একটা সময় ছিল যখন সমাজে এবং রাষ্ট্রে কোন কিছুর বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাল্পনিক অদৃশ্য এবং অলৌকিক সত্ত্বার বক্তব্য ব্যবহার করা হত। ঈশ্বর এবং দেব-দেবীদের এসব বানী মর্ত্যের মানুষের কাছে পৌছে দিতেন তাদের নিযুক্ত গ্রহদূতগন যারা আসলে মানুষ ছিলেন এবং এসব অলৌকিক বানী সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ছিল ধর্মদ্রোহিতার সামিল । রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যেহেতু পুরোহিততন্ত্রের ঝান্ডাবাহী এসব মানুষ অনেক কষ্ট করে স্বর্গ থেকে আগত বানী সমূহ মানুষের কল্যানে পৌছে দিতেন , সেহেতু এসব স্বর্গীয় গ্রহাদূতদের অর্থাৎ পূরোহিতদের বিরোধিতা করা শুধু ধর্মদ্রোহীতার পর্যায়ে থেমে থাকেনি । এ ধরনের কার্যকলাপ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। প্রায়ই রাষ্ট্রনায়কেরা ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করতেন। উদাহরণস্বরূপ , জাপানের সম্রাট, বাইবেলের কিং ডেভিড , রোম সম্রাটসহ পোপবৃন্দ , মহাভারতের অর্জুন এবং আরব্য উপদ্বীপের মুহাম্মদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের বিরোধিতা করা আর ঈশ্বরের বিরোধিতা করা একই ব্যপার। কঠোরতম শাস্তির বিধান রয়েছে এসব অপরাধের যেখানে অঙ্গহানিসহ নানারকম অভিনব মৃত্যদণ্ড তো আছেই অপরাধীর পরিবারকেও একই সাজা পেতে হয়েছে। পরবর্তীকালে সামাজিক বিবর্তনের ধারায় বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকার সমাজে ঈশ্বর গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, যার অনেক কারণ থাকলেও রাষ্ট্রতন্ত্রের সাথে পুরোহিত তন্ত্রের ক্রমবর্ধমান সংঘাতকেই মূল কারন হিসেবে চিহ্নিত করা যায় অর্থ্যাৎ, প্রথম প্রথম কাজে আসলেও এক সময় লেজই (পুরোহিততন্ত্র) কুকুরকে (রাষ্ট্র) নাড়াতে শুরু করে। ক্ষমতার দ্বন্দে দৃশ্যপট থেকে ঈশ্বর ক্রমশ: বিদায় নেয়ায় রাষ্ট্রের এ সময় নতুন বৈধতাদানকারী বিকল্পের প্রয়োজন পড়ে। পুরোন শত্রুতা ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হয় বিজ্ঞানের কাছে।
হ্যাঁ , যে বিজ্ঞানের প্রতি এতদিন রাষ্ট্র বিমাতাসুলভ আচরণ করে এসেছে , সেই বিজ্ঞান হঠাৎ করে হয়ে উঠল রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানকে একদিকে ব্যবহার করা হয় পুরোহিতদের সাইজ করার জন্য কেননা তারা তো সব সময়ই রাষ্ট্রের সমান্তরাল হিসেবে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে এসেছে যা কোন রাষ্ট্রনায়কের জন্য সবসময় সুবিধাজনক নয়। অন্যদিকে, বিভিন্ন মতাদর্শকে ‘বৈজ্ঞানিক’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রের আইনে অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন রকম বিধি নিষেধ আরোপ করা হয় , চালু করা হয় নিত্য নতুন কর। যে গাঁজা , আফিম , মদ ইত্যাদি এতদিন ধর্মীয় সামাজিক প্রথার অন্তর্ভুক্ত ছিল , সেগুলো চলে আসে আইনগত বিধিনিষেধের আওতায়। যে গনতন্ত্রের ধারণা অত্যন্ত প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রনায়কেরা এতদিন এটাকে অপছন্দ করতেন অথবা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন , সেই গনতন্ত্র হয়ে ওঠেছে হঠাৎ প্রায় ‘ধর্মসমান’ আদর্শবাদ।
সাধারণ যুক্তি আমাদের শেখায় যে , কিছুই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। কিন্তু প্রকাশ্যে ‘গনতন্ত্রের’ সমালোচনা করা ‘গনতান্ত্রিক সমাজে’ ধর্মদ্রোহিতার মতই দেখা হয়। যেখানে একসময় ধর্ম ছিল , সে জায়গায় ব্যবহার করা শুরু হয় উমুক বিজ্ঞান এবং তুমুক বিজ্ঞান। এদিকে বিজ্ঞানের উপর সাধারণ মানুষের আস্হা বাড়তে থাকে সময়ের সাথে চিকিৎসা এবং নানাবিধ ব্যবহারিক প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে। এই সুযোগে আকাশের নীচে যত কিছু বিষয় আছে সব কিছুতেই বিজ্ঞানের মোড়ক লাগানোর হিড়িক পড়ে যায়। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠে অমুক এবং তমুক বিজ্ঞান নামে বিজ্ঞানের তথাকথিত শাখা বিজ্ঞানের সর্বগ্রাহ্য নীতিমালার ধার না ধরে। এই সব দৌড় বিজ্ঞান , লাফ এবং ঝাঁপ বিজ্ঞান , নরম বিজ্ঞান , গরম বিজ্ঞান ইত্যাদি নাম দেয়ার পেছনের মূল উদ্দেশ্য আর কিছু নয় – যথা সম্ভব বৈধতা আদায় করা। এসব ‘বিজ্ঞানের’ কোনটা হয়ত বিজ্ঞান এবং বাকিগুলো বে-জ্ঞান এবং ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল বিজ্ঞান’। কিন্তু কিভাবে বোঝা যাবে কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা বে-জ্ঞান ? একটা এনালজী দিয়েই শুরু করা যাক।
ধরা যাক আপনি একজন ‘উচ্চাভিলাসী নরম বিজ্ঞানী” কিন্তু নাম ,যশ, খ্যাতি ,পয়সাকড়ি এসব কিছুই এখন পর্যন্ত আপনার কাছে সোনার হরিনের মতই সূদুর পরাহত। একদিন হঠাৎ সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করতে করতে দেখলেন একটা মরা মাছ সাগরের পানিতে ভেসে এসেছে। এই দৃশ্য দেখার পর পরই আপনার মাঝে স্যার আইজ্যাক নিউটনের গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখার মত একই রকম অনুভুতি কাজ করা শুরু করলো। আর্কিমিডিসের মত একাই চিৎকার করে উঠলেন ‘ ইউরেকা !! আমি আমার স্বপ্নের চাবি পেয়ে গেছি !’ এরও এক মাস পর কোন একটা একটা ‘জাঙ্ক জার্নালে’ আপনার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল যার অ্যাবস্ট্রাক্ট এরকম :
অ্যাবস্ট্রাক্ট
সমুদ্রে মূত্রত্যাগ মৎস মৃত্যুর প্রধান কারনআমরা জানি যে , সামুদ্রিক মাছদের মৃত্যু ঘটে । আমরা এটাও দেখি যে, সমুদ্রে প্রচুর মানুষকে মূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায়। প্রতিটা মৎস মৃত্যুর রিপোর্ট যে সময় আমাদের হাতে এসে পৌঁছোয় , একই সময় নিকটবর্তী সৈকতে কাউকে না কাউকে মূত্রত্যাগ করতে দেখা গেছে। এসব প্রাপ্ত ডাটার উপর ভিত্তি করে আমরা দেখতে পাই যে, সামুদ্রিক মৎসমৃত্যুর সাথে সমুদ্রে মূত্রত্যাগের পারস্পরিক সম্পর্ক ১০০% । বিষয়টা আমরা গবেষণাগারের সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অসংখ্যবার পরীক্ষা করি। আমরা পরীক্ষাগারে জার ভর্তি মূত্রের মধ্যে জীবন্ত মাছ রেখে দেখেছি যে সব সময়ই মাছের মৃত্যু ঘটে। অতএব , আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, সমুদ্রে মূত্রত্যাগ মৎস মৃত্যুর প্রধান কারণ এবং বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন পূর্বক অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
এর পর আপনি দেখা করলেন পরিবেশ এবং মৎসমন্ত্রীর সাথে। তারা প্রধানমন্ত্রীর ক্যাবিনেটের জরুরী সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলেন। দেশের মূল্যবান মৎস সম্পদ রক্ষার্থে সমূদ্রে মূত্রত্যাগ নিষিদ্ধ না করে বরং সব স্হানে মূত্র ত্যাগের উপর ১০ টাকা হারে কর ধার্য করা হল। প্রধানমন্ত্রী এতেই ক্ষান্ত হলেন না ।
তিনি জাতিসংঘের পরিবেশ সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর কাছে সামুদ্রিক মৎস মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করলেন কেননা উন্নত দেশের ধনী পর্যটকেরা সমুদ্রতীরে বেশি ঘুরে বেড়ায় এবং সে কারনে সেখানে সমুদ্রতীরে মূত্রত্যাগের হার অনেক বেশী যার পরিণতি গরীব দেশগুলোকে ভোগ করতে হয়। তিনি ইতিমধ্যেই প্রায় ৮০টি সল্পন্নোত দেশের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। ‘পরিবেশ অবান্ধব তকমা’ লেগে যাওয়ার ভয়ে বিষয়টা উন্নত দেশগুলির কাছে যথেষ্ট ‘পলিটিক্যলি কারেক্ট’ এবং উৎসাহ ব্যঞ্জক মনে হল , বিশেষ করে এনজিও এবং রিসার্চ ফান্ডিং সংস্থা গুলির কাছে। জাতিসংঘ বিশ্ব মূত্রায়ন সংস্হা গঠন করা হল এবং আপনাকে বানানো হলো সেই সংস্থার প্রথম সভাপতি যার বাৎসরিক বেতন ডলারে ছয় ডিজিট ! উন্নত দেশগুলি মুত্রায়ন গবেষণায় বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করে অনেক বেকার গবেষকের চাকরীর বন্দোবস্ত করল। এর পরের কাহিনী আমাদের সবার জানা , একদিন সকালে আপনি শুনলেন যে, বিশ্ব শান্তি এবং পরিবেশ রক্ষাকল্পে আপনার বিশাল অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আপনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
ভাইরে লেখাটা পইড়া খুবি ভাল লাগল (Y),তয় পরবর্তী লেখখাটা কি হইব?বেজ্ঞান এবং…. ইয়ে মানে… বড় বাথরুমতত্ত্ব? :))
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেরারজি দেশাই নাকি স্বমুত্র পান করতেন! মানব মূত্র নাকি সর্বরোগের দাওয়াই! 🙂
আপনার লেখার শেষ প্যারাটা জোস হইছে। তথাকথিত উন্নয়ন আন্দোলনের অন্তঃসারশূন্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এই সকল আন্দোলনে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলে, অনেক জাঙ্কের আয়-রোজগারের সদগতি হয়, পানির স্রোতের মত ফান্ড প্রবাহ হয়, কিন্তু যে ভালনারেবল গ্রুপের জন্য এত কিছু, তারা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যায়!
অনবদ্য রচনা, সংশপ্তক ভাই!
@কাজি মামুন,
মূল অংশটা কিন্তু মাঝেরটাই যার সারমর্ম অভিজিৎ রায় সুন্দর করে দু কথায় কথায় তুলে ধরেছেন :
😀 😀 😀 😀
@প্রদীপ দেব, (@)
ভাইজান, আমাদের মহানবী রোগ ব্যধি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উটের মূত্র পান করার জন্য বলে গেছেন। অনেকে তখন নাকি এটা পান করে সুস্থও হতো যা হাদিসে বলা আছে। হিন্দু ধর্মে নাকি গরুর মূত পান করার কথা বলা আছে, এ মূত নাকি শিশিতে করে বিক্রিও হয়। আর আপনি বলছেন সেই মূতই হলো সাগরের মাছ মরার কারন। বুঝলাম না ভাই আপনি আমাদের সাথে মস্করা করলেন কি না।
@ভবঘুরে,
মস্করা বইল্লাইতো তো মনে হয়; উপ্রে লেহাঃ রম্য রচনা। আর রম্য বইল্লাই তো পরিবেশবাদীরা এহনো মূত্রবোমা লয়া দৌড়ান দ্যায় নাই
@কাজী রহমান,
ছংগ্রামী পরিবেছবাদীদের কথা শুনিয়া অতিশয় ভীত হইলাম :
httpv://www.youtube.com/watch?v=G9Jm1x9ShIU
@সংশপ্তক,
হা হা হা ……শুনেন, পানির তলে ঐ টেবিলগুলা যেই পরিমান পানি সরাইসে, যাই কন; হেইডা কলাম মাপন যাইবো
@ভবঘুরে,
আমার মস্করা করার ট্রেনিংটা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের , এজন্যেই বুঝতে পারছেন না। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করুন , ‘মোকসুদুল মস্করা’ পাঠ আগে খতম করে নেই।
😀
@রায়হান আবীর,
(@)
মজা পাইলাম 😀
@মামুন আব্দুল্লাহ,
জেনে খুশী হলাম।
লেখাটা পড়ে প্রথমেই যেটা মাথায় আসছে সেটা হলো জারের ছবিটা পাইসেন কই??? ফটোশপে বানাইসেন? নাকি “মুত্রের মধ্যে মাছ” লিখে সার্চ দিছিলেন?
@রামগড়ুড়ের ছানা,
এ ধরনের ছবি গুগল সার্চে পেলে তাৎক্ষনিক সেভ করে রাখি আমার সংগ্রহে। কারণ, আপলোডার প্রায়ই ছবি মুছে দেয়।
তবে, গুগল সার্চ করার সময় ৮টির মত ভাষা ব্যবহার করি কারণ আপলোডার যে কোন ভাষায়ই ছবি ট্যাগিং করতে পারে।
দারুন টিপস পাইয়া চরম উৎসাহিত হইলাম 😛 ।
ঈশ্বরের মূল্যবান আর্শীবাদ মূত্র সাগরে এভাবে অপচয় করার বিরুদ্ধে আপনার এহেন যুক্তিবাদি গবেষণা “বে-জ্ঞান ও মূত্রত্তত্ব” প্রকাশিত হওয়ায় ঈশ্বর নিশ্চয় আপ্নারে বেহেস্ত নসীব করিবেন। কারণ আমরা সকলে জানি অপচয়কারী শয়তানের বড় ভাই। 😉
@রাজেশ তালুকদার,
আপনার উৎসাহে আমিও আনন্দিত।
ছবিগুলোর লিঙ্ক দেয়া নাই, তার মানে কি জারের পরিক্ষাটা নিজে নিজে করেছেন 😛
@rabbani,
নিজে পরীক্ষা না করে কি আর পোষ্ট দেই ! 😛
হাহাহাহাহা,’বে-জ্ঞানের’ জ্ঞান বিতরণের মহান উদ্দেশ্যে নাজিলকৃত ওহিটির শানে নযুলখান জানতে মঞ্চায় :-s। নতুন কোন কারণ নাকি পুরানা প্রদীপ বিস্ফোরিত হয়েই আবার জিনির আবির্ভাব ঘটলো?
@বন্যা আহমেদ,
কি যে বলেন ! মার্ফির ল থেকে বরং একটা আয়াত উদ্ধৃত করি :
“It’s not the one with your name on it — it’s the one addressed “to whom it may concern” that you should be worried about.” 🙂
হাঃ হাঃ হাঃ…।
“Correlation does not imply causation” -এই কথাটা আমরা হরহামেশা শুনি। কিন্তু আমাদের মাথায় হয়তো ঢুকাতে পারি না।
আপনার লেখাটি পড়েও তা অনেকের মাথায় ঢুকবে কিনা কে জানে! তবে পরিবেশবাদীরা যে নির্ঘাত আপনার উপর ক্ষেপবে তা চোখ বন্ধ করে বলতে পারি। 🙂
আর বাই দ্য ওয়ে, জারের ভিতর মূত্র রেখে পরীক্ষার ছবি পাইলেন কই? – এইটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
@অভিজিৎ,
‘এডভান্সড সার্চ টেকনিক’ ব্যবহার করে গুগলবাবার দয়ায় আর কি ! :))