(তৃতীয় পর্বের পর…)

মনুসংহিতায় নারী
এক কথায় বলতে হলে, মনুশাস্ত্রে নারী হচ্ছে পুরুষের ইচ্ছাধীন কর্ষণযোগ্য ক্ষেত্র বা জৈবযন্ত্র, যাতে পুরুষপ্রভু তার বীর্যরূপ বীজ বপন করে পুত্ররূপ শস্য হিসেবে যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের মাধ্যমে ধর্মরূপ পুরুষতন্ত্রের বহমান ধারাটিকে সচল রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। এখানে নারী কেবলই এক পুরুষোপভোগ্য জৈবসত্তা। নারীর মনস্তত্ত্ব বা কোনরূপ মানসিক সত্তাকে মনুশান্ত্রে স্বীকারই করা হয়নি। নারীর দেহসত্তাটিরই প্রাধান্য এখানে, যার মালিকানাও নারীর নিজের নয় অবশ্যই। এর মালিকানা শুধুই আধিপত্যকামী পুরুষ প্রভুর। পুরুষতন্ত্র তার ইচ্ছানুরূপ শারীরিক-মানসিক ভোগ-লিপ্সা চরিতার্থ করতে, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি ও সত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত রাখতে এবং তার নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদ কায়েম রাখতে যখন যা করার প্রয়োজন মনে করেছে, ধর্মশাস্ত্রের নাম দিয়ে মনুশাস্ত্রে তার সবই প্রয়োগ করা হয়েছে। কোন কিছুরই বাদ রাখা হয়নি। সর্বক্ষেত্রেই নিজেদের অনুকূলে প্রয়োজনীয় আইন ও অনুশাসন সৃষ্টির মাধ্যমে নারীকে বাধ্য করেছে সম্পূর্ণ পদানত রাখতে। এমনকি নারীভোগকে আরো উপভোগ্য করে নিংড়ে নেয়ার প্রয়োজনে নারীর মনস্তাত্ত্বিক যে বিমূর্ত জগত যেখানে আইনের শাসনও পৌঁছাতে পারে না, সেখানেও আধিপত্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ফাঁপা প্রশংসা বা কল্পিত গুণ-গান করে তাকে সুযোগমতো প্রতারণা করতেও দ্বিধা করা হয় নি।
.
তাই পুনরুক্তি হলেও এখানে যে বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া দরকার, মনুশাস্ত্রের বর্ণভিত্তিক সমাজে দ্বিজ না হওয়ার কারণে বর্ণদাস শূদ্রের যেমন নিজের মালিকানাও নিজের থাকে না, প্রভুর অধীন সে, তেমনি নারীও স্পষ্টভাবে পুরুষপ্রভুরই অধীন। সাধারণ শূদ্রের ক্ষেত্রে সে হয়তো জন্মসূত্রে শ্রমদাস হয়ে জন্মানোর কারণে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের সেবাদাস হয়ে আমৃত্যু শ্রমসেবা দিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু মনুশাস্ত্রের নারীর অবস্থা আরো শোচনীয়। জন্মসূত্রে শূদ্রতুল্য হওয়ায় ভিন্নভাবে একই নিয়তি তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলেও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নারীদেহটির কারণে তাকে শ্রমসেবার পাশাপাশি ইচ্ছেরহিত এক ভয়ঙ্কর দেহমূল্যও দিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে নারী শূদ্রের চেয়েও অধমই বলা যায়। আরেকটু এগুলেই আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, সর্বজ্ঞ মনুশাস্ত্রে নারীকে কিভাবে বিশেষিত করা হয়েছে।
.
পুরুষের কর্ষণযোগ্য শস্যক্ষেত্র নারী
নারী হচ্ছে পুরুষের মালিকানাধীন ও ইচ্ছাধীন কর্ষণযোগ্য শস্যক্ষেত্র, এটাই নারীর প্রতি ধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্তও। এই সিদ্ধান্ত নিরাপদে অটল রাখার প্রয়োজনেই গোটা মনুসংহিতায় নারী বিষয়ক যাবতীয় অনুশাসন একই দৃষ্টিভঙ্গিরই অনুগামী হয়েছে বলা যায়।

‘ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্।
ক্ষেত্রবীজসমাযোগাৎ সম্ভবঃ সর্বদেহিনাম্।।’
নারী শস্যেক্ষেত্রের মতো, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। এই ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে সকল প্রাণীর উৎপত্তি। (৯/৩৩)।
.
‘বীজস্য চৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।
সর্বভূত প্রসূতির্হি বীজলক্ষণলক্ষিতা।।’
বীজ এবং যোনি এই দুটির মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ বলে কথিত হয়। কারণ, সর্বত্র সন্তান বীজের লক্ষণ যুক্ত হয়ে থাকে। (৯/৩৪)।

এখানে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত। যেহেতু আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজকৃষ্টিতে নারীকে পুরুষের শস্যক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তাই পুরুষ তার নিজস্ব শস্যেক্ষেত্রে ইচ্ছে-স্বাধীন কর্ষণ করে প্রয়োজনীয় বীজ বপন করে পছন্দসই ফসল তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এবং ক্ষেত্রের মালিক যেহেতু পুরুষই, তাই ফসলের মালিকও পুরুষ প্রভুই হবে এটাও শিরোধার্য। তবে বিশেষ ধরনের সম্পদের মোহনীয় উপস্থিতি যেখানে স্পষ্ট, সেখানে মালিকানা দ্বন্দ্বেরও যে ক্রমবিকাশ ঘটে তার ইঙ্গিতও মনুসংহিতায় অস্পষ্ট নয়-

‘নশ্যতীষুর্যথা বিদ্ধঃ খে বিদ্ধমনুবিধ্যতঃ।
তথা নশ্যতি বৈ ক্ষিপ্রং বীজং পরপরিগ্রহে।।’
যেমন অন্যের শরে বিদ্ধ কৃষ্ণশারাদি প্রাণীর শরীরে ঐ বেধজনিত ছিদ্রে অন্য কোনও ব্যক্তির দ্বারা নিক্ষিপ্ত বাণ নিষ্ফল হয়, এবং ঐ মৃগ প্রথম বাণনিক্ষেপকারী পুরুষেরই প্রাপ্য হয়; সেইরকম পরস্ত্রীতে নিক্ষিপ্ত বীজও বীজী পুরুষটির নষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু তা থেকে উৎপন্ন সন্তানটি হয় ক্ষেত্রস্বামীর। (৯/৪৩)।

অর্থাৎ ব্যভিচারী প্রভাবশালী পুরুষদের মধ্যে নারীরূপ ক্ষেত্র দখল ও ভোগের যে স্বেচ্ছাচারিতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজদেহে প্রচল ছিলো এবং তার ফসল হিসেবে সন্তান সৃষ্টি ও তার মালিকানাজনিত জটিলতায় সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের উপর্যপুরি সম্ভাবনাও যে প্রকট হয়ে ওঠছিলো তা বুঝাই যায়। এই উদ্ভুত বিশৃঙ্খলা নিরসন করার প্রয়োজনেই সন্তানের মালিক চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে নারী যার মালিকানায়ই থাকুক না কেন তা যে লোভনীয় ও ভোগ্য এবং তা ভোগ করার ক্ষেত্রে চিরায়ত পুরুষশ্রেষ্ঠের জন্য কোথাও কিঞ্চিত অনৈতকতাদোষ থাকলেও তা যে অবৈধ নয় তা-ই আসলে পরোক্ষভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীমাত্রেই পুরুষভোগ্যা। এখানে দ্বন্দ্ব নারীর নয়, কেননা পুরুষ ভিন্ন তার স্বকীয় কোন অস্তিত্ব থাকার কথাও নয়। যেহেতু এই দ্বন্দ্ব পুরুষের সাথে পুরুষের, একজন পুরুষের বৈধ মালিকানার নারীতে যাতে অন্য কেউ পুরুষশ্রেষ্ঠতার প্রভাব নিয়ে ভোগের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে মনুশাস্ত্রে প্রভাবশালী পুরুষগণকে অতি উদার ও নমনীয়ভাবে কাল্পনিক অতীত গাথার প্রসঙ্গ টেনে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়-

‘অত্র গাথা বায়ুগীতাঃ কীর্ত্তয়ন্তি পুরাবিদঃ।
যথা বীজং ন বপ্তব্যং পুংসা পরপরিগ্রহে।।’
পরস্ত্রীতে বীজ বপন করা পুরুষের যে উচিত নয় সে সম্বন্ধে অতীতকালজ্ঞ পণ্ডিতেরা বায়ুকথিত কতকগুলি গাথা অর্থাৎ ছন্দোবিশেষযুক্ত বাক্য বলে গিয়েছেন। (৯/৪২)।
.
‘অন্যদুপ্তং জাতমন্যদিত্যেতন্নোপপদ্যতে।
উপ্যতে যদ্ধি যদ্বীজং তত্তদেব প্ররোহতি।।’
একরকম বীজ বপন করা হল আর অন্য রকম শষ্য জন্মালো, এরকমটি হতে পারে না; কিন্তু যেমন বীজ বপন করা হয় সেইরকমই ফসল তা থেকে জন্মায়। (৯/৪০)।
.
‘তৎ প্রাজ্ঞেন বিনীতেন জ্ঞানবিজ্ঞানবেদিনা।
আয়ুষ্কামেণ বপ্তব্যং না জাতু পরযোষিতি।।’
অতএব বীজ যখন ঐ রকম প্রভাবসম্পন্ন, তখন প্রাজ্ঞ (যিনি স্বাভাবিক প্রজ্ঞার দ্বারা যুক্ত), বিনীত অর্থাৎ শিক্ষিত, জ্ঞানে (অর্থাৎ বেদাঙ্গশাস্ত্রে) এবং বিজ্ঞানে (অর্থাৎ তর্ক-কলা প্রভৃতি-বিষয়ক শাস্ত্রে) অভিজ্ঞ এবং আয়ুষ্কামী ব্যক্তি নিজশরীরস্থিত ঐ বীজ কখনো যেন পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে বপন না করেন। (৯/৪১)।
.
‘যাদৃশং তূপ্যতে বীজং ক্ষেত্রে কালোপপাদিতে।
তাদৃগ্ রোহতি তত্তস্মিন্ বীজং স্বৈর্ব্যঞ্জিতং গুণৈঃ।।’
বপনের উপযুক্ত বর্ষাকাল প্রভৃতি সময়ে উত্তমরূপে কর্ষণ-সমীকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির দ্বারা সংস্কৃত ক্ষেত্রে যেরকম বীজ বপন করা হয়, সেই প্রকার ক্ষেত্রে সেই বীজ বর্ণ-অবয়বসন্নিবেশ রস-বীর্য প্রভৃতি নিজগুণের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে শস্যরূপে উৎপন্ন হয়। (৯/৩৬)।

অতএব এই ভয়ঙ্কর সত্যটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, মনুর ধর্মীয় দৃষ্টিতে ক্ষেত্রস্বরূপা নারী প্রকৃত অর্থেই জড়স্বভাবী পরাধীন সত্তা। কে কখন কিভাবে কোথায় তার উপভোগ্য নারীদেহটিকে নানারূপে নানাভাবে কর্ষণ বা ভোগ করলো কি না-করলো তা ওই নারীর দেখার বিষয় নয়, এ অধিকারও তার নেই। কারণ-

‘প্রজনার্থং স্ত্রিয়ঃ সৃষ্টাঃ সন্তানার্থঞ্চ মানবাঃ।’
গর্ভধারণের জন্য নারী এবং গর্ভাধানের জন্য পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে। (১০/৯৬)।

নারীদেহ যতই ভোগ্যপণ্য হোক, তবু পুরুষের মোক্ষলাভ তথা জন্মান্তরবাদী দৃষ্টিতে ইহলৌকিক-পারলৌকিক মুক্তি ও আধিপত্য অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী এই নারীদেহে পুত্র উৎপাদনই যেহেতু পুরুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তাই পছন্দসই পুত্র উৎপাদনার্থে তার একান্ত মালিকানাধীন স্ত্রী হিসেবে ভোগ্য ও যোগ্য নারীটি বাছাইয়ের দায়িত্বও পুরুষের উপরই বর্তায়। এক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্রের চাপানো অনুশাসনে নারীকে সম্পূর্ণ পরাধীন ও বাসনারহিত চেতনবস্তু হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
.
পুরুষের স্ত্রী-সংগ্রহে নারীর যোগ্যতা
মনুশাস্ত্রের ভোগবাদী দৃষ্টিতে নারী যেহেতু শস্যক্ষেত্রস্বরূপ, তাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরুষেচ্ছায় সন্তোষ প্রদানক্ষম দেহের যোগ্যতা দিয়েই নারীর যোগ্যতা নির্ণিত হয়। এর সাথে ক্ষমতার উত্তরাধিকারের মূর্ত প্রতীক পুত্র উৎপাদন সক্ষমতা জড়িত থাকার বিষয় তো রয়েছেই। তাই পুরুষদেরকে পুত্র উৎপাদনে সক্ষম জননোপযোগী কন্যা নির্বাচনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে অবশ্যই তা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে-

‘অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।
সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।
যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহবংশজাত না হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্বসম্পাদক বিবাহব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।

মাতামহ বা পিতামহের বংশজাত হলেই কি নারীর সাথে মৈথুন জনিত শারীরিক ক্রিয়ায় কোন সমস্যা হবার কথা ? মোটেও তা নয়। তবু মৈথুন কাজটিকে গুরুত্ব দেয়ার কারণ নিশ্চয়ই মৈথুনকর্মে সৃষ্ট সন্তান জন্মদানের প্রসঙ্গেই বিবেচিত হয়েছে। স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের লক্ষ্যে এই কন্যা নির্বাচন জনন উপযোগী হলেও যাতে উত্তরাধিকার মনোনয়নে সন্তানের বংশগতির ধারাটি নিরুপদ্রব থাকে তারই গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে এখানে। আবার কোন অর্থনৈতিক সুবিধা অস্বীকার করে হলেও এই বংশধারা সুস্থ-সাবলিল রাখার তাগিদেই হয়তো ঘোষিত হয়েছে-

‘মহান্ত্যপি সমৃদ্ধানি গোহজাবিধনধান্যতঃ।
স্ত্রীসম্বন্ধে দশৈতানি কুলানি পরিবর্জয়েৎ।।’
ব্ক্ষ্যমান দশটি কুল (বংশ বা পরিবার) গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশু এবং ধন ও ধান্যে বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হলেও স্ত্রীসম্বন্ধ-ব্যাপারে সেগুলি বর্জনীয়। (৩/৬)।

এই দশটি কুল কী ?-

‘হীনক্রিয়ং নিষ্পুরুষং নিশ্ছন্দো রোমশার্শসম্।
ক্ষয্যাময়াব্যপস্মারিশ্চিত্রিকুষ্ঠিকুলানি চ।।’
(এই কুলগুলি হল-) যে বংশ ক্রিয়াহীন (অর্থাৎ যে বংশের লোকেরা জাতকর্মাদি সংস্কার এবং পঞ্চমহাযজ্ঞাদি নিত্যক্রিয়াসমূহের অনুষ্ঠান করে না), যে বংশে পুরুষ সন্তান জন্মায় না (অর্থাৎ কেবল স্ত্রীসন্তানই প্রসূত হয়), যে বংশ নিশ্ছন্দ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নরহিত, যে বংশের লোকেরা লোমশ (অর্থাৎ যাদের হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গে বড় বড় লোম দেখা যায়), যে বংশের লোকেরা অর্শ অর্থাৎ মলদ্বারাশ্রিত রোগ বিশেষের দ্বারা আক্রান্ত, যে বংশের লোকেরা ক্ষয়রোগগ্রস্ত, যে বংশের লোকেরা আময়াবী (আমাশয়রোগাক্রান্ত বা মন্দাগ্নি অর্থাৎ ভুক্ত দ্রব্য যাদের ঠিকমতো পরিপাক হয় না), যে বংশের লোকেদের অপস্মার রোগ (যে রোগ স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বৈকল্য ঘটায়) আছে, যে বংশের লোকদের শ্বেতরোগ আছে এবং যারা কুষ্ঠরোগদ্বারা আক্রান্ত। এই দশটি বংশের কন্যাকে বিবাহ করা চলবে না। (৩/৭)।

অর্থাৎ এই সব বংশে বিবাহ করলে বিবাহোত্তরকালে উৎপন্ন সন্তানও সেই সেই রোগাক্রান্ত হতে পারে বলে বংশগতি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশংকা থেকে ঐসব পরিবারে বা বংশে বিবাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। কিন্তু যে বংশে কেবল কন্যাসন্তানই জন্মে সে বংশে বিবাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপের অর্থ কি কেবলই কন্যাসন্তান জন্মানোটা একটা ভয়ঙ্কর রোগ হিসেবে চিহ্নিত ? না কি সামাজিক অপরাধ ? তবে এই নিষেধাজ্ঞা থেকে নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবেই একটা নির্দেশনা পাওয়া যায় বৈ কি।
.
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের স্ত্রী নির্বাচনে নারীর যোগ্যতাকে রীতিমতো ব্যক্তিগত বা শারীরিকভাবেই আক্রমণ করা হয়েছে-

‘নোদ্বহেৎ কপিলাং কন্যাং নাধিকাঙ্গীং ন রোগিণীম্।
নালোমিকাং নাতিলোমাং ন বাচাটাং ন পিঙ্গলাম্।।’
কপিলা কন্যাকে (যার কেশসমূহ তামাটে, কিংবা কনকবর্ণ) বিবাহ করবে না; যে কন্যার অঙ্গুলি প্রভৃতি অধিক অঙ্গ আছে (যেমন, হাতে বা পায়ে ছয়টি আঙ্গুল আছে), যে নারী নানা রোগগ্রস্তা বা চিররোগিণী বা দুষ্প্রতিকার্য ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত, যে কেশশূন্যা (অথবা যে নারীর বাহুমূলে ও জঙ্ঘামূলে মোটেই লোম নেই, সে অলোমিকা), যার শরীরে লোমের আধিক্য দেখা যায়, যে নারী বাচাল (অর্থাৎ অতিপ্রগল্ভা) এবং যে নারীর চোখ পিঙ্গলবর্ণের- এই সমস্ত নারীকে বিবাহ করবে না। (৩/৮)।
.
‘নর্ক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীং নান্ত্যপর্বতনামিকাম্।
ই পক্ষ্যহিপ্রেষ্যনাম্নীং না চ ভীষণনামিকাম্।।’
ঋক্ষ অর্থাৎ নক্ষত্রবাচক নামযুক্তা (যেমন, আর্দ্রা, জ্যেষ্টা প্রভৃতি), বৃক্ষবাচক নামযুক্তা (যেমন, শিংশপা, আমলকী প্রভৃতি), নদীবাচক শব্দ যার নাম (যেমন, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি), অন্ত্যনামিকা অর্থাৎ অন্ত্যজজাতিবোধক নামযুক্তা (যেমন, বর্বরী, শর্বরী প্রভৃতি), পর্বতবাচক নামযুক্তা (যেমন, বিন্ধ্যা, মলয়া প্রভৃতি), পক্ষিবাচক নামযুক্তা (যেমন, শুকী, সারিকা প্রভৃতি), সাপবোধক নামযুক্তা (যেমন, ব্যালী, ভুজঙ্গী প্রভৃতি), ভৃত্যবাচক নামযুক্তা (যেমন, দাসী, চেটী প্রভৃতি) কন্যাকে এবং (ডাকিনী, রাক্ষসী প্রভৃতি) ভয়বোধক যাদের নাম এমন কন্যাকে বিবাহ করবে না। (৩/৯)।

অর্থাৎ নারীর নামের মধ্যেও পুরুষের মনোরঞ্জনের উপাদান থাকা বাধ্যতামূলক। যেহেতু নারীর গোটা সত্তাই পুরুষের ভোগের নিমিত্তে ব্রহ্মাকর্তৃক মর্ত্যলোকে পাঠানো হয়েছে, অতএব পুরুষকে সন্তোষ প্রদানই নারীর একমাত্র কাজ। তাই পুরুষের ভোগ্যসামগ্রি হিসেবে স্ত্রীলোকের একটি সুন্দর নাম যে তাকে ভোগের ক্ষেত্রেও মানসিক পরিতৃপ্তিজনক পরিস্থিতি বা আবহ তৈরি করে, সে বিবেচনাতেই হয়তো স্ত্রী-জাতির নামকরণে মনুর নির্দেশনা-

‘স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্।
মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ।।’
স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে (যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)। (২/৩৩)।

মনুশাস্ত্রে নারীর সৌন্দর্য্যের ধারণা সম্পূর্ণই দৈহিক এবং তা নির্বাচনের ক্ষমতা একমাত্র পুরুষেরই একচ্ছত্র বলেই সম্পূর্ণ পুরুষ-মনস্তত্ত্বজাত সৌন্দর্যবোধকেই নারীর উপর সবলে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সর্বশাস্ত্রজ্ঞ মনু পুরুষের ভোগের নৈবেদ্য হিসেবে বিবাহযোগ্য নারী নির্বাচনের লক্ষণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন-

‘অব্যঙ্গাঙ্গীং সৌম্যনাম্নীং হংসবারণগামিনীম্।
তনুলোমকেশদশনাং মৃদ্বঙ্গীমুদ্বহেৎ স্ত্রিয়ম্।।’
যে নারীর কোন অঙ্গ বৈকল্য নেই (অর্থাৎ অবয়বসংস্থানের পরিপূর্ণতা বর্তমান), যার নামটি সৌম্য অর্থাৎ মধুর, যার গতি-ভঙ্গি হংস বা হস্তীর মতো (অর্থাৎ বিলাসযুক্ত ও মন্থরগমনযুক্তা), যার লোম, কেশ ও দন্ত নাতিদীর্ঘ, এবং যার অঙ্গসমূহ মৃদু অর্থাৎ সুখস্পর্শ (অর্থাৎ যে নারী কোমলাঙ্গী), এইরকম নারীকেই বিবাহ করবে। (৩/১০)।

আর এই আদর্শ লক্ষণযুক্তা নারীই যেহেতু ভোগোদ্যত পুরুষের পছন্দশীর্ষে অবস্থান করে, তাই এরূপ সুরূপা দেহযুক্তা নারীরত্ন সংগ্রহের সুবিধার্থে ব্রাহ্মণ্যবাদী তীব্র বর্ণপ্রথাকেও এই বিশেষ ক্ষেত্রে শিথিল করে মনু বলছেন-

‘শ্রদ্দধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি।
অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি।।’
শ্রদ্ধাযুক্ত ব্যক্তি শূদ্রাদিজাতীয় লোকের কাছ থেকেও গারুড়াদি বিদ্যা অর্থাৎ সর্পমন্ত্র প্রভৃতি শ্রেয়স্করী বিদ্যা গ্রহণ করবে; অন্ত্যজ চণ্ডালাদি জাতির (যারা পূর্বজন্মে যোগাভ্যাসযুক্ত ছিল) কাছ থেকেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম (অর্থাৎ মোক্ষের উপায় আত্মজ্ঞানাদি) গ্রহণ করবে; এবং দুষ্কুলজাত অর্থাৎ নিজের থেকে নিকৃষ্ট কুল থেকেও উত্তমা স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করবে। (২/২৩৮)।
.
‘স্ত্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা ধর্মঃ শৌচং সুভাষিতম্।
বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বতঃ।।’
স্ত্রী, রত্ন (মণি-মাণিক্য), বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতবাক্য এবং বিবিধ শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে। (২/২৪০)।

চূড়ান্ত বিচারে নারী যে আসলে মানুষ নয়, অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর মতোই পুরুষের ব্যবহারযোগ্য উপভোগের সামগ্রী মাত্র উপরিউক্ত শ্লোক থেকে বুঝতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। তবে একটি ক্ষেত্রে বিবাহ-সম্বন্ধ করার ব্যাপারে মনুশাস্ত্রে স্পষ্টতই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে-

‘যস্যাস্তু ন ভবেদ্ভ্রাতা ন বিজ্ঞায়েত বা (বৈ) পিতা।
নোপযচ্ছেত তাং প্রাজ্ঞঃ পুত্রিকাধর্মশঙ্কয়া।।’
যে কন্যার কোনও ভ্রাতা নেই, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেই কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ হওয়ার আশঙ্কায় [ভ্রাতৃহীনা কন্যাকে পিতা ইচ্ছা করলে পুত্রের মত বিবেচনা করতে পারতেন, এইরকম কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত। আবার ভ্রাতৃহীনা কন্যার কোনও পুত্র হলে সে নিজে পুত্রস্থানীয় হয়ে সপিণ্ডনাদি কাজ সম্পন্ন করবে- অপুত্রক পিতার এইরকম অভিসন্ধি থাকলে সেই কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত।] অথবা যে কন্যার পিতা সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না তাকে জারজ বা মদ্যপব্যক্তির দ্বারা জাত সম্ভাবনায় অধর্ম হওয়ার ভয়ে বিবাহ করবে না। [অতএব, পুত্রিকাশঙ্কায় ভ্রাতৃহীনা কন্যা অবিবাহ্যা এবং যার পিতৃসম্বন্ধ অজ্ঞাত-জারজত্ব সম্ভাবনায় এইরকম কন্যা অধর্মাশঙ্কায় অবিহাহ্যা]। (৩/১১)।

পিতৃসম্পদের উত্তরাধিকার নির্বাচনের ধর্মীয় দায়ভাগ বিধানমতে পুত্রের অনুপস্থিতিতে ‘পুত্রিকা’ বিশেষ অবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে- এটা একান্ত নিরূপায় বিধান হলেও পুরুষতন্ত্রের জন্য নিশ্চয়ই বিব্রতকর বিষয়। কেননা পুরুষতন্ত্র কখনোই চায় না নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতা পাক। এর প্রতিবিধানকল্পে পুত্র উৎপাদনার্থে পুরুষের পুনর্বিবাহের সুযোগ রয়েছে, কিংবা অপুত্রক স্বামী মারা গেলে অনুমোদনকৃত বিশেষ নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে বিধবাকে পুত্রবতী করার ব্যবস্থা থাকার পরও এসব ব্যবস্থা গ্রহণ না-করার খেসারত হিসেবেই হয়তো পুত্রিকাকে বিয়ের প্রসঙ্গে এসে সংকটে পড়তে হচ্ছে। অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়ন পুরুষতন্ত্রের জন্য অসহ্য গাত্রদাহের বিষয়। এছাড়াও নারী যে তার দেহের বাইরে পিতৃপরিচয়েই অস্তিত্বমান এবং পিতৃপরিচয়ের নিশ্চয়তাবিধান যে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার, তা অক্ষুণ্ন ও নিরাপদ রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করেই কন্যার বংশপরিচয়ের সুস্পষ্টতা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীর জন্য পিতৃপরিচয় সম্পত্তির ধারণার চেয়ে বড় এবং পুরুষতন্ত্রের এই হাতিয়ারকে মনুশাস্ত্র কিছুতেই বিফল হতে দিতে রাজী নয়।

(চলবে…)
[১ম পর্ব ] [২য় পর্ব ] [৩য় পর্ব] [*] [৫ম পর্ব ]