১.

আমি যে আইএসপির লাইন ব্যাবহার করি সেই লাইনের আমরা বেশ কয়েকজন নিজেদের মধ্যে অনেক কিছু শেয়ার করি ল্যানের মাধ্যমে। মুভি, বই, রসময়গুপ্ত থেকে শুরু করে পর্ণ কোনটাই আমরা শেয়ারের আওতার বাইরে রাখি না। গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কথা। হাসিনা সরকার বেআইনি ঘোষনা করলেও তার আইনের মুখে মুতে দিয়ে শেয়ার করেই যাচ্ছি। কাজে সুবিধার জন্য ফেসবুকে একটা গ্রুপও খুলে নিয়েছি। নাম “পিনিকবাজের দল”। কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু , যার সাথে স্কুল কলেজে দুটোতেই একই সাথে পড়েছি, আমাকে ফেসবুকে মেসেজ করল গ্রুপে পর্ণ কালেকশন কেমন আছে জানতে চেয়ে। নেওয়া যাবে কিনা? বললাম আলবাৎ যাইব। কেন যাইব না? তবে শর্ত একটাই, তোমার নিজেরও কিছু শেয়ার করন লাগব বাপধন। তো আমাকে লিঙ্ক দিতে বললে আমি বললাম যে একটু অপেক্ষা কর, দিতাছি। ও বলল, তাইলে তুই দে, আমি নামাজটা পইড়া আসি!
কী আর করব, নামাজি বান্দার আবদারতো আর হেলায় ফেলাতে পারি না। দিলাম একগাদা কালকশনের লিঙ্কটা।

২.

আজকে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে ঢুকে দেখি স্কুলের এক বন্ধু একটা ছবি শেয়ার করেছে। কয়েকজন মিলে একটা প্লাকার্ড ধরে রেখেছে বাঙলাদেশ ভারত খেলায় স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারীতে। লেখা “Stop BSF Brutality”। বন্ধুর রাষ্ট্রনীতি সচেতনতা দেখে ভালো লাগল। তারপরে গেলাম “পিনিকবাজের দলে”। গিয়ে দেখি ঐ একই বন্ধু কয়েকটা স্থিরচিত্রের লিঙ্ক দিয়ে বলেছে গিয়ে পছন্দ করতে(ফেসবুকিও ভাষায় Like)। বন্ধুর আবদার রক্ষা করতে গেলাম। গিয়ে পছন্দ না করেই ফেরত আসলাম। এয়ারটেলের স্পন্সর করা একটা প্রতিযোগীতায় সে অংশগ্রহন করেছে। লক্ষ তার হিমালয়। জেতার প্রবল আগ্রহ। জিজ্ঞেস করলাম এই ভন্ডামীর কারন কী? খুবই যৌক্তিক একটা উত্তর দিল। বলল, ঐটা দেশের জন্য, আর এটা আমার জন্য। আমি চুপ মারিয়া রইলাম।

বুঝলাম বন্ধুর চিন্তাভাবনার ধারা। আগায় কোপ, গোড়ায় পানি। বাহ, কী ফানি কী ফানি। দেশাত্ববোধও হল, নিজের ক্যরিয়ারও হল। আবহমানকালের বাঙালি চরিত্র। আমার বিমল আনন্দের খোরাক। সাথে সাথে দুঃষহ বেদনারও।

আমার খুব বেশী ব্লগে ঢোকা হয় না। মুক্তমনায় একমাত্র নিয়মিত। মাঝেমাঝে সচলায়াতন আর সামহোয়্যারে। কথাটা এজন্যেই বললাম যে, ভারত বন্ধের ডাক আসলে প্রথমে কোন ব্লগ থেকে দেয়া হয়েছে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আমি যেহেতু সচলায়তনের মাধ্যমে জেনেছি সেই প্রেক্ষাপট থেকেই বলি।

কিছুদিন আগে যখন ইন্ডিয়া বাঙলাদেশের মধ্যে একটা সাইবার যুদ্ধ যুদ্ধভাব চলছিল, আমার জায়গা থেকে আমি সেটাকে সমর্থন করেছিলাম। আরো অনেককেই দেখেছি সমর্থন করেছে। এবং আরো অনেককে দেখেছি বুদ্ধিজীবির গম্ভীরতা নিয়ে বিরোধীতা করতে। সচলে এ বিষয়ে পোষ্ট দেখেছি।

পহেলা মার্চ আর পনেরেই মার্চ, এ দুটো তারিখে ব্লগিং জগতে অন্তত ভারত বন্ধ পালিত হয়েছে। পহেলা মার্চের বন্ধের ঘটনায় এয়ারটেলের বিচি কাধে না উঠলেও পেটে যে ঢুকেছে সেটা বোঝা গেছে এয়ারটেলের উপহারের বহর দেখে। শুধুমাত্র পহেলা মার্চের রিচার্জেই সম্ভবত ১০০% বোনাস দেয়া হয়েছিল(পরিমানটা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই)। হ্যাকারদের প্রতি আমার নৈতিক সমর্থন ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আমি এই বন্ধেরও পক্ষে। আমি যে জায়গাটায় হতাশায় ভুগি সেটা অবস্থান করছে অন্যখানে ।

আমার মা, টিভির সামনে বসে সাধারনত সন্ধা হবার সাথে সাথেই। ওঠে ১১ কি ১১.৩০টার দিকে। কোন কোন দিন ১২টাও পার হয়। যারা বুঝতে পারছেন না বাঙলাদেশের টেলিভিশনে কী এমন দেখায় যার জন্য এতসময় উনি টিভির সামনে বসে থাকেন, সে সমস্ত মূর্খদের জন্য বলছি পাহারা খাতুনের রঙিন টিভি সাদাকালো করে দেয়া মুখ এবং আBull এর সদাআবুলীয় হাসি ছাড়াও বাঙলাদেশের টিভিতে জি-বাঙলা নামে একটা চমৎকার চ্যানেল আছে। সেটার ইন্দ্রজালে একবার পড়লে আর বের হওয়া সম্ভব নয়। আরো আছে স্টার প্লাস নামে হিন্দিভাষী একটা চ্যানেল(মূলত বিউটিপার্লার এবং পূজামন্ডপ) যার প্রয়োজনীয়তা বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কর্মহীন গৃহিনীদের সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার এবং বাথ্রুমে যাওয়ার মতনই অত্যাবশকীয়। প্রথম প্রথম না বুঝলেও এখন আমি জানি এই আকর্ষনের কারন। একটা ধারাবাহিক শেষ হতে খুব কম করে হলেও ২ থেকে ৩ বছর লাগে। একটা জিনিস শুরু করে তার শেষ না দেখাটা দৃষ্টিকটু।

বাঙলাদেশের যেকোন ছবিতোলার ঘরে আপনি ঢুকে দেখুন, শুধু ভারতীয় চলচ্চিত্রের তারকাদের ছবি দেখবেন। আপনি ভারতেই আছেন কিনা ভেবে বিস্মিত হওয়াটা মোটেই বিস্ময় নয়।
আপনি যেকোন অনুষ্ঠানে যান, হিন্দি ছাড়া আর কোন গান আপনি পাবেন না।
আপনি বর্তমানের ছেলেপেলেদের সাথে কথা বলে দেখুন সরি’র পাশাপাশি এখন হিন্দিও শুনবেন।
এমন কী জাপানিজ একটা কার্টুন “ডোরেমন” যেটা কিনা তুমুল শিশুপ্রিয় সেটাও হিন্দিতে। এবারের বই মেলায় আমার ব্যক্তিগত মতে সর্বাধিক বিক্রিত বই হল ডোরেমন।

প্রথম ঘটনাটা উল্লেখ করেছিলাম, বাঙালি যদি মুসলমান হয় তাহলে তার উভয়সংকটটা কোথায় হয় সেটা বোঝানোর জন্য।

দ্বিতীয় ঘটনাটা উল্লেখ করেছি বাঙালির আন্তর-ইতিহাস বা বাঙালির আসল চরিত্রটা দেখানোর জন্য।
আর আমার মায়ের ঘটনাটা উল্লেখ করলাম বাঙ্গালি যখন কর্মহীন রমনী হয় তখন কী করে বা করছে।

পাত্রপাত্রী যখন এমন চরিত্রের তখন তাদের দিয়ে সিরিয়াস কাজ করতে যাওয়াও সিরিয়াস।

আজকে বাঙলাদেশ ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ কাটাতাঁরময় যোগ ফেলানীময় যোগ হাবু শেখময় যোগ বিএসিএফের যা ইচ্ছা তাময় সম্পর্ককের প্রেক্ষিতে ভারত বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। আগেই বলেছি এর সাথে আছি, আবারও বলছি আছি। কিন্তু ভাবিত হই বাঙালির চিরাচরিত খোলারহস্যের চরিত্র দেখে। এরা হুজুগে কিছুদিন নাচবে, যখন দরকার হবে এয়ারটেলের স্পন্সর করা প্রতিযোগীতায় নাম লেখাবে।
যখন দরকার হবে নামাজের আগে পর্ণ খুজবে(হয়ত বিষন্ন নামাজের বিমর্ষ সময়ে মন ভালো রাখার জন্য)।
আবার যখন দরকার হবে ফেসবুক ওয়ালে ইন্ডিয়া ভাজাভাজা করে ফেলবে। কিন্তু কাজের কাজ হবে না কিছুই। শাসক শাসকের মতনই থাকবে। বাঙালি আজীবন মিউমিউ করে সে পা চেটে দেবে।

বাঙালির গর্ব করার মতন তেমন কোন ইতিহাস নেই। বহু চর্বিত চর্বনে চূর্ণ ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের গল্প ছাড়া বলার মত আর কিছুই নেই। যার জন্য যে কোন ঘটনাতেই এই হজমকৃত ঘটনাদ্বয় ঘুরে দিরে আসে। এই দুই গর্বের কথা চিন্তা করেও যদি বাঙালি পারে তো ভারত বন্ধে হাতে হাত রাখুক। বলুক, ভারতীয় পণ্য ব্যাবহার করব না। ভারতীয় চ্যানেল দেখব না। ভারতীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যাবহার করব না। ভারতীয় ভাষা হিন্দিতে লটপট করব না কথার মাঝখানে। থাপ্পরের জবাবে থাপ্পর না দিতে পারি একটা ঝাড়ি অন্তত দেই, যাতে পরের বার থাপ্পর দেয়ার আগে ভাবনা চিন্তা করে নেয় ভালো মতন করে।

দেশের যৌক্তিক অবস্থানের প্রশ্নে মৌলবাদী হতে হবে। ইতিহাসের মিউমিউ করা প্রজাতীদের মধ্যে শ্রেষ্ট হওয়ায় আজকে বাঙালির এ অবস্থা। দু একটা গৌরব ধুয়েধুয়ে পানি খেতে খেতে ডায়রিয়া হতে চললেও পানি খাওয়া বন্ধ হচ্ছে না। বাঙালিকে এখন জাতিয়তাবাদী মৌলবাদী পানি খেতে হবে। গৌরবের পানি এত বছরে যে নর্দমার পানিতে পরিণত হয়েছে আর চেহারা হয়েছে শুকনো বিচির মত সেটা খেয়াল করে দেখতে হবে। এর চেয়ে জাতিয়তাবাদী ঘোলা পানি অনেক সুপেয় আর মিষ্টি।