(১)
স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখার সমস্যা অনেক-যদিও তার রচনাবলী আমি খুব ছোটবেলা থেকে পড়ছি। তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনেই আমার শিক্ষা- তবুও বিবেকানন্দকে নিয়ে মৌলিক কিছু চিন্তা লিপিবদ্ধ করা বেশ কঠিন কাজ। মূল সমস্যা এই যে, বিদেশে যাকে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগীতে প্রবন্ধ লেখা বলে, সেই ধরনের লেখা বিবেকানন্দের ওপর নেই। বিবেকানন্দের জীবনী ভাষ্যকাররা মহান বিবেকানন্দর সন্ধানেই লিখে গেছেন। অবস্থা এত খারাপ, একবার বিবেকানন্দর ওপর সব থেকে বড় স্যোশাল ফোরামে আমাকে তাড়ানো হয় এই অপরাধে যে আমি একটি নিরীহ তথ্য দিয়েছিলাম- শেষ জীবনে বিবেকানন্দ অনুতাপ করেছিলেন, কেন গৃহী না হয়ে সন্নাস্যী হয়েছেন-আরেকবার জন্মালে আর সন্ন্যাসী হবেন না, বে-থা করে গৃহীই হবেন।
তথ্যটি সত্য। শুধু তাই না, বিবেকানন্দ নিজের মায়ের দেখভাল করতেন, ভাইএর চাকরির জন্যে তদারকি করেছেন এবং পৈত্বৃক বসত বাড়ির শরিকি মামলার সাথেও ছিলেন। এর কোন কিছুই যদিও তাকে ছোট করে না, তবুও তার ভক্তবৃন্দ তাকে “সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসাবেই দেখতে পছন্দ করেন বেশী।
সমস্যা আরো বেশী গভীরে। গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি থেকে আপামর মহান ভারতীয় নেতারা যে “একটি” ব্যক্তিতে আপ্লুত ছিলেন তিনি বিবেকানন্দ। সাম্প্রতিক অতীতের প্রায় সবকটি জরিপে,তিনিই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়-গান্ধীর থেকেও স্বামীজি বেশী জনপ্রিয়।
তার বাণী ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িতে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ১৫০ কোটি টাকা খরচ করবে এই বছরে। শুধু সেকালের টাটা রা না, একালেও ভারতের প্রায় সব সবশ্রেণীর নেতাদের ( কর্পরেট, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ) প্রথম পছন্দের নাম স্বামীজি। ডান, বাম, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্ঠান প্রায় সব শ্রেনীর লোকের কাছেই তিনি প্রিয় ব্যক্তিত্ব। নহেরু, গান্ধীকে নিয়ে অনেক মতভেদ। ভারতীয় জাতিয়তাবাদিরা এদের পছন্দ করে না। বিবেকানন্দকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। প্রবীর ঘোষের মতন হাতে গোনা কয়েকজন যুক্তিবাদি বা নরসিংহমের মতন গবেষক ছারা, আর কেওই সেই অর্থে বিবেকানন্দের সমালোচনা করেন নি।
(২)
কিন্ত এখান থেকেই আমার প্রশ্ন শুরু। বিবেকানন্দ ভারতকে বা এই পৃথিবীকে কি দিয়ে গেছেন, যে আজকে সবাই তাকে সর্বকালের সেরা ভারতীয় বলে মেনে নিচ্ছে?
তিনি দর্শন শাস্ত্রে মৌলিক কোন অবদান রাখেন নি। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে, আধুনিক মোরকে হাজির করেছেন। এটা ঠিক বিবেকানন্দ রচনাবলী না পড়লে ভারতীয় দর্শন গভীরে বোঝা সম্ভব না। ধর্ম জিনিসটা ঠিক কি-সেটাও বিবেকানন্দ পড়েই আমার শেখা। তিনি একজন আধুনিক ভাষ্যকার। এই পর্যন্ত।
বিবেকানন্দের রাজনৈতিক এবং সমাজ চিন্তা বালখিল্যতা বললে কম বলা হবে।
প্রথমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বিশ্লেষনে আসব। ভারতের উন্নতির জন্যে বৃটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি দরকার-সেই নিয়ে তার সংশয় ছিল না। বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে কিভাবে দরিদ্র ভারতীয়রা নিষ্পেষিত হচ্ছে, নিচূ জাতের লোকেরা শোষিত হচ্ছে, সেই নিয়ে তিনি সরব ছিলেন। সেই জন্যেই তিনি ভারতীয় বিপ্লবীদের মন্ত্রগুরু। কিন্ত মুক্ত ভারতের রাজনৈতিক ভিত্তি কেমন হবে-তার জন্যে জাপানকে আদর্শ মনে করতেন। জাপানের ন্যাশালিস্টিক ফ্যাসিজম তার ভাল লেগেছিল। অতীতকে স্মরণে রেখে, জাতিগর্বে উৎসাহিত হয়ে, বস্তুবাদি উন্নতি করতে হবে। জাপানের মতন “ডিসিপ্লিনড” জাতি চাইছিলেন তিনি।
” Only I want that numbers of our young men should pay a visit to Japan and China every year. Especially to the Japanese, India is still the dreamland of everything high and good. And you, what are you? … talking twaddle all your lives, vain talkers, what are you? Come, see these people, and then go and hide your faces in shame. A race of dotards, you lose your caste if you come out! Sitting down these hundreds of years with an ever-increasing load of crystallized superstition on your heads, for hundreds of years spending all your energy upon discussing the touchableness or untouchableness of this food or that, with all humanity crushed out of you by the continuous social tyranny of ages – what are you? And what are you doing now? … promenading the sea-shores with books in your hands – repeating undigested stray bits of European brainwork, and the whole soul bent upon getting a thirty rupee clerkship, or at best becoming a lawyer – the height of young India’s ambition – and every student with a whole brood of hungry children cackling at his heels and asking for bread! Is there not water enough in the sea to drown you, books, gowns, university diplomas, and all?”
অর্থাৎ তার মতবাদ এই রকম- অভুক্ত জাতিকে আগে খেতে দিতে হবে। ভারতের ধর্মীয় সংস্কার এবং অহংকার ছেরে, আগে জাতিকে খাওয়ানো পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পেটে ভাত না থাকলে, বস্তুবাদি উন্নতি না হলে, সেই জাতির আত্মমর্যাদা থাকে না। সেই জন্যে জাপানের থেকে শেখ!
আপাত দৃষ্টিতে বিবেকানন্দের এই “মহান ভারত সত্ত্বার” শক্তিশালী লেখনীতে আমিও উদ্বেলিত হতাম। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে এই, ইউরোপ, জাপানে ফ্যাসিজিমের উত্থানের পেছনেও ঠিক এই ধারনাই কাজ করেছে। রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে জাতিকে গণউত্থানের এই চেষ্টা ফ্যাসিজমের ধাত্রীগৃহ এবং জাপানে উনি যেটা দেখেছেন সেটা একটা প্রাক-ফ্যাসিস্ট সমাজ। তার লেখাতে গণতান্ত্রিক ভারত অনুপস্থিত। বরং বিবেকানন্দের ভারতের সাথে “ফ্যাসিস্ট জাপানের” মিল পাওয়া যাচ্ছে। তার রাজনৈতিক ধারনাতে সবথেকে বেশী অনুপ্রাণিত ছিলেন নেতাজি। এবং নেতাজির মধ্যেও ফ্যাসিজমের ভূত এমন ভাবে চেপে বসেছিল, তিনি হিটলারের সহযোগী হতে রাজী হলেন। নেতাজি জার্মানীতে তিন বছর ছিলেন (১৯৪১-৪৩)-এবং এমন একটা সময়ে যখন জার্মানী গোটা ইউরোপকে ধর্ষন করছে। এর পরেও তিনি অবলীলা ক্রমে নাৎসিদের সাথে একসাথে থাকলেন তিন বছর কারন ফ্যাসিজমের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষন ছিল। নেতাজীর রচনাবলি পড়লে পরিস্কার হয়, তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের রাজনৈতিক মানস সন্তান। তবে আমার এই সিদ্ধান্তও হবে অকালপক্ক-সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এবার আসি আমেরিকান সমাজ প্রসঙ্গে। স্বামীজি দেখলেন, আমেরিকাতে ব্যবসায়ীরা সমাজ গড়ে-তারাই সব থেকে বেশী সন্মান পায়। আর ভারতে ব্যবসায়ী সমাজকে সঙ্গত কারনেই চোর ডাকাতের সাথে তুলনা করা হয়। সেই অবস্থা আজকে ১০০ বছরেও বদলায় নি। কারন আমেরিকাতে ধণতন্ত্র এসেছে কৃষকদের বণিক হিসাবে রূপান্তরের সাথে সাথে। আর ভারতের ধনতন্ত্রে বণিক শ্রেনী পরজীবি একটা কমিউনিটি যা বৃটিশরা তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান ধণতন্ত্রের সমস্ত ভালদিক গুলি তার চোখে পড়ল এবং তার উচ্ছাসিত প্রশংসা করেছেন তিনি। আমেরিকান লিবার্টিকে বা মানবমুক্তিকে উন্নতির প্রথম সোপান হিসাবে ঘোষণা করলেন।
ব্যাপারটা হল এই যখন যেটা ভাল লেগেছে, সেটাকেই তিনি মডেল করে দিতেন। জাপানের তিনি উচ্ছাসিত প্রসংশা করেছিলেন-কিন্ত জাপানিজরা সেই সময় মোটেও মুক্ত সমাজ ছিল না। আমেরিকাতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন, সেটা মানতে গেলে, জাপানের সমাজের মতন নিকৃষ্ট সমাজ নেই-কারন তারা খুবই ফ্যাসিস্ট এবং টোটালাটারিয়ান রিপাবলিকে বিশ্বাস করত। আবার আমেরিকার মতন মানব মুক্তি দিতে গেলে, আমেরিকান ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদকেও মেনে নিতে হয় যা ভারতীয় দর্শনের সামাজিক কর্তব্যের সম্পূর্ন বিপরীত। এই সাথে আমেরিকান ব্যাক্তি স্বতন্ত্রবাদ আর ভারতীয় দর্শনকে মহান করতে সত্যিই মার্কেটিং এর মহান ক্ষমতা লাগে!
মোদ্দা কথা সামাজিক দর্শনের ব্যাপারে তার লেখাযোখা প্রায় শ্লোগান সর্বস্য। অভিজ্ঞতা নির্ভর। এম্পিরিসিজম থেকে স্ট্রাকচারালিজমে তিনি যান নি। গভীরে তিনি ঢোকেন নি- গভীরে ঢোকার মতন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক জ্ঞান তার ছিল বলে মনে হয় নি।
এই ধরনের পরস্পর বিরোধিতা বিবেকানন্দ চরিত্রের ছত্রে ছত্রে। তাতে অসুবিধা নেই। এর থেকে বোঝা যায় তিনি মুক্তমনের অধিকারি ছিলেন, তার মনে দ্বন্দ ছিল। এবং মনে দ্বন্দ থাকাই মনের উন্নতির প্রাথমিক শর্ত। নিজের অভিজ্ঞতার কাছে তিনি সৎ থেকেছেন। কিন্ত রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শনের চর্চা তিনি গভীরে গিয়ে করেন নি।
(৩)
এবার আরেকটি বিতর্কিত টপিকে আসি। নারীমুক্তি নিয়ে বিবেকানন্দের ভাবনা।
ইউরোপ এবং আমেরিকাতে তার শিষ্যর থেকে শিষ্যা বেশী ছিল। নারী মুক্তি এবং নারীর অধিকারের সাম্যতা নিয়ে তিনি দেদারসে শ্লোগান দিয়েছেন। এবং বেদান্তের চোখে নারী-পুরুষ সমান সেটা তার লেখাতে অনেকবার এসেছে। কিন্ত হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান বা সব ধর্মে নারীর অবস্থান এত বাজে কেন-সেই নিয়ে কোন বিশ্লেষন তিনি করেন নি। করলে, ধর্মের সাথে ঐতিহাসিক সামাজিক শক্তির গুলির বিন্যাস তার চোখে পড়ত। বরং এই ব্যাপারে তার লেখালেখি অনেকটাই চটকদারি মন্তব্য-
The soul has neither sex, nor caste nor imperfection.”
“The best thermometer to the progress of a nation is its treatment of its women.”
” There is no chance for the welfare of the world unless the condition of women is improved.”
“Woman has suffered for aeons, and that has given her infinite patience and infinite preserverance.”
“The idea of perfect womanhood is perfect independence.”
এরপরেই আবার লিখলেন, ভারতে “নারীর” আদর্শ হচ্ছে মা-ইউরোপে “স্ত্রী”।
আরো লিখলেন, ভারতে নারীকে দেবীজ্ঞানে গৃহে পুজো করা হয়। যদিও বাস্তব হচ্ছে, ভারতে সেই সময় এবং কিছু কিছু সমাজে এখনো নারীর অবস্থান গৃহের গাভীর থেকে কিছু কম। গৃহবধূ হত্যায় ভারত সবার ওপরে। পৃথিবীতে প্রায় ৫৪০ রকমের “বিবাহের” সন্ধান পাওয়া গেছে-এর মধ্যে মোটে চার রকমের বিবাহে বরকে পণ দেওয়া চালু আছে। ভারতীয় সমাজ তাদের অন্যতম। এবং ভারতে মেয়েদের এই বাজে আর্থসামাজিক অবস্থানের জন্যে হিন্দু ধর্মের দায় সব থেকে বেশী।
হিন্দু ধর্মে জাতিভেদের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ যদিও বা কখনো সখনো লিখেছেন ( আবার বিদেশে জাতিভেদকে সমর্থন ও করেছেন ) হিন্দু ধর্মে নারীর করুণ অবস্থানের বিরুদ্ধে তিনি এক লাইন ও লেখেন নি। হিন্দু সমাজে নারী দুরাবস্থা নিয়ে অবশ্যই লিখেছেন। কিন্ত তার উৎসস্থল যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি সেটা স্বীকার করেন নি, বরং এটাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন, আদি বৈদিক সমাজে নারীর স্থান ছিল উঁচুতে- ব্রাহ্মনদের চক্রান্তেই এই অবস্থানের অনুন্নতি
In what scriptures do you find statements that women are not competent for knowledge and devotion? In the period of degeneration, when the priests made the other castes incompetent for the study of the Vedas, they deprived the women also of all their righ ts. Otherwise you will find that in the Vedic or Upanishadic age Maitreyi, Gargi, and other ladies of revered memory have taken places of Rishis through their skill in discussing about Brahman. In an assembly of a thousand Brahmans who were all erudite in the Vedas, Gargi boldly challenged Yagnavalkya in a discussion about Brahman. Since such ideal women were entitled to spiritual knowledge, why shall not the women have same privilege now? What has happened once can certainly happen again. History repeats itself. All nations have attained greatness by paying proper respect to women. That country and that nation which edo not respect women have never become great, nor will ever be in future. The principal reason why your race h! ! ! ! as so much degenerated is that you have no respect for these living images of Shakti. Manu says, “Where women are respected, there the gods delight; and where they are not, there all works and efforts come to naught.” There is no hope of rise for that fam ily or country where there is no estimation of women, where they live in sadness. (V7. p.214-15)
সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন সমাজ আসে নি যা পুরুষবাদি ছিল না। অধিকাংশ নৃতত্ত্ববিদদের মতে অতীতের নারীবাদি সমাজের কল্পনা একধরনের মিথ [১]।
নারীবাদের উত্থান মূলত শিল্প বিপ্লবের সাথে এবং শিশুমৃত্যু হার কম হওয়ার সাথে সাথে। যার জন্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় থেকে নারীরা কাজে যাওয়া শুরু করে। সব ধর্মই নারীকে ঘরে ঢুকিয়েছে-কারন সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বজায় রাখতে সেটাই দরকার ছিল। হিন্দু ধর্ম কোন কালেই তার ব্যতিক্রম ছিল না- বরং তা পুরুষবাদি সমাজের উজ্জ্বল উদাহরণ।
মোটামুটি বিবেকানন্দ জীবনীতে যেটুকু দেখছি- বিদেশী নারীর কাছে তিনি নারীবাদি, হিন্দুর কাছে তিনি হিন্দু, বিদেশীদের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক, জাপানীদের কাছে তিনি জাপানের জাতিয়তাবাদের ভক্ত!
মোদ্দা কথায়, হিন্দু ধর্মের দোষগুলিকে ঢেকে যেভাবে তিনি হিন্দু ধর্মের মার্কেটিং করেছেন, তা এক কথায় অসাধারন।
(৪)
এর পরেও আমি লিখব বিবেকানন্দ কিছু কিছু দিকে সত্যিই অসাধারন ছিলেন। সেটি হচ্ছে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং মানুষকে ভাল কাজের জন্যে অনুপ্রেরিত করার ক্ষমতা। মানবিক শক্তিগুলির এবং গুণের বিকাশের জন্যে তিনি জ্ঞানের থেকেও উপলদ্ধির ওপর জোর দিতেন। সফল সংগঠক হতে গেলে মার্কেটিং করার দক্ষতা লাগেই এবং তার কাছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রত্যাশা করাটা ঠিক না। মানবসেবায় সফল সার্থক বিবেকানন্দকে মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। আপত্তি আছে “সমাজ বিপ্লবী, স ংস্কারক” বিবেকানন্দকে মেনে নিতে।
আমার মূল আপত্তি অন্ধ বিবেকানন্দ ভজনায়। বিবেকানন্দ সংস্কার মুক্ত, নির্ভীক ভারত চেয়েছিলেন। তার সাধ শতবর্ষে যে ভারত আমরা পাচ্ছি, সেই ভারত কিন্ত আজো অন্ধ কুসংস্কারে নিমজ্জিত। উত্তর প্রদেশে ভোট হচ্ছে জাতের ভিত্তিতে। আজও। বরং পশ্চিম বঙ্গে জাতপাত তুলনামূলক ভাবে অনেক কম-এবং সেই কমার পেছনে বাংলাতে বাম আন্দোলনের ভূমিকা আছে। বিবেকানন্দের প্রচার বা বাণীতে ভারতের জাতিভেদ বা হিন্দু ধর্মের বজ্জাতি যার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ সরব ছিলেন-কিছুই কমে নি। বধূহত্যা অব্যাহত।
তাহলে বিবেকানন্দের ভুলটা কোথায় ছিল? কেন তার জাতিভেদ মুক্ত, সাম্যের আদর্শে দীক্ষিত নীর্ভিক ভারতের আজও জন্ম হল না?
কারনটা এই যে বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে আক্রমন করেন নি। বরং লোককে আরো হিন্দু ধর্মে গর্ব অনুভব করতে বলেছেন। তার চিন্তায় হিন্দু ধর্ম ভাল- সমাজ তাকে বাজে বানিয়েছে। এগুলি, যেকোন সমাজ বিজ্ঞানীর কাছে অসম্ভব বালখিল্য চিন্তা। ফুকোর ক্ষমতার তত্ত্ব দিয়ে এই ব্যাপারটা দেখলে দেখা যাবে বিবেকানন্দ ” কেন্দ্রীয় শক্তি” হিসাবে সেই হিন্দু ধর্মের কথাই বলছেন। এই ধরনের চিন্তাতে “ধর্মের বিরুদ্ধে” রাজনৈতিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়। যেটা মুসলিম দেশগুলিতে আরো বড় সমস্যা। কোরান ভাল, মুসলমানরা খারাপ- এই ধরনের চিন্তা আসলেই কোন ধর্ম বিরোধি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে না। আর ধর্ম বিরোধি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম না হলে, কোন দেশের ধর্মীয় সংস্কার সম্ভব না। যেটা ভারতের রাজনীতিতে সব থেকে বড় বাস্তব। এখানের গোবলয়ে মার্ক্সীয় পার্টিগুলিকেও জাত ধর্মের সমীকরণ মানতে হয়।
********************
[১] Why men rule- A theory of male dominance : Stefan Goldberg
http://www.amazon.com/Why-Men-Rule-Theory-Dominance/dp/0812692373
লেখা ভালো লাগলো না। যতটুকু পড়লাম, জোর করে পড়লাম।
বিবেকানন্দ প্যারিসে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা শুনেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্যাটেন্টের গুরুত্ব। তিনি জোর করে ভগ্নি নিবেদিতাকে দিয়ে জগদীশচন্দ্রের গ্যালেনা ডিটেক্টরের প্যাটেন্ট করান। পাশ্চাত্যের বাস্তবতা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
নিজকে গ্রহনযোগ্য করে তুলতে যেখানে যেমন দরকার তেমন করেই নিজকে উপস্থাপন করেছেন।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা বা মানুষকে ভাল কাজের জন্যে অনুপ্রেরনা দেয়া বা মানবসেবায় সফল ইত্যাদির চেয়ে কি সমাজ সংস্কারক বিবেকানন্দের বেশী প্রয়োজন ছিলোনা?
@ব্রাইট স্মাইল্,
তাতে তিনি মার্কেটিং গুরু স্বামী বিবেকানন্দ হোন। যিনি ধর্ম= স্যোশাল ইউটিলিটি ভ্যালু তে বিশ্বাস করতেন :))
সমাজ সংস্কারের জন্যে শ্লোগান দিয়েছেন। ভারতীয় সমাজে সংস্কার যেটুকু এসেছে সবটাই প্রযুক্তির উন্নতিতে- রাজনীতি বা ধর্মীয় আন্দোলন সংস্কারটা আনলো কোথায়? সংস্কারক বিবেকানন্দ ১০০% ব্য্ররথ।
ছোটবেলা ধর্ম বইয়ে নরেন্দ্র দত্ত নাম দিয়ে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দে গিয়ে তার জীবনী শেষ।আর তার
‘জীবে প্রেম করে যেইজন
সেইজন সেবিচ্ছে ঈশ্বর’ মন্ত্রে মুগ্ধ ছিলাম।
১৯৯২/৯৩ সালের দিকে কলকাতায় একটা প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে বিবেকানন্দ ও শিক্ষা বিষয়ক একটা চমৎকার বক্তৃতা শুনেছিলাম। বক্তার নাম মনে নেই।
এছাড়া তার সম্বন্ধে ছাড়া ছাড়া আলোচনা শুনেছি।তার কিছু বইও পড়েছি। আপনার আলোচনাটি ব্যতিক্রম, বিশ্লেষণপূর্ণ এবং বিবেকানন্দকে নিয়ে নতুন করে ভাবায়,তবে বানানে একটু খেয়াল রাখবেন কি? শিরোনামের বানানে পর্যন্ত ভুল। মডারেটরেরা শিরোণামের বানানটি অন্তত শুদ্ধ করে দিতে পারত।
@গীতা দাস,
বিশ্লেষণ ঠিক করলাম। বাংলা বানান ঠিক করে লিখতে গেলে লেখা তুলে দিতে হবে। ইংরেজি -বাংলা ডিকশনারী কাজে লাগিয়ে বাংলা বানান ঠিক করা যায়-তবে এত সময় নেই। বুঝতেই পারছেন আমরা সবাই সখের লেখক :-X
অনেক কিছু জানলাম।তবে আপনার সাথে একমত।তার মনে দ্বন্দ্ব ছিল।মুক্তমনের অধিকারী ছিলেন তিনি।সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।
বিপ্লব-দার লেখা মানেই চিন্তার জগতে ঝড়; আজকেরটিও ছিল সমান বিধ্বংসী!
কিন্তু এমন তো অনেক জায়গাতেই পড়েছি যে, অতীতে নারীদের বিশেষ সন্মানের চোখে দেখা হত, বিশেষত, সন্তান জন্মদানকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অংশ মনে করা হত! তাছাড়া অতীতে যে এত মহান ও শক্তিশালী দেবীর উদ্ভব ঘটেছিল, তার পিছনে আর কোন নৃতাত্ত্বিক কারণকে দায়ী করা চলে? এখনো তো অনেক আদি ট্রাইবে নারীবাদী সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায়!
ক্ষমতার তত্ত্ব বিষয়টা কি আরেকটু পরিষ্কার করা যায়?
”ভারতের ধর্মীয় সংস্কার এবং অহংকার ছেরে, আগে জাতিকে খাওয়ানো পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।” এ মতবাদের সাথে ”রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে জাতিকে গণউথানের চেষ্টা”র সম্পর্কটি আমার বোধগম্য হচ্ছে না!
মনু সত্যি এমন বলেছেন?
আমার মতে, আপনার এই লেখাটির সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন হয়েছে এখানেই! অথচ আমাদের অনেকের ভিতরই এমনটা দেখা যায়, যেহেতু তিনি রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শনের গভীরে ঢুকেননি, তার সমস্ত অবদানই গৌণ।
@কাজি মামুন,
নারীবাদি সমাজের অস্তিত্ব কোথাও ছিল না। সন্তানের পরিচয় মায়ের পরিচয়ে হয় মানে সেটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ মানেই সেই সমাজ নারীবাদি হয় না।
নারীর সমান অধিকার অতীতে সম্ভব ছিল না- কারন শিশু মৃত্যুর হার এত ছিল মেয়েরা ৬-৭ টা সন্তান গর্ভে না নিলে, সেই সমাজের বৃদ্ধি ছিল অসম্ভব। আর একজন নারীকে ৬-৭ টি শিশু সামলাতে হলে, খুব স্বাভাবিক ভাবে তাদের জীবন অতিবাহিত হত সন্তান পালনে। বাইরের কাজ করা সম্ভব হত না। ফলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে পুরুষের আধিপত্য স্বাভাবিক ব্যাপার। এছারাও গোল্ডবার্গে ব্যাখ্যা হচ্ছে বিবর্তনের কারনেই মেয়েরা “রাজনৈতিক আধিপত্যের” ব্যাপারে একটু অলস- অবশ্যই এ তত্ত্ব বিতর্কিত। কারন বাংলাদেশের দিকে তাকালে যে কেওই বলবেন দুই নারী নেত্রীর ক্ষমতার লিপ্সা ” রাদার নিরলস”।
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Inevitability_of_Patriarchy
শেখ হাসিনার ক্ষমতার উৎস কি?
বা ভারতে গান্ধী পরিবারের ক্ষমতার উৎস কি?
ফরাসী দার্শনিক মাইকেল ফুকো রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস এং লেজিটিমেসি নিয়ে, অনেক গবেষনা করেছেন। এখানে একটা সারসংক্ষেপ পাবেঃ
http://www.cla.purdue.edu/english/theory/newhistoricism/modules/foucaultpower.html
কিছু মুস্টিমেয় বুদ্ধিজীবি বরাবর অসংখ্য মানুষের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে । কেন?
এসবের কারন তিনি অনুসন্ধান করছিলেন।
সেই সূত্রে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রের মূলে, “স্বাধীন মানুষের” কিছু কিছু ধারনার ওপর গণঅনুগত্যের ওপর জোর দেন।
যেমন ইসলামের রাজনৈতিক শক্তির “মূল” অধিকাংশ মুসলমান মনে করে কোরান সম্পূর্ন জীবন বিধান-ফলে মুসলমান দেশগুলিতে সব রাজশক্তিকেই প্রমান করতে হয়, তাদের শাসন ইসলাম “মাফিক”-আর তার বিরোধিরা প্রমান করার চেষ্টা করে, এদের শাসন “ইসলাম বিরোধি”।
এক্ষেত্রে যেহেতু “ইসলামের ” পক্ষে গণ-রায়, সব শক্তিকেই নিজেদের ইসলামের নামে যাচাই করতে হয়।
বিবেকানন্দ ও সব কিছু হিন্দু ধর্মের পক্ষে থেকেই বিচার করেছেন। হিন্দু ধর্মকে সমালোচনা করে কিছু করেন নি। তিনি হিন্দুদের , তাদের প্রথাকে সমালোচনা করেছেন। অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম ভাল -কিন্ত হিন্দুরা খারাপ-এই ছিল তার লাইন। এটা মুসলিম সমাজে বর্তমানে বহুল চালু। কোরান ভাল-মুসলিমরা খারাপ! কারন আমাদের আশে পাশে এত বেশী চোর ডাকাত অসৎ হিন্দু বা মুসলিম চোখে পরে, হিন্দু বা মুসলিমরা ভাল-এটা কখনোই গণ “রায়” পাবে না। কিন্ত ধর্মগ্রন্থগুলো কেও পড়ে না- ওগুলোর এপ্রুভাল রেটিং বেশ বেশী।
এটা বুঝতে মুসোলিনী, হিটলার এবং স্টালিনকে জানতে হবে। এদের রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল নির্জাস হচ্ছে জাতির বস্তুবাদি উন্নতি, জাতির রাজনৈতিক অধিকারের আগে। বিবেকানন্দের জাপান ভজনার লেখাটা ভাল করে পড়লে বোঝা যাবে-তিনি বলছেন, আমাদের দেশের নেতারা লোকেরা শুধু কথা বলে চলে-আসলে কাজে কিছু করে না। দেশের লোককে খাওয়াতে পড়াতে জাপানের মতন ডিসিপ্লিনড জাতি চাই। এগুলি হিটলার মুসোলিনির ফেবারিট লাইন। থার্ড রাইখ ভাঙার সময় হিটলারের ভাষনে একই কথা আসবে-পার্লামেন্টে বিরোধিরা শুধু বাক্যবাগীশ-কথা বলে সময় নষ্ট করে। অথচ এটা কাজের সময় কারন লাখে লাখে জার্মান বেকার বসে আছে। সুতরাং জাতির ডিসিপ্লিনের স্বার্থে জার্মানীর গণতন্ত্রের কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন জাতির উন্নতির।
@বিপ্লব পাল,
ওয়াইমার রিপাবলিক বোঝাতে চাইছেন বোধহয়।
@রৌরব,
রাইট। আমার ভুল। ওটা ওয়াইমার রিপাবলিক হবে।
@বিপ্লব পাল,
একটা প্রশ্ন-
বিবেকানন্দ তো তার আসল নাম নয়। তার নামে নরেন। তিনি রামকৃষ্ণ
এর পাল্লায় পড়েন। এর পরেই কী তার এই পরিবর্তন? নাকি নিজ থেকে। নরেন তো প্রথম দিকে রামকৃষ্ণ’কে
তেমন পছন্দ করতেন না। বিবেকানন্দের বানী কে কী আমরা ধরে নিতে পারি যে রামকৃষ্ণ এর বানী?
জানতে ইচ্ছুক।
@আফরোজা আলম,
রামকৃষ্ণের শিক্ষা রামকৃষ্ণ কথামৃতে সংকলিত। তার সাথে বিবেকানন্দ রচনাবলীর ফারাক অনেক।
রামকৃষ্ণ কথামৃত অনেকটা লোক শিক্ষা, মেটাফর-এই জাতীয় ব্যাপার। বিবেকানন্দ রচনাবলীতে ভারতীয় দর্শন ভর্তি। রামকৃষ্ণর কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিল না- বিবেকানন্দ দর্শন এবং পাশ্চাত্য যুক্তিশাস্ত্রএ বি এ পাশ করেছিলেন। সেকালে বি এ পাশ করা আজকের দিনের পি এইচ ডি করার সমান বলে ধরতে হবে। ফলে বিবেকানন্দের পক্ষে সহজ হয়েছিল ভারতীয় দর্শনের বাণীকে পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে তুলনামুলক বিচার করে উপস্থাপনা করায়।
@আফরোজা আলম,
আরো একটা বিতর্কিত মন্তব্য থেকে চিরকার বিরত থেকেছি। সেটা ই প্রসঙ্গেই।
বিবেকানন্দের রচনাবলীতে দেখা যাবে তার লেখার স্টাইল টা একদম পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতন-ধাপে ধাপে যুক্তি দিয়ে সাজানো। সেই জন্যেই তিনিই প্রথম ভারতীয় গুরু যিনি পাশ্চাত্যে পরিচিত হোন। এটা তিনি পেয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রিন্সিপল উইলিয়াম হেস্টির কাছ থেকে। এখানেই তিনি লক,হিউমস, কান্ট, হার্বাট স্পেজসারের চর্চা করেন প্রায় তিন বছর। হেস্টির লেখা থেকে জানা যায় নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য দর্শন শুধু পড়েন ই নি- তিনি একজন প্রতিষ্টিত পাশ্চাত্য দার্শনিকের সমান পান্ডিত্য অর্জন করেছেন। এর পরেই তার আধ্যাত্মিক খোঁজ শুরু হয়।
লোকে যতই প্রচার করুক বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক শিষয় বা ইত্যাদি-আসলে বিবেকানন্দের লেখা পড়লে দেখা যাবে, তার চিন্তা এবং লেখার স্টাইলটা মোটের রামকৃষ্ণের মতন না। তা একজ পাশ্চাত্য দার্শনিকের মতন। বস্তুত পাশ্চাত্য দর্শনে শিক্ষা এবং সেই স্টান্ডার্ড দিয়ে ভারতীয় দর্শনকে উপস্থাপনা করা, তাকে বিখ্যাত করেছিল।সুতরাং আমার মতে লেখক বা প্রচারক বিবেকানন্দের ওপর উইলিয়াম হেস্টির প্রভাব বেশী।
কিন্ত এসব কথা কেও লেখে না বা আলোচনা করে না। কারন এসব দিকে ভাবলে বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ধর্ম ব্যবসা গড়ে উঠেছে, তা ডুবে যাবে।
@বিপ্লব পাল,
সঠিক কথা বলেছেন, কেননা নরেণ যখন এই দেশে পা রাখেন তখনই তিনি সু-শিক্ষিত হয়ে আসেন।
অনেক সময় রামকৃষ্ণের ডাকে তিনি বিরক্ত বোধ করতেন।
সহমত (Y)
বিবেকানন্দ যদি হিন্দু ধর্মকে সেই সময়ের সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে আক্রমণ করতেন তাহলে আমার বিশ্বাস বিবেকানন্দের উত্থান অঙ্কুরেই বিনষ্ট হত, হিন্দুরা বিবেকানন্দের কথায় কান দিতেন না। উনি পরিণত হতেন জাতীয় শত্রুতে। অথবা এমনো হতে পারে এই নিয়ন নীতি গুলোর প্রতি এক ধরণের দূর্বলতা থাকার কারণে কিছুটা সংষ্কার করে নিয়মগুলো বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন তিনি।
@রাজেশ তালুকদার,
আপনার বক্তব্য শতকরা ১০০% সত্য। আমি এই কথাটি অভিজিতকে ৭ বছর পূর্বে একটি বিতর্কে বলেছিলামঃ
http://groups.yahoo.com/group/mukto-mona/message/32421
সমস্যা হল এই যে স্বামী ব্রহ্মানন্দ দেখলেন রামকৃষ্ণ মিশন চালাতে হলে ধনী হিন্দু দের অর্থ সাহায্য দরকার। এরা হলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাতাল প্রজানিপীড়ক রাজন্য এবং হিন্দু জমিদার বর্গ। স্বামীজি যাদের কাছে অর্থা সাহায্য চেয়েছেন তারা এই শ্রেনীর রাজা বাদশাই ছিল। তারা সংস্কারক বিবেকানন্দর চেয়ে হিন্দু ধর্মের এম্পলিফায়ার বিবেকানন্দকে বেশী পছন্দ করতেন। ফলত রামকৃষ্ণ মিশন ক্রমশ সেই হিন্দু ধর্মের বৃহৎ গর্ভেই ফিরে যায়। বা বাধ্য হয়।
ঠিকই,
তার সম্পর্কে অনেকদিন থেকে জানবার ইচ্ছা ছিল।আপনার এ প্রবন্ধ থেকে জানার সুযোগ হল।
সম্ভব হলে নেতাজী সুভাস সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখতে পারেন। তার বিষয়েও অনকের জানবার আগ্রহ থাকবে।
ধন্যবাদ।
আমারও একটা ইচ্ছা ছিল প্রাচীন বিবেক ওবেরয়কে নিয়ে লেখার। তবে সেটা আরো পরে। আমার কষ্টটা কমিয়ে দিলেন। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ টপিক বাদ দিয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। সেটা হল,
নামে দুই লাইনের এক মহান বানী। এই বানী যে দেয় সেই কিনা আবার মা ধবল থুক্কু কালীর জন্যে বলির ব্যবস্থা করে। প্রতারনার কী সুন্দর উদাহরন।
@সাইফুল ইসলাম, ভাই কিছুক্ষন পরই এক বুদ্ধবাবা এসে জীবের সংজ্ঞা লৌকিক বা লোকত্তর নাকি সংকীর্ণ না বৃহৎ অর্থে বলা হয়েছে বলবে সুতরাং বিবেকানন্দ জিও :guru: 😀
@সাইফুল ইসলাম,
রামকৃষ্ণ মিশন সেবা ধর্মের ওপর জোর দেয়, সেখানে বলি নেই। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্নাসীদের ধ্যান করার থেকেও মানবসেবা [ যেমন দরিদ্র এলাকাতে শিক্ষার বিস্তার, বন্যার সময় সাহায্য করা] করার ওপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭১ এর যুদ্ধের সময় গোটা পশ্চিম বঙ্গ বর্ডার জুরে, রামকৃষ্ণ মিশন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য রান্না করেছে, চিকিৎসা দিয়েছে।
এখানে ডিসকানেক্ট নেই।
ডিসকানেক্ট এখানে যে, তার সাম্য এবং জাতিভেদের বাণীতে ভারতে জাতিভেদ প্রথার প্রভাব কমে নি। কুসংস্কার কমে নি। ধর্মে মেয়েদের অবস্থান ভাল হয় নি। কারন তিনি হিন্দু ধর্মকে সমালোচনা করা শেখান নি-ধর্ম ভাল-মানুষ ঠিক ঠাক ধর্ম পালন করছে না। এমন অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে তা হিন্দু জাতিয়তাবাদের সহায়ক হয়ে ওঠে।
ছোট কালে বিবেকান্দের জীবনী পড়ে তাকে আধুনিক ভারতের মহাগুরু জাতীয় কিছু একটা মনে হয়েছিল। সেটা অবশ্য বড় হবার সাথে সাথে কেটে যায়, তার একটা কারন সম্ভবত আমার মুসলিম উত্তরাধিকার ও অবিশ্বাসের পথে হাঁটার জন্য। তবে বিবেকানন্দ সম্পর্কে আমার জানার কৌতুহল হয় সুনীলের ‘প্রথম আলো’ পড়ে।
নেতাজী সুভাষ বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়ে দেশোদ্ধারে নেমে পড়লেন(এটাকে খারাপ অর্থে না নিলে খুশী হবো), আর বিবেকানন্দ হঠাৎ করেই বলতে গেলে জাতীয়তাবাদী ছেড়ে ধর্মবাদী হয়ে গেলেন পুরো দস্তুর। এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই রহস্যময় মনে হয় কেন তিনি হঠাৎ করে মোড় ঘুরে পুরোপুরি ধর্মপথে চলে গেলেন! তার ক্ষমতা ছিল অনেক কিছুই করার, কিন্তু তিনি কিছুই না করে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম প্রচার করে মানুষের চোখ অন্ধ করে দিয়ে অন্ধ ভক্তি অর্জন করগেলেন শুধু। আর এখন তার ভক্তদের ধারনা স্বামী বিবেকানন্দই সর্ব প্রথম মানুষকে ভালবাসা শিখিয়েছেন।
বিবেকানন্দের প্রতিভা পুরোটাই অপচয় বলে আমার মনে হয় এখন!
@থাবা,
নেতাজিএর সাথে বিবেকানন্দের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলে নিই। তাহলে হইয়ত ধোঁইয়াশা কাটবে।
বিবেকানন্দের মৃত্যুকাল ১৯০২, নেতাজির জন্মকাল ১৮৯৭।
নেতাজি বিবেকানন্দের ভারতের ধারনায় এবং তার রাজনৈতিক বক্তব্যে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এতটাই যে তরুণ বয়সে রাজনীতি ছেরে, রামকৃষ্ণ মিশনে সন্নাসী হওয়ার জন্যে গৃহত্যাগ করেছিলেন। তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আবার রাজনীতিতে ফেরত পাঠান স্বামী ব্রহ্মানন্দ যিনি বিবেকানন্দের গুরু ভাই। নেতাজির রাজনৈতিক আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সামাজিক চিন্তা। সেই জন্যে বলা চলে নেতাজি হচ্ছে বিবেকানন্দের রাজনৈতিক মানস সন্তান।
এই স্বামী ব্রহ্মানন্দ আশ্চর্য চরিত্র। সবাই স্বামী বিবেকানন্দের না, জানে অথচ স্বামী ব্রহ্মানন্দের নাম খুব কম লোকেই জানে। ইনি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং রামকৃষ্ণ মিশনের এই উত্থানের পেছনে তার অবদান সর্বাধিক। বিবেকানন্দ খেতে ভাল বাসতেন, রান্না করে খাওয়াতেন/ ধূমপান ও করতেন। মোদ্দা কথায় বেশ ভোগী লোক ছিলেন। ব্রহ্মানন্দ ছিলেন বিশুদ্ধ ত্যাগ এবং সেবা ধর্মের প্রতীক।
তবে তার আমল থেকেই রামকৃষ্ণ মিশন সমাজ সংস্কারের পথে না হেঁটে আরো বেশী হিন্দু ধর্মের মধ্যে ঢুকে পড়ে। স্বামীজির সমাজ বা রাজনৈতিক চিন্তার সংস্কারের দিয়ে মিশন আর কোন দিন হাঁটে নি। এবং ভগিনী নিবেদিতার সাথে মিশনের সম্পর্ক কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে “বন্ধ” করা হয় কারন নিবেদিতা ভারতের বিপ্লবীদের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
অন্যদিকে বিবেকানন্দ কেন রাজনীতি যে যান নি- সেটা মনে হয় না গুরুত্বপূর্ণ।
কারন ভারতের ১৯০০-১৯৫০ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধের রাজনীতিতে তার প্রভাব অপরিসীম। প্রতিটি বিপ্লবী দলে তার রচনাবলীর চর্চা হত। এমন কোন বিপ্লবী ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে পাওয়া যাবে না, যিনি স্বামীজি প্রভাবিত নন।
@বিপ্লব পাল,
দাদা, ধোঁয়াশা কাটার বদলে বেড়ে গেল… সিস্টার নিবেদিতা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যেটা এক সময় স্বামীজী ভালভাবে নেননি… কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল এটা আমার কাছে নতুন।
দাদা, আরেকটা ছোট্ট কৌতুহল ছিল, যদি আলোকপাত করেন… শ্রী অরবিন্দের বিপ্লবী থেকে সাধু হয়ে যাবার এই ট্রান্সফর্মেশনটা নিয়ে যদি কিছু লিখেন…!!!
“এমন কোন বিপ্লবী ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে পাওয়া যাবে না, যিনি স্বামীজি প্রভাবিত নন”-ভগত সিংহ কি প্রভাবিত ছিলেন ?
লেখা ভাল লাগল।
খুব সুন্দর একটা লেখা লিখেছেন বিপ্লবদা। বিবেকানন্দ বেশ কিছুদিন ধরেই আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। “Complete works of Swami Vivekananda” পড়ছি কয়দিন হল। উনার কয়েকটা লেখা পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হই আবার কয়েকটা লেখা পড়ে কিছুটা আশাহত হই এই ভেবে যে উনি কিছু সহজ জিনিষ ধরতে পারছেন না বা এড়িয়ে যাচ্ছেন। ধর্ম বা দর্শনের ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের বিশ্লেষণী শক্তি খুবই প্রখর। বিভিন্ন ধর্মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে তিনি খুব পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র চিন্তায় তাকে খুব একটা ভাল পাইনি। অনেক কিছুই তিনি ঘুরিয়ে বলেছেন যেমন একবার বলেছিলেন “ভারতে ধর্ম উদার কিন্তু সমাজ সংকীর্ণ আর পশ্চিমে ধর্ম সংকীর্ণ কিন্তু সমাজ উদার”। এর মাধ্যমে তিনি পরোক্ষভাবে হিন্দু ধর্মের সামাজিক অসঙ্গতিগুলোকে অস্বীকার করেছেন। বলতে চেয়েছেন হিন্দুদের সামাজিক কুসংস্কারগুলো ধর্মের অংশ নয় কিন্তু আমরা জানি তা সত্য নয়। আমার মতে কথাটা হওয়া উচিত এমন “ভারতে ধর্মের দার্শনিক অংশ উদার কিন্তু সামাজিক অংশ নয় আর পশ্চিমে তথা সেমেটিক ধর্মে দার্শনিক অংশ খুবই সংকীর্ণ কিন্তু সামাজিক অংশ তুলনামুলকভাবে উদার”।
এই অংশটুকুর সাথে পুরোপুরি সহমত। তার অনেক বাণী আমাকে অনুপ্রাণিত করে। জীবনকে সুন্দর ও সফল করার নির্দেশনা দেয়। তিনি সবসময় উপলব্ধির উপর জোর দিয়েছেন। উপলব্ধি ছাড়া জ্ঞান হয়ে পড়ে অন্তঃসারশূন্য ও নিরাবেগ। তাই এটা খুবই জরুরি। প্রায় প্রত্যেকটি প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মূল কথা ছিল আত্মউপলব্ধি। বৌদ্ধ এবং জৈনরা ঈশ্বর লাভের জন্য সাধনা করত না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ভেতরের ঈশ্বরকে বের করে আনা যেটাকে বিবেকানন্দ বলেছেন to evolve a god out of man। বিবেকানন্দ সফল ও অনুকরণীয় মানবতাবাদী কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা, কর্মপদ্ধতি আধুনিক জ্ঞানবাদী, মুক্তবুদ্ধির সমাজ গঠনের জন্য সহায়ক নয়।
@আলোকের অভিযাত্রী,
এটা ঠিক ধর্মের আধ্যাত্মিক দিকগুলো বুঝতে বিবেকানন্দের রচনা সব থেকে বেশী সাহায্য করবে। আবার এটাও ঠিক, তিনিও সামাজিক শক্তি হিসাবে ধর্মগুলির বিন্যাস বুঝতে পারেন নি। তাই ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম এবং সমাজকে আলাদা করেছেন। ধর্ম ভাল, সমাজ খারাপ-এই ধরনের লাইন নিয়েছিলেন-যেটা বেশ হাস্যকর এই জন্যে যে ধর্ম সমাজের সেলফ অর্গানাইজেশনের অংশ মাত্র।
ঠিক এই লাইনটার জন্যেই এই লেখা। তার রাজনৈতিক এবং সামাজিক চিন্তার ভাবনার মধ্যে “ক্রিটিক্যাল বা ডায়ালেক্টিক” চিন্তাধারার অভাব ছিল। তার চিন্তা অনেকটাই তার নিজস্ব উপলদ্ধি।
বিপ্লব,
বিবেকানন্দকে নিয়ে আমিও একটা লেখা দেয়ার প্ল্যান করছিলাম। প্রায় পুরোটুকু লিখে এনেছি – আর এখন দেখলাম তোমার লেখাটা। আমারটা এখন দিলে তো মনে হয় অনেক কিছুই ডুপ্লিকেট হয়ে যাবে। তোমার নিশ্চয় মনে আছে এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা মুক্তমনা ইয়াহুগ্রুপ্স-এ (এখানে কিংবা এখানে), তারপরে ব্লগের নানা মন্তব্যেও। তোমার তখনকার স্ট্যাণ্ড-এর সাথে এখন অনেক পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ!
@অভিজিৎ,
তোমার লেখাটা এখনই পোষ্ট করা উচিত। বিবেকানন্দের সাধ শতবর্ষ উপলক্ষ্যে অনেক লেখা মেইন স্ট্রিমে বেড়চ্ছে।
আমি আরো একটা ব্যাপারে লিখি নি। বিবেকানন্দও ” বিজ্ঞানে” সবই “ব্যাদে” আছে গোত্রের লেখা লিখেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। হিন্দু ধর্ম তথা উপনিষদ কত বৈজ্ঞানিক সে ব্যাপারে সর্বত্র লিখেছেন। বিবর্তন সাংখ্য দর্শনে আছে ইত্যাদি মণি মুক্ত ছড়িয়েছেন। এটা ভেবেছি, পরের কোন প্রবন্ধের জন্যে তোলা থাক। আমি এই লেখাটা মূলত তার সামাজিক এবং রাজনৈতিক চিন্তার অগভীরতা দেখাতে লিখেছিলাম।