আমি আর অলিল এখন জেলে। কারণ হিসেবে দেশের পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছে- ‘ধনী ব্যবসায়ী ও বেঙ্গল গ্রুফ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর লোটাস চৌধুরীর সোনার ঘড়ি, গাড়ি ও টাকাকড়ি ছিনতাই করে তাঁকে সমুদ্রে ফেলে হত্যা করেছে তাঁরই বাল্য বন্ধু কবি অলিল হাসান ও ছিয়ম মোহাম্মদ।…’
হ্যাঁ, লোটাস আমাদের বন্ধু। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ও আমাদের বন্ধু ছিল, এখনও আছে। যেমনটি আছে হাসুও।

ক.
কিছুক্ষণ আগে হাসু উত্তর পাড়ার মবেলকে মেরেছে। মবেলের ভাল নাম পুলিন রায়, আমরা ওকে মবেল বলে ডাকতাম। ওর গায়ের রঙ ছিল কটকটে কালো- এখানেই এই নামকরণের সার্থকতা। শেষ পর্যন্ত এই নামের জনপ্রিয়তা ওর পৈতৃক নামকেও ছাড়িয়ে যায়। মবেলের অপরাধ সে মার্বেল খেলায় হাসুর সব ক’টি মার্বেল জিতে নিয়েছিল। তবে বেশ যুতসই একটা উপলক্ষ খাড়া করেই তাকে মেরেছিল হাসু- হাসুর জামায় হাত রেখেছিল মবেল, মবেলকে মারার জন্যে এটাই তখন যথেষ্ট ছিল। হাসু কলা গাছের মতো নাদুস নুদুস হলেও গায়ে শক্তি কম আর মবেলের কলাইয়ের রুটি খাওয়া শরীর। মবেলের দাদার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ওর বাবা এখানে বিয়ে করে আর নিজের বাড়ি যায় নি, তবে ওখান থেকে মাঝে মধ্যে কলাইয়ের ময়দা আনতে ভোলেন না তিনি। হাসু ভাল করেই জানে যে মবেল ওর গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে না কারণ এখানে ওর লাঠির জোর নেই। তারপর ও আবার হিন্দু। তবু সাবধান থাকা ভাল ভেবেই আমাকে ইশারা করলো ওকে জাপটে ধরতে, আমি পেছন থেকে চোখ বন্ধ করে জাপটে ধরে থাকলাম, হাসু বেধড়ক কিলিয়ে গেল। মবেল একটুও নড়লো না, আমি না ধরলেও চলতো। হাসু ক্লান্ত হয়ে বলল- ‘ছেড়ে দে শ্যালাকে’। হ্যাঁ রে হাসু, মারবেল গুলো কি নিয়ে নেবো? আমি হাসুকে বললাম। ‘না থাক, ওগুলো ওরই পাওনা।’ আমি জানতাম হাসু এরকম কিছু একটা বলবে, ও ছেলে হিসেবে যতটা খারাপ দেখায় আসলে ততটাই ভাল- এটা শুধুমাত্র আমার ধারণা। সেদিন টিফিনের ঘণ্টা শেষ হলেও আমরা আর ক্লাসে যায় নি। হাসু বলল, ‘লোটাসের নানা মারা গেছে, ওরা সব ওখানে। চল, ওদের গাছে টসটসে ডালিম আছে খেয়ে আসি।’ আমি চললাম ওর পিছু পিছু। লোটাস আমাদের খুব কাছের বন্ধু। যাবার পথে অলিলকে সাথে নিলাম। সর্দি জ্বর হওয়ার কারণে আজ ও স্কুলে যায় নি। বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে প্রাচীর টপকে লোটাসদের বাড়িতে প্রবেশ করলাম। শরীর ভারী হলেও হাসু প্রাচীর টপকানোতে ওস্তাদ। অলিল লম্বা তাই ওর খুব একটা সমস্যা হলও না। প্রাচীরের হাইট মিডিয়াম, কিন্তু আমার হাইটে ঘাটতি থাকার কারণে বেশ কয়েকবার লাফিয়েও প্রাচীরের প্রান্ত হাতের নাগালে পেলাম না। বরাবরের মতো হাসু আমাকে টেনে উঠাল। ভেতরে গিয়ে দেখি বাড়ির সদর দরজা খোলা। ‘যাক বাবা এতো কষ্ট করে প্রাচীর টপকালাম কি জন্যে!’ অলিল বলল। ‘বাড়িতে বোধহয় কেউ আছে, চল কেটে পড়ি।’- হাসুকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি। ‘এসেছি যখন, একটা ডালিম না ছিঁড়ে যাচ্ছি না!’ আমাদের মধ্যে থেকে হাসু এগিয়ে গেল উঠানের উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ডালিম গাছটিকে তাক করে। ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ, হাসু তখন উঠানের মাঝখানে, আমি আর অলিল কলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গা ঢাকা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছি। ‘আরে তোরা, কখন আসলি?’ ‘যাক বাঁচলাম!- অলিল ফিসফিস করে বলল। আমরা লোটাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। ‘শুনলাম, তোর নাকি নানা মারা গেছে, তাই…!’ ‘তাই তোকে দেখতে আসলাম।’ হাসু আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল। ‘ভাল করেছিস। মারা যায়নি স্ট্রোক করেছে। ‘শ্যালা হাবু, এতবড় ভুল সংবাদ দিয়েছিস! আজ তোর রক্ষা নেই!’ হাসু ফিসফিস করে বলল। আমরা বিকেল পর্যন্ত লোটাসদের বাড়িতে ছিলাম। লোটাস ওদের ফ্রিজ থেকে একে একে আপেল, মিষ্টি, কমলা বের করে দিচ্ছিল আর আমরা ছাদে বসে খাচ্ছিলাম। গ্রামে এই একটাই দো’তলা বাড়ি। তাই সুযোগ পেলেই আমরা ছাদে উঠে আসে পাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটি। সেদিন আরও একটা কাজ আমরা করেছিলাম। লোটাসের বাড়ির পিছন দিকে ছিল মিলাদের বাড়ি। মিলা তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে- আমাদের এক ক্লাস নিচে। ডুমুর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লোটাসদের বাড়ির দিকে মুখ করে ভেজা শাড়ি পাল্টাচ্ছিল মিলার ভাবি। সেদিনই আমরা প্রথম উদোম মেয়ে মানুষ দেখেছিলাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি! তারপর আমরা যা করলাম, হাসুই বলল প্রথম, ‘আমি জানি এখন আমাদের কি করা উচিৎ’। আমাদের চোখে মুখে বিস্ময়। ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি দু’একবার করেছি। শুনেছি, বড়রা তো প্রতিদিনই করে।’ আমরা চারজন ছাদে একসাথে বসে মাস্টারবেট করেছিলাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। আমার চার চারটে সন্তান হয়ে গেল, কিন্তু সেই সুখ আর কখনো পাই নি। নারীর দেহ বলতে এখনো আমি মিলার ভাবিকেই বুঝি। আমার স্ত্রীকে জাপটে ধরে মিলার ভাবীকে জাপটে ধরার কথা ভাবতাম। ভেবে সুখ পেতাম। তারপর থেকে আমরা প্রায় ছাদে উঠতাম। যেদিন কোন বাহানা পেতাম না, সেদিন উঠতাম লোটাসের মা আর দাদির চোখ ফাকি দিয়ে। দুপুরে সাধারণত লোটাসের বাড়িতে আর কেউ থাকতো না। ছাদে উঠাতে আমাদের নেশা ধরে গেল, বেড়ে গেল স্কুল থেকে টিফিন পালানোর পরিমাণ। কিছুদিন পর মিলার ভাই ডুমুরের ঝোপটা কেটে ফেললে, মিলার ভাবী অন্যকোথাও শাড়ি পাল্টাতো। তারপর থেকে উল্টোদিকে রাহেলা আপাকে দেখতাম, রাহেলা আপা তখন কলেজে পড়ে। বিয়ে হয়নি, সালোয়ার কামিজ পড়তো। রাহেলা আপা টের পেয়ে গেলে, পাশের বাসায় লোটাসের ছোট চাচীকে দেখতাম। এমনি করে আরও অনেককেই দেখেছি।
সেদিন বিকেলে আমরা আর খেলতে গেলাম না। পশ্চিমের মাঠে একটা বিল ছিল। যখন আমরা কোনও বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা করতাম তখন ঐ বিলের ধারে চলে যেতাম। মাঝে মধ্যে চাম-গুল্টি নিয়ে পাখি মারতে, কিংবা ছিপ-বঁড়শি নিয়ে মাছ ধরতেও গেছি। তবে আমরা কোনদিনই পাখি কিংবা মাছ কোনটাই ধরতে পারি নি। একবার লোটাসের গুলটি একটা বকের লেজে লেগেছিল, শেষ পর্যন্ত ঐটাই ছিল আমাদের সর্বচ্চ সাফল্য। আর একবার আমরা একটা পানির শাপ মেরেছিলাম- পিটিয়ে। তবে শাপের রেসপন্স দেখে মনে হয়েছিল, হয় সে গভীর ঘুমে ছিল, আমাদের প্রথম আঘাতটা এতো জোরে ছিল যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই সে মারা গিয়েছিল, নচেৎ আমাদের আগেই কেউ সাপটাকে মেরে রেখে গিয়েছিল। সেদিন বিকেলে আমরা কোনও পাখি কিংবা মাছ মারতে যায় নি। নতুন কোনও পরিকল্পনাও ছিল না মাথায়। আমরা কিছুক্ষণ আগে যে ঘটনাটা ঘটিয়েছি সেটা নিয়েও কেউ কথা বলতে চাইছিলাম না। সেদিন কোনও কথা না বলেই আমরা বিলের ধারে হাটাহাটি করে যে যার বাড়ি চলে এসেছিলাম।

খ.
বাড়ি বলতে আমাদের যা ছিল তা হল চৌচালা টিনের ঘর। দুইখানা ঘর আর লম্বা একটি বারান্দা। একটি ঘরে মা বাবা আর ছোটবোন কুমকুম থাকতো। আর অন্যঘরে আমি আর আমার বড় দু’ভাই থাকতাম। এক কোনায় আটি বাঁধা থাকতো গরু ছাগলের জন্য কেটে আনা ঘাস। ঘুমের ঘোরে আমি মাঝে মধ্যে সবুজের গন্ধ পেতাম। শ্যামা ঘাসের গন্ধ ছাড়া ঘুম হতো না আমার। বাবা ছিলেন গরুর ব্যাপারী। বড় দুই ভাই মাঠে কাজ করতো। উঠানের এক কোনে ছিল গরুর নাদা বসানো, অন্য দিকে ছিল গোয়াল ঘর। নাদার চারপাশ জুড়ে কাদা আর গোবরে খ্যাঁতখ্যাঁত করতো। উঠোনের মাঝখানের এক ঢিবিতে বসে রান্না করত মা। ওখানে বসেই আমরা খেতাম। মাঝে মধ্যে গরুর চুনা এসে ছিটকে পড়তো খাবারে। একবার আমাদের একটি গাভী বাছুর প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়। তারপর মা সেই বাছুরটিকে মাতৃস্নেহে বড়ো করে তোলে। তার নাম রাখা হয়েছিল কুমকুম। মা কুমকুম বলে ডাক দিলে উত্তর নিতো সে । আমার ছোটবোন কুমকুমের জন্মের সময় মাকে সিজার করতে হয়, সেই টাকা জোগাড়ের জন্য বাবা বাধ্য হোন কুমকুমকে বিক্রি করে দিতে। বাবা-মা তাদের নতুন সন্তানের নাম রাখের কুমকুম। মা প্রায়ই বলতেন, ‘আল্লাহ আমাকে এক মেয়ি নি আরেক মেয়ি দি’ছে’। অভাবের সংসারেও বাবা আমাকে কোনও কাজ করতে দিতো না। এর অন্যতম কারণ ছিল আমাকে দিয়ে কোনও কাজ হতো না। বাবা স্বপ্ন দেখতো, আমি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরছি। আর প্রতিবারই আমার পরীক্ষার ফল শুনে হতাশ হতেন। ‘আমি রক্ত দেখতে খুব ভয় পাই, আমি মানুষের পেট-বুক কাটবো কি করে?’ একদিন ভাত খেতে খেতে মাকে বললাম। আমি চাচ্ছিলাম, বাবা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখায় বন্ধ করে দিক। মা জানালেন, বাবা চান আমি পশুর ডাক্তার হয়। মানুষের ডাক্তারের তো অভাব নেই। পশুর মানে গরু ছাগলের ডাক্তারের বড়ই অভাব। লোটাস, হাসু আর অলিলকে এই কথা বলার পর থেকে ওরা আমাকে দেখা মাত্রই ‘হাম্বা’ বলে ডাকতো। আমি ক্ষ্যাপতাম না বলে অবশ্য ওদের এই মজাটা বেশিদিন টেকেনি।
দক্ষিণ পাড়াতে ছিল হাসুদের বাড়ি। যতদূর জানি, হাসুর মা মারা গেছে যখন ও খুব ছোট ছিল। তারপর হাসুর ছোটখালাকে ওর বাবা আবার বিয়ে করেছে। বিয়ের পরপরই হাসুর বাবা নাকি বলে বেড়াতো, ‘বিয়ে-টিয়ে আর করবার ইচ্ছা ছিল না, হাসুর কথা ভেবেই ওর খালাকে ঘরে তুললাম’। লোকমুখে এ কথাও শুনেছি- হাসুর বাবার সাথে ওর ছোটখালার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। হাসুর মা সেকথা জেনে ফেলায় হাসুর বাবা তাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে। যখন মারে তখন হাসু নাকি তার মার বুকের দুধ খাচ্ছিল। হাসুর বাবা মেম্বার, বেশ কিছু জমিজমা আছে। হাসুর নামেও আছে এক বিঘা, ওর মা মারা গেলে নানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওর নামে লিখে দিয়েছে। হাসুর ছোট এক ভাই ও বোন আছে। অবশ্য সৎ ভাই বোন। সংসারে হাসুর কোনও কদর ছিল না। ও যতোটা সম্ভব বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত। আবোল তাবোল বুদ্ধি ওর মাথায় গিজগিজ করতো। ওকে দেখে বোঝায় যেত না যে ভেতরে ভেতরে ওর এত কষ্ট।
অলিলের বাড়ি গ্রামের উত্তর পাড়ায়। ওর বাবা মসজিদের ইমাম আর একটা মাদ্রাসায় আরবি পড়ায়। বাড়িতে ওদের সাথে ওর এক বিধবা ফুপু থাকেন। ওদের বাড়িতে আমি খুব বেশি যায় নি। ও খুব কম কথা বলে। খালি কি যেন ভাবে! ভাবতেই থাকে। মাঝে মধ্যে অদ্ভুত সব কথা বলে, শুনতে খুব ভাল লাগে যদিও তার কিছুই বুঝিনা আমি। পরে জানতে পেরেছিলাম ওগুলো সব কবিতা, কিছু ওর লেখা কিছু অন্যদের। সবসময় একটা অসুখী অসুখী ভাব থাকে অলিলের মধ্যে। কি যেন খুঁজে বেড়ায় কিন্তু পায়না কিছুতেই।
আর লোটাসের বাড়ি ছিল আমাদের পাড়াতেই। কথাটা এভাবে না বলে যদি বলি লোটাসের পাড়াতেই আমাদের বাড়ি ছিল তাহলেই ভাল শোনাবে। ওর বাবা ছোটখাটো একটা জমিদার বললে ভুল হবে না। ওরা একভাই, এক বোন। বিশাল বাড়ি কাজের লোকে ভরা। আমাদের যখন খুব অভাব ছিল, তখন নাকি মা ওদের বাড়িতে কাজ করেছে। কাজ করেছে বলতে কাঁথা সেলাই করে দিয়েছে, পাটি বুনে দিয়েছে, কুমড়োর বড়ি দিয়ে দিয়েছে, ধান সিদ্ধ করে দিয়েছে- এইসব। মার মুখে শুনেছি, ওদের শহরে নাকি অনেক বড় বড় আত্মীয় স্বজন আছে। ছোটবেলায় আমি লোটাসের ব্যবহার করা পোশাক অনেক পরেছি। লেখাপড়াতেও ও খুব ভাল। কখনই প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয় না। ভাল গানও গাইতে পারে। ছবিও আঁকতও বেশ। আরও অনেক কিছু পারে ও। আমাদের মধ্যে ওই ছিল সবচেয়ে সুখী। অনেক সুখী। মেধাবী ও সুন্দর তো বটেই। যদিও হাসু একদিন বলেছিল, ‘ওদের অনেক টাকা আছে বলেই ও এতো ফার্স্ট হয়’। আমার বিশ্বাস হয়নি।

গ.
দেখতে দেখতে আমাদের মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। দেশের অবস্থা তখন ভাল না। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান চলছে। আমরা একটু একটু করে দেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। এসব ব্যপারে হাসু আর লোটাসই বেশি কথা বলতো। আমি শুধু শুনতাম। আর বরাবরের মতো অলিল কি যেন একটা ভাবনায় ডুবে থাকতো। কবিতার নেশা ওকে আরও পেয়ে বসেছিল। মেট্রিক পরীক্ষা শেষ করে লোটাস চলে গেল আমেরিকায় মামার কাছে। দেশের অবস্থা ভাল না, যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে ভেবে ওর বাবা ওকে দেশে আর রাখলো না। হাসু চলে গেল ঢাকায়, মামার বাড়ি। অলিলের মামার বাড়ি পাশের গাঁয়ে, আমার এ গাঁয়েই। আমরা পড়ে রইলাম। শহরের কলেজে ভর্তি হলাম। দেশের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশের জনতা তখন স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। ২৬শে মার্চের সেই কাল রাত দেশের জনগণকে তাতিয়ে দিলো। যুদ্ধ শুরু হলো শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে্। আমি আর অলিল তখন বাড়িতে। লোটাস আর হাসু চলে যাওয়ার পর আমার আর অলিলের মাঝে আর দেখা হতো না বললেই চলে। সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি গেলাম অলিলের কাছে। ও তেমন কিছুই বললো না। আমিও কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। যুদ্ধ শুরু হলে বাবা মা, কুমকুম ও আমাকে ভারতের শরণার্থী শিবিরে রেখে গেলেন। আমাকে আলাদা করে বললেন- ‘আমি আর তোর দুই ভাই যুদ্ধে গ্যালাম। তুই একিনে তোর মা আর বুনের দেখাশুনা কর। দেশ স্বাধীন হবেই। জানি নে আমাদের কি হবে, আর দেখা হবে কিনা! ওদের দায়িত্ব এখন তোর হাতে।’ আমি আর কিছুই বলিনি। শরনার্থী শিবির থেকেই যুদ্ধের খোঁজ খবর নিতাম। হাসু আর অলিল কোথায়, কি করছে, কিছুই জানি না। মা শুধু কাঁদতেন, এতসব বোঝবার মতো বয়স কুমকুমের তখনো হয়নি।
নয় মাস পর দেশ স্বাধীন হল। আমরা দেশে ফিরে এলাম। বাবার খবর কেউ দিতে পারলো না। বড় দুভাই যুদ্ধে মারা গেছে। মেজো ভাই নাকি গ্রামের মৌলানার প্ররোচনায় রাজাকারদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। পরে নিজের ভুল বুঝতে পারলে পাকবাহিনী আর তাকে ফিরে আসতে দেয়নি। এর বেশি জানতে পারিনি। সবকিছু কেমন করে যেন পাল্টে গেল। মা আর কুমকুমের দায়িত্ব তখন আমার ওপরে। আমি পড়াশুনা ছেড়ে শহরের পোস্ট অফিসে চাকুরী নিলাম।

ঘ.
পোস্টঅফিসে একদিন অলিলের সাথে দেখা। প্রথমটাই ওকে চিনতে পারিনি। মুখ ভর্তি দাড়ি। লম্বা পাঞ্জাবি। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। অলিলের মুখে শুনলাম, হাসু যুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে। আর ও অল্পের জন্যে বেঁচে এসেছে, গুলিটা বাম পায়ে লেগেছিল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। অনেকক্ষণ। বাবা, ভাইদের মৃত্যু সংবাদ শুনেও এতোটা কাঁদিনি। কারণ হয়ত, ওটার জন্যে আস্তে আস্তে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছিলাম। হাসুর মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। অলিল হনহন করে চলে গেল। বলল, আবার আসবে। তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই আসতো। ও এখন ফুলটাইম কবি। পেপারে ওর কবিতা আসতো। আমি কবিতা বুঝি না, ওর নামটার ওপর বেশ কয়েকবার চোখ বুলিয়ে রেখে দিতাম। অলিল তখন একাই থাকতো। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বাবা আর মাসিকে ফিরে পায়নি। লোকমুখে জানতে পেরেছে, শরণার্থী শিবিরেই মারা গেছে তারা। আমরা সময় পেলে সেই বিলের ধারে চলে যেতাম। দু’জন পাশাপাশি হাঁটতাম। খুব কম কথা হতো আমাদের মাঝে। যুদ্ধ অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিল।
একদিন এক ঘন বর্ষায় আমি আর অলিল ছিপ হাতে বেরিয়ে পড়লাম- উদ্দেশ্য মাছ ধরার বৃথা চেষ্টায় কাটিয়ে দেবো সারাটাবেলা। বছরের অন্যান্য সময় বিলে পানি না থাকলেও এই সময় বেশ খানিকটা পানি এদিক ওদিক থেকে জমা হয়ে একটা ছোটখাটো নদীর আকার ধারণ করে। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ছিপ ফেলে আমরা বসেছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল হালকা বাতাসে ধুলো বালি উড়বার মতো করে, আস্তে আস্তে আমাদের মাথাটা ভিজে উঠছিল। বর্ষা নিয়ে একটি কবিতা আবৃতি করলো অলিল। বোধহয় খুব ভাল কবিতা। তুই লিখেছিস?- আমি জানতে চাইলাম। ‘হুম, না। রবীন্দ্রনাথ।’ অলিল, তুই কবিতা লিখে সুখ পাস? ‘পাই বই কি। কবিতায় তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’ আচ্ছা, সুখ পেতে হলে কি মানুষকে কিছু করতেই হয়? কোনও কারণ ছাড়া বেঁচে থাকতে ভাল লাগবার কথা না ?- আমি প্রশ্ন করলাম। ‘সুখ পেতে কোনও কারণ লাগে না। লাগে বিশ্বাস!’ তাহলে কি আমিও সুখই হতে পারবো? আমার কথায় হো হো করে হাসতে হাসতে ও বলল- ‘হ্যঁা, পারবি যদি ওই ধুমড়ি বউকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আছিস। তোর আল্লাহকেও ছাড়তে হবে।’ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না অলিল মজা করছে নাকি সত্যি সত্যিই বলছে। আল্লাহ তোর না? তুই কি তাঁকে ছাড়তে পেরেছিস? ঐ প্রথমবারের মতো আমরা যে যার বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছিলাম। ‘কবেই। বুঝতে শেখার পর থেকে ঐ যুদ্ধটাই তো করে আসছিলাম। আমি এখন মুক্তিযোদ্ধা। অলিলের কথাগুলো আমার ভাল লাগছিল না। মনে হল ভয়ংকর কিছু একটা এসে আমাকে আঘাত করছে। আমার রূপ পরিবর্তন করে দিতে চাইছে। যে বিশ্বাসটা আমি মা বাবার রক্ত থেকে পেয়েছি তাকে আমি যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই না। আমি চাইছিলাম অন্য বিষয়ে আমরা কথা বলি। অলিল বলেই চলে- জানিস, আমি খুব করে ভাবতাম। বাবা যখন সুরা পড়তেন, আমার মনে হতো ওগুলো কবিতা। সত্যি হতে পারে না। ওগুলো সত্যি না হলেই কি সৃষ্টিকর্তা নেই হয়ে যায়! আমি বেরিয়ে পড়লাম সন্ধানে, খুব করে খুঁজলাম- প্রতিটা গাছের ডালে, প্রতিটা পাখির চোখে, প্রতিটা বৃষ্টি ফোটায়, প্রতিটা ধূলিকণায়, প্রতিটা আলোকচ্ছটায়। তন্ন তন্ন করে হাতড়ালাম নিজের ভেতরেও। কোথাও পেলাম না। তবুও তাঁর না থাকাটাকে আমি মানতে পারছিলাম না। সে না থাকলে যে আমার কবিতা গন্তব্য খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে বিলীন হয়ে যাবে শূন্যে। তাঁকে যে আমার বড় দরকার। যুদ্ধের মাঝেও আমি অনেক খুঁজেছি। অস্ত্র হাতে যখন সবাই ধেয়ে যেতো পাক-হানাদারদের দিকে। পশুর মতো তেড়ে আসতো ওরা। আমি গুলি মারতাম শূন্যে। বিশ্বাস কর এই দেশ স্বাধীন হওয়াতে আমার বিন্দুমাত্র অবদান নেই। আমার যুদ্ধ তখন অন্যখানে। একদিন এক গ্রামে ঢুকে দেখি- গ্রামের নারী, শিশু, বৃদ্ধ সকলকে…! একটি শিশুর দেহ ঝুলছে বাঁশ গাছে। বকুল গাছে ঝুলছে একটি মেয়ে- শরীরের বস্ত্র নিয়ে টানাটানি করছে কয়েকটি কুকুর। বোঝা গেল, ওরা মেয়েটিকে জীবিত রেখে গেলেও মেয়েটির তা পছন্দ হয়নি। এমনি করে পাকহানাদাররা যাদেরকে জীবন-মৃত্যুর সংযোগ স্থলে রেখে ‘চয়েস’ দিয়েছে, তারা মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। আমাদের যোদ্ধারা সেদিন মাতালের মত টলতে টলতে উড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের মস্ত একটা ক্যাম্প। ওরা কেউ বাঁচতে পারেনি। সেদিন রাতে আমি প্রচণ্ড জ্বরে থর থর করে কাঁপছিলাম। স্বপ্নে দেখছিলাম- একটা কুকুর এসে আমার পা ধরে টানাটানি করছে, কিছুক্ষণ পর আমি কুকুরটার পা ধরে টানছি। একটু পরে দুটো কুকুর একটা ছিন্নভিন্ন অণ্ডকোষ নিয়ে মারামারি করছে। অণ্ডকোষটা আমার, কুকুর দুটোর একটি আমি। তারপর থেকে রাতে ঘুমানোর সাহস পেতাম না। মহাকাশের প্রতিটা গ্রহ নক্ষত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজতাম ঈশ্বরকে। একদিন গভীর এক অন্ধকার থেকে উদয় ঘটলো তার। দেশ তখন স্বাধীন হবার পথে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম তাকে। হাত ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। গভীর থেকে গভীরে। সব শূন্য, বাকাওয়াস!’ আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর কথাগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। অবশ্য না বুঝতে পেরেই আমার ভাল হয়েছিল। সেদিন আমরা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য এটা ওটা নিয়ে পাগলের মতো বকে যাচ্ছিলাম। অলিল একটা কথাও বলেনি। আমি জানতাম, ও নিজেকে যতোই সুখী ভাবুক না কেনো। ওর ভেতরটা গভীর অনলে দগ্ধ হতে থাকে সারাটাক্ষণ।

ঙ.
কুমকুমের বিয়ে হওয়ার দিন কতক পরেই মা মারা গেছে। শেষের কয়েক বছর তিনি স্বেচ্ছায় বাকশক্তিহীন হয়ে গিয়েছিলেন। আমার বিয়ে হয়েছে আরও আগে। এখন আমার দুই সন্তান, আরও একটা পৃথিবীর পথে। বরকত একটা বেসরকারি কলেজে বাংলা পড়ায়। বিয়ের কথা বললে বলতো, ‘কবিতা-টবিতা নিয়ে এই তো বেশ আছি, আবার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি বল!’ বিয়ে করা যে একপ্রকার ঝামেলাই সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। তাই আর ওকে বেশি জোরাজুরি করতাম না। আমার বেতনের তুলনায় সংসারটা বেশ বড়। তার ওপর আমার বউ একাই দু’তিনটা মানুষের সমান। দিন দিন যেন বর্ষার নদীর মতো ওর পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে। একদিন এ কথায় সে কথায় বরকত আমাকে লোটাসের কথা বললো। ওর মুখ থেকেই জানতে পারলাম লোটাস এখন দেশে। একটা নামকরা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সে দেশে আসার পর থেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। অলিল পাত্তা দেয়নি। আমি জানি, একধরনের অভিমান বশতই ও এই কাজটি করেছে। আমি কোনও কথা বলিনি। সত্যি বলতে, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল লোটাসকে। মনে হচ্ছিল সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে। হাসুকে আর পাবো না। লোটাস ফিরে এসেছে। আমরা কি আর আগের মতো হতে পারি না? আমার কথা শুনে অলিল বলল- ‘ও এখন বিরাট বড়ো কোম্পানি চালায়। ঢাকায় ফ্লাট বাড়ি, গাড়ি- সবই আছে। যতো কাছেই আসুক না কেনো ও অনেক দূরে চলে গেছে।’ ও বরাবরই অনেক সুখী। আমি বিড়বিড় করে বললাম।
কিছুদিন পর অলিলের স্কুলের পিয়ন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অলিলের জরুরী তলব। গিয়ে দেখি অলিলের পাশে বসা সাহেব গোছের এক ভদ্রলোক। আমি একটু অপ্রতিভ হয়ে গেলাম। পিয়ন হারামজাদা যদি বলতো শহর থেকে এক সাহেব এসেছে তাহলে তো বগল ছেড়া এই পাঞ্জাবিটা চেঞ্জ করে আসতে পারতাম। বৌটাও যেন কেমন, কতো করে বললাম ছেড়াটা বুজিয়ে দিতে। কে শোনে কার কথা! খালি খায় আর ঘুমায়। আর একটু জড়িয়ে ধরলেই পেট ফুলিয়ে ফেলে। ভদ্রলোক উঠে আসলেন আমাকে তাক করে। যেনো সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে উনি আমাকেই দেখতে এসেছেন। কাছে এসে বললেন- তুই তো দেখছি একটুও বড় হস নি। আগের ততটুকুই আছিস! বরকত যে বলল তোর আবার ছেলে-পুলেও হয়েছে। তা কি করে হল রে?’ আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। কেউ না বলে দিলে কারও বাপেরও ক্ষমতা হবে না বোঝার যে এটা আমাদের লোটাস- এই এলাকারই সন্তান। কি যে দেখাচ্ছিল মাইরি! আমাদের সাথে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় চলে গেল। বলে গেলো পরের বার আসবে আমাদের নিতে। হাসুর কথা শুনে ও কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল- ও নিশ্চয় পাকিস্তানী ক্যাম্পে ডালিম চুরি করতে গিয়েছিল!’ এতদিনে বুঝতে পারলাম- সেই দিন আমরা ঠিকই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। আমি হো হো করে হাসছিলাম। লোটাসের চোখের কোনায় জল ছলছল করছিল। আমার পিয়নগিরি শুনে বলল- ‘দেশে গরুর ডাক্তারের অভাবটা তাহলে আর ঘুচলো না! আহা ! গো ব্যাচারি!।’ বুঝলাম এতদিনে ও কিছুই ভোলে নি। ওকে পেয়ে আমরা সেই বিকেলেই ছুটে গিয়েছিলাম আমাদের গ্রামে, ফেলে আসা দিনগুলোতে। বিলের ধারে যাওয়ার সময় হয়নি। লোটাস বলল পরের বার এসে যাবে। অবশ্য গেলেও খুব একটা লাভ হতো না। সেই বিল আর নেই। এখন ওখানে ধান চাষ হয়। দেখে বোঝবার জো নেই, এইখানে একসময় প্রবাহিত হতো ছোটখাটো একটা নদী। আমাদের জন্যে সেটা নদীই বটে। গ্রামও আর সেই গ্রাম নেই। খুব কষ্ট করে চিনে নিতে হয়। এই জন্যে বোধহয় আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। সেদিন খুব করে মনে হচ্ছিল- সময়কে থামিয়ে রাখতে পারলে বেশ হতো। আচ্ছা, সব পরিবর্তন কি সুখের? ফেলে আসা দুঃখগুলোকেও এতো আপন মনে হয় কেনো, এতো সুখ কেনো তাতে! আমরা ফিরে আসলাম মেহেরপুর শহরে। ‘মনে হলো এতক্ষণ কাদা ঘেঁটে ঘেঁটে শুধু শুধু গন্ধটাই পেলাম, যে জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তা কিছুতেই পেলাম না।’- আসতে আসতে গাড়িতে লোটাস বলল। ‘বুকের ভেতরটা বড় দগদগে, ওখানে খুঁজে দেখ, ঠিকই পেয়ে যাবি।’ অলিলের কোথায় সাহস ফিরে পেলাম। তাহলে একেবারে হারায় না, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ঠিকই রয়ে যায়- হয়তো সবচেয়ে মূল্যবান জায়গাটাতেই রয়ে যায়।
একদিন হঠাৎ করে লোটাস এসে আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে গেল। আমি গেলাম মূলত ঢাকা শহরটা দেখতে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন- একদিন আমি এই শহর থেকে গরুর ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরছি। ডাক্তার না হতে পারলেও শহরটা তো দেখে যায়। পরকালে তাও তো বাবাকে বলতে পারবো। আর অলিল গেলো বিদেশী মদ খেতে। দেশি মদে নাকি আজকাল ওর কবিতা বেরোই না। আমরা প্রথমে গেলাম ওর অফিসে পরে ফ্লাটে। এতো সুন্দরভাবে গোছানো সবকিছু- মানুষ নিজ চোখে না দেখলে কল্পনাও করতে পারবে না। লোটাসের ফ্লাট দেখে আমার স্বর্গ দেখার স্বাদ যেন মিটে গেলো, আর ওর বৌয়ের কাছে হুররাও ফেল মারবে। যতক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিলেন তিনি, আমি যেন হ্যাংলার মতোন তাকিয়ে ছিলাম। যেন বাপের কালে কোন নারী দেখি নি। নারী আমি দেখেছি- খুব নেড়ে চেড়ে দেখেছি। কিন্তু হুরদের গল্প শুনেছি মাত্র- মসজিদের ইমাম বলতেন, আয়তলোচন আঁখি, নূরের আলো ঝড়ে পড়ে দেহ থেকে। স্বর্গ মর্ত্যের কেউ স্পর্শ করেনি। মসজিদে বসে তিনি এর বেশি বলতে পারতেন না, বাকিটা আমি কল্পনা করার চেষ্টা করতাম, মিলার ভাবীর নগ্ন শরীর এসে সব ভেস্তে দিতো। আর পারবে না। অলিল মাতাল হয়ে পড়ে রইল। লোটাস দরজা বন্ধ করে বিরাট একটা টিভিতে সিনেমা খাটালো। ‘দেখ, তোদের দারুণ একটা জিনিস দেখাবো। বাপের কালেও দেখিস নি। শুরু হলো চারটা মেয়ের নগ্ন হওয়ার দৃশ্য। একটা সুইমিং পুলে একটা ছেলেকে নিয়ে তারা যা-তা করছে। অলিল মাতাল হয়ে আবোল তাবোল বকছে। ‘সব মিথ্যে। কিচ্ছু নেই।’ এই দুটো শব্দ বোঝা যাচ্ছে। ‘মিথ্যে হবে কেনো। এগুলো ইউরোপে সত্যি সত্যিই হয়।’- লোটাস ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। আমার মন তখন অন্যখানে পড়ে। লোটাস হতাশ হয়ে টিভিখানা বন্ধ করে দিলো। মনে মনে ধরে নিলো- আমরা বোধহয় অনেকদূর এগিয়ে গেছি।
আমরা দুইদিন থেকে চলে আসলাম। লোটাস বার বার করে অলিলকে থেকে যেতে বলছিল। ‘ওসব কবিতা-টবিতা ছেড়ে চলে আয়- বিল ভর্তি বিদেশী মদ পাবি, চাইলে সাথে টদও পাবি।’ অলিল রাজি হয়নি। ও কবিতা ছেড়ে কোথাও থাকতে পারবে না। আমার বৌ বাচ্চা আছে শুনে হয়ত থাকতে বলার সাহস পায়নি। লোটাসের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটা আমেরিকায়, মেয়েটা কানাডায়- পড়াশুনা করছে। ওরাও নাকি লোটাসের মতোই মেধাবী। বাপকা বেটা। আর আমার ছেলেটা দুইবার দিয়েও ম্যাট্রিক পাশ করতে পারলো না। বড়ো মেয়েটা এইটে পড়াকালীন সময়ে এক রিকশা চালকের সাথে ভেগে গেল। ছোট মেয়েটাও শুনছি নাকি প্রেম করছে কোন এক ফেরিওয়ালার সাথে। সত্যিই, বাপকা বেটা !
তারপর থেকে আমরা মাঝে মধ্যেই লোটাসের বাড়িতে যেতাম। অলিলের বিদেশী মদে নেশা ধরে গিয়েছিল। আমাকে টানতো অন্যকিছু- একটু একটু করে আমি লোটাসের সুখে ভাগ বসাতে শুরু করেছিলাম। লোটাস মাঝে মধ্যে অলিলকে খ্যাপানোর জন্যে বলতো- ‘শ্যালা, গুলি খেয়ে দেশ স্বাধীন করলো। দেশের অবস্থা দেখেছিস- বঙ্গবন্ধু গেলো, জিয়া গেলো, জাতীয় নেতারা গেলো। ক্রমেই ইটস টার্নিং ইনটু অ্যা পারফেক্ট হেল। বাইরে বাংলাদেশের কথা বলতেই লজ্জা লাগে। নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবী করতে লজ্জা লাগে না? শ্যালা, সামলাতে পারবি নাতো যুদ্ধে গেলি কেনো?’ অলিল কিছুই বলতো না। আজ হাসু থাকলে হয়ত আরও কতো বিষয় নিয়ে জমে উঠতো আড্ডা। আমরা পদে পদে হাসুকে খুব মিস করতাম। কিন্তু কখনই আমরা ওকে নিয়ে আলোচনা করতাম না। আমরা তিনজনই অতীত থেকে পালাতে চাইতাম। ওদের হয়ত একটা ভবিষ্যৎ ছিল আমার তো তাও ছিল না। আমার ছিল একটা বর্ণহীন বর্তমান- একেক সময় একেকটা রঙ এসে রাঙিয়ে যেতো।
কিছুদিন আগে আবার আমার একটা ছেলে হয়েছে। বৌয়ের বয়স কম হলেও আমার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। এই বয়সে সন্তান হবার কথা না। তবুও হয়েছে। ভেবেছিলাম এইটা অন্তত দেখতে আমার মতো হবে। কিন্তু হয়নি। অন্যদের মতোই বেশ লম্বা, চওড়া আর ফর্সা হয়েছে। আমাকে যখন ওরা বাবা বলে ডাকে বড্ড বেমানান ঠেকে। সংসারের কোন কিছুই আপন মনে হয় না- না বৌ, না সন্তান, বাড়িটাও বড্ড অচেনা মনে হয়। একবার বিলের ধার থেকে একগুচ্ছ শ্যামাঘাস তুলে এনে বিছানার তোলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। খুব শান্তি করে ঘুমিয়ে ছিলাম দুইদিন। তৃতীয় দিন বৌ বলল- ‘দুইদিন ধরে বিশ্রী গন্ধ আসছে কোথা থেকে! খুঁজে খুঁজে শ্যামাঘাসগুলো বের করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। গরু কেনার সাহস আর হয়নি। মাঝে মধ্যে গোহাটে গিয়ে পায়চারি করতাম। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে বৌ বলেছিল- ‘তোমার গরুরোগ ধরেছে। কুকুরের পেটে কি আর ঘি ভাত সহ্য হয়!’

চ.
একদিন দুপুর বেলা লোটাসের গাড়ি এসে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। খাঁ খাঁ রোদ্রে যেনো পৃথিবী পরিশ্রান্ত কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে শ্বাস নিচ্ছে। লোটাসের এসি গাড়িতে ঢুকে মনে হলো যেনো সময়কে ছয় মাস পিছিয়ে আমরা জানুয়ারিতে পৌঁছে গেছি। আমেরিকায় পৌঁছানোর কথাও চিন্তা করতে পারতাম কিন্তু সেটা অতি উচ্চবিলাসী ভাবনা হয়ে যেতো। ঢাকায় পৌঁছেই আমরা আবার রওনা হলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। লোটাসকে জোরাজুরি করলে বলল- ‘অনেকদিনের ইচ্ছে মধ্যরাতে সমুদ্রের বিচে বসে পান করার তাই ওখানে যাচ্ছি। তোদের ইচ্ছে না হলে যাস না। ড্রাইভারকে বলছি রেখে আসবে।’ আমি চুপ করে থাকলাম। অলিলও কোনো কথা বলল না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। সমুদ্র দেখার কথা আমার কোনদিনই মাথায় আসে নি। বিলের ধারে গল্প করতে করতে হাসু একবার বলেছিল- চল, সমুদ্র থেকে কিছু জল এনে বিলে ছেড়ে দিই। দেখি শ্যালা কতো ভাব নিতে পারে! ‘শ্যালা, বিলের ধারে বসে খুব ভাব নিচ্ছ। সমুদ্রের একটা ডাক শুনলেই ভয়ে জানটা শুকিয়ে কিসমিস হয়ে যাবে!’ লোটাসের কথা শুনে বুঝেছিলাম, ওটা বিশাল কিছু। আমার ওসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আজ সমুদ্রে যাচ্ছি। কিসমিসের কথা মনে পড়ছে খুব। গ্রামের বিলটা থাকলে সত্যি সত্যি ওখান থেকে কিছু জল এনে ছেড়ে দিতাম।
রাত দশটার পর কয়েক বোতল মদ নিয়ে বিচে চলে গেলাম। খুব কাছের একটা হোটেলে আমরা উঠেছি। আমি আর অলিল অনেকটা সময় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঠাঁই। অলিল বিড়বিড় করে কি যেন বলছিল। কোন কবিতা-টবিতা হবে হয়ত। লোটাস আমাদের থেকে খানিকটা দূরে বসেছিল। থেকে থেকে সমুদ্রের ডাকে চমকে চমকে উঠছিলাম। মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে আজ যেন আমি আসমানে উঠে গেছি- ভয় তো একটু লাগবারই কথা। রাত বাড়তে থাকে। আমি আর অলিল পান করতে করতে মাতাল হয়ে পড়ি। আমার মদ খাওয়ার অভ্যেস নেই তাই একটুতেই মাতলামি শুরু করে দিই। আর অলিল মাতাল হওয়ার জন্যেই পান করে। লোটাস আমাদের মদ ঢেলে ঢেলে দিচ্ছিল। হোটেলে বলা আছে শেষ রাতের দিকে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আমি বেশ ঘোরের মধ্যে ছিলাম। লোটাস বলল, ‘এই অলিল, আমাকে একটা কবিতা দিবি, সমুদ্রের বুকে লিখে আসবো- আজ খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। বিনিময়ে, এই নে আমার সোনার ওয়াস, গাড়ির চাবি, ক্রেডিট কার্ড সব দিয়ে দিলাম’। আমি হাসতে হাসতে বললাম- শ্যালা বোধহয় একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। জীবনে এই প্রথম আমি লোটাসকে শ্যালা বললাম। আমার বেশ মনে আছে। অলিল মুখে হাত রেখে বলল- ‘চুপ, একদম চুপ! সমুদ্র এখন ঘুমবে। যাহ, তোকে আমার সব কবিতা দিয়ে দিলাম। পৃথিবীর সমস্ত কবিতা এখন তোর, যা লিখে সমুদ্রের বুকে একেবারে পাকিয়ে ফেল।’ তারপর আমরা আরো কি কি যেনো বলেছিলাম। মাতলামি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো পুলিশের গুঁতোগুঁতিতে। ভোর হতে তখনো খানিকটা বাকি। আমাদের সবকিছু বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। খানিকটা দূরে দেখি কিছু মানুষের জটলা। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না কিছুই।

ছ.
এক সপ্তাহ হল থানায় আছি। লোটাসের বৌ থানায় এসে আমাদের বিরুদ্ধে কেস ডায়েরি করে গেছে। লোটাসের আত্মহত্যা নিয়ে অলিল অনেকগুলো সম্ভাবনা দাঁড় করিয়েছে : বউয়ের সাথে বনিবনা ছিল না, অথবা, সন্তানদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল না, কিংবা ব্যবসায় খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল- এইসব। প্রকৃত সত্যটা ওর মাথায় এখনো আসেনি। আমি জানি, বেশ ভাল করেই জানি, অতিরিক্ত সুখই তার আত্মহত্যার কারণ!
ধুমড়ি বৌকে ছেড়ে এখন আমি অলিলের সাথে আছি, সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়তে পারিনি। অলিল কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে। জেলখানায় নাকি কবিতারা আসতে চায় না। আমরা এখন মাঝে মধ্যে বিলের ধারে বসে লোটাস আর হাসুর সাথে প্রচণ্ড আড্ডায় মেতে উঠি। জেলখানার কনস্টেবল এসে আমাদেরকে ঘরে ফেরার কথা মনে করিয়ে দেয়। লোটাস আর হাসু ভেসে যায় মেঘে, আর আমরা ডুব দিই জলে।