ভয়ংকার হুংকার ছেড়ে তেড়ে এলো লরেন্স। দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্য প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে সাধারণত রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীরা এ রকম হুংকার ছুড়ে থাকেন। লরেন্সের কন্ঠ থেকে উদ্গত হুংকারের প্রতিপক্ষ কোন রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী নন; একজন টোকাই, নাম সুলেমান।
আর একজন টোকাই বলেই হয়তো সুলেমান, ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। প্রতিপক্ষকে পিছিয়ে যেতে দেখে লরেন্সের কন্ঠের উত্তাপ গেল বেড়ে । আর সুলেমান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দুই হাত জোড় করে মাফ চাইল। কোন কাজ হলো না। রাষ্ট্রীয় জীবনে একজন ক্ষমতাহীন মানুষের যা হয়; এক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। অর্থাৎ লরেন্স তার প্রভুর হাতের শিকল ছিঁড়ে, সম্ভব হলে এ মুহূর্তেই চূড়ান্ত মীমাংসার একটা দাড়ি টেনে দেয়।
হাতের ফুলগুলোও, হাত থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তাই ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে, ঠাঁই না পেয়ে সুলেমানের হাতেই রয়ে গেল। ফুলগুলো নিয়ে, ভয়ে জড়োসড়ো সুলেমান ভেবে পাচ্ছিল না, ‘কুত্তাটা এমন ঘেউ ঘেই করতাছে ক্যান?’ সে তো চুরি-চামারি বা কাউকে খুন করতে আসেনি? তারপরই সে খুব গোপনে একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়; নিশ্চয়ই আজ কুত্তার পেটে দানাপানি যায়নি, তাই মাথা খারাপ। এরকম তার নিজের ক্ষেত্রেও হয়।
প্রভুর একটানা অনুরোধে কিছুটা শান্ত হয়ে এলেও, থেমে থেমে হুংকার ছাড়ছিলো লরেন্স। নিরাপদ দূরত্ব থেকে কিছুটা এগিয়ে এসে, সুলেমান তার সদ্য আবিষ্কৃত তথ্যটি যাচাই করার জন্য সুরাইয়াকে জিজ্ঞেস করে, আপা, কুত্তারে আইজ খাউন দেন নাই?
সুরাইয়া চোখ পাকিয়ে বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠ বললো, তোকে বলছি না; ওর একটা নাম আছে, কুত্তা বলবি না।
সুলেমানের ডান হাতে ছিল ফুল, তাই বাম হাতে আলতো করে নিজের দু’গালে দু’টো চড় বসিয়ে দিয়ে বললো, তওবা, তওবা। কষ্টের সংগ্রহিত ফুলগুলোর মূল্য হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়ে আরো একধাপ এগিয়ে বললো, আর কমু না, মাফ কইরা দেন। এবং এ কথাগুলো বলে তার মনে হলো যথেষ্ট হয়নি, সে তার ফুল-ক্রেতার মন-তুষ্টির জন্য কুকুরকে মিয়া উপাধিতে বিভূষিত করে বলে উঠলো, কুকুরকে মিয়ারে কি খাউন দিতে দেরি অইছে?
ক্রেতার ফুলগুলো হয়তো বেশি দরকার, তাই অনেক দিনের চেনা বিক্রেতাকে তাড়িয়ে না দিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো, ওর নাম কুকুর মিয়া নয়, লরেন্স।
লরেছ কি কিছু খায় নাই?
লরেছ নয়, লরেন্স। তোকে না বলেছি উচ্চারণটা ভাল করে শিখ, তা শিখবি না, তোদের উন্নতি হবে কি করে?
আপা ভুইল্যা যাই। পেটের ধান্ধা করতে গিয়া আর কিছু মনে থাহে না।
পেট পেট করেই তোরা মরবি, নাগরিক আদব-কায়দা তোদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। গ্রাম্য অভ্যাস কি আর সহজে যায়? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে একটা যথার্থ কথা বলতে পেরে, সে স্বস্তিবোধ করে এবং রাগটাও কিছুটা হ্রাস পায়।
এতবড় আপা তার সাথে কথা বলছে ভেবে সুলেমান খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে। অপরাজয় বাংলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে অর্জিত জ্ঞান; সে-ও সুযোগ বুঝে একটুখানি চালান করে দেয়, আপা আমাগো গেরাম আর বস্তির মধ্যে কোন ফারাক নাই। তয় লরেছ নামটা খারাপ না। আমাগো বস্তির মালিক হারেছ মিয়ার লগে এট্টুখানি মিল আছে, নামেও মিল, কামেও মিল। ভাড়া ঠিকমত না পাইলে খুব গালিগালাজ করে। মাথা খারাপ অইয়া যায়।
সুরাইয়া অবাক হয়ে বলে, কিরে তুই দেখছি একখানা ভাষণ দিয়ে দিলি।
এটাকে একটা ভীষণ বিজয় মনে করে, সুলেমান বেশ গম্ভীর হয়ে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপরাজয় বাংলার পাদদেশে ছাত্রনেতাদের ভাষণ দেয়ার বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গি। মুহূর্তের জন্য সেও নেতা বনে যায়। বাম হাতটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বলে, আপা, এইগুলা খুব হাছা কথা। বাশন না। আমি তো আর ইনিবার্সিটিতে পরি না যে বাশন দিমু। তয় হেগো বাশন শুনলে খুব বালা লাগে। মনে অয়….. তার চোখ চলে যায় লরেন্সের উপর।
সুরাইয়ার পায়ের কাছে বসে আছে রণক্লান্ত লরেন্স, চোখে মুখে উদাসীন ভাব। সুরাইয়ার ডান হাতটা চলে যায় লরেন্সের মাথার উপর। আলতোভাবে হাত বুলাতে বুলাতে সুরাইয়া বলে, কি রে, তোর ফুলের দাম কত, বললি না তো?
সুলেমান আসলে ডুবে গিয়েছিল ভাবের সাগরে। পেটে নাই ভাত তার আবার ভাব। তবুও সে তার নিজের হাত দিয়ে নিজের মাথায় হাত রেখে অন্যকোন হাতের সন্ধান পেল না। তখন তার মনে হলো, কেউ তো কখনো তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি।
কি রে ফুল বেঁচবি না?
ইতস্তত করে কি একটা বলতে গিয়ে , ড্রাইভারকে আসতে দেখে থেমে যায়।
আপা গাড়ি রেডি।
আজিজকে ডাকো।
ড্রাইভার চলে যায়।
সুলেমান হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। খদ্দের কি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে? সে দ্রুত ফুলগুলি হস্তান্তর করতে গিয়ে আবার পিছিয়ে যায় লরেন্সের ভয়ে। মনে মনে ভাবলো, রাস্তায় যুদি তরে কুনুদিন পাইছি, খাইছি হালার পুত। আর মুখে বললো, আপা ফুল নিবেন না?
রাখ, ওদের বিদায় করে নি’।
একটা বাকেট সাবান-স্যাম্পু আর তোয়াল নিয়ে আজিজ উপস্থিত, সাথে ড্রাইভার। লরেন্সকে গাড়িতে করে ওরা চলে গেলো রমনা লেকে।
রাস্তায় নেমে সুলেমান পৃথিবীটাকে দেখে। লরেন্সের কাছে সব যেন তুচ্ছ। এমনকি ছাত্রনেতাদের ভাষণ পর্যন্ত। তার কাছে এ মুহূর্তে সবকিছু কেমন রহস্যময় মনে হয়। পকেট থেকে পাঁচ টাকার কড়কড়ে নোট বের করে, ঘ্রাণ নেয়। দোয়েল চত্বরের সামনে আসতেই মিছিলের আওয়াজ পেল। বাংলা একাডেমির দিক থেকে মিছিলটা এগিয়ে আসছে। তার চোখের সামনে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে একটা গাড়ি। মিছিল তার সামনে এসে পড়ে, সে দেখতে পায়, গোসল করে বাড়ি ফিরেছে লরেন্স, খুব আয়েস করে ভুনা মাংস খাচ্ছে।
আজ আর তার মিছিলে যেতে ইচ্ছে করল না।
গল্প পড়ে ভাল লাগল। টিভিতেও দেখতে ভাল লাগে।
(F)
হাতের ফুলগুলোও, হাত থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তাই ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে, ঠাঁই না পেয়ে সুলেমানের হাতেই রয়ে গেল। ‘—এরকম বণর্না গল্পটাকে অসাধারণ করে তুলেেেছ। মনে হয় ঘটনার প্রিিতটি বণর্না এতো নিখুঁত………। সুন্দর । গল্পটা দুবার পড়লাম জনাব।
নকল প্রেমে এমন আঘাত আসতে থাকুক বারবার গল্পে-কবিতায় ।
(Y) (D)
@নিলীম আহসান,
ধন্যবাদ।
(F) :))
@ঢাকা ঢাকা,
ধন্যবাদ।
এখানে স্পষ্ট হয় গল্পচ্ছলে সামাজিক বিভেদ-বৈষম্য তুলে ধরার অভিপ্রায়। আমরা সবাই ফুল বিক্রেতা আর ক্রেতাকে দেখেছি; কিন্তু আপনি দেখেছেন অনেক বেশী, অনেক গভীরে; বঞ্চনার্ত সুলেমানদের ভিতরকার স্নেহের খরা তাই এত সাবলীলভাবে আবিষ্কার করতে পারেন আপনি।
অন্তঃসারশূন্য শিক্ষাব্যবস্থার উপর দারূন রম্য আক্রমণ!
নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ।
খুব বেশী স্পষ্ট করে ফেলা হল না কি এইখানে? পুরো গল্পের ইঙ্গিতময়তা এখানে দুর্বল হয়ে গেছে।
টাইপো ।
ভাল থাকবেন, স্বপন ভাই।
@কাজি মামুন,
খুব ভাবনার মধ্যের ফেলে দিলেন। লেখাটা ১৪ বছর আগে লেখা। প্রকাশ করিনি, কারণ সমাপন নিয়ে ঘোর সংকটে ছিলাম। সেই সংকট যদিবা কাটলো কিন্তু মন্তব্যের ঘরে এমন চমৎকার সমালোচনা পড়ে খুব খুব করে লেখাটাকে আবারো ঘষামাজা করার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠলো।
আবারো, আবারো ধন্যবাদ।
আপনিও ভাল থাকবেন কাজিদা।
@স্বপন মাঝি,
ছোট পরিসরে লেখাটা খুব ভালো লাগল।
@আফরোজা আলম,
আমি তো ভাল লাগার জন্য লেখিনি। তার মানে ব্যর্থ প্রয়াস। যা হোক পাঠকদের মন খারাপ করে দেয়ার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
ভাল থাকবেন, ভাল থাকুন।
আমাদের একটা পোষা প্রানী আছে। ওকে আমরা মানুষের বাচ্চার মতই আদর করি। আপনার গল্পটা পড়ে মন খারাপ হলো। তখন নিজেকে সান্তনা দেবার জন্য চিন্তা করলাম, আমাদের পোষা প্রানীটা চার বছর আগে রাস্তা থেকে টুকিয়ে আনা । ও হয়তো এতদিনে মরেই যেত আমরা দেখে না রাখলে। সান্তনা তে কাজ হচ্ছে না। কিন্তু ভাবানোর জন্য ধন্যবাদ। লেখাটার আবহটা কল্পনা করতে পারছি খুব সহজে, খুব ভালো ফুটিয়ে তুলেছেন।
@নির্মিতব্য,
আপনাকে বা আপনাদের মত যারা জীবে দয়া করছে; তাদের কথা এখানে বলা হয়নি। হয়তো আমি সবটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারিনি।
আমার কাছে মনে হয়, পোষা প্রাণীও সমাজে স্ট্যাটাস নির্ধারণে একটা মানদন্ড হয়ে উঠছে। এই যেমন কার কুত্তা কি খায়, কোন জাতের, কত দাম, প্রভু ভক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি এসব বালাই থেকে নিরাপদ দূরত্বে আছেন।
ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন, ভাল থাকুন এবং আপনাদের পোষা প্রাণীটিও।
ভাইরে , আমি বড্ড বোকা, গল্পের ভাবখানা ভালো বুজি নাই, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম…।
@কামরুল আলম,
আমি হয়তো আপনার চেয়েও বেশি বোকা বলে, ঠিকঠাক বলতে পারিনি। আপনাকে আরো হতাশ করার জন্য পরের পর্বটি অপেক্ষা করছে, পালাবেন না কিন্তু!
ভাল থাকুন। ধন্যবাদ।
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।সুলেমানরা সারাজীবন ই আমাদের তথাকথিত সুশীলদের কুকুরের চেয়েও কম মূল্য পাবে।আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এইরকম। 🙁 আপনার গল্পের জন্য (Y)
@মোঃ সাব্বির আলম,
ভাল বলেছেন। ধন্যবাদ।
ছোট্ট গল্প, কিন্তু দারুণ! (F)
@লীনা রহমান,
ধন্যবাদ, পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য।
স্বপন মাঝি,
আমি তো ভাবলাম সুলেমান বাদশার গল্প লিখেছেন, পড়ে দেখি টোকাই সুলেমানকে নায়ক বানিয়ে দিয়েছেন। ভালো লেগেছে গল্পটা। যদিও সেই পুরাতন ‘হ্যাভস’ আর ‘হ্যাভনটস’ নিয়ে প্লট, তবুও আপনার লেখার গূণে পড়তে ভালোই লেগেছে। আরো লিখুন।
@ইরতিশাদ,
ধন্যবাদ, পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য।
মিছিল এখন আর মানুষের পক্ষে নেই।
@মুরশেদ,
চমৎকার পর্যবেক্ষণ।
ধন্যবাদ।
সেই শিক্ষাগুরুর কথা মনে পড়ে গেলো, যিনি ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তিন পা-অলা একটা কুকুরের প্রতি পায়ের খরচ যদি (এতো) হয়, তবে একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন কত?’ এখনো আমরা আসলেই সেই-সময়েই পড়ে আছি। পশুর প্রতি মমত্ববোধ দেখাতে ইংরেজ প্রভুর বদলে এসেছে দেশি-উচ্চবিত্ত, মানুষের প্রতি মমত্ববোধের-দায়িত্ববোধের দায় এড়িয়েই। ধন্যবাদ লেখককে।
@শাতিল আহমেদ,
সে গল্প খুব খুব মনে পড়ে। সম্ভবত এটা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। লেখকের নাম ভুলে গেছি।
পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।
দ্বিতীয় পর্বে আপা কি আত্খা হিজাবী হয়া যাইবো? আচ্ছা লরেন্সকে কি পবিত্র মার্চের গন্ধপচা হাড্ডি শুঁকায়া চিপায় নিয়া গাব্বুইরা মাইর দেওন যায় না? বিচ্ছুরা সব গেল কই? ওরা আর কত পলায়া থাকবো? আইচ্ছা অরা কি বৈশাখী মেলায় আসে, দ্বিতীয় পর্বে? ধুরো, কিয়ের মইদ্দ্যে কি কই, খা- মা- খা (D)
@কাজী রহমান,
আপনি পাঠ করেছেন, ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য আমার বোধগম্য না হওয়ার কারণে আমি কিঞ্চিত কুন্ঠিত।
ইঁদুরের গর্তে। কিছু পাবেন জামাত বিএনপির পকেটে।