লিখেছেনঃ নাছির আলম

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ‘মাস্তান ছাড়া সবাই অসহায়’ এ চরম সত্যটি অনুধাবন করতে কারো সমাজ বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের অতি সহজ সরল সাধারণ মানুষটিও আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে আমাদের সবুজ মানচিত্রের শ্যামল প্রান্তরে অকুতোভয় সন্ত্রাসীদের সোনালী রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে একদিনে প্রতিষ্ঠত হয়নি এই রাজত্ব। আমাদের আকাশচুম্বি লোভ লালসা আর নির্লজ্জ স্বার্থপরতার ভিতের উপর গড়ে উঠেছে বেহায়া, দূর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী রাজপুত্রদের এক বিশাল সাম্রাজ্য। এই রাজপুত্রদের সীমাহীন ক্ষমতার সরল উৎস রাষ্ট্র। এদের অপরিসীম দূষ্কর্মের সুদৃঢ় ছত্রছায়া অসহায় মানুষের পয়সায় পরিপুষ্ঠ চির-দূর্নীতিবাজ প্রশাসন। (প্রথম শ্রেনীর দূর্নীতিবাজ প্রশাসনের সিংহ পুরুষগুলো যেন অনন্তকাল যাবৎ কারো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। জনগনের কাছে তাদের দায়বদ্বতা শুধু কাগজে-কলমে। জনগনের ভোটে এরা নির্বাচিত নয় তাই কোনরকম জবাবদিহিতা এদের বেড়ে উঠার পথে কোন বাধাঁ হয়ে দাড়ায় না। তারা দিনে দিনে বেড়ে উঠে ক্ষমতায়, বেড়ে উঠে বিত্ত-ভৈববে। এদের আকাঁশ-ছোয়া বিত্ত-ভৈববের খবর কে না জানে? সরকারী সকল সম্পদের স্বঘোষিত মালিক এরাই) এদের পরিত্রাণকর্তা প্রচলিত রাজনীতি, প্রচলিত গণতন্ত্র(যে গণতন্ত্র শুধু ভোটের রাজনীতি বুঝে মানুষের মৌলিক অধিকার বুঝে না)।প্রচলিত রাজনীতির(যার প্রথম এবং প্রধান চাওয়া ক্ষমতা) পরিপাটি পোশাক পরে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রের বিশাল আনুকূল্যে এরা পরিচালিত হয় নির্ভয়ে এরা পরিবর্ধিত হয় আয়তনে। এভাবে নিরন্তর বাড়ছে এদের সাম্রাজ্য, এদের ভৌগলিক সীমা-পরিসীমা। রাষ্ট্র এদের অনুগত। রাষ্ট্রের নিঃশর্ত আনুগত্য এদের সীমাহীন ঘুষ-দূর্নীতি, সন্ত্রাসের সহজ সুযোগ তৈরী করে।

সন্ত্রাস কি চায়? ভোগ-দখল, আধিপত্য। আধিপত্য অবৈধ সম্পদের বিশাল পাহাড় বিনির্মাণের প্রয়োজনে। অবৈধ সম্পদ রক্ষা করতে চায় নিরংকুশ ক্ষমতা। নিরংকুশ ক্ষমতার উৎস প্রচলিত রাজনীতি। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি আবার রাজনীতির জন্য প্রয়োজন কাড়ি কাড়ি টাকা। কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জনের জন্য প্রয়োজন পড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা।(রাজনীতি ক্ষমতা সম্পদ। এ এক আকর্ষণীয় সাইক্লিক অর্ডার। তাই আজকের বাংলাদেশ এমন একটি রাজনীতি ধারণ করে যার সাথে মনোপলি বাবসার তুলনা চলে এবং যে ব্যবসাতে কোনো বিনিয়োগই বিফলে যায় না)। এরা যেন একে অন্যের পরিপুরক। সম্পদ উপার্জনের জন্য প্রয়োজন যে রাজনীতি তাতে ঘুষ-দূর্নীতি-সন্ত্রাসের বিকল্প কি হতে পারে? তাই সন্ত্রাস আর রাজনীতি সমার্থক হয়ে দাড়ায়। তাই এখানে আশি শতাংশের বেশী সন্ত্রাস তৈরী হয় রাজনীতি থেকে। বিশ শতাংশের কম যে সামাজিক সন্ত্রাস তাও আবার কখনো কখনো রাজনীতিতে আশ্রয় খুঁজে পায়।

প্রচলিত রাজনীতিতে জনগণ ক্ষমতার উৎস হতে পারে না। ক্ষমতার উৎস অবৈধ সম্পদ, অবৈধ সম্পদের উৎস রাজনৈতিক ক্ষমতা,তাই ভোটের মালিক প্রজাকূল(কখনো কখনো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয় এই মালিকানা),ক্ষমতার মালিক যুবরাজগণ। রাজনীতির গর্ভ থেকে জন্ম নেয় ঘুষ-দূর্নীতি-সন্ত্রাসের অকুতোভয় দৈত্য-দানবেরা। আজ এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে একশত ষাট মিলিয়ন নিরীহ প্রজার ভাগ্য। এরা দেবতা সমতুল্য। রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসন এদের পূজা অর্চনায় গলদঘর্ম। এরা মহান সংসদের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আইন বানায়। এদের আইনে পরিচালিত হয় রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি। এরা মানুষকে অঝোরে কাঁদায় আবার মানুষের জন্য কাঁদে(ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এদের বুকফাটা ক্রন্দনে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠে)। মানুষ বহন করে কষ্টের বোঝা- মিল চালায়- লাংগল টানে- প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পেছনে ফেলে বিদেশ পাড়ি দিয়ে শরীর, মগজ (ভদ্র ভাষায় শ্রম বলা চলে)বিক্রি করে মুদ্রা আহরণ করে। সে মুদ্রার স্বাদ পায়না তার অনাহারী-অর্ধাহারী প্রিয়জনেরা। সে মুদ্রা দিয়ে রাজপুত্ররা অত্যাধুনিক বাহন কিনে, টেকনাফ-তেতুলিয়া চষে বেড়ায়। সে মুদ্রা দিয়ে সচিবালয় তৈরী হয়- সংসদ ভবন তৈরী হয়, সরকার চলে- রাষ্ট্র চলে। ক্ষমতাহীন রক্তশূন্য মানুষগুলো প্রশ্ন তুলেনা- কার সরকার? কিসের সরকার?

প্রচলিত গণতন্ত্রে ‘জনগণের সরকার, জনগণের জন্য সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার’ এই দার্শনিক বাক্যটি শুধুমাত্র দর্শনশাস্ত্রে শোভা পায়। আজকের বাংলাদেশে গনতন্ত্রে চলছে নির্লজ্জ বাণিজ্যিক বিনিময়। অত্যন্ত সফল বাণিজ্য-মনোয়ন বাণিজ্য, ভোটের বাণিজ্য। কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনে নেয় গনতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরীরা। আবার ভোট কেনার জন্য ব্যায় করে কোটি কোটি টাকা। কারো প্রার্থীতার যোগ্যতার মাপকাঠি রাজনীতি নয়, বৈধ-অবৈধ টাকার পরিমাণই নির্ধারণ করে তার ভাগ্য। প্রার্থী বাছাইয়ের রুদ্ধদ্বার সাক্ষাৎকারে প্রথম এবং প্রধান যে জিনিসটি পরখ করা হয়-তা হচ্ছে এইমুহূর্তে কার হাতে পূঞ্জিভূত টাকার পরিমাণ কত। মনোয়ন কেনার জন্য কে কত টাকা নগদ দিতে পারে এবং মনোনয়ন পেলে ভোট বাণিজ্যের জন্য কে কত টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। কার কত রাজনৈতিক যোগ্যতা, কার কত নৈতিকতা এবং কার কত জনসম্পৃক্ততা তা মোটেই বিবেচ্য বিষয় হতে পারেনা। দলের মার্কা হচ্ছে প্রাথীর ট্রেড মার্ক। তাই শ্লোগান তৈরী হয়-মার্কা আছে? কোন সে মার্কা?—-। তাই যার হাতে টাকার পরিমাণ বেশী মনোয়ন পাওয়া তার জন্য একেবারেই সহজ। গণতন্ত্রের চর্চ্চা এখানেই শেষ নয়। সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-নেত্রী নির্বাচনেও নীতি-নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক সততা ও যোগ্যতার কোনরকম প্রয়োজন অনুভব করা হয়না। এখানেও টাকা-প্রভাব-প্রতিপত্তির সুচতুর খেলা। এইভাবে তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত, আঞ্চলিক নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত লুঠেরা মহাজনদের হাতে গণতন্ত্রকে সজ্ঞানে সুপরিকল্পিতভাবে বিক্রি করে আমাদের নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রের মানসপুত্র-মানসকন্যা। এইভাবে বাণিজ্যিক বিনিময়ের মাধ্যমে গড়ে উঠা রাজনৈতিক সততা, নৈতিকতা বিবর্জিত নেতৃত্ব- সাদা পোশাকের কালো টাকার মানুষগুলো ক্ষমতা গ্রহণ করে। দেশ ও দেশের মানুষকে নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান করবে এই ভাবনা বাতুলতা মাত্র। মনোয়ন খরিদ করে সৌভাগ্যবান মহাজনগুলো হয়ে উঠে দেশের ত্রাণকর্তা। দেশের সর্বোচ্চ আইন পরিষদ সংসদে বসে এরা আইন তৈরী করে, সেই আইনেই পরিচালিত হয় দেশ। নির্বাচিত সরকারের আমলে কালো টাকা সাদা হয়, ঋণখেলাপীরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়, খুনের আসামী ক্ষমা পেয়ে যায় ,থানা-কোর্ট-কাচারী পরিচালিত হয় দাগী চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের(নেতা-নেত্রীদের পালকপুত্র) আঙ্গুলি ইশাঁরায়। এসবের মুল শেকড় এখানেই- আমাদের আজকের দিনের গণতান্ত্রিক চর্চায় একথা অতি সাধারণ মানুষও একটু খোলা মনে চিন্তা করে অনুধাবন করতে পারে। মজার ব্যাপার এই বিশাল বাণিজ্যের সফল পুরূষেরা শুধু সংসদে আসন গ্রহণ করেন না দায়িত্ব নেন মন্ত্রণালয়ের। ব্যবসা বাণিজ্যের অলি-গলি বিচরণ করে বৈধ-অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে যে সফল ব্যবসায়ী তিনি পেয়ে যান বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের গুরু দায়িত্ব, পরিহন সেক্টরে উপার্জনের হারাম-হালাল সকল কলা-কৌশল রপ্ত করে যিনি অনেক উপরে উঠে যান তিনি দেশের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মালিক(ভদ্র ভাষায় মন্ত্রী)। (ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে ভাসে) তাই তো দেশের বিশাল মানুষের ভাগ্য নিয়ে জুঁয়া খেলছে যে সাধুবাবারা তাদের বিরুদ্ধে সকল আস্ফালন হয়তো লোক দেখানো অথবা ভাগ-ভাটোয়ারার দ্বন্ধ।