের উপর। প্রমাণের ভিত্তিটা একেক দর্শনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যভিত্তিক একেক রকমের। চার্বাক দর্শনে প্রত্যক্ষণই একমাত্র প্রমাণ। সাংখ্য দর্শনে প্রমাণের ভিত্তি তিনটি- প্রত্যক্ষণ, অনুমান ও শব্দ বা আগম। যোগ দর্শনেও তাই। আবার ন্যায় দর্শনে প্রমাণের ভিত্তি চারটি- প্রত্যক্ষণ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। এভাবে একেক দর্শনে একেক ধরনের ভিত্তি। তবে সব দর্শনেই প্রত্যক্ষণকে প্রমাণজ্যেষ্ঠ হিসেবে মানা হয়, যদিও চার্বাক ছাড়া বাকিরা প্রত্যক্ষকে একমাত্র হিসেবে মানে না। এবার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আপনার কথা দিয়েই বললে প্রমাণের ভিত্তি হচ্ছে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল। এই পরীক্ষালব্ধ ফলাফল মানেই কি প্রত্যক্ষণ নয় ? আমি এটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম। এবং তাকেই আমি বিজ্ঞান-দর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছি মাত্র। হা হা হা !
আমি কি বোঝাতে পেরেছি কাজী রহমান ভাই ?
@রণদীপম বসু,
কিন্তু সেসব প্রমান পরীক্ষালব্ধ নয়। এই সময়ের সহজলভ্য তথ্য যাঁচাই বাছাই করবার অবাধ সুযোগ থাকায় শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমান বলা যায় কি করে? আর এই প্রত্যক্ষণ পরীক্ষার ফলাফলও হয় বিভিন্ন। সুতরাং শুধু প্রত্যক্ষনলব্ধ ফলাফলের উপর নির্ভর করা অবৈজ্ঞানিক হয়ে পড়ে। চার্বাক প্রমানতত্ত্ব ছকের শুধুমাত্র একটিকে, প্রত্যক্ষণকে স্বীকার করে বলেই তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না, বড়জোর অনন্য হতে পারে, তবে দর্শন দর্শনই বটে; অন্য কিছু নয় 🙂
@কাজী রহমান ভাই, এবার আমার একটি কৌতুহলি প্রশ্ন আছে। সেটা হলো, বিজ্ঞান কি দর্শনের বাইরে ? কিংবা বিজ্ঞানের কি কোন দর্শন নেই ?
@রণদীপম বসু,
বিজ্ঞান তত্ত্ব নির্ভর যা কিনা খণ্ডনযোগ্য (ফলসিফাইয়েবল), এটিঃ
১। পরীক্ষণ যোগ্য,
২। পরিমাপযোগ্য,
৩। পুনরাবৃত্তি যোগ্য
৪। পূর্বাভাস যোগ্য
৫। বস্তুনিষ্ঠ
৬। প্রমাণ নির্ভর
এখন আপনিই বলুন দর্শনের চরিত্রে এসব আছে কি? বিজ্ঞানকে কি ভাবে দর্শন বলবেন?
চার্বাকদের সময় প্রত্যক্ষবাদ যুক্তিবাদের প্রথম সোপান হিসেবে চিহ্নিত হলেও আধুনিক যুক্তিবাদ ‘কেবল’ প্রত্যক্ষবাদের (মানে কেবল চোখে দেখা যদি বলা হয়) উপর খুব বেশি নির্ভরশীল নয়। আধুনিক যুক্তিবাদ, সংশয়বাদ মূলতঃ বৈজ্ঞানিক যুক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। বৈজ্ঞানিক যুক্তির আলোকে গড়ে উঠা জীবন দর্শনকেই যুক্তিবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমরা ইলেকট্রন, প্রটোন নিউট্রন, কোয়ার্ক ফোটন কিংবা বাতাস কোন কিছুই চোখে দেখিনা। কিন্তু যুক্তিবাদীরা বলে না যে সেগুলো অবৈজ্ঞানিক বা অযৌক্তিক। বাতাসকে আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু বাতাসের স্পর্শ আমরা অনুভব করি ঝড়ের সময়। আর শূন্য বেলুন ওজন করে আর পাশাপাশি বেলুনকে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ওজন করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে দুই ওজনে পার্থক্য আছে, এ থেকে বোঝা যায় – বাতাসের আবার ওজনও আছে। তেমনিভাবে বিজ্ঞানী ইউগেন গোল্ডস্টেইন থেকে শুরু করে স্যার জ়ে জ়ে থম্পসন, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড সহ অনেকেই ইলেকট্রণের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ দিয়েছেন বলেই আমরা ইলেক্ট্রনের অস্তিত্বকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি। একইভাবে আমরা পৃথিবীকে সূর্যের চারিদিকে ঘুরতে দেখিনা, অন্ততঃ প্রত্যক্ষভাবে নয়। কিন্তু গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের সাহায্যে অন্য গ্রহদের চালচলন পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে ফুকোর পেন্ডুলাম সহ নানা পরীক্ষাতেই কিন্তু পৃথিবী ঘোরার কথাই প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলো যৌক্তিকভাবে প্রমাণিত বলেই আমরা মেনে নিয়েছি। আধুনিক যুক্তিবাদ এভাবেই কাজ করে।
আসলে আমি মনে করি কেবল তর্ক বিতর্কের জন্য যে কোন ধরণের যুক্তি দেয়াকে যুক্তিবাদ বলা যায় না। সেজন্যই এমনকি প্রাচীনকালেও তর্কবিদ্যা বা সফিস্টদের কাজকররমের সাথে যুক্তিবাদীদের কাজের পার্থক্য আছে। এই সফিস্টদের অনেকেই আবার বেদ আর ধর্মশাস্ত্রকে অভ্রান্ত ধরে নিয়েছিলেন। আমরা এদেরকে তার্কিক বলতে পারি, কিন্তু যুক্তিবাদী নয়।
রণদীপমদার লেখাটা চমৎকার কিন্তু আমি মনে করি তোমার পয়েন্টগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেবল প্রত্যক্ষবাদের উপ্র নির্ভরশীল থাকার সীমাবদ্ধতাগুলো লেখায় আসা উচিৎ। অর্থাৎ লেখাটা কেবল চার্বাক দর্শনেই শেষ না হয়ে আধুনিক যুক্তিবাদিতার মতবাদগুলোতে এসে শেষ হওয়া উচিৎ। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক মতবাদ্গুলোর অনেকগুলোই সরাসরি প্রত্যক্ষবাদের সাথে ‘সরাসরি’ যুক্ত নয়।
@অভিজিৎ, দা, নিশ্চয়ই ওই পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রাচীন দর্শনের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের সমান্তরাল আলোচনাটা কি আদৌ খাপ খাবে ? মূলত চার্বাকের বিষয়টার গুরুত্ব হচ্ছে তার সমকালীন সমাজে প্রতারণার সর্বময় উৎস হিসেবে আধ্যাত্মিক ভণ্ডামিকে চ্যালেঞ্জ করা। সেখানে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান আর যুক্তিই ছিলো প্রধান অবলম্বন। এখন এই বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে এসেও আধ্যাত্মিক ভণ্ডামিগুলো সেই আগের মতোই প্রতারণাপূর্ণ পূর্ব-অবস্থানে রয়ে গেছে। এ যুগের আধুনিক চার্বাক আপনারা বিজ্ঞানের সর্বশেষ হাতিয়ারগুলি নিয়ে যেভাবে সফল লড়াইটা চালাচ্ছেন, এ তো সেই চার্বাকদেরই যোগ্য উত্তরসূরী। কিন্তু সেই পূর্বসূরী চার্বাক প্রজন্মের ইতিহাসটা আমাদের এ প্রজন্মের কাছে বিস্মৃত হতে চলেছে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ যুগের চার্বাকদের সাথে সেই পূর্বসূরী চার্বাকদের একটা সমন্বয় সূত্র জুড়ে দেয়া। মূলত সেটারই এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হিসেবে এ কাজটা হাতে নিয়েছি আমি। তবে বর্তমান প্রচলিত প্রধান ধর্মগুলিকে সেই চার্বাকের মাধ্যমেই দার্শনিক চ্যালেঞ্জে যাচাই করার এই সুপ্ত ইচ্ছাও রয়েছে।
প্রাচীন জ্ঞানশাস্ত্রে সেকালের লড়াইটার একটা পটভূমি আমাদের হাতের কাছে থাকা উচিৎ। সেই সব মালমসলাগুলো একত্র করার উদ্যোগও বলতে পারেন এটাকে। বর্তমানের বিজ্ঞানসম্মত পটভূমি নিয়ে তো আপনারা কাজ করছেনই। আপনাদের এই বিশালায়তনিক কাজের একটা চুম্বক পাঠ দিতে গেলেও যে পরিসর ও ভিন্নমাত্রিক জটিলতা তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকবে তাতে করে দর্শনের আবহটা ক্ষুণ্ন হবার আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে যদি গ্রন্থ হিসেবে এই লেখাটার পটভূমি বিবেচনায় থাকে, তাহলে অন্তত একটা ভিন্ন অধ্যায়ে বর্তমান পটভূমির রূপরেখার সাথে চার্বাকদের উদ্যোগের একটা সমন্বয়ের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে। এজন্যেই রেফারেন্সের তালিকায় আপনাদের বইগুলিও হাতের কাছে রেখেছি। অবশ্য কাজ করতে করতে পরিকল্পনাটার আরো ঝালাইপালাই হতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত কোন্ অবস্থানে গিয়ে দাঁড়ায় দেখা যাক্ ।
@রণদীপম বসু,
না আমি ঠিক সেভাবে খাপ খাওয়াতে বলছি না। আমি ভাবছিলাম যে, আপনি যখন চার্বাক দিয়ে শুরু করেছেনই, সেখানেই না থেমে যুক্তিবাদিতার সোপান ধরে আধুনিক যুক্তিবাদীদের কাজে এসে থামবেন। তাহলে পাঠকেরা পুর্ণাঙ্গ একটা ধারণা পাবে সামগ্রিকভাবে। এটা দরকার। চার্বাকেরা ভাববাদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বস্তুবাদি মতবাদের মাধ্যমে, কিন্তু তারপরেও তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো, যে সীমাবদ্ধতাগুলো আবার পরবর্তী যুগের যুক্তিবাদীরা অতিক্রম করেছেন। আসলে যুক্তিবাদ তো একটি চলমান প্রক্রিয়ার নাম। সেই চার্বাক দিয়ে শুরু … তারপর বুদ্ধ, মহাবীর, স্পিনোজা, কাণ্ট, হেগেল, কভুর, পপার, ডিরোজিও, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, আরজ আলী মাতুব্বর, প্রবীর ঘোষ, জেমস র্যাণ্ডি, মাইকেল শারমার হয়ে রিচার্ড ডকিন্স …অনেকেই একে বিভিন্নভাবে একে বিকশিত করেছেন। এখনো বিকশিত করেছেন আপনি এবং আপনার মতো মুক্তমনারা…
অবশ্যই। বরাবরের মত দুর্দান্ত কাজ হচ্ছে একটা।
@অভিজিৎ, দা, ধন্যবাদ। আসলে এই একটি মন্তব্য দিয়েই আপনি চলমান লেখাটার উদ্দেশ্য-বিধেয়টুকু কী হওয়া উচিৎ বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমারও সেরকমই ইচ্ছা। বাকিটা সামর্থ সুযোগ আর সময়ের উপর।
@অভিজিৎ,
ক্রোনোলজিটা মহাবীর, বুদ্ধ, চার্বাক এইভাবে হবে।
@বিপ্লব দা, ক্রোনোলজিটা মহাবীর, বুদ্ধ ঠিক থাকলেও চার্বাকের অবস্থানটা কিন্তু আলোচনা সাপেক্ষ। অবশ্য চার্বাক শব্দটা দিয়ে বিবেচনা করলে ঠিক আছে। কিন্তু জড়বাদী মতবাদটা দিয়ে বিবেচনা করতে হলে এ নিয়ে বিস্তর বাদানুবাদ রয়েছে বলেই মনে হয়। হা হা হা !
@রণদীপম বসু,
এটার কারন অন্য।
অদ্বৈত বেদান্তের বক্তব্য হচ্ছে এই মহাবিশ্ব বা মহারিয়ালিটি অসীম-সসীম মানুষের ক্ষমতা নেই সেই বাস্তবতাকে স্পর্ষ করার। সুতরাং আমরা যে রিয়ালিটিই দেখি বা মানি না কেন-তা পরম হতে পারে না, তা আপাত। আর সমস্ত সত্যই যেহেতু রিয়ালিটি নির্ভর, তাই খন্ডিত রিয়ালিটি হেতু, সেই সত্য পরম সত্য না-তা মায়া।
এখানে যুক্তির ধাপ হচ্ছে এই
[১] রিয়ালিটি অসীম-সসীম মানুষের পক্ষে সেই রিয়ালিটি অনুধাবণ করা বা দেখা বা প্রত্যক্ষ কিছু করা সম্ভব না।
[২] সুতরাং মানুষ যে রিয়ালিটি দেখছে [ তা কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা জিটিআর ], বিগ ব্যাঙ্গ যায় হোক না কেন- তা খন্ডিত ও অসম্পূর্ন।
[৩] সুতরাং মানব সত্যের রূপ ও খন্ডিত, অসম্পূর্ন
[৪] মানুষ যেহেতু সেই অসম্পূর্ন সত্যকেই পরম সত্য বলে ভাবে, তাই তা একধরনের মায়া। ছায়া দেখে গাছ চেনার মতন।
এখন এখানে দেখার বিষয় এটাকে প্রাকৃতিক না অপ্রাকৃতিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে। আমি এটাকে প্রাকৃতিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে, অদ্বৈত বেদান্ত প্রলাপ এবং অপ্রয়োজনীয়।
কিন্ত অপ্রাকৃতিক দর্শনে এর ভিত্তি আছে। বিজ্ঞানের বাস্তবতার সাথে পরম বাস্তবতার একটা পার্থক্য থাকবেই। সেই গ্যাপ হাজার গবেষণাতেও পূর্ন হবার না। কিন্ত সেই গ্যাপ আছে বলে, বিজ্ঞানের বাস্তবতাকে “মায়া” বললে, তাতে যুক্তি যাই থাক, ব্যাপারটা সেই কালেভদ্রে প্রলাপেই দাঁড়াবে।
@বিপ্লব দা, আপনিই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন মন্তব্যে। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন বা শঙ্করের মায়াবাদ তো অপ্রাকৃতিক দর্শনই ! অপ্রাকৃতিক দর্শনের ভিত্তি তো জ্ঞানের অসীমতার হাইপোথিটিক্যাল কারণেই। অনন্তকাল ধরে আমাদের জ্ঞানের পরিসীমা বাড়তেই থাকবে। তাই বলে কি আমরা কখনোই ছুঁতে পারবো না এমন অপ্রাকৃতিক কোন শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেবো ?
বর্তমান বৈজ্ঞানিক বাস্তবতায় আমাদের অর্জন এবং কল্পনার প্রকৃতি ও গতিসীমা দিয়ে সেই প্রাচীন ভাববাদী অবৈজ্ঞানিক দার্শনিক কল্পনা যে বাস্তবতার সাপেক্ষে আজগুবি ছিলো তা বলার দৃঢ়তা কি এখনো আমাদের অর্জিত হয় নি ? অতএব অপ্রাকৃতিক দর্শনের সেই হাইপোথিটিক্যাল ভিত্তিটাকে আমাদের অলস মুহূর্তের কৌতুককর কল্পনার জন্যেই রেখে দেই নাহয় ! হা হা হা !
অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব দা।