(নালন্দা নিয়ে নালন্দার ধ্বংস বনাম ধর্মীয় বিজয় নামের একটা লেখা দেয়ার পর কিছু পাঠক আগ্রহ প্রকাশ করেন তক্ষশীলা, সোমপুর ইত্যাদি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি গুলো নিয়ে আলোকপাত করতে। পাঠকদের উৎসাহে তারি ধারাবাহিকতা রক্ষায় রত্নগর্ভা তক্ষশীলার পর আজকের আয়োজন পালকীর্তি পাহাড়পুর তথা সোমপু্র)

ইতিহাসে সভ্যতা, শিক্ষা, সংষ্কৃতি ও শিল্প ভাষ্কর্যের গৌরবের জাজ্বল্যমান সাক্ষ্যি হয়ে যে কয়টি পুরাতাত্মিক নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে তাদের মধ্যে পাহাড়পুর বিহার অন্যতম। ইউনেস্কো ঘোষিত তালিকায় এই পাহাড়পুর বিহারকে ৩২২তম বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে (২-৬) ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐহিত্য রক্ষা কমিটির এক সমাবেশে এই বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের গৌরব প্রদান করা হয়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, পাহাড়পুরের গঠন শৈলী তাদের মধ্যে অন্যতম সেরাদের একটি। সেই সুবাদে পর্যটনে হতদরিদ্র বাংলাদেশে দেশী বিদেশী ভ্রমণ বিলাসী মানুষের কাছে অন্যতম পর্যটন আকর্ষণের মূর্ত প্রতীক রূপে অবর্তীণ হয় পাহাড়পুর। এই বিহার বাংলায় পাল রাজত্বের আরেকটি অনন্য বিস্ময়কর কীর্তি।

৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে গৌড় রাজ শশাঙ্কর মৃত্যু হলে উপযুক্ত ন্যায়পরায়ন বলিষ্ট প্রজ্ঞাবান দেশ শাসকের অভাবে বাংলার ইতিহাসে সূচনা হয় হতাশা নৈরাজ্য কুয়াশার কালো চাদরে ঢাকা এক তিমির যুগের। এই যুগের দেড়শো বছর পার হয়ে যায় দেশ জুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ, অত্যাচার অনাচার, হত্যা, লুন্ঠন ইত্যাদি নানান অপকর্মের বন্যায়। পারষ্পরিক অবিশ্বাস, দলাদলি ও প্রশাসনিক দূর্বলতার কারণে বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়ে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে। সমাজে অনাকাঙ্খিত গৃহ বিবাদ, নানা অরাজগতা বিশৃঙ্খলার কারণে যুগটি বাংলার ইতিহাসে অভিহিত হয় “মাৎস্যন্যায়” কাল হিসাবে। বাংলার এই চরম নিপতিত দূর্গত অবস্থা থেকে উত্তরণের আশায় সাধারণ মানুষ বেছে নেয় গোপাল নামক এক ন্যায়বান ধর্মপরায়ন সামন্তরাজাকে বাংলার রাজা হিসেবে। শুরু হয় বাঙালী পালযুগ নামে এক নব যুগের পদচারনা। আনুমানিক ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ প্রায় ৪০০ বছরের অধিক সময় পাল রাজারা বাংলা শাসন করেন। গোপাল হলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাসক। তিনি ছিলেন আরেক ইতিহাস খ্যাত মগদের ওদন্তপুরি মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা। মগধের (পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত ছিল) এই ওদন্তপুরি বিহারেই সম্ভ্রান্ত বংশিয় বঙ্গিয় যুবক আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসাবে দীক্ষা নিয়ে অতীশ দীপঙ্কর নাম ধারণ করে অসামান্য পান্ডিত্যের ছাপ রাখেন বাংলা ইতিহাসে। মাত্র ৩১ বছর বয়সে তিনি মেধায় মননে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বিক্রমশীলা ও সোমপুর(পাহাড়পুর) বিহারের শিক্ষক ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে তিনি প্রায় ১৭৫টি বই লেখেন বলে জানা যায়। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গোপাল নালন্দায় একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দৌহিত্র আরেক রাজা দেবপাল নালন্দার উন্নয়ন কল্পে পাঁচটি গ্রাম দান করেন।

রাজা গোপালের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ধর্মপাল। এই পাহাড়পুর মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ধর্মপাল। বিহার রাজ্যে তাঁর পিতার গড়া ওদন্তপুরী বিহারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেন বিদ্যানুরাগী ধর্মপাল। তাঁর ঐকান্তিক সহযোগিতায় এই ওদন্তপুরী পরে মর্যাদা পায় ভারতবর্ষের শিক্ষা ইতিহাসের ২য় প্রাচীণ বিশ্ববিদ্যালয় রূপে। তিব্বতীয় এক সূত্র থেকে জানা যায় এখানে ১২,০০০ ছাত্র লেখাপড়া করত। এছাড়া শিক্ষা বিস্তারে ধর্মপালের আরো একটি অসামান্য কীর্তি বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় যা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিহার রাজ্যের ভাগালপুরে। লক্ষ্যনীয় প্রাচীণ ভারতের নালন্দা, ওদন্তপুরি, বিক্রমশীলা, জগদ্দল, সোমপুর সব গুলো বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক সময় বৌদ্ধধর্ম প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে। কিন্তু দূরদর্শী ও জ্ঞান তাপস বৌদ্ধভিক্ষুদের কল্যাণে ও শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার যৌথ প্রয়াসে শিক্ষা বিস্তার ও জাতি উন্নয়নের মহৎলক্ষ্যে এক একটি মহাবিহার ধীরে ধীরে ধর্মের গণ্ডি পেরেয়ি রূপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, জ্ঞান সাধনার আখড়াতে। এই সব বিহার ভরে ওঠে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম, চিকিৎসা, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি গ্রন্থ, পুঁথিতে ঠাসা সব গ্রন্থাগারে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলুর নিয়ম নীতি, আইন কানুন ভিক্ষুদের দ্বারা পরিচালিত হলেও ভর্তি যোগ্যতার মাপকাঠিতে ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রদের বৌদ্ধ হওয়ার কোন পূর্ব শর্ত ছিল না। ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন জাতির, ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষার যে কোন উপযুক্ত বিদ্যাউৎসাহীর জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল সব সময়। বর্তমানে “শিক্ষার জন্য চীন দেশে যাও”- নিয়ে এক শ্রেণীর লোক বাক্যটি বহুল ব্যবহার করেন কিন্তু সেই চীন দেশের লোকেরা দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে আমাদের ভারতবর্ষে আসত সুশিক্ষার নিমিত্তে, এ কথাটি কেন যেন অপ্রচারিত থেকে যায়। কথিত আছে, ধর্মপাল নাকি ৫০টির মত বৌদ্ধ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন যেখানে সবার লেখাপড়ার সমান সুযোগ বজায় ছিল।

নালন্দার মত ওদন্তপুরি ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় দু’টিকেও আক্রমণ করে ভিক্ষুদের মেরেকেটে ও লুঠতরাজ করে বইগুলোতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর শিক্ষা বিস্তার প্রচেষ্টার কফিনে শেষ পেরেক টুকে বিজয়ের পতাকা (ধর্মান্ধদের ভাষায়) উড়ান দূর্ধর্ষ লুটেরা (সাম্যবাদীদের চোখে) বখতিয়ার খিলজী।

বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল কাশ্মিরে এক সময় প্রচুর বৌদ্ধনুসারীর বসবাস ছিল। শাক্য শ্রীভদ্র নামে এক প্রসিদ্ধ কাশ্মিরী বৌদ্ধভিক্ষু সেই সময়ে ভ্রমণ উদ্দেশ্যে এবং তীর্থদর্শন-মানসে মগধে আসেন। তিনি ওদন্তপুর এবং বিক্রমশীলা বিহারে ধ্বংসস্তূপ দখে ক্ষুব্ধ এবং মগধে তুর্কীজাতির সংখ্যাধিক্যে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে বিহার ত্যাগ করে উত্তরবঙ্গের জগদ্দল বিহারে আশ্রয় গ্রহণ করেন(History of Bengal, Dacca University, Vol, II, p.3)।

আবার মূল প্রসঙ্গ অর্থাৎ পাহাড়পুর বিহার নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসি। এই বিহার আবিষ্কারের পূর্বে লামা তারানাথ নামের এক তিব্বতীয় ঐতিহাসিকের লেখা ইতিহাস থেকে এই সোমপুর বিহার নামে এক বিহারের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্নতাত্বিকগণ প্রথম ধারনা পান।

অষ্টম শতাব্দির শেষদিকে বিহারটি নির্মাণ করেন ধর্মপাল। বিহারটির অবস্থান নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলাতে। পাল আমলে এই এলাকার নাম ছিল সোমপুর। অনেকে ওমপুরও বলে থাকেন। এলাকার নামানুসারে বিহারটির নাম রাখা হয় সোমপুর বিহার। বিহারটির মূল মন্দিরের উত্তর-পুর্ব অংশে ৮নং বাহু সংলগ্ন স্থানের ধ্বংসাবশেষ হতে প্রাপ্ত চওড়া দেয়ালের নমুনা বিশ্লষণের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতকের দিকে এখানে কোন জৈন মন্দির ছিল। ঐ সময় এলাকাটি পরিচিত ছিল বটগোহালী নামে। পরে কোন কারণে জৈন মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানে নতুন করে বিহার নির্মাণ করেন ধর্মপাল। এই বিহার তৈরীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জৈন মন্দিরের কিছু উপকরণ পুনঃব্যবহার হয়েছিল। উপকরণ গুলোর মধ্যে ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতকে প্রচলিত কিছু ভাষ্কর্যের নমুনা পাওয়া যায়। বিহারটি আয়তনে এত বিশাল ছিল এ রকম আর ২য় কোন বিহারের সন্ধান মেলেনি অখন্ড ভারত উপমহাদেশে। মোট ২৭ একর জমির উপর বিহারটি অবস্থিত ছিল। বিস্ময়কর মূল মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন। অসাধারণ এর শৈল্পিক পরিকল্পনা। মন্দিরের দেয়াল জুড়ে পাওয়া যায় প্রায় ২ হাজারটি অপূর্ব পোড়ামাটির ফলকচিত্র। এতে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রাচীণ বাংলার সাধারণ জনজীবনের প্রত্যাহিক প্রতিচ্ছবি। যেমনঃ- মানুষ, শিকারি, নৃত্যরত রমণী, রাখাল, গাছপালা, ফুল, পশু-পাখি, হাতি, ঘোড়া আরো কত কি। চারিদেকে তাকালে চোখে পড়ে নান্দনিক শিল্প সুষমার সমাহার। মূল মন্দিরটি ছিল বিহারের মাঝখানে। এটি ধাপে ধাপে পিরামিডের মত করে উপরের দিকে উঠে গেছে। এখানে ছিল প্রদক্ষিণ পথ। এই মন্দিরটির চূড়া এতই উঁচু ছিল এ সম্পর্কে এক বর্ণনায় বলা হয়েছে- “এটি সূর্যের গতি রোধকারী”, মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, প্রস্থ ৩৫০ ফুট। প্রধান মন্দিরটি তৈরী করা হয়েছিল ইটের সাথে কাদা মাটি মিশিয়ে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই মন্দিরের নয়নাভিরাম গঠন শৈলী পরবর্তীতে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল বার্মা, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার জাভা আর বালি দ্বীপের বিভিন্ন বিহার নির্মাণকে। পুরো বিহারটা ঘেরা ছিল ইটের বেষ্টনি দিয়ে। বিহারের মূল বেষ্টনির যে দেয়ালটি পাওয়া গেছে তা ২০ ফুট চওড়া। বেষ্টনির ভিতরে আরো ছোট ছোট অনেক মন্দিরের উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিহারটির আয়তন উত্তর দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পুর্ব পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। মূল মন্দিরের চারপাশে রয়েছে ১৭৭ টি কক্ষ। যেখানে ভিক্ষুরা বাস করতেন বলে অনুমান করা হয়। এই সব প্রতিটি কক্ষের দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট আর প্রস্থে ১৩ ফুট। প্রায় ৮শ’জন ভিক্ষুর বাসোপযোগী ছিল এই বিহার। প্রত্যেকটি কক্ষে প্রবেশের জন্য আছে ছোট ছোট দরজা। ঘরগুলোর সামনে দিয়ে চলে গেছে লম্বা বারান্দা। আবিষ্কৃত হওয়ার পর যে অংশটুকু আমরা পাই তা কেবল নীচের অংশ। বর্তমানে এর উচ্চতা ৭০ ফুট। উপরের চূড়ার দেয়াল ও ছাদ আবিষ্কারের বহু পূর্বেই বিলীন হয়ে গেছে। যে অংশটুকু অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে তার দৈর্ঘ্য ২৮০ মিটার আর প্রস্থ ২৮১ মিটার। সদর তোরণের দুই প্রান্তে দুটি হলঘর ও দুই পাশে একাধিক প্রহরী কোঠা পাওয়া যায়। পূর্বদিকে উত্তর কোণের কাছে একটি ছোট আসা যাওয়ার গলি এবং পূর্ববাহুর মাঝামাঝিতে পাওয়া যায় আরো একটি গোপন গলি পথের ব্যাবস্থা। এ ছাড়া বিক্ষিপ্ত ভাবে পাওয়া যায় প্রশাসনিক ভবন, রান্না ঘর, ভোজন শালা, নিবেদন স্তুপ, কুয়ো ইত্যাদি।

পোড়ামাটির চিত্র ফলক

১১শ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলার শাসন পালবংশ থেকে কেড়ে নেয় ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা গোড়া ব্রাহ্মণ সেনরা। ফলে এই সব বিহারগুলো থেকে দ্রুত সরে যায় প্রশাসনের শীতল ছায়া। ইতিহাস থেকে মুছতে শুরু করে সোমপুর বিহারের অগ্রযাত্রা। পাল শাসন আমল থেকে বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণ আর সেনবংশের বাংলা শাসন কালে বাঙাল সেনারা আগুন দিয়ে এই বিহারে পুড়িয়ে দিলে এখানে বসবাসরত ভিক্ষুরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেন আমলেই গোঁড়া ব্রাহ্মণদের চাপে সব গৌড়ব হারিয়ে জনশুন্য হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে যায় সোমপুর বিহার। প্রকৃতি যেন অনেকটা বাধ্য হয়ে পূর্বপুরুষদের শিক্ষা সভ্যতার গৌরব চিহ্ন উত্তর পুরুষদের হাতে সঁপে দিতে নিজ দায়িত্বে যুগ যুগ ধরে এ বিহারটকে আচ্ছাদন করে লুকিয়ে রাখে ধুলোর মলিন চাদরে। ধুলোর চাদর পুরু হতে হতে রূপ নেয় এক বিশাল পাহাড়ের। তাতে জন্মে হরেক রকম গাছ গাছালি, লতাপাতা, বটপাকুড়ের চারা, সবুজ ঘাস। তৈরী হয়ে যায় ঘন জঙ্গল। প্রকৃতির এই বদন্যতায় সোমপুর বিহারের নাম হারিয়ে নতুন নাম হয় পাহাড়পুর বিহার।

সময়ের আঁকাবাঁকা রুক্ষ্ম পথ বেয়ে সেন আমল পেরিয়ে বাংলা আসে মুসলমানদের দখলে, তারপর আবার হাত বদল হয়ে আসে ইংরেজ শাসন। ইংরেজ রাজত্ব চলাকালীন সময়ে বুকানন হ্যামিল্টন নামে এক ইংরেজ সাহেব আসেন ভারতবর্ষে। মাটি খুঁড়ে প্রাচীণ ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের মত বিচিত্র সব খেয়ালি শখ ছিল তাঁর। কি করে যেন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়পুরের খবরটা তাঁর অনুসন্ধিৎসু কানে গিয়ে পৌঁছে গেল। ১৮০৭ সালে একদিন তিনি গিয়ে হাজির হলেন এই জনমানবহীন ঘন গাছ গাছালি ভরা পাহাড়ের ঢিবিতে। সেখানে তখন ছিল শুধু হিংস্র সাপ, চিতাবাঘ ও কিছু বন্য জন্তুর আনাগোনা। মাটির ঢিবির ফাঁকে লাল ইটের সারি দেখে তাঁর জহুরি চোখ বুঝে নিল এখানে লুকিয়ে আছে কোন অমূল্য পুরাকীর্তি নিদর্শন। কিছু একটা আবিষ্কারের খুশিতে চাপা উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে ফিরে এসে ইউরোপের কয়েকটি জার্নালে প্রচার করলেন তাঁর অনুমানের কথা। এই সূত্র ধরে এলেন ওয়েষ্ট ম্যাকট। এলাকাটি পূর্ণ জরিপ করে তিনি ফিরে গেলেন। চারদিকে ফিসফিসানি ক্রমেই বাড়তে থাকল। এরপর ১৮৭৯ সালে তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম স্বয়ং এলেন খনন অভিযান চালাতে। তিনি কিছু খনন কাজ চালাতেই বলিহারের জমিদার কোন এক অজানা কারণে সেই কাজে শুরু করে দিলেন প্রচন্ড বিরোধীতা। স্বল্প খনন করেই তিনি ফিরে গেলেন কিন্তু বুঝে গেলেন এই পুরাকীর্তির মহাত্ম। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯০৪ সালে পাহাড়পুরকে আনা হয় পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের অধীনে। এতে প্রশাসনিক কিছু সুবিধা পাওয়া গেল বটে কিন্তু এত বিশাল খনন কাজ চালাতে নতুন বাধা হিসাবে আবির্ভাব হল টাকা। চাই খনন কাজে প্রচুর টাকা, এত টাকা জোগাড় হবে কোথা থেকে? কে যোগাবে এত টাকা? এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন বিদ্যানুরাগী পুরাকীর্তি প্রেমী দিঘাপতিযার রাজা শরৎকুমার। তাঁর আর্থিক সহযোগিতা আর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টার সমন্বয়ে ১৯২৩ সালে পূর্ণদ্যমে শুরু হল পাহাড়পুরের খনন কাজ। এর প্রায় দু’বছর পর সেই কাজে যোগ দিলেন বাংলার আরেক খ্যাতিমান প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়। এবরো থেবরো যোগাযোগ ব্যবস্থা, তাবু খটিয়ে রাত্রি যাপন, বিষাক্ত পোকা মাকড় ও বন্য জন্তুর ভয় ইত্যাদি নানান প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে যতই মাটি খুঁড়াখুঁড়ি চলতে থাকল ততই বেরিয়ে আসতে শুরু করল একের পর এক সারি সারি পোড়ামাটির ফলকচিত্র, হলঘর, মন্ডপ, বেদী, নিবেদন স্তুপ, লোহার রড, তামার হাঁড়ি, ৩০টি তামার মূদ্রা, মূর্তি, “ধর্মসেন” ও “সিংহসেন” নামের পোড়া মাটির সীল মোহর, আরো একটি সীল মোহরে পাওয়া গেছে যেখানে লেখা আছে “সোমপুরস্থিত ধর্মপাল মহাবিহারের ভিক্ষুসঙ্ঘ” ইত্যাদি আরো নানান বিস্ময়। দীর্ঘ এগারো বছর ধরে টানা চললো এর খনন কাজ। এরপর উন্মোচিত হল আজকের বিস্ময় পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ।