প্রথম পর্ব

মিছিল চোখের আড়াল হয়ে গেলে, রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজের মনে, ‘ঘেউ ঘেউ’ করে ওঠে। সুর আরোপ করে, কখনো মৃদু লয়ে, কখনো দ্রুত লয়ে। সুর নিয়ে খেলতে খেলতে সে লরেন্সের খুব কাছাকাছি পৌঁছতে চায়। লরেন্সের কাছাকাছি পৌঁছবার আকাঙ্খা, তাকে বেশ আমোদিত করে তুলে। সে পাশ ফিরে দেখতে পায়, তার পাশে উপবিষ্ট আজিজ মিয়া, ল্যাজে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, নানান রকম সুস্বাদু খাবারের গল্প করছে।
আশেপাশে কোন দোকান নেই। পেটের ভেতরে যতটুকু ক্ষুধা ছিল, লরেন্স এসে সেই ক্ষুধাকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে, উধাও হয়ে গেল।
রবির দোকানে বসে খেতে খেতেই তার মাথায় অর্থ উপার্জনের একটা নতুন ধারণা উঁকি দিয়ে গেল। কিন্তু তার তো টাকা নেই। রবিকে বলা যায়। রবি হয়তো খুশি হয়ে, খাবারের মূল্য বাবদ কোন পয়সাই নেবে না।
‘রবি ভাই, কুত্তার খাওন-দাওনের একটা দোকান দাও, মাইনশের কাছে বেইচ্চা যা কামাও, তার চেয়ে অনেক বেশি পইসা কামাইতে পারবা।‘
কথাটা শুনে রবি বাম হাত তুলে, বললো, এক চড় দিয়া বত্রিশটা দাত ফালায় দিমু। চা-নাস্তা বেচি দেইখ্যা মনে করচস আমাগো কুনু মান ইজ্জত নাই। কুত্তার খাওনের দোকান দিমু? যা ভাগ!
নিজেকে বড় অপমানিত বোধ করলো সুলেমান। আশেপাশে চেয়ে দেখলো, কেউ নেই। একবার মনে হলো, পার্কে গিয়ে তার দলবল নিয়ে এসে রবির দোকানে হামলা চালায়।
পরক্ষণে মনে হলো, তার সঙ্গী-সাথিরাও হয়তো কুত্তা নিয়ে ঝগড়া করায় তেমন সাড়া দেবে না। তার চেয়ে বরং তার পরিচিত ছাত্রনেতা হামিদকে বললে, সে এর গুরুত্ব বুঝতে পারবে, সেক্ষেত্রে রবির গালে একটা কি দুইটা চড়ও বসিয়ে দিতে পারে।
দুপুর পর্যন্ত মধুর ক্যান্টিনের সামনে ঘুরঘুর করে সুলেমান। নেতাদের সিগারেট এনে দেয়, ম্যাচ এনে দেয়, তাতে তার পয়সা উপার্জন না হলেও, বন্ধুদের কাছে মর্যাদা বেড়ে যায়। আর এতে সে তার বন্ধুদের উপর হুকুম খাঁটাবার, একটা অলিখিত অধিকার পেয়ে যায়। রবির অপমান আর হামিদকে খুঁজে বের করার প্রত্যয় ডুবে যায় বন্ধুদের উপর খবরদারি করতে গিয়ে। তারপর মিছিল বেরুলে, সেও তার সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাধারণত সে মিছিলের আগে আগেই থাকে। আর অই মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গিটা এমন; যেন সামরিক জান্তাকে হাতের নাগালে পেলে, মানুষকে শাসন করার সাধ জন্মের মত মিটিয়ে দেবে।
শরীরের অঙ্গ-ভঙ্গিতে ফুটে ওঠা এইসব অর্থ সহসা হুমকির মুখের পড়ে, মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত ছাত্র-জনতার ভেতরে, সেও এক অসহায় দর্শক।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। মধুর ক্যান্টিন, টিএসসির চত্বর পরিণত হয় শ্মশানে।
সুলেমানের রুটি-রুজিতে টান পড়ে।
বস্তিতে অনেকে সুলেমানকে সমীহ করে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিয়মিত যাতায়াত আর অনেক নেতার সাথে তার সদ্ভাব। বস্তির দু’য়েকজন রিকসা চালকও সুলেমানকে দেখেছে, মিছিলের আগে আগে, এমনকি ছাত্রনেতাদেরও আগে আগে। আবার কেউ কেউ তাকে দেখেছে, খোলা চা-র দোকানে, ছাত্রনেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে, খাচ্ছে। ফলে বস্তিতে তার একটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতে সে যে একজন নেতা হয়ে উঠবে, কারো কোন সন্দেহ ছিল না।
যার এত মান সম্মান, ঠিকমত পয়সা না দেয়ার অপরাধে তার সৎ মা তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল; কেউ দেখবার আগেই সুলেমান হাইকোর্টের সামনে উপস্থিত। না, সে এখানে মামলা বা কোন আইনজীবির সন্ধানে আসেনি। ফুটপাতের একপাশে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলো। সে কিছুতেই তার সৎ মাকে বুঝাতে পারলো না, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, তাই তার উপার্জনও বন্ধ।
সুলেমানের মাথায় হঠাৎ করেই লরেন্স যেন দৌড়াতে শুরু করে। কোথায় যাবে, ভেবে পেল না। আধো অন্ধকারে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো, লরেন্সের থামার কোন লক্ষণ নেই। একটা সিগারেটের টুকরো কুড়িয়ে সে এগিয়ে গেল, একটা জটলার সামনে। জটলা থেকে উদ্গত গাঁজার ধোয়ার সাথে ভেসে আসছিল এলোমেলো শব্দ। ভাবলো, কিছুক্ষণ ইতস্তত করে আগুন চেয়ে বসলো। যার কাছে চেয়েছিল, সে তখন নেশায় বেসামাল। সুলেমানের দিকে তাকাবারও সময় নেই। শুধু জড়িত কন্ঠে বললো, কে রে বাবা, বসে যাও না।
সিগারেটের পাছায় আগুন দিয়ে, এক দৌড়ে সে চলে গেল অনেকটা দূরে, একটা গাছের নিচে। প্রথম কয়েক টান দিয়েই সে কাশতে শুরু করলো। ঠোঁটটা তেতো হয়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতাদের ফেলে দেয়া সিগারেটের টুকরো কুড়িয়ে, লুকিয়ে খেয়েছে, এত খারাপ লাগেনি। বার কয়েক টান দিয়ে, সে সিগারেটটা দূরে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়লো। তার চোখে তখন ঘুম।
ঘুম ভাঙ্গলো, রাতে। স্বপ্ন বা তেমন কিছু নয়। কে যেন তাকে চেপে ধরে রেখেছে।
সকাল হবার আগেই সে নেমে আসে রাস্তায়। কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে, অভ্যাস বসে চলে এলো টিএসসির সামনে, মানুষ, দোকান সব যেন উধাও। পার্কের ভেতরে চলে গেল। সেখানেও আগের মত লোকজন নেই।
সকাল যায়
দুপুর যায়
রাত যায়
আবারো সকাল কিন্তু সুলেমানের খাদ্য সংগ্রহের উপায় যেন আর আসে না। এমত অবস্থায় লরেন্স এসে উপস্থিত, আর লরেন্সই তাকে মনে করিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রিয় আপা সুরাইয়ার কথা। সে হাঁটতে শুরু করে। সে হাঁটছে, আর পথ যেন তার সাথে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সে থেমে যায়।
দুই চোখে, হঠাৎ করেই আশার আলো জ্বলে ওঠে। সে এগিয়ে যায়, তিন জন যোদ্ধা, দু’জন তার বয়সি, আর একজন দেশীয় নেড়ী কুকুর। সেও এগিয়ে যায় । ডাস্টবিনের চারপাশে একটা উৎসব।
তারপরের কাহিনী খুবই সাধারণ। ডাস্টবিনটা ছিল রাস্তার মোড়ে, আর সেই মোড়ে ছিল চলাচলের লাল হলুদ আর সবুজ বাতি। আর গল্পকার এখানে ইচ্ছা করেই সুরাইয়ার গাড়িটাকে এনে থামিয়ে দিল, যদিও এপথ দিয়ে সুরাইয়া খুব একটা যাতায়াত করে না বা করলে যে লাল বাতি দেখে থেমে যেতে হবে, এমন কোন কথা নেই। তবুও থেমে গেল, সুলেমানকে কল্পিত কাহিনীর নায়ক বানাবার জন্য।
সুলেমান অবাক হয়ে দেখলো- এই প্রথম লরেন্স তাকে দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করেনি; না চেনার ভান করে মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিল অন্যদিকে।