তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত “মুক্তির গান” প্রামান্যচিত্রটির ডিভিডি সংগ্রহে থাকলেও দেখা হয়ে ওঠেনি আজকের আগে। এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একদল তরুণ লেখক, আঁকিয়ে, গায়ক, বাদক, নাট্যশিল্পী সর্বোপরি একদল দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীদের গড়া সাংস্কৃতিক দল “বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা” এর শরণার্থী শিবির ও মুক্তাঞ্চলে গানের ও নাটকের ভান্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ফুটেজ নিয়ে। এই ভিডিও ফুটেজগুলো সেলুলয়েডে ধারণ করেছিলেন মার্কিন চলচ্চিত্রকার লেয়ার লেভিন। “বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা” দলটির কাজ ছিল ট্রাকে করে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা- দেশাত্মবোধক গানের আসর করে, মানুষের সাথে কথা বলে, পুতুল নাটকের আয়োজন করে। লেয়ার লেভিনের ধারণকৃত প্রায় ২০ ঘন্টার ফুটেজ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রয়কৃত মুক্তিযুদ্ধকালীন ফুটেজ সংগ্রহ করে তা থেকে বাছাইকৃত কিছু অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে এই প্রামান্যচিত্র। সাংস্কৃতিক দলটির কর্মকান্ড, শরনার্থীদের সাথে আলাপচারিতা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও যুদ্ধ, সাধারণ মানুষদের অনুভূতি ও চিন্তা, আহতদের চিকিৎসার অস্থায়ী ক্যাম্প বা হাসপাতালের অবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্জয় মনোবল ও অকুতোভয় চেতনা, দেশের ও স্বাধীনতার প্রতি সর্বসাধারণের আকুলতা, জয়ের আনন্দ এসব কিছু উঠে এসেছে ১ ঘন্টা ১৩ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রে।

এই প্রামাণ্যচিত্রের মূল আকর্ষণ হচ্ছে এতে ওই সময়ের সকল স্বাভাবিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা খুব ভালভাবে এসেছে। ঐ সাংস্কৃতিক দলটি যখন এক শরণার্থী পরিবারের বাড়িতে আতিথেয়তা পায় তাতে সেই সর্বহারা পরিবারটির অন্তরের চিরায়ত বাঙালির আতিথিপরায়নতা যেমন চোখে পড়ে, তেমনি সেই পরিবারের পোষা তোতা পাখিটি উপহার পেয়ে দলটির সদস্য তারিক আলীর সেই পাখিটিকে “জয় বাংলা” বুলি শেখানোর চেষ্টায় “জয় বাংলা” স্লোগানের শক্তি ও মানুষের কাছে তার গ্রহনযোগ্যতা প্রকাশ পায়, আবার তারিক আলী যখন মুক্তিযোদ্ধা হবার অদম্য ইচ্ছেয় মুক্তিবাহিনিতে যোগ দিতে চায়, কিন্তু “চশমাওয়ালা” হওয়ার কারনে সুযোগ পায়না তখন ফিল্মিভাবে তাকে মুক্তিবাহিনিতে নেয়ার সুযোগ হয়না, কিন্তু সিনেমার চেয়েও বাস্তব দেখায় তার আশাভঙ্গের বেদনা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের আকাঙ্খা। রেডিওতে বলা হচ্ছিল, এক ক্যাম্পে ২০-২২ বছরের এক যুবক মতিয়ুর- যার পায়ের মাংস উড়ে গেছে, ডাক্তারকে বলছিল তাড়াতাড়ি তাকে সুস্থ করে দিতে, কারণ খান সেনারা আসছে। দুই আহত মুক্তিসেনার একজন বলছে “ডাক্তারবাবু, আমি বাঁচবনা। ও বাঁচবে। আপনি ওকে দেখুন।”- এই বাস্তবতা সবচেয়ে ভাল অভিনেতার সবচেয়ে ভাল সিনেমার ডায়লগের চেয়ে অনেক বড় মনে হয়েছে আমার কাছে। পুতুল মুক্তিসেনা যখন নাটকে পুতুল ইয়াহিয়াকে ভয় পাওয়াচ্ছে তা দেখে মানুষ মজা পাওয়ার সাথে সাথে এই মেসেজটাও পেত যে ইয়াহিয়াকে অর্থাৎ পাকিস্তানি বাহিনিকে আসলেই হটতে হবে, হটানো হবেই। আসলে যখনই ভাবছিলাম যে, যা দেখছি সবটাই বাস্তব, কেমন অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল। বিশেষ করে মুক্তাঞ্চলে আসার সুযোগ পেয়ে ঐ দলের মানুষগুলো যেমন হাভাতের মত মাটি কপালে ছোঁয়াচ্ছিল, কাঁদার দলা হাতে নিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি মুখে ফুটিয়ে তাকিয়ে ছিল- সেই সময়।

এই ছবি দেখে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, ঐ সাংস্কৃতিক দলটিতে তরুণ-তরুণীর সহাবস্থান ছিল, এবং সেসব তরুণ-তরুণীরা প্রায় সবাইই ছিল শিক্ষিত ও প্রতিভাবান। ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ সব ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি পুরুষ-নারী উভয়কে পাশাপাশি। এখানেও দেখা গেল এতগুলো মেয়ে একসাথে এমন একটা বিপদসঙ্কুল সময়ে ট্রাকে করে দেশজুড়ে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে এবং তার সঙ্গী পুরুষরা তাদেরকে নারী নয় সঙ্গী বা কম্প্যানিয়নের মতই ভাবছে। অথচ এত বছর পরে এখন এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের মাঝেও এই স্বতস্ফুর্ততার ঘাটতি দেখি। অনেক ছেলেকে বলতে শুনেছি, “মেয়েমানুষ নিয়ে ঘোরা ঝামেলা” ইত্যাদি ইত্যাদি, ঢাকার বাইরে বা ২-৩ দিনের ট্যুরে পরিবার বা ডিপার্টমেন্ট ছাড়া শুধু বন্ধুরা- ছেলে-মেয়ে মিলে যাওয়া কেন যেন অনেকের কাছেই মঞ্জুর নয়। আর ছেলে-মেয়ে মিশ্রিত বন্ধুদল যদি ঘুরতে বের হয় তাহলে তাদের অনেক সহপাঠী বা পরিবার থেকেই কটাক্ষ শুনতে হয়, অনুমতি পাওয়া যায়না বিশেষ করে মেয়েদের বাড়ি থেকে অনুমতি পাওয়া যায়না, যে জায়গায় যাচ্ছে সে জায়গাটা মফস্বল বা প্রত্যন্ত হলে তো কথাই নেই, স্থানীয় লোকজনও কথা শোনাতে দ্বিধা করেনা। আর ঐ দলের এমন অনেক মেয়ে থাকে যারা এইসব অশিক্ষিত এবং সংকীর্ণমনা মানুষদের কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলে বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছের চেয়ে আর নিজের কান মলে সকল আকাঙ্ক্ষা রেখে দেয় স্বামীর সাথে বা অভিভাবকদের সাথে পূরণ করার আশায়। যেকোন জায়গার পরিবেশ ও সঙ্গীদের মনোভাব বুঝে সচেতন ও সাবধান থাকা জরুরি কিন্তু সংকীর্ণমনার ভুল একটা কথাতে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ? আর আমাদের যেকোন আন্দোলনের সময় ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সবার সামনে থাকত ছাত্র-ছাত্রীরা, কিন্তু আজ তাদের অধিকাংশই রাজনীতিসহ এ ধরণের আন্দোলনের ধারণা রাখা ও পদক্ষেপ নেয়াতে অনেক পিছিয়ে। আমরা মনে হয় উলটোপথে হাঁটা শুরু করেছি এখন।

প্রামাণ্যচিত্রটির শেষ কথাগুলো ছিল,

“যুদ্ধ শেষ, দেশ স্বাধীন। বিজয়োল্লাস ও উৎসবের এই আনন্দমুহূর্তেও আমার মনে পড়ছে সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের চেহারা- সেই বালকযোদ্ধার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চাহনি, মনে পড়ছে বৃদ্ধ কৃষক সেই মুক্তিযোদ্ধার কথা, আমি কোনদিন ভুলবনা গামছা মাথায় সেই স্বাধীনতার সৈনিককে-যার সাহসিকতা ছিল কিংবদন্তির মত কোনদিন ভুলবনা অকুতোভয় সেই বীর শহীদদের যারা প্রাণ দিয়েছিল বিজয় ছিনিয়ে আনতে। কিন্তু এই মহৎ আত্মদানের কথা মনে রাখাই কি যথেষ্ট? প্রশ্ন তবু থেকে যায়। আমরা কি পারব তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাখতে? আমরা কি পারব তাদের সেই মহান লক্ষ্য সমুন্নত রাখতে?”

পারিনাই মনে হয় আমরা, পারছিনা… 🙁

সবশেষে প্রয়াত (বিশেষণটা লিখতে খুব কষ্ট লাগল, শূন্যতা টের পাচ্ছি বুকে) চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ এবং চিত্রপরিচালক ক্যাথরিন মাসুদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা রইল যারা আমাদেরকে মুক্তির গান শোনাবার আন্তরিক তাগিদ থেকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেয়ার লেভিনের পাতাল কক্ষে বাক্সবন্দী ও নানা দেশের ধারণকৃত এই ফুটেজগুলো সংগ্রহ করে স্বল্প পরিসরে বাস্তবতার এই শিল্পটি উপহার দিয়েছেন।