প্রলম্বিত অনাবাসী জীবন – সুদূর বাংলাদেশের গ্রামীন কায়িক-শ্রম ভিত্তিক সংস্কৃতি থেকে ক্যানাডার অতি আধুনিক যান্ত্রিক শহুরে সভ্যতায় | উন্নত জীবনের আশায় আর নতুনত্বের সন্ধানে | যদিও নতুনের প্রতি মানুষের এই আকর্ষণ মজ্জাগত, জীবন থেকে পুরাতন সব কিছু ঝেড়ে ফেলে নতুনকে বরণ করার আকুতি মানুষের চিরায়ত রীতি, তবুও আমরা কি ইচ্ছা করলেই পারি আমাদের জীবন থেকে পুরাতন সব কিছু মুছে ফেলতে ! জন্ম আর মৃত্যুর আকরে যেমন আমাদের এই জীবন গড়া তেমনি পুরাতন আর নতুনের মাখামাখিতে আমাদের এই জীবন-পথে চলা | আজ এই বরফজমা তীব্র শীতের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় দশ সহস্র মাইল দূরে ক্যানাডার গুয়েলফ শহরে লিখতে বসে আমার মনে উঁকি দিচ্ছে আমার অতি শৈশবের ফেলে আসা কিছু স্থান, মানুষ আর তাদের ঘটনা | অতি পুরাতন সেই স্মৃতির অনেকটাই আজ সময়ের নিষ্ঠুর আঁচড়ে ছিন্ন-ভিন্ন | তবুও মন সুখ খুঁজে পেতে চায় সেই ছিন্ন-স্মৃতির রোমন্থনে |

আমাদের বাড়ি ও ভাটি অঞ্চল:
বাংলাদেশের যে এলাকাটায় আমার জন্ম সেটি নিচু ভূমি – বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত | সুরমা-কুশিয়ারা -মেঘনার জল ধারায় বাহিত পলি মাটি দিয়ে এই অঞ্চল গঠিত | নদী-খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, সরল-মনা মানুষ আর বাউল-ভাটিয়ালি-জারি-সারি-কবিগান এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য | শীত আর বসন্তে মাঠ জুড়ে বোরো ধানের ক্ষেত, আর বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত অথৈ-অগাধ জলরাশি – তারই মাঝে মাঝে নিভৃত সব পল্লী | এমনি একটি অখ্যাত পল্লীগ্রামে আমার জন্ম | গ্রামটির নাম চাতল পাড় | মেঘনার কূল ঘেষে গ্রামটির অবস্থান | নদীর ঠিক পাড়েই আমাদের পাড়া – নদী থেকে প্রায় একশ গজ হেঁটে গেলেই আমাদের বাড়ি | বর্ষাকালে নদীর দুকূল ছাপিয়ে পাড়ার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা প্লাবিত করে আমাদের বাড়ির ঘাটে জল আসত | জৈষ্ঠ্যের শেষ থেকেই যখন নদীতে একটু একটু করে জল বাড়তে শুরু হত আমাদের ছোটদের মনে তখন আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করত | অপেক্ষা করতে থাকতাম কতক্ষণে আমাদের বাড়ির ঘাটে জল আসবে | রৌদ্র-তপ্ত দুপুরে বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে বর্ষার নতুন জলে চলত আমাদের আনন্দের জলকেলি | সেই জলখেলায় ডাঙ্গায় ছোট ছেলেমেয়েদের নাকি জলে মাছেদের বেশি আনন্দ হত তা বোধ করি আজও গবেষনার বিষয় | মনে পড়ে আমাদের বাড়ির ঘাটে একবার বড়শি ফেলে আমার কাকাবাবু একটা মস্ত বড় বোয়াল মাছ ধরেছিলেন | পাড়ার সবার সাথে সেই বোয়াল মাছ ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ মন থেকে কোনদিনই মুছে যাবে না |

মন খারাপ লাগতে শুরু করত যখন ভাদ্রের শেষে একটু একটু করে জল কমতে শুরু করত | আশ্বিনের প্রথম দিকটায় চলে যাওয়া জলের স্মৃতিচিহ্ন – খস খসে, এবড়ো থেবড়ো আধা ভিজে আধা শুকনো কাদা মাটির দিকে তাকিয়ে বর্ষার চলে যাওয়া জলের জন্য আমার শিশুমন হাহাকার করে উঠত | আজ এত বছর পড়ে হারানো সেই দিনের কথা মনে পড়ে মন ব্যথিত হচ্ছে | ইচ্ছে করছে আবার সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে যেতে | ইচ্ছে করছে, আর একবার হারানো সেই বন্ধুদের সাথে মিলে নব বর্ষায় বৃষ্টি-স্নাত হয়ে বর্ষার নতুন জলে অবগাহন করে এতো বছরের জড়ো হওয়া জীবনের সব ক্লান্তি আর শ্রান্তি ধুয়ে মুছে ফেলতে !!

ক্ষীরোদ পোদ্দার, লক্ষ্মীর মা এবং বোনদুদু:
আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনদিকটায় ছিল আমার মার এক মামার বাড়ি | নিম্ন-বিত্ত একটি পরিবার | সংসারের টানা- পোড়েনের মধ্যেও মার মামা ক্ষীরোদ পোদ্দার ছিলেন সর্বদা সাদা ধূতি পরিহিত সদা হাস্যময় এক অসাধারণ মানুষ | পাড়ার সব ছোট ছেলেমেয়েদের তিনি ছিলেন বন্ধু |

প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিনে আমাদের গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় কীর্তনের দল আসত | তারা প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি যেত | মানুষ বাতাসা আর কদমা লুট দিত | শিশুরা তা কুড়িয়ে অগাধ আনন্দ পেত | সেই দিনে ক্ষীরোদ পোদ্দার আমাদের পাড়ার সব ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা কীর্তনের দল গড়তেন – তিনি খোল বাজাতেন – আর আমরা ছোটরা বাজাতাম করতাল | কীর্তন করতে করতে আমরা সবার বাড়িতে যেতাম – লুটের বাতাসা আর কদমা কুড়িয়ে আমরা সেদিন সারাদিন ভরে মনের আনন্দ জোয়ারে ভাসতাম |

ক্ষীরোদ পোদ্দারের দুই মেয়ে শেলী মাসী আর খেলা মাসী আমার ছোট্টবেলার খেলার সাথী | আমি তখন সবে মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি | বছর না পেরোতেই একদিন শুনলাম তারা ভারতে চলে যাচ্ছে | খেলতে খেলতে শেলীমাসীই একদিন কথাটা বললো | তার কিছুদিন পরই তারা দেশ ছেড়ে চলে গেল | দীর্ঘদিন তাদের শুন্য বাড়িটা শুন্যই পড়ে থাকলো | তারা চলে যাবার কিছুদিন পরই সারা গ্রামে রটনা হলো – ভারত সরকার আরো অনেক শরণার্থীর সাথে ক্ষীরোদ পোদ্দারের পরিবারকেও দন্ডকারন্যে পাঠিয়ে ছিল এবং ক্ষীরোদ পোদ্দারকে সেখানে বাঘে খেয়ে ফেলেছে | সেই সংবাদ শুনে আর দন্ডকারন্যের নাম শুনে আমার শিশুমনে বড় ভয় হলো আর শেলীমাসী ও খেলামাসির পিতৃহারানোর বেদনায় চোখে জল এলো |

আমাদের বাড়ির ডানদিকটার বাড়িটা ছিল লক্ষ্মীর মা’র | আমাদের মতো তাঁরও বড় বাড়ি | দুই বাড়ির মাঝখানে বাঁশের হালকা বেড়া | আমাদের বাড়ির উঠান থেকে তাঁর বাড়ির পুরোটাই দৃষ্টিগোচর হতো | তাঁকে প্রায়ই দেখতাম উঠানে আর তাঁর ফল বাগানে শাদা শাড়ি পরে একা একা কাজ করতে | মার কাছে জেনেছিলাম তিনি বিধবা | তাঁর মেয়ে লক্ষ্মী যখন খুবই ছোট তখন তিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন | লক্ষ্মীর বিয়ে হয়ে গেছে তাও অনেক আগে | মনে পড়ে আম আর পেয়ারার মৌসুমে তিনি পাড়ার সব ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে আম আর পেয়ারা বিলোতেন | সেই সুবাদে আমিও গিয়েছি তাঁর বাড়িতে কয়েকবার – কিন্তু তাঁকে সব সময়ই দেখতাম একা – লক্ষ্মীকে কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়ে না | তাঁকে কি সম্বোধন করতাম তাও আজ এত বছর পরে আর মনে নেই – তবে পাড়ার সবার কাছেই তিনি ছিলেন লক্ষ্মীর মা নামেই অধিক পরিচিত | তখন আমি সবে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠেছি – তিনি তাঁর একার এত বড় বাড়িটা বিক্রি করে একদিন ত্রিপুরার আগরতলায় চলে গেলেন | তাঁর সাথে আমাদের পরিবারের খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল বলে মনে পড়ে না | কিন্তু তবুও লক্ষ্মীর মা’র ফেলে যাওয়া বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অনেকদিন আমার শিশুমন যেন কেমন উদাস হয়ে যেত |

আমাদের বাড়ির ঠিক বামপাশটায় ছিলেন বিধবা-বয়স্কা-সাধ্বী অনন্যাসাধারণ এক ভদ্র মহিলা আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া তার অশীতিপর বৃদ্ধা মা | পাড়ার সকল বড়দের নিকট তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন মাসীমা আর আমরা ছোটরা তাঁকে ডাকতাম “বোনদুদু ” বলে | ছোটদের তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং ছোটরাও তাকে খুবই ভালবাসত | বোনদুদুর মা ছিলেন আমাদের সকলের বড়মা |

তাঁদের বাড়িটা ছিল ইটের পুরনো একতলা দালান বাড়ি | সিঁড়ি দিয়ে তাঁদের দালানের সদর দরজায় উঠলে তার পাশেই ছাদে যাওয়ার বাঁকানো সিঁড়ি | আমরা শীতের সকালে প্রায়শ-ই সেই ছাদে যেতাম সকালের প্রথম মিষ্টি রোদের পরশ পেতে | তাঁদের দালানের পিছনদিকটার বারান্দায় প্রতিদিন ভোরে আর বিকালে তিনি বাচ্চাদের পড়াতেন | তিনি ছিলেন পাড়ার প্রায় সকল বাচ্চাদের বাল্য শিক্ষক | আমারও শিক্ষা জীবনের হাতে কড়ি তাঁর কাছেই |

বোনদুদু আর বড়মার সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁরা দুজনেই ছিলেন একনিষ্ঠ কৃষ্ণ-ভক্ত এবং তাঁদের বাড়িটা ছিল কৃষ্ণ মন্দির | তাঁদের দালানের মাঝখানের সবচেয়ে বড় কক্ষটা ছিল ঠাকুর ঘর, সেই ঘরে কালো মার্বেল পাথরের শ্রী রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি | মা’র কাছে শুনেছি খুব অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পর থেকেই তিনি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের নিত্য পূজারী | প্রতিদিন তিন বেলা তিনি রাধা-কৃষ্ণের পূজা-ভজন করতেন | সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ি থেকে কাঁসর আর করতালের শব্দ শুনা যেত – সেই শব্দ শুনে আমি দৌড়ে যেতাম প্রসাদ খাওয়ার জন্য | প্রতি সন্ধ্যায় পাড়ার বউ -ঝি আর বাচ্চাদের নিয়ে ভজন সহ সন্ধ্যারতি হত | আমার ছোট পিসিকে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় সেই সন্ধ্যারতিতে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি | প্রতি পৌষ মাসে এক মাস ব্যাপী ভোরে মঙ্গলারতি হত | আমরা ছোটরা সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝাঁঝ আর ঘন্টার শব্দ শুনে সেখানে দৌড়ে যেতাম প্রসাদ লাভের জন্য |

বোনদুদু আর বড়মার জীবনে শ্রী রাধা-কৃষ্ণের নিত্যপূজা পরিনত হয়েছিল তাদের প্রাত্যহিক নিত্যকর্মে | পাড়ার ছোটদের পড়িয়ে আর কৃষ্ণ-সেবা করে তাঁদের জীবন ভালই চলছিল – কিন্তু কি জানি কেন বিধি বাধ সাধলেন | বাংলাদেশের অনেক হিন্দু পরিবারের মতই তাঁদেরও একজন গুরু-গোঁসাই ছিল | সেই গোঁসাইয়ের পরামর্শে তাঁরা একদিন মন্দির-বাড়ি বিক্রি করে দিলেন | গোঁসাই তাঁদের ভারতে নিয়ে যাবে এই আশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এত বছরের সাধনার স্থান ত্যাগ করে হতভাগ্য বোনদুদু আর অতিবৃদ্ধা বড়মা দূরে কোন এক গ্রামে গোঁসাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন | পরে সবার মুখে মুখে রটনা থেকে জেনেছিলাম গোঁসাই তাঁদের সাথে প্রতারণা করে সব টাকা আত্মসাত করেছিল | শ্রী কৃষ্ণের পরম ভক্ত সতী-সাধ্বী বোনদুদু আর বড়মা শোকে-দুঃখে তিল তিল করে শুকিয়ে একদিন সেই গোঁসাইয়ের বাড়িতেই দেহত্যাগ করলেন | আজ এত বছর পরেও আমার পরম শ্রদ্ধেয় বোনদুদু আর বড়মার কথা লিখতে গিয়ে আমার মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হচ্ছে !

সুভদ্রা আর সুচিত্রা:
সুভদ্রা আর সুচিত্রা আমার বাবার খুড়তুতু ভাইয়ের দুই মেয়ে | সেই সম্পর্কে তারা আমার খুড়তুতু বোন | আমাদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পরেই ছিল তাদের বাড়ি – নদীর কূল ঘেঁষে আমাদের পাড়ার প্রথম বাড়ি | সেই বাড়িটাতে ছিল বাবার তিন খুড়তুতু ভাই | ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাসে তাদের তিন ভাইই অনেকগুলো অনাথ সন্তান ফেলে রেখে তাদের পত্নীদের সহ অল্প বয়সেই কলেরায়, বসন্তে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন | স্রোতস্বিনী মেঘনার পাড় ঘেঁষা এই বিশাল বাড়িটায় এতগুলো পিতৃ-মাতৃহারা অসহায় সন্তানদের কি অবস্হা হয়েছিল তা পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন | আমি তাদের করুন পরিণতির বর্ণনা দিয়ে পাঠক হৃদয়কে আর অধিক দুঃখ ভারাক্রান্ত করতে চাই না | আমার এ কাহিনী শেষ করব কেবল শিশু সুভদ্রা আর সুচিত্রার একটা ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা দিয়ে |

তখন ভরা বর্ষাকাল | চারিদিকে অথৈ জল | সুভদ্রা আর সুচিত্রাদের উঠানে জল ছুঁই ছুঁই | আষাঢ়ের বৃষ্টিহীন কাঠফাটা রোদের একটি মধ্য দুপুর | জলে অনেক ছেলেমেয়ে তখনও ঝাপাঝাপি করছে | সুভদ্রাদের বাড়ির ঘাটে একটা ছই-ওলা নৌকা এসে ভিড়ল | জলে ক্রীড়ারত ছেলেমেয়েরা জলকেলি ফেলে নৌকার পাশটায় এসে দাড়ালো | ডাঙায় সুচিত্রাদের ঘাটে আমি, আমার ভাইবোন এবং পাড়ার আরো অনেক ছেলেমেয়ে | অনাথা সুভদ্রা-সুচিত্রা তাদের মামার সাথে তাদের মামাবাড়ি কলিকাতায় চলে যাচ্ছে | কলিকাতা তখন আমার মনে এক অজানা দেশের অচিনপুরী | সুভদ্রা-সুচিত্রার নৌকায় আরোহনের দৃশ্য দেখে আমার মন কেঁদে উঠলো, চোখ দিয়ে অঝোরে জলের ধারা বইতে শুরু করলো ! আমার কচি মনে একটা বড় প্রশ্ন এসে দেখা দিল – কেন এই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি আর অবাধ জলকেলি ফেলে রেখে সুভদ্রা-সুচিত্রা অজানা আর অচেনা – সুদূরের দেশ কলিকাতায় চলে গেল |

একটু বড় হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ছুটি ” গল্পের ফটিকের কাহিনী পড়ে সুভদ্রা আর সুচিত্রার কথা আবার মনে পড়লো | কিন্তু মহানগরী কলিকাতায় তাদের মামাবাড়িতে গিয়ে তাদের কি পরিনতি হলো – তা আর কোনদিনই আমার জানা হলো না !

পাদটীকা:
একটু বড় হয়ে কানন বালা দেবীর গানে “চাতল পাড়”-এর উল্লেখ দেখে আমাদের গ্রামটিকে আর অখ্যাত গ্রাম বলে মনে হত না !

১৯৯৩ সালে কর্মোপলক্ষে ভারতের উত্তর প্রদেশের পান্টনগর কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল | সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমাদের ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজারের মতই একটা ছোট্ট বাজার আছে এবং সেখানে সপ্তাহে একদিন হাটও বসে | হিন্দুস্তানি অধ্যাপক ড: শ্রীবাস্তবা-এর বাসায় সেদিন রাতে আমার খাওয়ার নিমন্ত্রণ | অধ্যাপক মহাশয় সেদিন বিকালে আমাকে নিয়ে সেই হাটে গেলেন তরিতরকারি কিনতে | সেখানে দূর থেকে সবজি বিক্রেতা এক দম্পতিকে দেখিয়ে তিনি আমাকে বললেন তারা বহু বছর আগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি | অনেকটা অবাক হয়ে এই সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমি তাদের সাথে গিয়ে বাংলায় কথা বললাম | তারা স্পষ্ট বাংলায় আমাকে জানালো ভারত বিভাগের পর খুব ছোট বেলায় তারা বাবা-মার সাথে শরণার্থী হয়ে এখানে চলে আসে | পড়ে ড : শ্রীবাস্তবা আমাকে জানালেন দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অনেক বাঙালি শরণার্থীকে সরকার পান্টনগরের জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে পুনর্বাসনের ব্যবস্হা করেন, কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তাদের বেশির ভাগই বন্য মশার কামড়ে ম্যালারিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় |

মনে প্রশ্ন জাগে – ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলো – বাংলা দুভাগ হলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে – দুই ভুখন্ডেই অনেকেরই নেতা হওয়ার সুযোগ হলো – তাদের পোয়াবারো হলো, কিন্তু দুই বাংলার সংখ্যালঘুরা কি পেল ? পান্টনগরে বন্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়া অনেক শরণার্থীর মত আরো অসংখ্য শরনার্থী অচিনদেশের অজানা পরিবেশে অসহিষ্ণু জাতের রোগ জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করলো | আন্দামান -নিকোবর আর দন্ডকারন্যে নির্বাসিত হয়ে ক্ষীরোদ পোদ্দারের মত অনেককেই বাঘের হাতে প্রাণ বিসর্জন করতে হলো | বিধবা লক্ষ্মীর মা’কে তার অতি পরিচিত জগত ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হলো | আমার সহজ সরল বোনদুদু আর বড়মাকে ভারত যাওয়ার লোভে পরে ভন্ড গোঁসাই দ্বারা প্রতারিত হয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করতে হলো !!

আমরা অনেকেই ঈশ্বরের কাছে নিয়ত প্রার্থনা করি, তাঁর পূজা করি, তাঁর ভজন-সাধন করি | পাঠক আগেই জেনেছেন – আমার সেই বোনদুদু আর বড়মা ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একনিষ্ঠ সেবিকা – বৈধব্যকে ধারণ করে সারাটা জীবন তাঁরা কাটালেন শ্রী রাধা-কৃষ্ণের পূজা-ভজন করে | মনে কি প্রশ্ন জাগে না – সেই একনিষ্ঠ পুজারী সরল সহজ বোনদুদু আর বড়মা যখন সেই কপট গোঁসাইয়ের কবলে পতিত হলেন – তখন তাঁদের এই ঘোর বিপদের দিনে শ্রী ভগবান কৃষ্ণ চন্দ্র কোথায় ছিলেন ? কেন তখনো শ্রীমতি রাধিকা দেবী নীরব-নিথর ছিলেন ?

আমরা অনেকেই এক সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি | আবার আমরা অনেকেই কথায় কথায় বলে থাকি – “ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন” | যে কোন চিন্তাশীল মনে কি প্রশ্ন জাগে না কি সেই “মঙ্গলের ” জন্য ভগবান সুভদ্রা আর সুচিত্রার মত লক্ষ লক্ষ শিশুকে অনাথ আর আশ্রয়চ্যুত করেন ??

শেষ কথা:
আমাদের এই জীবন পথে চলতে গিয়ে আমরা সারা জীবন ভর অসংখ্য মানুষ আর ঘটনার সন্মুখীন হই | তার সব স্মৃতি ইচ্ছা করলেও মনে ধরে রাখা যায় না, আবার অনেক স্মৃতি শত চেষ্টা করেও মন থেকে বাদ দেয়া যায় না – কি জানি কেমন করে মনের অজান্তেই মনের এক কোনে এসে বাসা বেঁধে থাকে ! আমিও জীবনের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক কিছুরই সাক্ষাত পেয়েছি, তার অনেক কিছুই মন থেকে মুছে গেছে – কিন্তু আমার জীবন থেকে আজও মুছে যায়নি ক্ষীরোদপোদ্দার, লক্ষ্মীর মা , বোনদুদু আর বড়মার স্মৃতি !, মুছে যায় নি পিতৃ-মাতৃহীন অনাথা আর অসহায়া সুভদ্রা আর সুচিত্রার স্মৃতি যারা একদিন অতি পরিচিত নিবিড় পল্লীর মায়া ছেড়ে মহানগরী কলিকাতার জনসমুদ্রে ডুবে হারিয়ে গিয়েছিল !!