কয়েক দিন পূর্বে একটা গেট টুগেদার ছিল আমাদের চার বন্ধুর। যথাসময়ে সবাই উপস্থিত হলেও দেরী করছিল শুধু সোহেল। অথচ ওর বাসা আমাদের আড্ডাস্থলের নিকটতম। এমনকি রাস্তায় জমে যাওয়ার আশংকামুক্ত ছিল সে, যেহেতু পুরো রাস্তাটাই ছুটির দিনে থাকে জামমফ্রি। সর্বশেষ ফোনে সোহেল জানিয়েছিল, আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছুবে। কিন্তু সেই আধা ঘণ্টা পেরিয়ে ঘণ্টা গড়িয়ে ঘড়ির কাটা এখন দেড় ঘণ্টা ছুঁইছুঁই; তবু সোহেলের দেখা নেই। ওর ঘড়ির কাটা মনে হয় থেমে আছে।

হয়ত হঠাৎ কোন জরুরী কাজে আটকে গেছে, এমন ভাবনায় আমরা যখন সোহেলের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, তখনই সে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হল। ওকে খানিকটা বিধ্বস্ত ও অপরিপাটি দেখাচ্ছিল। তবে তা আমাদের ভিতর তেমন সমবেদনা জাগাতে পারল না। বরং মনে মনে আমরা সবাই এক চোট হেসে নিলাম। অবশ্য রতন টিকতে না পেরে এক সময় জিজ্ঞেস করে বসল, ”কিরে বৌয়ের লগে ঝগড়া কইরা আইলি?’’
সোহেল নির্লিপ্ত স্বরে বলল, – ”বৌয়ের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে আমার লগে ঝগড়া করবো?’’
রতন হেসে বলল,- ”তার মানে তোর বউ তোকে ভয় করে?’’
সোহেল পরিতৃপ্তি সহকারে বলল,- ”প্রথম প্রথম একটু সাহস দেখানোর চেষ্টা করত। এখন ঠিক হয়ে গেছে। এখন কোন ব্যাপারেই আর ঘাটায় না। আমি ওকে এভাবেই গড়ে তুলছি।”
মাসুদ বলল,- ”আরে, বউরে দেখি পুরাই ম্যানেজ কইরা ফালাইছস! চাকরিজীবী বউরে এত সহজে ম্যানেজ করলি কি কইরা?’’
সোহেল বলল, – ”এইটা কোন বিষয়ই না। সব সময় স্ট্রিক্ট থাকবি। ভুলেও কখনো নরম হবি না। সব সময় হুকুমের স্বরে কথা বলবি। আবারও বলতেছি, একটু নরম হলেই কিন্তু পস্তাবি। পুরা পাইয়া বসব।”
রতন বেচারাম ভঙ্গিতে বলল,- ”কি সোনার বৌভাগ্য তোর! অনেক কপালগুনে এমন বৌ পাওয়া যায় রে! আর দেখ, আমার কি ফাটা কপাল, বউ খালি কথায় কথায় বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দেয়।”
সোহেল বলল, – ”তুই তো একটা আস্ত ছাগল। নইলে কোন সত্যিকারের পুরুষ বউয়ের হুমকিরে পাত্তা দেয়? আরে যেতে দে না বাপের বাড়িতে! ওখানে কয়দিন রাখবে? আবার তো ফিরে আসতেই হবে! বিয়ের পর মেয়েদের আর কোন যাওয়ার জায়গা আছে নাকি?’’
রতন বলল, – ”কিন্তু যদি সত্যি সত্যি ফিরে না আসে?’’
সোহেল মনে হয় ব্যাপক মজা পেল, – ”তাইলে আর কি করবি, চোখ-মুখ ভাসিয়ে কান্নাকাটি করবি।”
মাসুদ বলল, – ”তোর ভজর ভজর থামাবি, সোহেল? তোর কপাল ভাল, এমন বাধ্য আর অনুগত মাইয়া জুটছে, নইলে এত চটাস চটাস কথা বলতে পারতিস না।”
সোহেল বলল, – ”কপাল গুনে পাই নাই, বানায় নিছি, একেবারে হোম মেড, বলতে পারিস কাস্টমাইজড ফর মি। আমি প্রথম কয়েক মাসেই বুঝায় দিছি, আমার স্বাধীনতায় কোন ধরনের হস্তক্ষেপ চলবে না। আমার যখন যা খুশী করব। ধর কোন দিন দেরী করে বাড়ি ফিরার পর বউয়ের মুখ দিয়ে সামান্য কথা বাহির হলে পরবর্তী কয়েকদিন আরও দেরী কইরা বাসায় গেছি। সে অবশ্য কয়েকবার মুরব্বিদের দ্বারস্থ হইছে আমাকে তার ইচ্ছামত চালানোর জন্য। তবে আমি শ্বশুরকে স্পষ্ট বইলা দিছি, প্রয়োজন হলে মেয়েরে নিয়া যান, কিন্তু আমারে বদলাইতে পারবেন না।‘’
মাসুদ দুঃখিত স্বরে বলল, – ”নিশ্চয়ই বউডার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দিন যায়, তোর মত গোয়ারের সাথে ঘর করতে হলে এছাড়া আর কি করার আছে?’’
মাসুদকে শেষ করতে দেয় না সোহেল,- ”দেখ, চোখের পানি হইল স্ত্রীলোকের বৈশিষ্ট্য, আর কোন ধরনের বাধা-বন্ধনে না মানা হল পুরুষ মানুষের বৈশিষ্ট্য। সত্যিকারের পুরুষরে কোন চেইন দিয়া আটকায় রাখা যায় না। তোদের ভিতর পুরুষত্বের অভাব আছে, নইলে বউয়ের নেওটা হয়ে থাকতি না।”

আমি আড্ডায় সাধারণত চুপই থাকি। বলার চেয়ে শুনতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য আমার। তবে আড্ডাটা সেদিন ক্রমেই তিক্ততার পর্যায়ে ধাবিত হচ্ছিল; তাই মুখ খুলতে বাধ্য হলাম, – ”আচ্ছা, এসব বাদ দে তো তোরা। যতসব আজুইড়া প্যাঁচাল। আর সোহেল তোর দেরী হল ক্যান? ফোনে কইলি, রওনা দিছস, অথচ দুই ঘণ্টায়ও কোন খবর নাই।’’
সোহেল তিক্ত স্বরে বলল,- ”রওনা তো হয়েই গেছিলাম দোস্ত। কিন্তু মেয়েটা পেছন থেকে শার্ট টাইনা ধরল। তারপর থেকে আর কিছুতেই পিছ ছাড়ে না। আমি তাকে বেশ কয়েকবার ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার মেয়েটা আবার খুব স্মার্ট। সে সবসময় এলার্ট যাতে তাকে ফাকি দিয়ে যেতে না পারি। শেষমেষ মারধোর করে বুয়ার কাছে রাইখা আসছি।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, – ”কি বলিস, বুয়ার কাছে রেখে এলি? কেন ভাবি ছিল না বাসায়?’’
সোহেল বলল, – ”না তোর ভাবী একটু মার্কেটে গেছে। আর বুয়ার কাছে থাকলে কোন সমস্যা নাই; ও তো সারা বছরই বুয়ার কাছেই থাকে। তোর ভাবি আর আমি দিনের বেলা অফিসেই থাকি।‘’
আমি বললাম,- ”তা না হয়, বুঝলাম। কিন্তু এতটুকু বাচ্চাকে মারতে গেলি কেন?’’
সোহেল বলল,- ”দেখ, আমার মেয়েটা অতিরিক্ত পাকা। ছেলেদের থেকেও বেশী দুষ্টুমি করে।”
এতক্ষণ বাদে রতন আবার আলোচনায় অংশ নিল,- ”কিন্তু ভাবিরে তুই একাই ছেড়ে দিলি মার্কেটে?’’
সোহেল বলল,- ”দেখ, শপিং হল মেয়েদের কাজ। এইসব ঘরকন্নার কাজে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নাই। আর এইসব কাজ করার জন্যই তো বউ রাখছি। নইলে বউয়ের কি দরকার ছিল?’’ কথাটা বলে সোহেল গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগল।

ততক্ষণে টেবিলে বোতল এসে গেছে। মাসুদ আনন্দমাখা কণ্ঠে বলল, ‘’চল, আমরা মাল চর্চায় নেমে পড়ি’’। উল্লেখ্য, বোতল উৎসবকে আমরা ঘরোয়াভাবে নাম দিয়েছি মাল চর্চা। অন্যরা যখন বিজ্ঞান চর্চা, রাজনীতি চর্চা, সাহিত্য চর্চা বা অন্যান্য সুকুমার চর্চায় লিপ্ত থাকে, আমরা তখন বন্ধুরা মিলে মাঝে মাঝে মাল চর্চা করি।
রতন এক ঢোক গিলে বলল,- ”দেখ তোরা যাই বলিস, আমার কাছে এইটা হইল মল চর্চা; কারণ এগুলি খাইলে আমার মল পরিষ্কার হয়।’’
মাসুদ হেসে বলল, – ”আমাদের মহান মাল চর্চাকে কলুষিত করার জন্য আগামী কয়েক ম্যাচের জন্য তোকে সাসপেন্ড করা হল।”
সোহেল বলল,- ”দেখ, আমার কাছে বেটার সলিউশান আছে, আমরা একে মাল বা মল না বলে মেল প্রাকটিস বলতে পারি। কারণ এই চর্চাটির সাথে জড়িত ইনহেরেন্ট মেল ফাংশন।”
আমি বললাম,- ”কি বলছিস, তুই এইসব? ম্যালপ্রাকটিস, ম্যালফাংশন তো নেগেটিভ মিনিং বোঝায়!’’
সোহেল বলল, – ”তুই চিরকালই গাধা রয়ে গেলি। আর তাই এখনো বিয়ে করতে পারলি না। আমি কোন নেগেটিভ শব্দ উচ্চারণ করি নাই, আমি মেল ফাংশন আর মেল প্রাকটিসের কথা বলছি; আর এগুলো খাঁটি পুরুষবাচক শব্দ।” আমাদের মধ্যে সোহেলের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডই সবচেয়ে ভাল। তাই ওর কথা বিনা বাক্যে মেনে নিলাম।
এরপর আর তেমন কথা হল না। মেল প্রাকটিসে আপাদমস্তক ডুবে রইলাম আমরা চার বন্ধু।

২.
সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১ টা। বাবা দরজা খুলে দিয়েছিল। যখন কাপড় ছাড়ছিলাম তখন পাশের ঘর থেকে মা-বাবার ভাসা ভাসা কথোপকথন কানে আসছিল। বাবা বলছিলেন, ‘’তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিতে হবে। তা হলে আর রাত করে বাড়ি ফিরবে না।‘
মা উত্তরে বললেন,-‘‘অনেক দিন পর আইজ বন্ধুরা এক সাথে হইছিল তো। তার জন্যই মনে হয় দেরী হইছে।’‘
বাবা বললেন,-‘‘দরজা খোলার সময় তোমার ছেলের মুখে গন্ধ পেলাম। মনে হয় নেশা করেছে।‘’
মা বললেন,- ”তোমার পোলা তোমার মতই হইছে! তুমি কম জালাইছ আমারে?’’

আমার চোখে তখনো ঘোর। নেশা পুরোপুরি কাটেনি। মাথার ভিতর খালি ঘুরপাক খাচ্ছে দুটি শব্দ, মেল ফাংশন আর মেল প্রাকটিস। কিছুতেই তাড়াতে পারছিলাম না শব্দদুটিকে। অনেকক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু শব্দ দুটি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। জানি না আদৌ আসবে কিনা ঘুম। শান্তির ঘুম। স্বাভাবিক ঘুম। শব্দদুটি কেবলই আমাকে জাগিয়ে রাখছে। আর এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার পৃথিবী। অজান্তেই।