(১ম পর্বের পর…)
.
মনুসংহিতার উন্মেষ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ
বেদ (Veda) ও উপনিষদের পরে ভারতবর্ষে ছয়টি আস্তিক দর্শনের আবির্ভাব ও পর্যায়ক্রমে স্তরে স্তরে এগুলোর ক্রমবিকাশ ঘটে। অর্থাৎ বেদের সংহিতাকে আশ্রয় করে পরবর্তীতে পর্যাক্রমে রচিত অন্য সাহিত্য বা স্মৃতিগ্রন্থগুলো যেমন ব্রাহ্মণ, আরণ্যক হয়ে উপনিষদের যুগে এসে পুরোপুরি ভাববাদে প্রবেশ করেছে। ততদিনে ভারতীয় সমাজে হিন্দুইজম (Hinduism) বা বৈদিক দর্শন রীতিমতো শেকড় গেড়ে বসেছে। এবং সেগুলোকে আশ্রয় করে পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থের মাধ্যমে ধর্মীয় শাসনতন্ত্র তার শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে সমাজদেহে পূর্ণ থাবা বিস্তার করে ফেলেছে। তারই ঐতিহাসিক উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে মনুস্মৃতি (Manu smriti) বা মনুসংহিতা (Manu samhita), যাকে বৈদিক সংস্কৃতি বা ব্রাহ্মণ শাসনের সংবিধান বললেও বাহুল্য হবে না। সামাজিক বিশ্বাস এমন যে- এর মধ্যেই নিহিত আছে সমস্ত বেদার্থ। অথচ এই মনুসংহিতাই হলো পৃথিবীর অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূণ বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের আকর গ্রন্থ। ভারতীয় শ্রুতি ও স্মৃতির পরম্পরায় বৈদিক পরিমণ্ডলের ধর্মীয় দুরুহতা অতিক্রমের জন্যেই উপনিষদগুলোর পরবর্তী ধাপে মনুসংহিতার মতো ধর্মশাস্ত্র সৃষ্ট হয় বলে দাবী করা হয়। এটিকে বেদের নির্যাস স্মৃতিগ্রন্থ হিসেবে দাবি করা হলেও মূলতঃ তা উপরিউক্ত সবগুলো গ্রন্থেরই নির্যাস নিয়ে রচিত ব্রাহ্মণ্য শাসনতন্ত্রের নীতিসূত্রগ্রন্থ বলে মনে করা হয়। তার আলোকেই হিন্দু ধর্মের যাবতীয় রীতিনীতি জীবনযাপন পূজাশাসন আচারবিচার সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং এখনো তার ভিত্তিতেই ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে যাবতীয় ক্রিয়াকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। এমন কি বর্তমানেও হিন্দু ধর্মানুসারীদের জন্য প্রয়োগযোগ্য রাষ্ট্রীয় যে বিশেষ আইন যেখানে ‘হিন্দু আইন অনুযায়ী’ শব্দ-সমষ্টি দ্বারা ট্যাগ করা হয়ে থাকে তার অন্যতম উৎস হিসেবেও মনুসংহিতাই প্রধান। অর্থাৎ এটি সমাজ-উদ্ভূত বিশেষ আইনশাস্ত্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অথচ মজার ব্যাপার হলো, চা থেকে যেমন পেয়ালা গরম হয়ে থাকে তেমনি বেদের সহনীয় নিরপেক্ষতার চাইতেও কথিত বেদাশ্রিত মনুসংহিতার আরোপিত অনুশাসনগুলো শতগুণ কট্টর বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক ও তীব্র অমানবিকই শুধু নয়, অদ্ভুত বর্ণাশ্রম প্রচলনকারী এই শাস্ত্রগ্রন্থে বস্তুত মানবিক সত্তাময় মানুষের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। আর নারী তো সেখানে মানুষই নয়, হয়তো অন্যকিছু।
.
প্রায় দুহাজার সাতশত শ্লোক সংবলিত দ্বাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত বর্তমানে প্রচলিত ‘মনুসংহিতা’ ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত গ্রন্থ নিঃসন্দেহে। এটিকে একাধারে স্মৃতিশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্র হিসেবে অত্যন্ত মান্য করা হয়। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মনুসংহিতাকে পরিপূর্ণ একটি ধর্ম ও শাস্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এজন্যে যে, এই গ্রন্থে বিশ্বজগৎ বা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুনিচয়, গোটা প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র-পৃথিবী, আলো-জল-হাওয়া, দিন-রাত্রি-সময়-কাল-যুগ, জীব-জগতের উৎস, স্বভাব-চরিত্র-জীবনযাপন, গুণ ও দোষবাচক সমস্ত অনুভব-অনুভূতি, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক, জীবলোক-মৃতলোক, সাক্ষি-বিচার-শাসন, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, খাবার-খাদ্য, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, শূচি-অশূচি ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়ের সৃষ্টিরহস্য ব্যবহার-বিবেচনা বর্ণিত হয়েছে কল্পনার সমৃদ্ধ শিখরে অবস্থান করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। মোটকথা মনুসংহিতা হচ্ছে বিশ্বাসীদের কাছে একটি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সমগ্র জীবন বিধান। কারণ এগুলো স্বয়ং মনুর বচন। যদিও শাস্ত্রগ্রন্থটির নাম থেকেই বুঝা যায় এটি মনুর রচিত সুক্ত বা শ্লোক বা স্মৃতিশান্ত্র, তবু এই মনুর পরিচয় নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়ে গেছে স্মৃতিশাস্ত্রেই। তাহলে এই মনু কে ?
.
কে এই মনু ?
সুপ্রাচীন বৈদিকযুগ থেকেই বিভিন্নভাবে এই মনু’র উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তা থেকে মনুর প্রাচীনত্বই প্রমাণিত হয়। ঋগ্বেদের ২ মণ্ডল ৩৩ সুক্ত ১৩ ঋক-এ ঋষিগণ মরুদগণের উদ্দেশ্যে স্তুতি নিবেদনের সময় পিতা মনুর সুখপ্রদ ঔষধ মনোনীত করার কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে-
“যা বো ভেষজা মরুতঃ শুচীনি যা শন্তমা বৃষণো যা ময়োভু।
যানি মনুরবৃণীতা পিতা নস্তা শঞ্চ যোশ্চ রুদ্রস্য রশ্মি।।”
হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (২.৩৩.১৩)।
আবার অষ্টম মণ্ডলের ৩০ সুক্তের ৩ ঋকে দেবতাদের কাছে ঋষিরা প্রার্থনা জানাচ্ছেন, তাঁরা যেন পিতা মনু থেকে আগত পথ হতে ভ্রষ্ট না হন। দেবতাদের উদ্দেশ্যে মনুর যজ্ঞনিবেদনের কথাও ঋগ্বেদে বহুবার (৮.৩০.২, ১০.৩৬.১০ ও ১০.৬৫.১৪ প্রভৃতি) পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে মনু’র এরকম বহু উল্লেখ থেকে তাকে একজন প্রভাবশালী স্বতন্ত্র মানুষ বলে মনে হয় এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে নানা প্রসঙ্গে মনুকে মনুষ্যজাতির জনক আদিপিতা, পুরাতন ঋষি, অগ্নিদেবের সংস্থাপক, অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা, কৃতযুগের রাজা প্রভৃতিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের সর্বানুক্রমণীতে মনুকে পাঁচটি সুক্তের ঋষি বলা হয়েছে এবং বেদের নিরুক্ত ভাষ্যকার সায়ণ এইসব সুক্তের ভাষ্যে মনু-অর্থে বৈবস্বত মনুর উল্লেখ করেছেন।
.
তৈত্তিরীয় সংহিতায় মনু’র নির্দেশকে ‘ভেষজ’ বলা হয়েছে- “যদ্বৈ কিং চ মনুরবদৎ তদ্ ভেষজম্।” ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণে “সর্বজ্ঞানময়ো বেদঃ সর্ববেদময়ো মনুঃ” উক্তিটির মাধ্যমে মনুর মধ্যে সমস্ত বেদের জ্ঞান নিহিত আছে বলে প্রশংসা করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি বলছেন- “প্রজাপতি (ব্রহ্মা) মনুকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মনুই প্রজাদের মধ্যে তা প্রচার করেন।”- “প্রজাপতি র্মনবে মনুঃ প্রজাভ্যঃ” (৩.১১.৪)। তৈত্তিরিয় সংহিতায় মনু থেকেই প্রজা সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। মহাভারতেও অসংখ্যবার মনু’র উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে কখনো ‘স্বায়ংভুব মনু’ এবং কখনো বা ‘প্রাচেতস মনু’র উক্তি উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৩৬.৩৮-৪৬) বর্ণিত হয়েছে-
পুরুষোত্তম ভগবান ধর্মবিষয়ক লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিলেন, যার দ্বারা সমগ্র লোকসমাজের পালনীয় ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিলো (লোকতন্ত্রস্য কৃৎস্নস্য যস্মাদ্ ধর্মঃ প্রবর্ততে)। স্বায়ংভুব মনু নিজে ঐ ধর্মগুলি প্রচার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে উশনাঃ ও বৃহস্পতি মনু-স্বায়ংভুবের গ্রন্থ আশ্রয় করে নিজ নিজ শাস্ত্র রচনা করেছিলেন।–
“স্বায়ংভুবেষু ধর্মেষু শাস্ত্রে চৌশনসে কৃতে।
বৃহস্পতিমতে চৈব লোকেষু প্রতিচারিতে।।”
আবার মহাভারতের অন্তর্গত ভগবদ্গীতায় বৈবস্বত মনুরও উল্লেখ দেখা যায়। ভগবদ্গীতায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ নিজের উপদিষ্ট যোগের প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অর্জুনকে বলছেন-
“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবান্ অহমব্যয়ম্।
বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ।।” (৪.১)
ভগবান ঐ যোগ পুরাকালে বিবস্বানকে বলেছিলেন এবং বিবস্বান নিজপুত্র বৈবস্বত মনুকে বলেছিলেন। পরে বৈবস্বত মনু ঐ যোগ ইক্ষাকুকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
তবে খোদ মনুসংহিতার মধ্যেই মনুস্মৃতির উদ্ভব কাহিনী বর্ণিত রয়েছে ভিন্নভাবে। স্বয়ম্ভু ভগবান কর্তৃক পূর্বে অপ্রকাশিত এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি ও সংহারের পর্যায়ক্রমিক বিশদ বর্ণনার এক পর্যায়ে এসে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে-
এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যামিদং সর্বং চরাচরম্।
সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ।। (১/৫৭)
এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই এই শাস্ত্র প্রস্তুতির উল্লেখ-
ইদং শাস্ত্রং তু কৃত্বাসৌ মামেব স্বয়মাদিতঃ।
বিধিবদ্ গ্রাহয়ামাস মরীচ্যাদীংস্ত¡হং মুনীন্।। (১/৫৮)
ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র প্রস্তুত করে আমাকে যথাবিধি অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং আমি (মনু) মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে অধ্যয়ন করিয়েছি।
প্রখ্যাত শাস্ত্রভাষ্যকার মেধাতিথি মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের এই ৫৮ সংখ্যক শ্লোকের ভাষ্যে বলেন-
“নারদশ্চ স্মরতি। শতসাহস্রো গ্রন্থঃ প্রজাপতিনা কৃতঃ স মন্বাদিভিঃ ক্রমেণ সংক্ষিপ্ত ইতি।” অর্থাৎ এখানে নারদ বলছেন- “এই গ্রন্থ শতসাহস্র বা লক্ষ সন্দর্ভাত্মক; প্রজাপতি (ব্রহ্মা) এটি রচনা করেছেন। তারপর ঐ লক্ষ সন্দর্ভটিকে ক্রমে ক্রমে মনু প্রভৃতি মহর্ষিগণ সংক্ষিপ্ত করেছেন।”
এই একই শ্লোকের টিকায় কুল্লুকভট্ট নারদের উক্তি উল্লেখ করে বলেন-
ব্রহ্মা প্রথমে স্মৃতিগ্রন্থটি প্রণয়ন করেন; তারপর মনু নিজ ভাষায় তার সারসংক্ষেপ করেন এবং সেই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থটিই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করেন।
.
পুরাণে পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে ১/৬১-৬৩ শ্লোকে। শ্রী হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতে- “এইসব মনু ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা এক এক জন মনু এবং তাঁদের নামানুসারেই সেই জাতির জীবিতকালকে ‘মন্বন্তর’ বলা হয়।” মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে (শ্লোক ৩২-৩৫) দেখা যায়, প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকে বিরাট্ পুরুষের উৎপত্তি হয়েছিল এবং সেই বিরাট্ পুরুষ তপস্যার দ্বারা মনু-কে সৃষ্টি করেছিলেন। মনু আবার প্রজাসৃষ্টির অভিলাষে ক্লেশকর তপস্যা করে যে দশজন প্রজাপতি (এঁরা সকলেই মহর্ষি) সৃষ্টি করলেন তাঁরা হলেন- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু এবং নারদ। প্রথম অধ্যায়ের শ্লোক ৫৮-৫৯ অনুযায়ী বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা মনুসংহিতায় আলোচনীয় শাস্ত্র অর্থাৎ বিধিনিষেধসমূহ প্রস্তুত করে প্রথমে মনু-কে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং তারপর মনু তা মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পড়িয়েছিলেন। ভৃগুমুনি এই সম্পূর্ণশাস্ত্র মনুর কাছে অধ্যয়ন করলেন। চারটি বর্ণের ও সঙ্কর জাতিগণের ধর্মসমূহ জানার উদ্দেশ্যে মনু-সমীপে আগত মহর্ষিদের মনু জানালেন যে, তিনি এইসব শাস্ত্র ভৃগুকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই ভৃগুই ঐ শাস্ত্র আদ্যোপান্ত সকলকে শোনাবেন। মনুকর্তৃক এইভাবে আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি ভৃগু খুশি হয়ে সকল ঋষিকে তাঁদের জিজ্ঞাস্যের উত্তর দিতে লাগলেন- এভাবেই মনুসংহিতা ভৃগু কর্তৃক সংস্কার ও সংকলিত হয়ে প্রচারিত হলো। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতার সর্বশেষ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ের অন্তিম শ্লোকটি লক্ষ্যণীয়-
ইত্যেতন্মানবং শাস্ত্রং ভৃগুপ্রোক্তং পঠন্ দ্বিজঃ।
ভবত্যাচারবান্ নিত্যং যথেষ্টাং প্রাপ্লুয়াদ্ গতিম্।। (১২/১২৬)
ভৃগুর দ্বারা কথিত এই মনু-সৃষ্ট-শাস্ত্র নিয়মিত পাঠ করতে থাকলে দ্বিজগণ সতত আচারনিষ্ঠ হন এবং যথাভিলষিত উৎকৃষ্ট গতি অর্থাৎ স্বর্গ লাভ করেন।
এইসব শাস্ত্রীয় বিভ্রম বা অহেতুক বিভ্রান্তিকর তথ্য উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ধর্ম ও সামাজিক ব্যাপ্তিতে এই মনু ও মনুসংহিতার অসাধারণ শাস্ত্রীয় গুরুত্ব এবং তার সমকালীন প্রভাব ও প্রাধান্যটুকু সম্যক ধারণা নেয়ার জন্যে। ভারতীয় সমাজ শাস্ত্র ও সংস্কৃতিতে নারীদেরকে মানুষ থেকে এক ঝটকায় ভোগ্যপণ্য সামাজিক সত্তা বানিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষতান্ত্রিক ভোগের মহোৎসবে পরিণত করার মূল হোতা এই মনু গং যে এতোটা সর্বগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করেছিলো, মনু-শাসনের নারী-নিবর্তনমূলক অঙ্গনে প্রবেশের আগে তার ব্যাপক আয়োজনের প্রেক্ষিতটাও জানা জরুরি বৈ কি। এ ব্যাপারে ভারতীয় শাস্ত্রগুলোতে একটু সতর্ক মনোনিবেশ করলেই এর গূঢ় অভিসন্ধিটুকু আঁচ করা যায়।
.
মনুর কাল ও আধিপত্য
প্রাচীনকাল থেকেই যে এই মনুসংহিতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে, বহু প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থেই এর উল্লেখ রয়েছে।
যেমন রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রকর্তৃক আহত বানররাজ বালি রামচন্দ্রকে ভর্ৎসনা করলে রামচন্দ্র মনুসংহিতা থেকে দুটো শ্লোক উদ্ধৃত করে নিজ দোষ ক্ষালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন-
“রাজভিঃ ধৃতদণ্ডাশ্চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।
নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।।
শাননাদ্ বাপি মোক্ষাদ্ বা স্তেনঃ পাপাৎ প্রমুচ্যতে।
রাজা ত্বশাসন্ পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্ ।।”
মানুষ পাপ করলে যদি রাজা তাকে দণ্ড দেন, তবে সে পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যবান ব্যক্তির ন্যায় স্বর্গে যায়; রাজার দ্বারা শাসিত হলে, অথবা বিচারের পর বিমুক্ত হলে, চোর চৌর্যপাপ থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু রাজা চোরকে শাসন না করলে তিনি নিজেই ঐ চৌর্যপাপের দ্বারা লিপ্ত হন।
রামায়ণে উদ্ধৃত এই শ্লোক দুটি মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩১৬ ও ৩১৮ সংখ্যক শ্লোকে প্রায় একইভাবে পাওয়া যায়। এ থেকে মনে করা যায়, রামায়ণের সময়েও শ্লোকাকারে মনুসংহিতা আংশিকভাবে হলেও প্রচলিত ছিলো।
.
৮০০ থেকে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবির্ভূত টীকাকার বিশ্বরূপ তাঁর যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার টীকায় মনুসংহিতা থেকে দুশটিরও বেশি শ্লোকের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলে P.V. Kane দেখিয়েছেন। সপ্তম শতকে আবির্ভূত বিখ্যাত অদ্বৈতবাদী বা মায়াবাদের জনক শঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে প্রায়ই মনুসংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃতি দিয়েছেন (উল্লেখ্য, বর্তমানকালের প্রচলিত হিন্দু দর্শন শঙ্কারাচার্যের এই মায়াবাদের উপরই আশ্রিত বলা যায়)। মোটামুটিভাবে চতুর্থ-পঞ্চম শতকের লোক মহাকবি কালিদাস তাঁর রচিত রঘুবংশের প্রথম সর্গে ১৭ সংখ্যক শ্লোকে দিলীপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন-
এই রাজার শাসনপ্রভাবে মনুর সময় থেকে প্রচলিত চিরাচরিত আচার-পদ্ধতি থেকে তাঁর প্রজারা বিচলিত হননি-
“রেখামাত্রমপি ক্ষুণ্নাদা মনো র্বত্মনঃ পরম্।
ন ব্যতীয়ুঃ প্রজাস্তস্য নিয়ন্তু র্নেমিবৃত্তয়ঃ।।”
আবার চতুর্দশ সর্গে ৬৭ সংখ্যক শ্লোকে কালিদাস বলেছেন-
রাজা যাতে বর্ণ ও আশ্রম সুরক্ষিত করতে পারেন, তার জন্য মনু কিছু ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন-
“নৃপস্য বর্ণাশ্রমপালনং যৎস এব ধর্মো মনুনা প্রণীতঃ।”
২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে মনুর একটি অনুশাসনের উল্লেখ রয়েছে এভাবে-
“অয়ং হি পাতকী বিপ্রো ন বধ্যো মনুরব্রবীৎ।
রাষ্ট্রাদস্মাত্তু নির্বাস্যো বিভবৈরক্ষতৈঃ সহ।।”
মনুর মতানুসারে পাপাচারী ব্রাহ্মণ বধ্য হবেন না, বরং এঁকে এঁর সমস্ত ধন-সম্পদের সাথে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করাই বিধি।
৫০০ খ্রিস্টাব্দের বেশ কিছুকাল আগেই আবির্ভূত জৈমিনি-সূত্রের ভাষ্যকার শবরস্বামী তাঁর ভাষ্যে মনু ও অন্য কয়েকজনকে উপদেশদাতা রূপে চিহ্নিত করেছেন এবং মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায় থেকে একটি স্মৃতিবিষয়ক শ্লোক (৪১৬ সংখ্যক) স্মরণ করেছেন এভাবে-
“এবং চ স্মরতি। ভার্যা দাসশ্চ পুত্রশ্চ নির্ধনা সর্ব এব তে।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ধনম্।।”
স্মৃতিকারগণের মতে, ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম; এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে, তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে।
এসব উদাহরণ থেকে অনুমান করা ভুল হবে না যে আনুমানিক দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ থেকেই এই মনুসংহিতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। ফলে এটাও স্পষ্ট যে এই সময়কালের আগেই অর্থাৎ দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই মনুসংহিতা রচনা সম্পন্ন হয়েছে। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ ২য় শতকের মধ্যে মনুসংহিতা রচিত হয়েছিলো।
.
আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও কয়েকবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্য বা চাণক্য মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের সময় (৩২০-৩১৫ খ্রিঃ পূর্বাব্দ) আবির্ভুত হয়েছিলেন। অতএব এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মনুর নামে প্রচলিত কিছু শ্লোক ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই প্রচলিত ছিলো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কয়েকটি উক্তির সাথে মনুসংহিতার বর্ণনার সামঞ্জস্য দেখা যায়। যেমন, “কন্যাদানং কন্যামলংকৃত্য ব্রাহ্মো বিবাহঃ। সধর্মচর্যা প্রাজাপত্যঃ। গোমিথুনাদানাদার্ষঃ। অন্তর্বেদ্যামৃত্বিজে দানাৎ দৈবঃ।” ইত্যাদির সাথে মনুসংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের বিভিন্ন ধরনের বিবাহের প্রকৃতি ও স্বরূপ বর্ণনা সংবলিত ২৪, ২৭-৩৪ শ্লোকগুলোর সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এবং কামন্দকীয় নীতিসারে ‘ইতি মানবাঃ’ বলে যে অভিব্যক্তি আছে, টীকাকারেরা ‘মানবাঃ’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন ‘মানবাঃ মনোঃ শিষ্যাঃ’ এভাবে। এ থেকে ধারণা করা হয় ‘মানবাঃ’ শব্দটি মনুর দ্বারা প্রচারিত শ্লোকগুলোকে আশ্রয় করে পরবর্তীকালে রচিত ধর্মশাস্ত্রগুলোর রচয়িতাদের বোঝানো হয়েছে; এদের মধ্যে অবশ্য ভৃগুই ছিলেন প্রধান। অতএব ‘ইতি মানবাঃ’ নামে কৌটিল্য সম্ভবত ভৃগুরচিত বর্তমানে প্রাপ্ত মনুসংহিতার কথাই বলতে চেয়েছেন।
.
আরেক স্মৃতিশাস্ত্রকার বৃহষ্পতির আবির্ভাবকাল ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে। তিনিও প্রয়োজনবোধে বহুস্থানে মনুবচন উদ্ধৃত করেছেন। আবার অপরার্ক, কুল্লুক ভট্ট প্রভৃতি ভাষ্যকারগণও নিজ নিজ মন্তব্যের সমর্থনে বৃহষ্পতির ঐ উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করেছেন। যেমন, কুল্লুক ভট্ট মনুসংহিতার প্রথম শ্লোকের টীকায় মনুবচনের প্রশংসাসূচক বৃহষ্পতির দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে-
“বেদার্থোপনিবন্ধৃত্বাৎ প্রাধান্যং তু মনুস্মৃতৌ।
মন্বর্থবিপরীতা যা স্মৃতিঃ সা ন প্রশস্যতে।।”
বেদের অর্থ ঠিক ঠিক ভাবে উপস্থাপিত করার জন্যই মনুস্মৃতির প্রাধান্য। যে স্মৃতি মনুবচনের বিরুদ্ধ তা নিন্দনীয়।
আবার-
“তাবচ্ছাস্ত্রাণি শোভন্তে তর্কব্যাকরণানি চ।
ধর্মার্থমোক্ষোপদেষ্টা মনুর্যাবন্ন দৃশ্যতে।।”
তর্ক, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্র ততক্ষণ পর্যন্তই শোভা পায়, যতক্ষণ মনুস্মৃতি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে। মনু হলেন ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের উপদেষ্টা।
বোঝা যাচ্ছে, মনুবচনই বেদবাক্য হিসেবে শিরোধার্য্য হয়ে আছে। এমনকি এই মনুসংহিতায় আলোচনীয় বিষয়বস্তু সম্বন্ধে প্রথম অধ্যায়ের একটি শ্লোকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে এভাবে-
“অস্মিন্ ধর্মোহখিলেনোক্তো গুণদোষৌ চ কর্মণাম্।
চতুর্ণামপি বর্ণানামাচারশ্চৈব শাশ্বতঃ।।
এই শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় হল- ধর্ম বা স্মার্তধর্ম; এখানে এই বিষয়টি বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে; যা কিছু ধর্ম নামে অভিহিত হতে পারে তা-ই এই শাস্ত্রে সমগ্রভাবে বলা আছে। বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্মের গুণ ও দোষ বর্ণিত হয়েছে, এবং চার বর্ণেরই শ্বাশ্বত আচার-ব্যবহারও কথিত হয়েছে। অতএব ধর্ম-বিষয়ক জ্ঞানলাভের জন্য এই শাস্ত্রই যথেষ্ট, অন্য কোন শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল হতে হয় না,- এ-ই হলো এই শ্লোকের অভিপ্রেতার্থ। (১/১০৭)।
অর্থাৎ পরবর্তীকালের বৈদিক ধর্মে মানবসমাজের সর্বক্ষেত্রে মনুসংহিতার অনুশাসনই চূড়ান্ত, এর অন্যথা হবার উপায় ছিলো না। বস্তুত সভ্যতার নানান চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে এই বর্তমান যুগে এসেও সেই প্রাচীন মনুযুগের অনুশাসন থেকে এখনো যে মুক্ত হতে পারছি না আমরা, এটাই তিক্ত সত্য ও পরিতাপের বিষয়। এবং মানবতার কলঙ্কও।
.
মনুসংহিতার বিষয়বস্তু নানা ধারায় বিস্তারিত। বৈদিক ভাবপরম্পরাকে আশ্রয় করে মনুসংহিতা রচিত হয়েছে বলে প্রচার করা হলেও যে সময়ে এই গ্রন্থের জন্ম, সে সময়ের সমাজের দিকে দৃষ্টি রেখেও অনেক নতুন কথা এখানে বলা হয়েছে। ফলে মনুসংহিতায় বর্ণিত ব্রাহ্মণ প্রাধান্য, বর্ণভেদপ্রথা, বিবাহসম্পর্কীয় আলোচনা, নারীর স্বাতন্ত্র্য অননুমোদন, বর্ণ ও আশ্রম ব্যবস্থা প্রভৃতি প্রসঙ্গগুলো বেদসংহিতার কোথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকার কারণে বর্তমানযুগে এগুলোর নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে সুদীর্ঘকাল যাবৎ মনুবচনকেই বেদবাক্য শিরোধার্য্য করে ব্রাহ্মণ্যবাদ নামের যে অনৈতিক শাসন ব্যবস্থা এখনো নানারূপে চালু রয়েছে তা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হবে না এবং সেক্ষেত্রে নারীকেও পুরুষের ভোগ্যবস্তুর অপমানকর অবস্থান থেকে মানব সত্তায় উন্নীত করা যাবে না আদৌ। তাই বর্তমান বিজ্ঞান-চেতনা ও জ্ঞানস্তরের সাপেক্ষে মনুশাস্ত্রের অমানবিক আবহে ভাগ্যহত নারীর মানবেতর অবস্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে মনুসংহিতার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর উপর মুক্তদৃষ্টি নিক্ষেপ জরুরি। কেননা, এর মাধ্যমেই পরবর্তীতে সৃষ্ট ও প্রচলিত ধর্মতত্ত্বগুলোরও প্রকৃত গন্তব্য ও মৌলিক প্রবণতাটা কী এবং নারী কেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনাটা কী তারও ধারণা পেতে সহায়ক হবে।
…
(চলবে…)
[১ম পর্ব ] [*] [৩য় পর্ব ]
…
্আপনার লেখাটা পরলাম খুব ভাল লাগল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
রণদীপম দা, আপনার নিচের অংশটুকু দেখে অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে আরো জানার ইচ্ছা করতেছে।
তাই আপনার অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে কোন লেখা থাকলে, তা জানালে উপকৃত হবো । ধন্যবাদ।
@রণদীপমদা,
হিন্দু ধর্ম আমার কাছে হিজিবিজি মনে হচ্ছে। এত এত মনুর মধ্যে সাধারণ হিন্দুরা কোন মনুকে আসল মনু মনে করে, নাকি তারা সব মনুকে একই মনু মনে করে? মনু নিয়ে কি হিন্দুদের মধ্যে মতভেদ বা দল-উপদল আছে? আমি বুঝতে পারছি আপনি যথা সম্ভব সহজ করে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন তবু পড়তে যেয়ে মাথা আউলাইয়া যাচ্ছে।
@হেলাল, হিন্দুরা কোনো মনুকেই পাত্তা দেয় না। হিন্দুদের একটা বড়ো সুবিধা হল পাত্তা না দিলে কারোকে গলা কেটে নেওয়ার দায়িত্ব দেয়নি। বলতে গেলে হিন্দুরা সেদিক থেকে ধর্ম-স্বাধীন। হিন্দুদের কাছে মনুসংহিতার মনু আর পেতনিপাড়ার মনার কোনো তফাৎ নেই।
হিন্দুধর্ম শাস্ত্র, দর্শন বিষয়ে আমার জ্ঞান গীতা এবং বাংলা মহাভারত পর্যন্ত। তাও খুব মনযোগ দিয়ে পড়া হয়নি। মনুসংহিতাতো কখনো পড়াই হয়নি। তবে একজন পাঠকের দেয়া মনুসং হিতার যে পিডিএফ কপি পেলাম তাতো প্রায় সবই সংস্কৃত ভাষাতে ভরা। তবে আপনার বহু সময় ও শ্রমের বিনিময়ে লেখা রচনাটি পড়ে মনে হলো, এধরনের গবেষনা মূলক লেখার প্রয়োজন রয়েছে ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচনের খাতিরে, পাঠকের বিপুল জ্ঞান জিজ্ঞাসার উত্তরের জন্য। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
@শাখা নির্ভানা,
আসলে মনুসংহিতাই হলো হিন্দুশাস্ত্রের যাবতীয় অনুশাসনের সংকলন গ্রন্থ। অন্যান্য যত গ্রন্থ বলেন, সবই এর বিস্তার, পৌরানিক কাহিনী আর তত্ত্বের ডিপো। তাই অন্যভাবে বললে সমস্ত শাস্ত্রের সার-সংক্ষেপ ও অনুশাসনিক জীবন-বিধানই মনুশাস্ত্র বা মনুসংহিতা। একে মনুস্মৃতিও বলে।
মানব সমাজকে চারটি বর্ণাশ্রমে ও বর্ণবিহীন অস্পৃশ্যে বিভাজিত করার মনুকৃত কালা কানুন নিয়ে ‘অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন দাদাসাহেব’ শিরোনামে আগের একটা সিরিজ লেখা একসাথে পিডিএফ করে মুক্তমনার ই-বুক আর্কাইভে পাবেন। মনুর বিধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয়ে যাবে। বর্তমান সিরিজটি কেবল নারীকে কিভাবে দেখা হয়েছে তার বিস্তৃত বিশ্লেষণ যা পরবর্তী পর্বগুলোতে নমুনাসহ একে একে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হবে।
মতামত জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
@রণদীপম বসু,
দাদা- কি বলবো একদম ফাটা-ফাটি। ব্যাখ্যা তো অনেকেই করছে। সময়ের অভাবে আমি আর ওদিকে গেলাম না। এমন লেখার জন্য আপনাকে (F)
চমৎকার কিছু মন্তব্য এসেছে। এর মধ্যে কিছু জবারে কিঞ্চিৎ ফাঁক রয়েছে বলে মনে হচ্ছে আমার দৃষ্টিতে। সে প্রেক্ষিতে আমার মতামত হলো-
বেদকে অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের সাথে তুলনা করার সুযোগ নেই এজন্যেই যে, অন্যান্য সকল ধর্মগ্রন্থগুলোই একক ব্যক্তির মাধ্যমে নাজেল বলি, অবতীর্ণ বলি বা রচিত বলি কিছু একটা হয়েছে। যেখানে বেদের প্রসঙ্গ একেবারেই অন্যরকম। বেদ রচিত হয়েছে একদল কথিত ঋষির শিষ্য বা গোষ্ঠী পরম্পরাক্রমে। পণ্ডিতদের মতে এই পরম্পরা চলেছে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। অতএব বেদকে আদৌ ধর্মগ্রন্থ বলা হবে না কি যৌথ গোষ্ঠী-সাহিত্য বলা হবে সেটাও বিবেচনার বিষয়। তবে মানব সভ্যতার প্রাচীনতম সাহিত্য হিসেবে এটা যে একটি মানবগোষ্ঠীর সভ্যতার বিবর্তনের অমূল্য দলিল এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, এই বেদ রচয়িতা আধিপত্যবাদী আর্যরা ছিলেন লিপিহীন শিকারি একদল মানবগোষ্ঠী। সে তুলনায় তাদের দ্বারা প্রায় ধ্বংস করে দেয়া হরপ্পা বা সিন্ধুর নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা সে তুলনায় অগ্রসর ছিলো, তাদের লিপি ছিলো যাকে সিন্ধু লিপি বলা হয়। কিন্তু হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ খুড়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন নমুনায় অংকিত সিন্ধু লিপির অর্থ এখনো উদ্ধার করা যায় নি বলে হয়তো আরো অনেক বিস্ময়ও আমাদের অজানা রয়ে গেছে আজো। সে যাক্, বেদ নিয়ে যদি সিরিজ লিখি তখন বিষয়গুলো বলার চেষ্টা করবো।
আমাদের এখনকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যে মনুসংহিতা, তার গুরুত্ব ও প্রভাব বুঝতে পোস্টের শেষ তিনটি উদ্ধৃতি শ্লোক খেয়াল করলে নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হবে না যে, হিন্দুইজমে বেদ নয় আসলে মনুসংহিতার প্রভাবই সর্বগ্রাসী। কেউ কেউ মন্তব্যে বলছেন, বেদের সাথে মনুসংহিতার বিষয় সাংঘর্ষিক। অবশ্যই এটা ঠিক। কিন্তু সবচেয়ে বড় ফাঁকিটা হচ্ছে, উপনিষদের যুগে যে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আসলে বেদকে লিখিত সংরক্ষণ করেছিলেন, তারাই মূলত ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্রষ্টা। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমান হিন্দুইজম। ওই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বেদকে ধর্মগ্রন্থ ঘোষণা দিয়ে বেদের শেষের দিকে নিজেদের ধ্যান ধারণা তত্ত্ব দর্শনকে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন বেদের দশম মণ্ডলে। আর এর উপর ভিত্তি করে অনেকগুলো ভাষ্য ব্যাখ্যা টিকা ইত্যাদি রচনাসহ বহু শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করে তৎকালীন জনপদে ব্রাহ্মণ্যশাসন কায়েম করে। বেদের ভাষা অদ্ভুত, অপরিচিত ও অনেকটা অগ্রহণযোগ্যও। আদিম কিছু গোষ্ঠীবদ্ধ গোত্রের শিকার পরবর্তী খাদ্যপ্রস্তুত কালীন কতক নিরীহ সামগান জাতীয় নৃত্যগীতের উল্লাসের ভাষাতে কোন ধর্মতত্ত্ব নেই, দর্শন নেই, দিগদর্শনও নেই। অথচ উপনিষদযুগের চতুর ব্রাহ্মণরা সেগুলোকে নিজেদের মতো করে অর্থ বসিয়ে ব্যাখ্যা তৈরি করে কার্য হাসিল করেছে খুব ভালোভাবেই। তাই হিন্দুইজম মানে উপনিষদ, যেখানে ধর্ম নিয়েই যত কল্পনা, দর্শন, তত্ত্বের সৃষ্টি। আর এ সবের একত্রিত সংকলিত অনুশাসনমূলক গ্রন্থ হলো মনুসংহিতা। অতএব হিন্দুইজমের আসল তত্ত্ব কিন্তু এসব উপনিষদ ও সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রগ্রন্থের মধ্যেই লুকায়িত। মজার ব্যাপার হলো, গোটা হিন্দু জনগোষ্ঠীর দশমিক এক পার্সেন্টের কাছেও বেদসংহিতার সংরক্ষণ নেই বা তার প্রয়োজনও কখনো হয় না। যদি বেদই মূল ধর্মগ্রন্থ হবে তাহলে এই অবহেলা কেন ? আসলে যোগ্য ঐতিহাসিক, ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী পণ্ডিতদের কাছে বেদের যে অপরিসীম গুরুত্ব, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বেদ ততটাই গুরুত্বহীন। যদিও বেদকে পরম মান্য হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখে বাস্তবে গ্রন্থগুলো না দেখেই।
আর উপনিষদে ঢুকলে অনেকগুলো জটিল ভারতীয় দর্শনের ধন্ধের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে কুল খুঁজতে হবে। এজন্যেই কাজী মামুন ভাইয়ের কোন এক মন্তব্যে জবাবে বলেছিলাম যে, হিন্দুইজমের সব বিষয় নিয়ে একসাথে আলোচনা করা আমি তো ছার্, কারো দ্বারাই সম্ভব নয়। ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি দর্শন ধর্ম শাস্ত্র তত্ত্ব ইত্যকার শতশত বিষয়কে একসাথে আলোচনা আদৌ কি সম্ভব !!
এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, পদ্মফুল নিকের মন্তব্যকারী যে বলেছেন, মনুসংহিতার তেমন মূল্য তিনি দেখেন না, আমি মনে করি বর্তমনা হিন্দু সংস্কৃতি কোন দিক দিয়ে মনুসংহিতার সীমানা থেকে এক কদম বাইরে যেতে পেরেছে ? এখানে বেদের কোন মূল্যই নেই, কারণ এটার কোন ব্যবহারিক গুরুত্বই নেই। মনুর অনুশাসন অনুযায়ীই হিন্দু সংস্কৃতির যাবতীয় বিষয় আশয় গড়ে ওঠেছে যা এখনো বহমান। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ও অন্যান্য আচার কি মনুর অনুশাসনের বাইরে বৈধভাবে মানা সম্ভব ? আমরা যারা মানি না তারা এটাকে ভাঙি বলেই মানি না। এজন্যে নিজেদের গোষ্ঠীতে বহু ধরনের বিরোধিতার মধ্য দিয়েই আমরা এগুলোকে ভাঙছি। আমাদের হিন্দু সংস্কৃতিটাই তো মনুময় ! এজন্যেই মনুসংহিতা নিয়ে আমার এতো কথাবার্তা।
বড় মন্তব্যের জন্য দুঃখিত। আসলে পোস্টের বর্তমান বিষয়টাকে ছোট করেই সুনির্দিষ্ট করেছিলাম। তবু প্রাথমিক ধারণার জন্য একটু ভূমিকা টানতেই অনেক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে গেছে। অবশ্যই এটা আনন্দের বিষয় যে আমাদের কৌতুহল উস্কে উঠছে। যা পরবর্তী আরো আলোচনায় প্রেরণা জোগাবে। আপনারা নির্দ্বিধায় আলোচনা করুন, প্রশ্ন করুন, মতামত জানাবেন অবশ্যই। এতে করে আমার পরবর্তী আলোচনাগুলো তৈরি করতে সুবিধা হবে।
রণ’দা, পোস্ট এবং মন্তব্যগুলো পড়লাম। সুপাঠ্য আলোচনার সুযোগ করে দেয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনার কথায় সহমত। তবে, বর্তমানে হিন্দুইজম বলতে যতখানি বোঝায়, সেটা দর্শনগত বা ঐতিহাসিক মূল্যকে পাশে সরিয়ে রেখে মূলত কিছু আচার আচরনের মধ্যে এসে ঠেকেছে। একই সাথে, নতুন কিছু উপরিপাতন আমরা দেখতে পাই, যেমন আধ্যাত্মবাদী কথায় ঠাসা কিছু বুজুর্গ মানুষ- রামকৃষ্ণ, লোকনাথ এমন বিভিন্ন ধাপের মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী কজন বর্তমান সময়সংশ্লিষ্ট চরিত্র ইত্যাদি; এই সময়ের হিন্দুত্বের সাথে পুরনো হিন্দুত্বের যতখানি ধারণাগত এবং অস্তিত্বগত মিল-অমিল, সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা কি হতে পারে? এই আলোচনা হয়তো হিন্দু সাহিত্যের দর্শনগত বা ঐতিহাসিক প্রত্যাখ্যানের ভয় না রেখে ধর্মটিকে প্রত্যাখ্যান করার পথ বাতলে দিতে পারবে।
এই বই তার লেখকের নাম কি সে.. কোথা থেকে এই শ্লোক গুলো নিয়ে চে… বলা বাধ্যতামূলক… আসল বই থেকে বিচার না করে…. এই ভাবে যে কোন বই থেকে edit করে মিথ্যা বলে অভিযোগ করা… সম্পূর্ণ ভুল, আপনাদের এই বই গুলো কে বিশ্বাস করা… মনে জেনে বুঝে… মুসলিম দের support করা… Bhagban কে অপমান করা
@রণদীপম বসু,
আপনি এই অবস্থানে একটা জরুরি কথা বলে ফেলেছেন .. এই আর্য দেবতাদের বাইরে হরপ্পায় শিবকে উপাসনার প্রমান পাওয়া যায় .. এবং এখানে তাদের ধর্মদর্শন আমাকে খুব আকৃষ্ট করে .. এখানে সৃষ্টিকর্তা বলতে বুঝানো হয়েছে সময়কে (মহাকাল,শিবের ওপর নাম) (এখানে বলে নেওয়া ভালো বুদ্ধদেব সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না, এবং তিনি বলেছেন সময় হচ্ছে মায়া বা মনের ভুল).. এবং শিব বলতে বোঝানো হয়েছে শুভ(ভালো)কে .. তাকে বলা হয়েছে পরমেশ্বর .. একক ঈশ্বর হিসেবে .. এবং এই শিব সবার দুঃখ বুঝতে পারে (অন্তর্যামী), এমনকি প্রাণীরও (পশুপতি) .. শিব এবং কালী(মহাকালী সময়ের স্ত্রীলিঙ্গ) দুজনকে এক দেহে দেখানো হয়েছে এটা বুঝাবার জন্য যে তারা একজনিই .. কেউ কেউ মনে করে ঔম শব্দটির মানে হলো এক (one) ..
কিন্তু আর্যদের উপস্থিতিতে দেখানো হয়েছে ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু (সম্ভবত পারস্য দেবতা) এরা সবাই এক ..
আর সন্করাচার্যের ওই অদ্বৈতবাদ এর অর্থ গ্রীকদের ধারণার সমকক্ষ .. “বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তলে সাগর অতল” .. এর মানে সংবেদনশীল এবং ভালো বৈশিষ্টের একক দেবতা প্রতিটি জীবের মাঝে বিরাজমান ..”যত জীব তত শিব” ..
আমার এই ঘাটাঘাটির একটা মূল্যায়ন আশা করছি ..
রণদীপম দাদার এত সুন্দর একটা সিরিজ পোষ্ট আামাদের সবার কাছেই খুব ভালো লাগছে, সামনে যে আরো দারুন দারুন চমক আসছে তা বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা কারণে দাদার পোষ্ট টা অসম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তা হচ্ছে আমাদের অধিকাংশ ই মনুসংহিতা পড়িনি। আর ও বড় সমস্যা হচ্ছে চাইলে হয়তো নেটে ইংরেজীটা পাওয়া যাবে কিন্তু বাংলা টা পাওয়া সহজ না। তাই সেই অসম্পূর্ণ জিনিসটা আজকে সম্পূর্ণ করছি। মনুসংহিতা বাংলা আজ শেয়ার করছি সবার সাথে। প্রথমেই বলে নিচ্ছি এটা অনেকদিন আগের বই এর থেকে স্ক্যান করে পিডিএফ ফাইল হিসেবে তৈরী করা আছে। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কতৃক সম্পাদিত বাংলা ১৩০৪ সনে লেখা বইটি আজকে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
কয়েকটি ভাগে দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা তবু ও মোট সাইজটা বেশ বড় ৮৬ মেগাবাইট। আমরা কয়েকটা ভাগে দিয়েছি। তবে যারা শুরু করবেন তাদের কে priliminary page টা ভালমত পড়ার অনুরোধ করছি।
আর নিচের লিংক থেকে ডাউনলোড করুন। সনাতনে মনুসংহিতা বাংলা চতুথ সংস্করণ
ধন্যবাদ সবাইকে।
@পদ্মফুল,
মনুসংহিতা ডাউনলোড করে চোখ বুলালাম। বেশীর ভাগ সংস্কৃতি। তবুও বাঙলা যা দেখলাম—তাতে একটু বিস্মিত হলাম।
মনুসংহিতাকে মোটামুটি হিন্দু শরীয়া। ইসলামী শরীয়ার মত মনুসংহিতাতেও অনেক নিয়ম কানুন আছে।
মনে হচ্ছে মনুসংহিতার প্রধাণ ভিত্তি হচ্ছে বেদ অথবা বেদ সমূহ, যেমন ইসলামী শরীয়ার প্রধাণ ভিত্তি হচ্ছে কোরান।
বেশ চমকিত হলাম—ধর্মের গঠনের প্রক্রিয়ার সাথে এই দুই ধর্মের বেশ মিল দেখা যাচ্ছে।
আপাতত ছোট করে মাত্র দু একটা কথাঃ
উপরে উল্লেখ করা মূল ঐ কথাগুলো মাথায় রেখে আপনার পর্বগুলো পড়া উচিৎ, নয় কি? তা না হলে, আপনি আগে যেমন ধারণা করেছিলেন, মোটামুটি ভালই ‘আউলা’ হয়ে যেতে হবে।
নীচের ‘উদ্ধৃতি’ দেওয়া কথাগুলোও মনে হয় মাথায় রেখে পড়া দরকার। প্রাথমিক মনুর সৃষ্টি বা উল্লেখকাল, মনুসংহিতা রচনাকাল, পর্যায়ক্রমে তার সুবিধাবাদী রূপান্তর বা বিকৃতি, উদ্দেশ্য, সুবিধা ভোগীগোষ্ঠী ইত্যাদি বিশ্লেষণে ফোকাস না হারানো মনে হয় খুব জরুরী, তাই মন্তব্য প্রতিমন্তব্যে প্রসঙ্গের অহেতুক ব্যাপ্তি না ঘটানোই ভালো বলে মনে হয়।
খুব জম্পেশ লেখা হচ্ছে। লেখা আর আলোচনা চলতে থাকলে নতুন আলোর দেখা যে মিলবে তা নিশিত করে বলা যায়। শুভেচ্ছা।
@কাজী রহমান, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনি একেবার বিষয়ের কী-পয়েন্টেই টোকা দিয়েছেন। আসলেই তাই। এতো বিশালায়তনিক প্রেক্ষাপটে একসাথে একবারে ঢোকার চেষ্টা না করে একটা একটা ক্ষেত্র নিয়ে পর্যালোচনায় আগানোটাই সার্বিক বিচারে সুবিধাজনক বলে মনে হয়। আমি আসলে সেরকমটাই করার চেষ্টা করছি। ফলে অনেকগুলো আলাদা আলাদা সিরিজ লেখার প্রয়োজন হবে। সে পর্যন্ত সাধ্য, সাধনা ও সময় এই ত্রৈ’স’ ধরে রাখাটাই কুলোবে কিনা জানি না। দেখা যাক !!
আপনার রচনা বহু আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। হিন্দু ধর্মের শিকড় জানা যাচ্ছে।
ইস`লামের সাথে একটু সমান্তরাল চিন্তা করছি—
মনুসংহিতা = হিন্দু শরীয়া
এটা বলা কী ঠিক হবে?
ইসলামী শরীয়ার প্রধাণ ভিত্তি = কোরান + সুন্না + হাদিস
মনুসংহিতার ভিত্তি = বেদ সমূহ + উপনিষদ + গীতা
এই রকম চিন্তা ্করা কি সঠিক হবে?
আর একটা প্রশ্ন–বিশ্বের কোন কোন রাস্ট্রে মনুসংহিতার কার্য্যকর করা হয়? অর্থাৎ বিশ্বের কোথায় কী হিন্দু শরিয়া আইন চালু আছে?
@আবুল কাশেম, ভাই আপনার ধারণার একটু ভুল আছে, ইসলাম ধর্মের সাথে সনাতন ধর্মের সবদিক থেকে মিল পাবেন না । কারণ এটা একটা মৌলিক দর্শন অপরদিকে অন্য কয়েকটি ধর্মের সন্মিলিত একটা রুপ হচ্ছে ইসলাম ।
তবে শরীয়ার সাথে মনুসংহিতার মিল দেখাতে চাইলে একবারে ব্যার্থ্য হবেন না । অনেকাংশে মিল পাবেন। মনুসংহিতাতে শুধুমাত্র একটি বিশেষ গোষ্ঠী তথা ব্রাক্ষ্মনসমাজকে উপরের স্থান দেওয়া হয়েছে অনেক অনেক ক্ষেত্রে বেদের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক হওয়া সত্বেও নিজেদের অস্তিত্ব উপরে ধরে রাখার জন্য মনুসংহিতাতে অনেক কিছু সন্নেবেশিত হয়েছে।
একটা প্রমান দেই মনুসংহিতাতে বলা হয়েছে নারীরা বেদ পড়ার যোগ্য না। অথছ বেদে দেখবেন বেশ কিছু শ্লোক নারীরা ও রচনা করেছেন। কেমন সাংঘর্ষিক বুঝতেছেন। তবে ভালো ভালো বেশ কিছু ও আছে।
কিন্তু ভাই একটা কথা আছেনা survival the fittest তেমনি এর মাহাত্ব্য পরবর্তী প্রজন্মে আর গ্রহণযোগ্য হয়নি তাই হিন্দু সমাজে মূলত মনুসংহিতার তেমন মূল্য আমি দেখিনা।
এখানে ভুল হচ্ছে ইসলামিক দিক আপনি খুব ভালো জানেন তবুও আমার মনে হয় হাদিসে পরবর্তীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে মানুষকে লাইনে আনার জন্য। কিন্তু মনুসংহিতার ক্ষেত্রে বলতে হবে এর আবির্ভাবের সময়কাল বেদের পরপরেই। যেটা উপরে রণদীপম দাদা ও আলোচনা করেছেন। তাই উপনিষদ এর সাথে সম্পর্ক নাই আর গীতা তো সেই তুলনায় সেদিন আসলো।
তবে মনুসংহিতার ভিত্তি হচ্ছে তৎকালিন আর্য তথা ব্রাক্ষ্মনসমাজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বেদের উদ্ধৃতি ও মর্মার্থ কে প্রয়োজনে বিকৃত করে রচনা করেছেন মনুসংহিতা। এতে সবদিকে ভালো পাবেন কিন্তু ব্রাক্ষ্মনদের জন্য সেরাটুকু পাবেন। অথচ এগুলো সব ই বেদের বিরোধী। ধন্যবাদ ভাই
@পদ্মফুল,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ—হিন্দু ধর্মের অনেক ব্যাপার খোলাসা করার জন্য।
আমার শেষ প্রশ্ন ছিল–
এর কি কোন উত্তর আছে? হিন্দু শরীয়া বললে ভুল বুঝবেন না। আমি বলতে চাচ্ছি বিশ্বের কোথাও এমন দেশ আছে যেখানে হিন্দু আইন প্রয়োগ করা হয়? বইতে আইন লিখা আর বাস্তবে তা প্রয়োগ করার মাঝে যে তফাৎ আছে আমি তাই`ই বুঝাচ্ছি।
@আবুল কাশেম, চমৎকার একটা প্রশ্ন করলেন !
আপনার এ প্রশ্নটার উত্তর দেবার আগে একটা ঘটনা বলি। বিয়ে করতে গিয়ে একজন এথিস্ট বেঁকে বসলেন যে তিনি সপ্তপদী বা অন্যান্য অনুষ্ঠান না করে রাষ্ট্রীয় আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় বিয়ে করবেন। প্রচলিত হিন্দু বিয়েতে কোন রেজিস্ট্রেশন হয় না। রাষ্ট্রীয় আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় গেলে আইনসম্মত বিয়েও হলো, রেজিস্ট্রেশনও হলো। নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন হবার সময় প্রয়োজনীয় দলিলপত্রে দুজন করে সাক্ষিসহ বর ও কনে উভয়পক্ষের স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখা গেলো স্পষ্ট করে লিখা- আমি অমুক পিতা অমুক সাং এই এই সম্পূর্ণ সজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে অন্য কারোর দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে হিন্দু আইন ও নিয়ম মোতাবেক কন্যা অমুক পিতা অমুক ইত্যাদি ইত্যাদিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলাম। একইভাবে কন্যার ক্ষেত্রেও অনুরূপ কথা লিখা। এটা বাংলাদেশের ঘটনা।
এখন বলেন তো এখানে হিন্দু আইন প্রয়োগ হলো না কি হলো না ? এই দম্পতির সন্তানদের উত্তরাধিকার ও সম্পদ বন্টন কোন্ আইনে হবে ? খুবই সহজ! হিন্দু আইন। একজন মুসলিম বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর জন্যে স্ব স্ব আইনই প্রযোজ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রের এখানে নিজস্ব কোন সত্তা নেই। শেষপর্যন্ত ঠিকানাটা কিন্তু সেই গোয়ালই হয়ে যাচ্ছে। এই সিরিজের প্রথম পর্বের শুরুতে কিন্তু এ বিষয়গুলোরই ইঙ্গিত করেছিলাম। এছাড়া গত আগস্টে নারী নীতি বিষয়ক একটা পোস্টে ধর্ম ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক অবস্থান আসলে কী তা নিয়ে ছোট্ট একটা পোস্টে এই বিষয়টাকে আনার চেষ্টা করেছিলাম (এখানে দেখুন )।
ধর্মীয় পরিচিতির বাইরে কেবল মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয়বাহী ব্যবস্থা বিশ্বের কয়টি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বলবৎ রয়েছে তা আমার জানা নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনচক্র এই ধর্মীয় বৃত্তের বাইরে কি এখনো যেতে পেরেছি আমরা ? আমাদের পরিচয়টাই এখনো খণ্ডিত। একজন হিন্দু ও একজন মুসলিমের মৌলিক অধিকার কি জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান ? কিংবা একজন পুরুষ ও একজন নারীর মৌলিক অধিকার ? আবার একজন হিন্দু নারী ও একজন মুসলিম নারীর মৌলিক অধিকার ? এগুলো অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন। যা উপরোক্ত নারী নীতি বিষয়ক পোস্টে উত্থাপনের চেষ্টা করেছিলাম।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আমি কি আদৌ বুঝাতে পেরেছি, যা বলতে চাচ্ছি ?
@রণদীপম বসু,
হাঁ, আপনি বুঝাতে পেরেছেন। আমি এখন পরিষ্কার জানলাম যে হিন্দু আইন এখনও জীবিত–অন্ততঃপক্ষে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে। আপনার কথাই সত্য—ধর্মের যাঁতাকলে আমরা প্রতি পদে পদে নিষ্পেশিত হচ্ছি।
বাংলাদেশ এবং ভারতে মুসলমানদের জন্যও পারিবারিক, যথা বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার…ইত্যাদি ‘মুসলিম ফেমিলি ল’ এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে হয়। এর জন্য রয়েছে ‘হেদায়া’ আইন বই, যা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, এমন কি ইংল্যাণ্ডের ব্যারিস্টাররা ব্যবহার করে থাকেন। এবং এই বইয়ে লিখিত আইন অনুযায়ীই সমস্ত মুসলিম ফেমিলি সঙ্ক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়। এই উপমদেশের সব মোহামেডান আইনই এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে–হিন্দুদের জন্যও কী এই ধরণের কোন আইন বই আছে? না মনুসংহিতা পালন করা হয়?
আর একটু প্রশ্ন…বাংলাদেশ এবং ভারতে মুসলিমরা আংশিক ভাবে ইসলামী শরীয়া আইনের আওতায় পড়ে। কিন্তু সৌদি আরব, ইরান, সোমালিয়া, আফগানিস্থান, সুদান…এই সব ইসলামী স্বর্গ গুলিতে পুরাপুরি ১০০% শরীয়া আইন চালু আছে—
বিশ্বের কোথাও কী এমন দেশ আছে যেখানে ১০০% হিন্দু শরীয়া আইন প্রয়োগ করা হয়? শুনেছি বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাস্ট্র হচ্ছে নেপাল। নেপালে কি ১০০% হিন্দু শরীয়া আইন মানা হয়? ভারতে কী হিন্দু শরীয়া মানা হয় ১০০%?
দুঃখিত, আপনাকে অনেক প্রধ্ন করে বিব্রত করছি। কিন্তু সত্যি বলতে কী আপনার রচনা পড়ে হিন্দু ধর্মের উপর আমার অনেক আগ্রহের সৃষ্টি হল।
রনদীপন-দা,
আপনার এই লেখাটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। লেখাটা পড়লাম এবং অনেক কিছুই জানতে পারলাম। তবে আমার কিছু প্রশ্ন রয়েছে।
১. অনেক ঐতিহাসিক বলেন, হিন্দু ধর্মের মনু আর বাইবেলীয় ধর্মগুলোর প্রফেট নোয়াহ বা নূহু একই ব্যক্তি। ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
২.’মনু’ থেকেই কি ‘মুনি’ বা ‘মানব’ শব্দের আবির্ভাব ঘটেছে? আর ‘বেদ’ থেকে কি ‘বিদ্যা’ এসেছে?
৩.
এই ছয়টি আস্তিক দর্শন কি কি?
৪.
এই মায়াবাদ বা অদ্বৈতবাদ কি একেশ্বরবাদী ধর্মের একত্ববাদের সমরূপ?
৫.
তাহলে বেদ কি নির্ভুল, অপরিবর্তনীয় ও অমোচনীয়? মনুসংহিতার নিয়ম-কানুন নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তাই বা আসছে কেন? সুস্থ সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্রের কি অভাব রয়েছে?
পরিশেষে, আমাদের বেশী অপেক্ষায় না রেখেই তথ্যসমৃদ্ধ ২য় পর্বটি নিয়ে এসেছেন, এজন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন অপেক্ষা করছি ৩য় পর্ব ও অবশ্যই চার্বাকের জন্য।
@কাজি মামুন, প্রথমেই চমৎকার মন্তব্যটির জন্য ধন্যবাদ।
আপনার প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে আমার ধারণাগত বিষয়টি উল্লেখ করছি-
১. ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই প্রাজ্ঞ এ ব্যাপারে। তাঁরা তাদের ইতিহাসের সূত্রগুলোকে জোড়া লাগিয়ে হয়তো একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করান। কিন্তু সেটাও হয়তো ধারণাই। সেব্যাপারে আমার ঠুনকো জ্ঞান নিয়ে কোন মতামত দেয়ার মতো জোর এখনো নেই। তবে এই লেখাটাতে মনু বিষয়ক কিছু প্রচীন সূত্র দেয়ার চেষ্টা করেছি, যা পেয়েছি আমি। বেদের সূত্র গণনায় নিলে বেদে উল্লেখিত মনুর কাল অন্তত ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বকালের আগেই হওয়ার কথা। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে প্রাচীন আর্যরা কিন্তু বাইরে থেকেই এসেছে। অতএব ঐতিহাসিকদের গবেষণাকে হেলাফেলা করার কোন কারণ নেই।
২. মনু থেকে মানব এবং বেদ থেকে বিদ্যা শব্দের উৎপত্তি খুবই যুক্তিসঙ্গতই তো মনে হয়। এ ব্যাপারে ভাষাবিদরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার কাছে এটাকেই সম্ভব বলে মনে হয়।
৩. ছয়টি আস্তিক দর্শনের মাঝখানে একটা প্রধান শব্দ লাগালে আরো ভালো হতো। যাক্, এই ছটি দর্শনকে একসাথে ষড়দর্শন বলা হয়। এগুলো হচ্ছে- ন্যায়দর্শন, বৈশেষিক দর্শন, সাংখ্য দর্শন, যোগদর্শন, মীমাংসা দর্শন, বেদান্ত দর্শন।
এগুলোর আবার কিছু শাখা প্রশাখা আছে। যেমন বেদান্ত দশনের একটি শাখা অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন, যা শঙ্করাচার্যের মায়াবাদকে ঘিরে দানা বেঁধেছে।
৪. জী, এটা একেশ্বরবাদের সমরূপ। একেশ্বরবাদী দর্শন আরো আছে। তবে এটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই জগত হলো একটা মায়া, বাস্তব নয়। ঈশ্বর বা পরমাত্মাই সত্য, আর সব তারই মায়া।
৫. সুস্থ সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ব্যবস্থাপত্রের কোন অভাব আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমি হয়তো ওখানে কথাটা বোঝাতে পারি নি। আসলে মনুসংহিতাকে যেভাবে বেদাশ্রিত বলা হয়েছে, সে প্রেক্ষিতে প্রথমে জানা দরকার মনুর কালাকানুনগুলো আসলেই বেদে রয়েছে কিনা, এটার একটা ব্যাখ্যা দরকার। দ্বিতীয়ত বেদ কী এবং এই জিনিসটার জন্ম আসলে কিভাবে হয়েছে তার নির্মোহ বিশ্লেষণ জানা দরকার। উপনিষদযুগের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যে বেদ সংরক্ষণের কালে তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদের বহু অসৎ উপকরণ সেখানে ঢুকিয়ে দেয়নি তার গ্যারান্টি কে দেবে। বেদের রচনার অসংগতি নিয়ে একটু ইঙ্গিত আগের পর্বে দিয়েছিলাম। ধর্মবাদীরা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। কিন্তু যুক্তিবাদের দৃষ্টিতে এগুলোর ব্যাখ্যার কি দরকার নেই ? প্রচীন চার্বাকরা সেই বেদান্তের কাল থেকে যুদ্ধ করেছেন। এ যুগের চার্বাকদেরও কি এই তাত্ত্বিক কাজটা করতে হবে না ? আমি এটারই ইঙ্গিত করেছি।
উল্লেখ্য, এ বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতরা।
আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে বিষয়গুলো গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য।
@রণদীপম বসু,
অনেক ধন্যবাদ, দাদা, ধৈর্য ধরে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য। মনু আর বাইবেলের নোয়াহ বা ইসলামের নুহু নবী যে একই ব্যক্তি, সে ব্যাপারে আমার কাছে কিছু মাধ্যমিক তথ্য ছিল। কিন্তু আপনার বক্তব্যের পরে, তা উল্লেখের আর প্রয়োজন দেখি না। তবে একটা বিষয় প্রনিধানযোগ্যঃ ঐতিহাসিকদের দাবী যদি সত্যি হয়, তবে যারা সব ধর্মের মিলনের স্বপ্ন দেখেন, তাদের চেয়ে বেশী খুশি বোধহয় আর কেউ হবে না।
আর আপনার প্রথম লেখাটি পড়ে, মনের কোনে বেদকে প্রগতিশীল চার্বাকের চরম প্রতিপক্ষ বানিয়ে রেখেছি! কিন্তু আপনার এবারের বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বোধহয় এত সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যাই হোক, পরবর্তী পর্বগুলো পড়ার পর ধন্দগুলো দূর হয়ে যাবে বলে মনে হয়।
@কাজি মামুন, এ ব্যাপারে আমার সল্প জ্ঞান থেকে কিছু বলছি
মনু এর উত্তরসূরি বা সন্তানদের মানব বলা হয়। আর মুনি এর ব্যাপার হচ্ছে, তৎকালিন সময়ে যারা সাধনা করতেন তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতেন না । (এর কিছু ধর্মীয় কারণ আছে)। এটাকে বলা হত মৌন বৃত্তি যারা মৌনবৃত্তি পালন করতেন তারা ই মুনি। আর VEDA থেকে বিদ্যা শব্দটি আসতে পারে। নিশ্চিত নই।
দ্বিতীয়ত
সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মে কোথাও বহুঈশ্বরবাদের স্বীকৃতি নাই অন্তত আমি দেখিনাই, তবে যেটা আছে তা হচ্ছে বহু রুপ। অর্থাৎ নিরাকার ঈশ্বর কোন কাজ করার জন্য সাকার রুপ ধারণ করলে সেই সাকার রুপটিকে ঈশ্বরের বিশেষ একটা রুপ হিসেবে পূজা করা। পরবর্তীতে হিন্দুরা এটাকে বহুঈশ্বর হিসেবে ভুল ধারণা করতে পারে । কিন্তু মূলত এক ঈশ্বর। বেদ এ আছে “একহোহম বহুধা বিপ্রন্তি” অর্থাৎ আমি এক, জ্ঞানীরা বহু নামে ডাকে।
আর মায়াবাদ, দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ এবং অদ্বৈতবাদ এগুলো হিন্দু ধর্মের আলাদা আলাদা দর্শন, প্রতিটি দর্শন পড়লেই সেটাকেই প্রকৃত মনে হয়। তবে এর মাঝে সবচেয়ে উচ্চমার্গের দর্শন হচ্ছে একেশ্বরবাদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্লগে দর্শনগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি এবং দ্বৈতবাদ পোষ্ট করা হয়েছে । বাকীগুলো হলে রেফারেন্স দিতে পারবো।
@পদ্মফুল,
অনেক ধন্যবাদ বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করার জন্য। আপনার দর্শন আলোচনা পড়তে আগ্রহী। আশা করছি, অচিরেই রেফারেন্স পাব।