কবি নজরুল
আকাশ মালিক
আজ ২৫শে মে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম দিন। ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের এই দিনে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে সাম্যের কবি নজরুল জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার জীবনী নয়, কবির জন্মদিনে শুধু কবির কিছু কবিতা, কিছু বাণী স্মরণ করাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। প্রশ্ন জাগে মনে, সেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশ হওয়ার সময় থেকে আজ এ পর্যন্ত আমরা, আমদের দেশ, আমাদের সমাজ কতটুকু বদলালো, কতটুকু সামনে অগ্রসর হলো, নাকি আমরা আজও তালাকের ফতোয়া খুঁজি কোরান হাদিস চষে? আজও কি ধর্মগ্রন্থের নির্দেশে সাতক্ষিরা জ্বলেনা? কাঠমোল্লাদের অঙ্গুলী নির্দেশে হেনা, শেফালী, হোসনাদের মাটিতে পুরে হত্যা করা হয় না? ধর্মগ্রন্থ নিয়ে নজরুল লিখেছেন- পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।
যে গ্রন্থ মানুষের রচিত সেই ধর্মগ্রন্থের সমালোচনা করলে আজও আমাদের কণ্ঠ রোধ করে দিতে, হাতের কলম কেড়ে নিতে ধেয়ে আসে মূর্খ ধার্মিকেরা। আজও দেশের কবি সাহিত্যিকেরা হয় খুন, হয় নির্বাসিত। যে দিন থেকে ধর্মগ্রন্থ দুনিয়ায় এসেছে, সে দিন থেকে জগতের মানুষ তার মনুষ্যত্ব পরিচয় ভুলে গিয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে বহু ধারায়, বহু জাতিতে বহু পরিচয়ে। ধর্মগ্রন্থ মানুষের কাছে মানুষকে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় নজরুল বলছেন-
‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?… যে প্রশ্ন করছিলাম এই যে ভেতরের ন্যাজ, এর উদ্ভব কোথায়? আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে। টিকিপুর ও দাড়ি-স্থানই বুঝি এর আদি জন্মভূমি।
এতোদিন পরেও কি আমরা মানুষকে মানুষ রূপে জানতে শিখেছি? আজও কি আমরা ক্রস, টিকি-দাড়িতে মানুষের পরিচয় খুঁজিনা? নজরুল মানুষেরই মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের পরিচয়, লিখেছেন-
গাহি সাম্যের গান-গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
মোল্লাতন্ত্রের উৎপীড়ন, নির্যাতন থেকে মানুষকে বাঁচাতে নতুন প্রজন্মকে নজরুল আহবান করেন-
আমাদের সমাজের কল্যাণকামী যে সব মৌলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনোজল আনিয়াছিলেন, তাঁহারা যদি ভবিষ্যৎদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন বেনোজলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের জলও সব বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অজস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে। মৌলানা মৌলবী সাহেবকে সওয়া যায়, মোল্লা ও চক্ষুকর্ণ বুজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইহাদের ফতুয়া-ভরা ফতোয়া। বিবি তালাক ও কুফরির ফতোয়া তো ইহাদের জাম্বিল হাতড়াইলে দুই দশ গন্ডা পাওয়া যাইবে। এই ফতুয়াধারী ফতোয়াবাজদের হাত হইতে গরীবদের বাঁচাইতে যদি কেহ পারে তো সে তরুণ।
খাল কেটে আপন ঘরে যারা কুমির এনেছিলেন সেই সকল ফতুয়াধারী ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে নজরুল সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন-
এই ঘরো যুদ্ধ ভাইয়ের সহিত, আত্মীয়ের সহিত যুদ্ধই সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক। তবু উপায় নাই। যত বড় আত্মীয়ই হোক, তাহার যক্ষ্মা বা কুষ্ঠ হইলে তাহাকে অন্যত্র না সরাইয়া উপায় নাই। যে হাত বাঘে চিবাইয়া খাইয়াছে তাহাকে কাটিয়া ফেলিয়া দেওয়া ছাড়া প্রাণ রক্ষার উপায় নাই।
আমরা বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি। সমাজকে কুষ্ঠরোগীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা শুধু নিজের প্রাণ বা নিজেকে বাঁচাতে সমাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চলেছি। এই কুমিরদের আমরা সরাতে পারি নাই বা সরাবার চেষ্টা করি নাই, তাই তারা মাঝে মাঝে নুরজাহানদের মাটিতে পুঁতে হত্যা করে, সাতক্ষিরায় আগুন জ্বালিয়ে তাদের উপস্থিতি জানায়।
নজরুল দেখেছেন, ধর্মগ্রন্থ চুমে চুমে, ধর্মের পুজারী মানুষগুলো কেমন করে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে পশুত্ব গ্রহন করে নিল। তাই অতিশয় বেদনাহত নজরুল আক্ষেপ করে বলেন-
পশু সাজবার মানুষের একি ‘আদিম’ দুরন্ত ইচ্ছা!- ন্যাজ গজাল না বলে তারা টিকি দাড়ি জন্মিয়ে যেন সান্তনা পেল। ……হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পন্ডিত্ব। তেমনি দাড়িও ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই “ত্ব” মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ যত চুলাচুলি!……….. মানুষ আজ পশুতে পরিণত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজ গজিয়েছে ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে লুংগিকে, মারছে নেংগোটিকে; মারছে টিকিকে, দাড়িকে! বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির কি অবসান নেই?
মোল্লাতন্ত্র আমাদের নারীসমাজকে গৃহবন্দী করে রেখেছে যুগযুগ ধরে। অবরোধবাসিনী নারীরা ভুলেই গেছেন তারাও যে মানুষ। অবরোধ প্রথাকে শ্বাসরোধ বলে উল্লেখ করে নজরুল বলেন-
আমাদের পথে মোল্লারা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল। আমাদের দুয়ারের সামনের এই ছেঁড়া চট যে কবে উঠিবে খোদা জানেন। আমাদের বাংলাদেশের স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের যে অবরোধ, তাহাকে অবরোধ বলিলে অন্যায় হইবে, তাহাকে একেবারে শ্বাসরোধ বলা যাইতে পারে। এই জুজুবুড়ির বালাই শুধু পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও যেভাবে পাইয়া বসিয়াছে, তাহাতে ইহাকে তাড়াইতে বহু সরিষা-পোড়া ও ধোঁয়ার দরকার হইবে। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত লোকই চাকুরে, কাজেই খরচের সঙ্গে জমার তাল সামলাইয়া চলিতে পারে না। অথচ ইহাদের পর্দার ফখর সর্বাপেক্ষা বেশি। আর ইহাদের বাড়িতে শতকরা আশিজন মেয়ে যক্ষ্মায় ভুগিয়া মরিতেছে। আলো-বায়ুর অভাবে। এই সব যক্ষ্মা রোগগ্রস্ত জননীর পেটে স্বাস্থ্য-সুন্দর প্রতিভাদীপ্ত বীর সন্তান জন্মগ্রহণ করিবে কেমন করিয়া! ফাঁসির কয়েদিরও এইসব হতভাগিনীদের অপেক্ষা অধিক স্বাধীনতা আছে। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চির-বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ-মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই সর্বপ্রথম বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কি দুঃখ কিসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে।
নজরুলের মতো আজও কি আমাদের আক্ষেপ হয়না, তার কথাগুলোর সত্যতা আজও কি আমরা আমাদের সমাজে দেখতে পাইনা? আজ নারীরাই অবস্থান নিয়েছে নারীর বিরুদ্ধে। পর্দা, বোরখায় অভ্যস্থ নারী আজ কথা বলে নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে। এই ভুত তাড়াতে যদি বহু সরিষা-পোড়া ও ধোঁয়ার দরকার হয়, সেটা তো আমাদেরকেই করতে হবে। আসুন আমরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। নজরুলের উত্তরসূরী আমরা বিশ্বকে গান শুনাবো নজরুলের ভাষায় ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।
বাঙ্গালির চিন্তা ও চেতনায় কবি নজরুল ইসলাম এবং কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছোট বেলায় আমাদের পাঠ্য সূচীতে এই কবিদের কবিতা দিয়েই কবিতা চেনা মূলত শুরু হয়।
কবি নজরুল সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কিছুরই অবতারনা করতে হয় তবে তা করছিনা, অল্প কিছু বলার লোভ ছাড়তে পারছিনা। বলা হয়ে থাকে নজরুল সাম্যের গান গেয়েছেন। যাতে জাতি ধর্ম সব ভেদাভেদ ঘুঁচিয়ে দিতে চেয়েছেন।
এই অসম্ভব এক মহান কবিকে কি দিয়ে বা কোন আঙ্গিকে বিচার করা যায় আমার জানা নেই।
একদিকে দেখি তাঁর পুত্রের মৃত্যু শোকে পিতার রুপ, যেখানে তিনি রচনা করেছেন,
ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি-
সেই সাথে তাঁর অসম্ভব প্রেমিক রুপ পাই তাঁর রচনায়,
মোর প্রিয়া হবে এসো রানি
দেবো খোঁপায় তারার ফুল-
বা ‘
গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙ্গে যায়
কে যেন আমারে ডাকে
সেকি তুমি, সেকি তুমি
( সুর-কমল দাশ গুপ্ত )
তাঁকে বলা হয়ে থাকে বিদোহী কবি তাইতো তার অসংখ্য লেখায় পাই,
আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত-
তিনি সাম্যের গান গেছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে এককাতারে আনতে চেয়েছেন।
সেই কারনে তাঁর রচনায় এক দিকে শ্যামার গান পাই। অন্য দিকে ইসলামি গান দেখতে পাই।
সেই সময়কার আলোকে দেখতে হলে দেখা দরকার তখন পাকভারত উপমহাদেশের অবস্থার প্রেক্ষাপট।ইংরেজের কারনে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ইত্যাদি নানান কিছু।
ইংরেজ শাসনে জনগন অতিস্ট। বিদ্রোহী লেখার কারনে তিনি ইংরেজ আমলে জেল খেটেছেন।
দুঃখ পাই তখন যখন দেখি কতিপয় মানুষ তাঁকে আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে নিয়ে আলাদা ভেদাভেদ করে। অথচ রবীন্দনাথ ঠাকুর তাঁকে এক লেখায় লিখেছিলেন,
তুমি কেমন করে গান করো হে গুনী
আমি অবাক হয়ে শুনি,
লেখা দীর্ঘ হয়ে গেলো। প্রিয় পাঠক নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন।
সুন্দর রচনার জন্য আকাশ মালিক’কে অনেক ধন্যবাদ। সময়োপযোগী এক লেখা পাঠক’কে উপহার দেবার জন্যে তার প্রাপ্তি- (F)
@আফরোজা আলম,
বাহ, একজন কবির কাছ থেকে গোলাপ উপহার, এ তো বড় ভাগ্যের ব্যাপার। আমি যে কী ছাইপাশ লিখেছি সে তো আমিই জানি। আমার নিরীহ কংকালসার আধমরা টাইপের লেখা যে আপনাদের মতো গুনীদের মন্তব্যেই বেঁচে থাকার ভরসা পায়। সেই ভরসা সেই বিশ্বাস থেকেই মাঝেমাঝে কিছু লেখার চেষ্টা করি।
এক কথায় নজরুলকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলে আমি বলবো- নজরুল ছিলেন মানুষের কবি। আমি নজরুলের গান শুনার আগে ভজনা আর শ্যামা সঙ্গীতের পার্থক্য বুঝতাম না। আজ আমাকে, আমার স্কুল- মাদ্রাসার সাথীরা, ছোটবেলার বন্ধু্রা, আমার আত্মীয়-স্বজনেরা হাজারটা গালি আর অভিশাপ দিলেও আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করবো, নজরুলের ইসলামী গান ও গজলের চেয়ে ভজনা আর শ্যামা সঙ্গীতের আবেদন অনেক বেশী। দুইটা গান আমার খুব প্রীয়। একটা হলো, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলে দেখে যা আলোর নাচন আর অন্যটা আমার হাতে কালি মুখে কালি—। চলুন একটা গান শুনি-
httpv://www.youtube.com/watch?v=lLOagnBltl4&feature=fvwrel
নজরুল অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বাঙ্গালীর জন্য। নজরুল হেয় করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, ব্যাপারটি দুঃখজনক। আবার কেউ কেউ অহেতুক তাকে দেবতা বানাতে চান। কিন্তু মানুষকে মানুষের পর্যায়েই রাখতে হয়।
অসাম্প্রদায়িকতার জ্বলন্ত উদাহরণ কবি নজরুল। তিনি হয়ত ইসলামে বিশ্বাস করতেন কিংবা সেভাবে করতেন না, কিন্তু একজন ধর্মবিশ্বাসী যখন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেন তখন তার ক্ষেত্রে আর ধর্মবিশ্বাস সমস্যার বিষয় হতে পারে না।
অনেকে তাকে খুব একটা বড় কবি মনে করেন না। আমি বলব তিনি কবি না হয়ে এমনকি ছড়াকার বা পদ্যকার হলেও তার আবেদন এতটা কমে না।
আবার অত্যন্ত নির্লজ্জ কিছু মৌলবাদী তাকে ব্যবহার করতে চায়। এ চক্রান্ত রুখে দেয়া আবশ্যক।
নজরুলকে নিয়ে একটি বড় সমস্যা হল আস্তিক, নাস্তিক, কমিউনিস্ট, সাম্যবাদী, মানবতাবাদী সবাই নিজেদের মতন করে নজরুলকে ব্যবহার করতে পারেন আর নিজেদের গোত্রভুক্ত করে নিতে পারেন। নজরুল সত্যই অনেক ইসলামী গান কবিতা প্রভৃতি লিখেছিলেন। এর মধ্যে – ‘আল্লাহ আমার মাথার মুকুট, রাসূল গলার হার’ জাতীয় গান তো আছেই। আবার সেই নজরুলই আবার হিন্দু পুরাণ এবং তার ঐতিহ্য নিয়ে লিখেছেন, সৃষ্টি করেছেন শ্যামা সঙ্গিত। আবার তিনিই অন্যত্র বলেছিলেন – ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন’।
আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয় নজরুলের কোন বিশেষ ‘দর্শন’ বা ফিলসফি সম্ভবত ছিলো না। তিনি ছিলেন বাংলার কবি, মানুষের কবি। বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের খণ্ডিত কবি তিনি ছিলেন না। তারপরেও যেভাবে ইসলামিস্টরা নজরুলকে বিশিষ্ট ইসলামী কবি বানাচ্ছে তাদের জন্য কিছু কথা বয়ান করতেই হয়। নজরুলের সময় তার ইসলামী ভাবধারার কবিরা তার কি ধরনের সমালোচনা করেছিলেন সেগুলো জানলেই এর তাৎপর্য ধরা পড়ে। যেমন ইসলামী কবি ছৈয়দ এমদাদ আলী বলেছিলেন,
আরেকটি সমালোচনা ছিল এরকমের –
আরেক সমসাময়িক মৌলবাদী সাহিত্যিক বলেন,
‘কাজীর কেরদানী’ নামের একটা প্রবন্ধে মৌলবাদী লেখক নজরুলের সমালোচনা করেন এভাবে –
এরকম অনেক উদ্ধৃতি দেয়া যায় সেসময় ইসলামিস্টরা নজরুলকে কি চোখে দেখত তা তুলে ধরতে। অথচ সেই ইসলামিস্টদের উত্তরসূরীরা আজ মরিয়া হয়ে নজরুলকে ইসলামী কবি প্রমাণে সদা ব্যস্ত।
নজরুল নিজেই অবশ্য নিজেকে কাফের বলেছেন বহুবার। যেমন, ১৯২৬ সালের ১৭ই জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আত্মপ্রকাশিত ‘শিখা’এর এক সভায় কবি নজরুল বলেছিলেন –
এ থেকে আজকের দিনের ইসলামিস্টরা কি বুঝতে পারেন?
অভিজিৎ, এ উক্তিগুলো দিয়ে একটি রচনা করে প্রতি নজরুল জয়ন্তীতে পুনঃপুনঃ প্রকাশ করা প্রয়োজন। আসল নজরুলকে বাঁচাতে তা খুবই সহায়ক হবে। আজকের মুক্ত-চিন্তুকদেরকে এ দায়িত্ব নিতে হবে।
@অভিজিৎদা,
অসাধারণ শিক্ষণীয় মন্তব্য!
তারা জেনে বুঝেই নজরুলকে নিয়ে রাজনীতি করেন; কারণ আমজনতার কাছে নজরুলকে ‘ইসলামের’ মোড়কে হাজির করা যত সহজ এবং কার্যকর, ফররুখ আহমদ বা গোলাম মোস্তফাকে দিয়ে ততটা নয়। রাজনীতিই যেখানে মুখ্য, সেখানে হাতের কাছের সেরা তাসকেই তারা বেছে নিয়েছেন।
আমি তো জানতাম ২৫ শে মে। ২৪ শে মে এর কোন ব্যাখ্যা থাকলে জানাবেন। আমি ঠিক জানি না।
প্রিয় নজরুল এই দুইটা লাইন এ যে সাহসের ও সাম্যের পরিচয় দিয়েছে তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। বুকের পাঁটা ছিল বলতেই হয়।
@অরণ্য,
ঠিক করে দিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আর এখানে-
আজ এমন সাহসী কথা বলার কয়জন আছেন এই বাংলায়?
@আকাশ মালিক,
🙂 আপনাকেও ধন্যবাদ, ভুল শুধরে নেবার জন্য। আসলে মুক্ত-মনার লেখা কে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয় তো, তাই জানা কোন তথ্যের ব্যতিক্রম দেখলে কনফিউসড হয়ে যাই।
দারুন একটি লেখা। অনেক ছত্র অনেক গান মনে পড়ে গেল। সুন্দর লেখার জন্য সাধুবাদ।
কিছু কিছু ইসলামি গান কবিতা রচনার কারণে, ইসলামি পোশাক চাপিয়ে দিয়ে, নজরুল ইসলামকে ইসলামের কবি বানানোর যে জোর তৎপরতা চলছে, তার বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে নজরুলকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লেখককে ধন্যবাদ, উজান স্রোতের গান শুনানোর জন্য।
সেদিন মুসলমানরা নজরুলের বিরুদ্ধে “ইসলামের শত্রু” বা “কাফের কবি” ইত্যাদি ফতোয়া জারী করেছিল, যা তাঁকে ইসলামের ভক্তিমূলক গান ও কবিতা রচনায় বাধ্য করে। আজ সে মুসলমানরাই নজরুলকে সহি মুসলিম বানিয়ে ফেলছে।
মুসলিমদের প্রকৃতিই এমন। আর-রাজী ছিলেন ইসলামের চরম সমালোচক (critic par excellence), অথচ আজ সে ইসলামের সর্বাধিক নন্দিত চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক।
@আলমগীর হুসেন,
ঠিকই বলেছেন। আমি ছোটবেলা মনে করতাম নজরুল এ সব লিখেছিলেন নিজের মনের বিশ্বাস থেকে। বিশেষ করে এই গানটি-
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই
ইংল্যান্ড আসার পর, নজরুলকে কাছে থেকে দেখেছেন এমন একজন প্রবীণের সাথে কিছুদিন কাজ করার বদৌলতে তার কাছ থেকে নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। তিনিও বলেছিলেন যে, শেষ বয়সে নজরুল বাধ্য হয়েই কিছু ইসলামী গজল/গান লিখেছিলেন।
তারিক মুনাওয়ারের কিছু কছু ভিডিও দেখা যায় সেখানে তিনি নজরুলের অনেক ইসলাম পন্থী গান গজল পড়ে পড়ে শুনান এবং প্রমান করার চেষ্টা করেন নজরুল সব সময় ইসলামের পক্ষে গেয়ে গেছেন। এমনকি তার কোন একটি কবিতায় মসজিদের নিকট তার কবরের আসা করার কারনে আল্লাহ ও সেই ব্যবস্থা করেছেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মুনওয়ার সাহেবরা তো কখনো নিম্ন বর্নিত কবিতা গুলী কখনো পড়িয়া জনগনদের শুনাননা,যার দ্বারা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হইতে পারে?
যেমন:
গাহি সাম্যের গান-গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
ধন্যবাদ, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ দেওয়ার জন্য।
নজরুল তাঁর অভিনব জাগরণী উদ্দীপনামূলক কবিতা, গান, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এবং শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন।নিচে তাঁর কিছু বানী উল্লেখ করলামঃ
আকাশ মালিক ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ তিনি নজরুলের আবির্ভাব দিবস উপলক্ষ্যে তাঁকে স্মরণ করে, সুন্দর একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্যে……।
@শামিম মিঠু,
আপনার উল্লেখিত নজরুলের কথাগুলো এই লেখায় আসার কথা ছিল। ড্রাফটে লেখাও ছিল। একই সময়ে দুইটা লেখা (প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ ও নজরুল) রেডি করতে গিয়ে কোনটাই সময় মতো দেয়া যাচ্ছিলনা। এমন আমার প্রায়ই হয়। কিছু লিখতে গেলে সময়ের আকাল পড়ে যায়। এই লেখাটা আসলে যেভাবে সাজাতে চেয়েছিলাম সেভাবে মোটেই হয়নি। কোনদিন সময় পেলে লেখাটা আরো বড় করবো। যে কবিতাটা লেখার শেষে যোগ করবো বলে মনস্ত করেছিলাম, চলুন সেই কবিতাটা শুনা যাক-
httpv://www.youtube.com/watch?v=E9CNnpIz6cU&feature=related
ভাল লাগল লেখাটি
অনেক ধন্যবাদ,
কস্ট লাগে তখনি যখন এই কাঠ-মোল্লারাই উদাহরন দেওয়ার চেস্টা করে…… ” মসজিদ এর পাশে মোর কবর দিয়ো …. ” এই বলে
অনেক ধন্যবাদ, আকাশ মালিক ভাই। অসাম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুলের বলিষ্ঠ উচ্চারণ আজও ভীষনভাবে উপযোগী; বস্তুত এ আবেদন কখনোই ফুরাবার নয়, যেহেতু ‘ন্যাজ’ মানবসমাজের অস্তিত্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, একটি খসে পড়লে আরেকটি গজিয়ে উঠে ভিন্ন রং ও মাত্রা নিয়ে!
আকাশ ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাংলার এ মনীষীর সত্য পরিচয়কে তুলে ধরার জন্য।
আজ যখন বাংলার এ সাহসী মানবতাবাদী নাস্তিক নজরুলকে খাঁটি মুসলমান বানানোর পায়তারা করছে মুসলিমরা, তখন প্রকৃত নজরুলকে জীবিত রাখার জন্য এমন লেখা খুবই প্রয়োজন।
নজরুল-সাহিত্য সম্বন্ধে নজরুল নিজেই বলেছেন-
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের ন্ই নবী।
কবি ও অকবি যাহা বল মোর মুখে বুঝি তাই স্ই সবি।
.
সমালোচকদের্ও নজরুল-সাহিত্য সম্বন্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ হলো- নজরুল আর্টের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কলম ও তুলির চেয়ে লাঠি ও তলোয়ার্ই বেশি ব্যবহার করেছেন।
তবে এ কথাও বলা চলে যে নজরুল গোলক ধাঁধাঁ ও জটিল দার্শনিক কবি নন। তাঁর দর্শন অতীব সরল, সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে হবে।
গ্যায়টেও আর্ট সম্বন্ধে বলতেন-
“প্রতিভার কাছে আমাদের প্রথম ও শেষ দাবি সত্যপ্রীতি”
এ জন্য্ই নজরুলকে দেখা যায় সাম্যবাদী কবিতা গ্রন্থে সত্যপ্রীতার গান গাইতে।
.
যেমন চোর -ডাকাত কবিতাটির ক’য়েকটি চরণ-
.
বিপন্নদের অন্ন ঠাসিয়া ফোলে মহাজন-ভুঁড়ি
নিরন্নদের ভিটে নাশ ক’রে জমিদার চড়ে জুড়ি!
পেতেছে বিশ্ব বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়,
নিচে সেথা পাপ- শয়তান-সাকি, গাহে যক্ষের জয়!
অন্ন, স্বাস্থ্য,প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকর কিছু.
দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু।
পালাবার পথ নেই।
মনেকরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাধ ।ধন্যবাধ সুন্দর লেখার জন্য ।
@মাসুদ,
যতদিন আছি সময় সুযোগে সাধ্যানুযায়ী অবহেলিত নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো শিল্পীদের, অন্যায়ের প্রতিবাদী কণ্ঠের মানুষদের কথা মনে করিয়ে যাবো ইনশাল্লাহ। বলছিলাম না মানুষ বড় ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আমার লেখায় বানান ভুল আর কেউ দেখিয়ে দেন না। আমি দেই, কারণ মুক্তমনাকে আমি নিছক একটি বৈজ্ঞানিক জার্ণাল হিসেবে কখনও দেখিনা। অনেক আগেই বলেছিলাম মুক্তমনা একটি পাঠশালা, অন্তত আমার জন্যে। সে যাক, ধন্যবাদ বানানটা দুইবার ভুল করেছেন, আগামীতে ঠিক করে নিবেন। লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ।
@আকাশ মালিক, ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ ।আসলে বাংলায় টাইপ করতে এখনো আমি ভাল ভাবে পারিনা আরো কয়েকটা দিন সময় লাগবে ।
@আকাশ মালিক,
জার্ণাল ?