[ স্বীকারোক্তি : সুপ্রিয় পাঠকদের কাছে প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি, গত পর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে এটা হবে শেষ পর্ব। কিন্তু সে মোতাবেক কাজ করতে গিয়ে দেখা গেলো, পর্বটা পাঠকের বিরক্তি উৎপাদনের চাইতেও দীর্ঘ হয়ে যায়। তাই সবার কাছে আরেকটি পর্ব ধার চেয়ে নিচ্ছি। আগামী পর্বে নিশ্চয়ই সিরিজটা শেষ করতে পারবো। ]

(অষ্টম পর্বের পর…)

সম্পদে উত্তরাধিকারে অধিকাররহিত নারী
সম্পত্তির অধিকারই অর্থনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকাঠামোয় এই অধিকার সম্পূর্ণই পিতার। পিতার বর্তমানে পুত্রেরাও সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। কেবল পিতার মৃত্যুর পরই পুত্রেরা সম্পত্তির মালিক হতে পারে। আর এ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান বহু বহু দূরে-

‘উর্দ্ধং পিতুশ্চ মাতুশ্চ সমেত্য ভ্রাতরঃ সমম্।
ভজেরন্ পৈতৃকং রিক্থমনীশাস্তে হি জীবতোঃ।।’
পিতা এবং মাতার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা সমবেত হয়ে পিতার এবং মাতার ধন বিভাগ করে নেবে, কারণ, তাঁরা জীবিত থাকতে পুত্রদের কোন স্বামিত্ব বা অধিকার নাই। (৯/১০৪)।

ধর্মানুসারে জ্যেষ্ঠ পুত্র ধর্মজ এবং অন্য সন্তানেরা কামজ (৯/১০৭) এবং জ্যেষ্ঠই জন্মমাত্র পিতৃঋণ পরিশোধ করে বলে জ্যেষ্ঠপুত্রই প্রকৃত অর্থে পুত্রপদবাচ্য (৯/১০৬)। তাই সম্পত্তির দায়ভাগ বিধান মতে জ্যেষ্ঠই সমস্ত পিতৃধন লাভ করার যোগ্য। অতঃপর-

‘পিতেব পালয়েৎ পুত্রান্ জ্যেষ্ঠো ভ্রাতৃন্ যবীয়সঃ।
পুত্রবচ্চাপি বর্তেরন্ জ্যেষ্ঠে ভ্রাতরি ধর্মতঃ।।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আহার ও বস্ত্রাদি দান করে সহোদর কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের পিতার মতো পালন করবে; এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতারাও ধর্মানুসারে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি পিতার মতো আচরণ করবে। (৯/১০৮)।
.
‘জ্যেষ্ঠস্য বিংশ উদ্ধারঃ সর্বদ্রব্যাচ্চ যদ্বরম্।
ততোহর্দ্ধং মধ্যমস্য স্যাৎ তুরীয়ন্তু যবীয়সঃ।।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতার ধন সম্পত্তির বিশ ভাগের এক ভাগ ‘উদ্ধার’ অর্থাৎ অতিরিক্ত পাবে, এবং সকল দ্রব্যের মধ্যে যেটি সেরা সেটিও পাবে। মধ্যম তার অর্দ্ধেক অর্থাৎ চল্লিশ ভাগের এক ভাগ ‘উদ্ধার’ পাবে আর কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের চতুর্থ ভাগ অর্থাৎ সমগ্র ধন-সম্পত্তির আশি ভাগের এক ভাগ ঐ ‘উদ্ধার’ পাবে। (৯/১১২)।
.
‘স্বেভ্যোহংশেভ্যস্তু কন্যাভ্যঃ প্রদদ্যুর্ভ্রাতরঃ পৃথক্।
স্বাৎ স্বাদংশাচ্চতুর্ভাগং পতিতাঃ স্যুরদিৎসবঃ।।’
ভ্রাতারা স্বজাতীয় অবিবাহিত ভগিনীগণকে নিজ নিজ অংশ থেকে চতুর্থ ভাগ ধন পৃথক করে দান করবে; যদি তারা দিতে অনিচ্ছুক হয় তা হলে পতিত হবে। (৯/১১৮)।

অর্থাৎ বিবাহিত ভগিনীরা পিতৃসম্পত্তির অধিকারী নয়।
.
সম্পত্তির মালিকানা বা উত্তরাধিকারের জন্য পুত্র থাকা অনিবার্য বলেই যদি পুত্র না থাকে, সেক্ষেত্রে পিতা বিকল্প উপায় হিসেবে তার কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে পারেন-

‘অপুত্রোহনেন বিধিনা সুতাং কুর্বীত পুত্রিকাম্।
যদপত্যং ভবেদস্যাং তন্মম স্যাৎ স্বধাকরম্।।’
যে লোকের কোন পুত্র সন্তান নেই সে এই বক্ষ্যমান নিয়মে নিজের কন্যাকে ‘পুত্রিকা’রূপে স্থির করবে। কন্যাকে পাত্রস্থ করবার সময় ঐ কন্যার পিতা জামাতার সাথে বন্দোবস্ত করে এই কথা তাকে বলবে- ‘এই কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে সে আমার পিণ্ডদানকারী হবে’। (৯/১২৭)।

উল্লেখ্য যে, শাস্ত্রানুযায়ী পুত্রের প্রয়োজন হয় পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি বা সদগতির লক্ষ্যে (স্বর্গারোহণ) শ্রাদ্ধাতিতে পিণ্ডদান করার জন্য (৯/১৩৭)। পিণ্ডদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে মূলত অন্যান্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। একইভাবে পিণ্ডদানের অধিকারক্রম অনুযায়ীই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ধারাক্রম নির্ধারিত হয়। তাই কন্যার প্রতি দায় বা মমত্ব থেকে পিতৃতন্ত্র পুত্রিকা গ্রহণ করে তা ভাবার কোন সুযোগ নেই। বরং উত্তরাধিকারের সংকটমুক্তির লক্ষ্যে এখানে পুত্রিকার পুত্রকেই নিজ-পুত্র কল্পনা করার প্রকৃত মনোভাব হিসেবে কাজ করে। কেননা-

‘যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ।।’
নিজেও যেমন পুত্রও সেইরকম অর্থাৎ আত্মা ও পুত্রতে প্রভেদ নেই; আবার দুহিতা অর্থাৎ ‘পুত্রিকা’ পুত্রেরই সমান। সেই পুত্রিকা-পুত্র স্বয়ং বিদ্যমান থাকতে অন্য কোনও ব্যক্তি ঐ পুত্রিকা-পিতার ধন কেমন ভাবে গ্রহণ করবে ? (৯/১৩০)।

আবার-

‘পুত্রিকায়াং কৃতায়ান্তু যদি পুত্রোহনুজায়তে।
সমস্তত্র বিভাগঃ স্যাজ্জ্যেষ্ঠতা নাস্তি হি স্ত্রিয়াঃ।।’
পুত্রিকা সম্পাদন করার পর যদি কোনও ব্যক্তির পুত্র জন্মগ্রহণ করে, তাহলে পুত্র ও পুত্রিকা উভয়ের মধ্যে সমান-সমান ভাবে ধনবিভাগ হবে। কারণ, স্ত্রীলোকের জ্যেষ্ঠতা নেই অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ পুত্র যে ‘উদ্ধার’ পেত তা ঐ পুত্রিকা পাবে না। (৯/১৩৪)।

এতেই প্রতীয়মান হয় যে পিতৃতন্ত্র আসলে পুত্রমুখীই। তাছাড়া পুত্রিকা গ্রহণে পিতৃবংশধারা রুদ্ধ হবার সংশয়ও ত্যাগ করা যায় না-

‘অপুত্রায়াং মৃতায়ান্তু পুত্রিকায়াং কথঞ্চন।
ধনং তৎপুত্রিকাভর্তা হরেতৈবাবিচারয়ন্।।’
পুত্রিকা যদি অপুত্রক অবস্থায় ঘটনাক্রমে মারা যায়, তাহলে ঐ পুত্রিকার যা কিছু ধন-সম্পত্তি তা তার ভর্তাই বিনা-বিচারে গ্রহণ করবে। (৯/১৩৫)।

এই সংশয় থেকেই, কিংবা ব্যক্তি সন্তানহীন হলে, সামাজিক নিয়োগ-প্রথায় দেবর বা অপর পুরুষের মাধ্যমে যথাবিহিত পুত্র উৎপাদনের মধ্য দিয়ে এই উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করে সম্পত্তি-রক্ষার সংকট নিরসন করা হয়-

‘হরেত্তত্র নিযুক্তায়াং জাতঃ পুত্রো যথৌরসঃ।
ক্ষেত্রিকস্য তু তদ্বীজং ধর্মতঃ প্রসবশ্চ সঃ।।’
গুরুজনদের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে যদি কোনও স্ত্রী বিধানানুসারে সন্তানোৎপাদন করে, তাহলে ঐ পুত্র ঔরসপুত্রের মতো পৈত্রিকধন প্রাপ্তির যোগ্য হবে, কারণ শাস্ত্রব্যবস্থা অনুসারে সেই নারীর গর্ভে যে বীজ নিষিক্ত হয়েছিলো, তা ক্ষেত্রস্বামীরই বীজ বলে গণ্য হবে এবং সেই পুত্রটিও ক্ষেত্রস্বামীরই অপত্য হবে। (৯/১৪৫)।

কিন্তু তা গুরুজন কর্তৃক আদিষ্ট না-হয়ে কিংবা যথাবিহিত নিয়ম ব্যতিরেকে হলে উৎপাদিত সন্তান কামজ ও জারজ বলে গণ্য হওয়ায় সম্পত্তির অধিকারী হবে না। অতএব যথানিয়মে ক্ষেত্রজ পুত্র জন্মালে তার ক্ষেত্রে সম্পত্তি বন্টন হবে-

‘যবীয়ান্ জ্যেষ্ঠভার্যায়াং পুত্রমুৎপাদয়েদ্ যদি।
সমস্তত্র বিভাগঃ স্যাদিতি ধর্মো ব্যবস্থিতঃ।।’
কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি মৃত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পত্নীতে পুত্রসন্তান উৎপাদন করে, তা হলে সেই পুত্রের এবং তার পিতৃব্যের মধ্যে সমান সমান বিভাগ হবে, এটিই ধর্ম ব্যবস্থা। (৯/১২০)।

দায়ভাগ বিধানের উপরোক্ত বণ্টনপ্রক্রিয়া মূলত পূর্বে ধনবিভাগকৃত সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। কিন্তু পূর্বে ধনবিভাগ না করেই যদি কোনও ভ্রাতার মৃত্যু হয়, তাহলে মনুর বিধান হচ্ছে-

‘ধনং যো বিভৃয়াদ্ ভ্রাতুর্মৃতস্য স্ত্রিয়মেব চ।
সোহপত্যং ভ্রাতুরুৎপাদ্য দদ্যাত্তস্যৈব তদ্ ধনম্।।’
(পূর্বে ধনবিভাগ না করেই) যদি কোনও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্ত্রী রেখে পুত্ররহিত অবস্থায় মারা যায় এবং ঐ মৃত ভ্রাতার বিভক্ত ধনসম্পত্তি যদি পত্নী রক্ষা করতে অসমর্থ হয়, কিন্তু কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি ঐ সম্পত্তি রক্ষা করে এবং ভ্রাতৃপত্নীকে পোষণ করে, তাহলে ঐ কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠভ্রাতৃজায়াতে পুত্রোৎপাদন পূর্বক জ্যেষ্ঠভ্রাতার সমস্ত সম্পত্তি ঐ পুত্রটিকে দেবে। (৯/১৪৬)।

এ সব কিছু মিলিয়ে মানে দাঁড়ালো একটাই, কোনভাবেই পারিবারিক সম্পত্তি তথা ক্ষমতা হাতছাড়া করা যাবে না, তাই যেকোনভাবে পুত্র চাই। পুত্রই পিতৃতন্ত্রের ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। প্রয়োজনে ভ্রাতৃজায়াতেও পুত্র উৎপাদন করিয়ে নেয়াটাকেও বৈধ করা হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক তথা অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন হিসেবে। তাই অদ্ভুতভাবে এই বিশেষ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যৌনসম্পর্ককে কাম-নিরপেক্ষতার আবরণ দেয়া হয়েছে। কেননা কামজ হলেই সম্পত্তিতে অধিকাররহীনতার নির্দেশনা। ক্ষমতার এই কেন্দ্রিকতায় নারী কার্যকরভাবেই অনুপস্থিত। নারীর উপস্থিতি এখানে শুধু পুরুষের নৈতিক-অনৈতিক ইচ্ছার ক্রীড়নক হয়ে পুত্র উৎপাদনে ব্যবহৃত হওয়া। যদিও এই নৈতিক বা অনৈতিকতার মানদণ্ডও নির্ধারণ হয়েছে পিতৃতন্ত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে, যা একান্তই উদ্দেশ্যমূলক ও আধিপত্যবাদী। তবে এখানেই শেষ নয়।
.
মনুশাস্ত্রে যেহেতু পুরুষের একাধিক বিয়ের স্বীকৃতি বিদ্যমান, সেক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান বিদ্যমান থাকলে আরো কিছু বিষয়ও এসে যুক্ত হয় তখন। এবং যদি তারা হয় একাধিক বর্ণের, তবে জটিলতা আরো বেড়ে যায়। ফলে বর্ণাশ্রমের মৌলিক নীতি অনুযায়ী অনিবার্যভাবেই স্ত্রীর জ্যেষ্ঠতা ও বর্ণের স্তরভেদ অনুসারে উৎপাদিত সন্তানের উত্তরাধিকার বা সম্পত্তির মালিকানার বিষয় নির্ধারণ করা হয়-

‘সর্বং বা রিক্থজাতং তদ্দশধা পরিকল্প্য চ।
ধর্ম্যং বিভাগং কুর্বীত বিধিনানেন ধর্মবিৎ।।’
যা কিছু ধনসম্পত্তি আছে তা দশ ভাগ করে বিভাগধর্মজ্ঞ ব্যক্তি নিম্নলিখিত ব্যবস্থা অনুসারে ধর্মসঙ্গতভাবে বিভাগ করবেন। (৯/১৫২)।
.
‘চতুরোহংশান্ হরেদ্বিপ্রস্ত্রীনংশান্ ক্ষত্রিয়াসুতঃ।
বৈশ্যাপুত্রো হরেদ্ব্যংশমংশং শূদ্রাসুতো হরেৎ।।’
ব্রাহ্মণীর পুত্র চার অংশ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিন অংশ, বৈশ্যার পুত্র দুই অংশ এবং শূদ্রার পুত্র এক অংশ লাভ করবে। (৯/১৫৩)।
.
‘যদ্যপি স্যাত্তু সৎপুত্রো হ্যসৎপুত্রোহপি বা ভবেৎ।
নাধিকং দশমাদ্দদ্যাচ্ছুদ্রাপুত্রায় ধর্মতঃ।।’
ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত পুত্র বিদ্যমান থাকুক আর নাই থাকুক শূদ্রাস্ত্রীর পুত্রকে দশমাংশের বেশি দেবে না, এ-ই হলো ধর্মসঙ্গত ব্যবস্থা। (৯/১৫৪)।

একে তো কন্যাসন্তানের পিতৃ-সম্পত্তিতে অধিকার স্বীকৃতই হয় নি, তারপরও নারীর জন্মজাত বর্ণ-অবস্থানের ভিত্তিতে তার গর্ভজাত পুত্রের সম্পত্তি-অধিকারে বৈষম্য সৃষ্টি করে মূলত নারীকেই আরেক দফা নিবর্তনের শিকার করা হয়েছে। এই নিবর্তন হীনজাতীয়া হওয়ার কারণে শূদ্রা নারীর উপরই তীব্রতম। দ্বিজাতি পুরুষের শূদ্রাস্ত্রীর পুত্রকে কোন অবস্থাতেই দশমাংশের বেশি দেয়া যাবে না। আবার আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে-

‘ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশ্যাং শূদ্রাপুত্রো ন বিক্থভাক্।
যদেবাস্য পিতা দদ্যাত্তদেবাস্য ধনং ভবেৎ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এদের শূদ্রা নারীর গর্ভজাত পুত্র ধনাদির অংশ পাবে না। তবে পিতা তাকে স্বেচ্ছায় ধনের যা দিয়ে যাবেন তা-ই তার ধন হবে- তাই তার ভাগস্বরূপ হবে। (৯/১৫৫)।

তবে শূদ্র পুরুষের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রতিলোম বিবাহ অর্থাৎ উচ্চবর্ণের স্ত্রী গ্রহনের কোন সুযোগ নেই, তাই তার সন্তানাদির ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই কোন বৈষম্য আরোপ দেখা যায় না-

‘শূদ্রস্য তু সবর্ণৈব নান্যা ভার্যা বিধীয়তে।
তস্যা জাতাঃ সমাংশাঃ স্যুর্যতি পুত্রশতং ভবেৎ।।’
শূদ্রের কিন্তু একমাত্র সবর্ণা স্ত্রী-ই ভার্যা হবে, অন্য কোনও জাতীয়া ভার্যার বিধান নেই। কাজেই শূদ্রের সজাতীয়া পত্নীতে যে সব পুত্র জন্মাবে তারা সংখ্যায় একশ জন হলেও সকলেই পৈতৃক ধনসম্পত্তির অংশ সমান সমানই হবে। (৯/১৫৭)।

এভাবেই সমাজকর্তৃত্ব দারিদ্র্যসাম্যের ক্ষেত্রে যে উদার থাকে, তা হয়তো ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্বের প্রতি যেখানে কেউ হুমকিস্বরূপ হয় না সেখানেই। তবে সেখানেও কন্যাসন্তানের সম্পত্তির অধিকার প্রযোজ্য হয় না।
.
পিতৃতন্ত্রে পুত্র যেমন ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতীক, একইভাবে পিতৃতন্ত্র কর্তৃক নারীকে ইচ্ছানুরূপ ভোগ ও ব্যবহারের প্রতীকও পুত্র। এই প্রতীকী অবস্থান প্রকাশমান হয় পুত্রকে পিতৃসম্পত্তির অধিকার বণ্টনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তাই উত্তরাধিকার নির্বাচন কেবল নারী-নিবর্তন ও বঞ্চনার ইতিহাসই নয়, একইসাথে নারী-নিবর্তনের বহুমাত্রিক চিহ্নায়কও। মোটকথা পুরুষকর্তৃক বহুভোগ্যা নারীকে ব্যবহারের মাত্রা, অবস্থান ও বৈচিত্র্যের প্রকার-প্রক্রিয়ার উপর পুত্ররূপ ফলাফলের প্রকার-পরিস্থিতি বিবেচনাকে গ্রাহ্য করেই উত্তরাধিকার প্রদানের উদ্দেশ্যমূলক প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। এটাই নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের স্পষ্টরূপ আধিপত্য ঘোষণা। এটা পিতৃতন্ত্রের বদমায়েশিকে নারীর উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া হলেও কোনও লুকোছাপের বিষয় হয়নি। আর এই নির্লজ্জ ঘোষণা বলবৎ হয় উৎপাদিত পুত্রের জাতিবাচক নামকরণ কিংবা প্রকার নির্দেশের মাধ্যমে। ভিন্ন বর্ণের অনুলোম-প্রতিলোম সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট বিভিন্নরকম সন্তানের বহুধরনের নামকরণ মনুসংহিতায় রয়েছে যাদের অধিকাংশই অস্পৃশ্য বা চণ্ডাল শ্রেণীভুক্ত, যাদেরকে পুত্র বলেই স্বীকার করা হয় না। তবে মনুশাস্ত্রে সম্পত্তি বণ্টনার্থে দ্বাদশ প্রকার পুত্রের উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে কারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, কারা হবে না তাও নির্দেশ করা হয়েছে-

‘ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিম এব চ।
গূঢ়োৎপন্নোহপবিদ্ধশ্চ দায়াদা বান্ধবাশ্চ ষট্।।’
ঔরস (সমানবর্ণা ভার্যাতে নিজের উৎপাদিত পুত্র- legitimate son of the body), ক্ষেত্রজ (সমাণবর্ণা ভার্যাতে অন্য ব্যক্তির দ্বারা উৎপাদিত পুত্র- son begotten on a wife of another), দত্তক (অন্যের পুত্রকে নিজ পুত্র হিসেবে গ্রহণ- adopted son), কৃত্রিম (মাতাপিতাহীন বালক, যাকে কেউ টাকা-জমি প্রভৃতির লোভ দেখিয়ে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছে- a son made), গূঢ়োৎপন্ন (স্বামীর ভার্যাতে সজাতীয় অজ্ঞাত পুরুষকর্তৃক উৎপন্ন পুত্র- son secretly born), এবং অপবিদ্ধ (যে পুত্র মাতা-পিতাকর্তৃক পরিত্যক্ত এবং অন্যের দ্বারা পুত্ররূপে গৃহীত- a son cast off)- এই ছয় প্রকারের পুত্র গোত্র-দায়াদ এবং বান্ধব (অর্থাৎ এরা সপিণ্ড ও সগোত্রদের শ্রাদ্ধতর্পণ করতে পারে এবং গোত্রধারী ও ধনাধিকারীও হয়- six heirs and kinsmen)। (৯/১৫)।
.
‘কানীনশ্চ সহোঢ়শ্চ ক্রীতঃ পৌনর্ভবস্তথা।
স্বয়ংদত্তশ্চ শৌদ্রশ্চ ষডদায়াদবান্ধবাঃ।।’
কানীন (অবিবাহিতা নারীর পুত্র- son of an unmarried damsel), সহোঢ় (বিবাহের আগে যে নারী অন্তঃসত্ত্বা হয় সে যে পুত্রকে বিবাহের সময়ে সঙ্গে নিয়ে আসে- son received with the wife), ক্রীত (যে পুত্রকে তার পিতা-মাতার কাছ থেকে ক্রয় করে পুত্র করা হয়- the son bought from his parents), পৌনর্ভব (পুনর্ভূ অর্থাৎ পুনর্বিবাহিত স্ত্রীলোকের সন্তান- son begotten on a re-married woman), এবং শৌদ্র (দ্বিজের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত পুত্র- the son of a sudra female)- এই ছয় প্রকার পুত্র গোত্র-দায়াদ নয়, কেবল বান্ধব অর্থাৎ শ্রাদ্ধপিণ্ডাদির অধিকারী হয় মাত্র, ধনাধিকারী নয়। (৯/১৬০)।

সাধারণভাবে ঔরসপুত্রই পিতৃসম্পদে অধিকারী হয়। অন্য পুত্রদেরকে দেয়া হয় মূলত পাপ-পরিহারের কারণে-

‘এক এবৌরসঃ পুত্রঃ পিত্র্যস্য বসুনঃ প্রভুঃ।
শেষাণামানৃশংস্যার্থং প্রদদ্যাত্তু প্রজীবনম্।।’
একমাত্র ঔরসপুত্রই পিতার ধনসম্পত্তির অধিকারী হবে। তবে পাপ পরিহারের জন্য অর্থাৎ না দিলে পাপ হবে বা নিষ্ঠুরতা হবে- এই কারণে সেই ঔরসপুত্র অন্যান্য পুত্রগণের গ্রাসাচ্ছাদানের উপযোগী ধনদানের ব্যবস্থা করবে। (৯/১৬৩)।

অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের পুত্র উৎপাদনে পাপ বা নিষ্ঠুরতা নেই। যদিও পুরুষের এমন উদার মনও কানীন পুত্রের সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতাই পালন করে। তবে চূড়ান্তভাবে এও বলা হচ্ছে-

‘সর্বাসামেকপত্নীনামেকা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ।
সর্বাস্তাস্তেন পুত্রেণ প্রাহ পুত্রবতীর্মনুঃ।।’
একই ব্যক্তির বহু পত্নী থাকলে তাদের মধ্যে একজনও যদি পুত্রবতী হয়, তাহলে ঐ পুত্রের দ্বারা অন্যান্য সকল পত্নী পুত্রবতী বলে পরিগণিত হবে অর্থাৎ তারা আর দত্তক-পুত্র নিতে পারবে না। -এ কথা মনু বলেছেন। (৯/১৮৩)।

এদ্বারা প্রকারান্তরে পুরুষকে তার যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের লক্ষ্যে পুনর্বিবাহের কথাই নির্দেশ করা হচ্ছে। সেই উত্তরাধিকারী হবে পিতৃতন্ত্রেরই সুযোগ্য রক্ষক। নইলে পিতৃতন্ত্র কতোটা নির্দয় মমতাশূণ্য হতে পারে তার আরেকটি নমুনা হচ্ছে-

‘অনংশৌ কীবপতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
উন্মত্তজড়মূকাশ্চ যে চ কেচিন্নিরিন্দ্রিয়াঃ।।’
কীব, পতিত (outcastes), জন্মান্ধ, জন্মবধির, উন্মত্ত, জড়-অর্থাৎ বিকলান্তঃকরণ, বর্ণের অনুচ্চারক মূক এবং ঐরকম কাণা প্রভৃতি বিকলেন্দ্রিয় ব্যক্তি- এরা কেউই পিতার ধনসম্পত্তির অংশভাগী হবে না। (৯/২০১)।
.
‘সর্বেষামপি তু ন্যায্যং দাতুং শক্ত্যা মনীষিণা।
গ্রাসাচ্ছাদনমত্যন্তং পতিতো হ্যদদদ্ভবেৎ।।’
তবে যারা রিক্থভাগী অর্থাৎ ধনসম্পত্তি লাভ করবে, তারা সুবিবেচনাপূর্বক যথাশক্তি ঐ সব ক্লীব প্রভৃতিকে যাবজ্জীবন গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করবে- তা না করলে তার পতিত হবে। (৯/২০২)।

পিতৃতন্ত্রে নারীকেও হয়তো এই সমান্তরালেই বিবেচনা করা হয়েছে।
.
(চলবে…এবং আগামী পর্বে সমাপ্য…)
[১ম পর্ব ] [২য় পর্ব ] [৩য় পর্ব] [৪র্থ পর্ব] [৫ম পর্ব ] [৬ষ্ঠ পর্ব] [৭ম পর্ব] [৮ম পর্ব ] [*] [১০ম ও শেষ পর্ব ]