ভ্রমনটা ছিল প্রেজেন্ট ! ফার্ষ্ট চয়েস ভেনিস ! না ! ভুল একটুও হয়নি । জল বেষ্টিত ভেনিসে
চমৎকার কাটল কয়েকটাদিন ! এ্যাপার্টমেন্ট নেয়া হয়েছিল । সকালে নাস্তা খেয়ে সারাদিন জলবাসে ঘোরাঘুরি আর হাঁটাহাটিঁ । কারণ ভেনিসের —দ্বীপ গুলিতে গাড়ী বা বাস চলেনা ।
গ্র্যান্ড ক্যানালের ( মুল বড় খাল ) দু পাশে বড়বড় প্রাসাদ, চার্চ, রেষ্টুরেন্ট বাসাবাড়ি আর দোকানপাট। ১৭৭টা খাল এই দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ।
গ্র্যান্ড ক্যানালে ওয়াটারবাস,স্পীডবোট আর পুলিশের বোট আর ওয়াটার এম্বুলেন্স সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে । আর প্রতিটি স্টপে কিছুক্ষন পর পর যাত্রী নেয়া ও পৌঁছানোর জন্য ওয়াটারবাস থামছে ।
ছোট ছোট খালগুলোতে গন্ডোলা (ছোট নৌকা) চলে মাঝিরা বিচিত্র পোষাক পরে গান গাইতে গাইতে মূলত পর্যটকদের নিয়ে দ্বীপটা ঘুরে দেখায় ।
তিনটা রেষ্টুরেন্টেই বাঙলাদেশি ওয়েটার ! দেশের মত জলদিয়ে ঘেরা ভেনিসে মনে হল তারা আনন্দেই আছেন ! পরিবেশটাই মনকে আশ্চর্য রকম ভাল করবার মত !
ভেনিস কতগুলো দ্বীপের সমষ্টি । ইউরোপের ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোর অনেক আগেই এরা ভারত আর চীনের সাথে ব্যবসা করত । চীন থেকে আনত মূলত সিল্ক আর ভারত থেকে মসলা, চমৎকার অলঙ্কার আর হাতীর দাঁতের সামগ্রী ।
আর সেসময়েই ভেনিস প্রায় গোটা ইউরোপের বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ভেনিসের সন্তান মার্কোপোলো (১২৫৪ -1324 ) ছিলেন ব্যবসায়ী নিকোলোপোলের ছেলে । নিকোলোপোলো ব্যবসার জন্য কনস্টান্টিনোপলও (ইস্তাম্বুল ) যেতেন । একবার মার্কোপোলোর বয়স যখন ৬ তখন গিয়ে তার বয়স যখন ১৫ তখন ফিরে আসেন ভেনিসে । ততদিনে মার্কোর মাও মারা গিয়েছেন।
একবার মার্কোর বাবা আর চাচা রাশিয়ায় যান ব্যবসার জন্য । ভলগার তীরে যুদ্ধ বাঁধলে পথ ঘুরে বোখারা হয়ে যেতে তাদের চীন সম্রাট কুবলাই খানের দূতের সাথে সাক্ষাৎ হয় । দূত তাদের সম্রাটের সাথে দেখা করাতে পিকিং নিয়ে যান । কুবলাই খান সাদাদের বিরাট সম্বর্ধনা দেন । তিনি ইউরোপের সংস্কৃতি , আচার , ধর্ম বিষয়ে আগ্রহ দেখান । কনফুসিয়াজমে বিশ্বাসি সম্রাট পোলোভ্রাতৃদ্বয়কে অনুরোধ করেন যেন তারা গিয়ে পোপকে বলেন –পোপ যেন ১০০ জন খ্রীষ্টিয় পুরোহিতকে তার কাছে পাঠান । যাতে তারা নিরাপদে দেশে ফিরতে পারেন সেজন্য তাদের তিনি সোনার সিলমোহর দেন ।
মাত্র ১৭ বৎসর বয়সে মার্কোপোলো সিল্করোড ধরে ক্যারাভানে পোপের চিঠি নিয়ে বিপদসঙ্কুল ভ্রমন শেষে ক্যাথি বা এখনকার চীনে পৌছেঁন । আবার ২৫ বছর পর বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করে ভেনিসে ফিরে আসেন ।
কয়েক বৎসর পর সমুদ্র যাত্রায় তাকে জেলে যেতে হয়, সেখানেই “রুটিচেলো ফান পিজা” নামের এক লেখককে তার বিভিন্ন দেশ ভ্রমনের চমৎকার অভিজ্ঞতা বলেন । তাই পরে মার্কোপোলোর ভ্রমনকাহিনী হিসেবে ছাপা হয় ।
এর আগে ইউরোপীয়রা কখনও প্রাচ্যদেশীয় কোন চাক্ষুস গল্প শোনেনি !
উইলিয়াম সেক্সপিয়ার কিন্তু ভেনিসে কখনও আসেন নি । তার “মার্চেন্ট অফ ভেনিস “ ও “ওথেলো” ভেনিসে ভ্রমনকারীদের অভিজ্ঞতা শুনে লেখা ।
জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটে ভেনিসে গিয়েই প্রথম সমুদ্র দেখেন, লিখে ফেলেন ইটালি ভ্রমনের ওপর বই ।
ইংল্যান্ডের আরেক সাহিত্য দিকপাল চার্লস ডিকেন্স ভেনিস ও ইটালি ভ্রমন শেষে লেখেন পিকচার ফ্রম ইটালি ।
রোমান্টিক চরিত্র জিওভানি কাসানোভা (১৭২৫ -১৭৯৮)ভেনিসেরই সন্তান ।
কূটনীতিক, বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী, বেহালাবাদক, প্লেবয়, জুয়ারী, লেখক, গুপ্তচর এ চরিত্রটি নিয়ে সিনেমাও হয়ছে ।
দর্শনীয় প্রাসাদ “Palazzo Ducalo” বাইজেন্টাইন, গথিক ও রেনেসাঁস স্থাপত্য।
“Piazza San Marco”শতাব্দী ধরে ভেনিসের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ।
আধুনিক আর পুরোনো আর্টের অনেক মিউজিয়াম এখানে ।
দেখলাম মডার্ন আর্টের “Peggy Guggenheimcollection”।
“Basilica” বিশাল এক চার্চ ।ছাদে সোনার প্রলেপের ওপর ফ্রেসকো চিত্রমালা !
বাইবেলের গল্প । ইতিহাস বলে ভেনিসের ব্যবসায়ীরা ক্রুসেডে গিয়ে এসব সোনা নিয়ে এসেছে।
ভেনিসের বিখ্যাত স্থান সাধু মার্কের চত্বর, বিশাল এলাকা জুড়ে চত্বরটির মাঝখানে রয়েছে সাধু মার্কের গীর্জা। কথিত আছে মিশরের আলেকসান্ড্রিয়া থেকে দুজন ব্যাবসায়ী চুরি করে আনলেন সাধু মার্কের দেহাবশেষ। যে বাক্সটির ভেতরে লুকিয়ে আনা হোল দেহাবশেষ তার ওপর লিখে দেয়া হোল” সবজী আর বরাহ”। মুসলমান অধুষ্যিত অঞ্চল থেকে সহজেই পেরিয়ে গেলো সেই বাক্স।
সাধু মার্কের দেহাবশেষ আবারো সমাধিস্থ করা হোল ভেনিসে, ধর্মবিশ্বাসীরা ভীড় জমালো , বেড়ে গেলো রাষ্টের আয়। ধর্মানূভুতির চেয়ে রাষ্ট্রের আয় ই বোধ করি ছিলো মুখ্য। আমার এই চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রথম যে কথা টি মনে হোল তা’ হোল “ধর্মের কি সুচারু বাণিজ্যকরন”। তবে এ কথা সত্যি সোনালী মোসাইকের এই গীর্জা নয়নকাড়া।
সাধু মার্কের গীর্জার উল্টো দিকে রয়েছে সান্তা মারিয়া দেলা সালুতে (উচ্চারন বোধ করি অন্য কিছু) নামের আরেকটি গির্জা। এর ইতিহাসটি এরকম -ভয়ংকর প্লেগে যখন মানুষ মারা যাচ্ছিলো তখন ভেনিস বাসী প্রতিজ্ঞা করেছিলো মহামারী থেকে পরিত্রাণ পেলে একটি গীর্জা বানাবে- এই সেই গীর্জা।
একটি সেতু না দেখলে ভেনিস দেখা অপুর্ণ রয়ে যায়-তা হোল Bridge of Sighs দীর্ঘশ্বাসের সেতু। ডোজের অর্থাৎ তৎকালীন শাসকদের প্রাসাদে বিচারের পর কয়েদীদের একটি ছাদে ঢাকা দু পাশ বন্ধ সেতু দিয়ে নিয়ে যাওয়া হোত কারাগারে। হয় মৃত্যুদন্ড অথবা যাবতজীবন কারাদন্ড। সেতুর ঝাঝঁরী কাটা ঘুলঘুলী দিয়ে কয়েদীরা শেষ বারের মত দেখতে পেতো বাইরের পৃথিবী। সেই দেখা অশ্রু হয়ে যেতো। ভেনিসের সৌন্দর্য্যের শেষ দৃশ্যটি একটি দীর্ঘশ্বাস হয়ে গেঁথে যেতো তাদের মনে।
রাতে ভেনিস সাজে আরেক রুপে, মনে হয় জোনাকীর মেলা বসেছে, প্রদীপের মত ঝিলমিল প্রতিবিম্ব পড়ে কালো জলে । আধার বাড়তে থাকে, রেস্টুরান্ট থেকে ভেসে আসা মিষ্টি বাজনায় মুখরিত হতে থাকে সমস্ত প্রাঙ্গন আর ঘাট………
@কেয়া রোজারিও,
পড়া ও মন্তব্যের জন্য অনেক শুভেচ্ছা ।
ভেনিসে যাবার লোভটা উসকে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ছবিগুলো চমৎকার।
@প্রদীপ দেব,
অসংখ্য ধন্যবাদ !
ভেনিসে ভ্রমনের শুভকামনা থাকল ।
পুরান সৌন্দর্য্যময় নগরী হিসাবে ভেনিসের নাম সর্বাগ্রে আসে। আগে বাস্তবে একবার ঘুরে আসলেও আপনার লেখা ও ছবি দেখে আরো একবার ঘুরে এলাম। তবে বাঙালী তেমন চোখে পড়ে নাই, লেখা পড়ে জানলাম ওখানে এখন অনেক বাঙালী।
@শাখা নির্ভানা,
আসলেই ওখানে এখন অনেক বাঙালি ।
নেমেই বাংলা শুনেছি ।
অনেক ধন্যবাদ পড়া ও মন্তব্যের জন্য ।
ভালো লাগলো ভেনিস নিয়ে লেখাটি, গত বৎসর ভেনিসে বেড়াতে যাবার স্মৃতি মনে পরে গেলো। ওয়াটার বাস আর গন্ডোলাতে চড়ে ভেনিস ঘুরে বেড়াবার অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম, বেশ মজার। বুঝা গেলো আপনার ভ্রমনটা বেশ উপভোগ্য হয়েছে। ভেনিসের কিছু ছবি আর তথ্য পাওয়া গেলো, ধন্যবাদ।
@ব্রাইট স্মাইল্,
অনেক ভাল লাগল আপনার মন্তব্য ।
ধন্যবাদ !