আর মাত্র কয়েক মাস পর আমাদের স্বাধীনতার চার দশক পূর্ণ হতে চলেছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় জন্মের মাত্র দু’যুগের মাথায় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ভেঙ্গে বাঙালি এ নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। তাই আজ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশ কি তার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছে ? একাত্তুরের একজন (গেরিলা) মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আজ আমার অসংকোচ উচ্চারণ-সেদিন যে স্বপ্ন বক্ষে ধারণ করে, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে, আমরা স্বাধীনতার রক্তসূর্য-খচিত পতাকা ছিনিয়ে এনেছিলাম, আজকের বাংলাদেশ সে স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়।
কী স্বপ্ন সেদিন বাঙালি দেখেছিল?
ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। তার ভৌগোলিক কাঠামো ছিল, আকাশ পথে এগার শ’ মাইল দূরে অবিস্থিত দু’টি ভূ-খণ্ড, যাদের মধ্যখানে একটি উপমহাদেশ, এবং সে ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। জন্মের কিছু দিনের মধ্যে সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তান একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। বস্তুত: পাকিস্তান সৃষ্টির পর মো: আলী জিন্নাহের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার আড়ালে বাঙালিকে রাজনৈতিক ভাবে শাসন ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণের নিগড়ে আবদ্ধ করার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেছিল । সে লক্ষ্যে পূর্ব বাংলাকে তাদের একটি স্থায়ী উপনিবেশ এবং এতদাঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে তাদের সেবাদাসে পরিণত করতে তারা প্রথম আঘাত হানল বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। তাদের আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি জাতিরও মোহভঙ্গ হল। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাঙালি উপলব্ধি করল, কেবল ধর্ম এক হলে কখনো একটি জাতি হয় না, বরং জন্ম ও বিকাশগত ভাবে একই নৃ-গোষ্ঠী একটি জাতি সৃষ্টি করে এবং সেক্ষেত্রে ভাষা এবং সংস্কৃতি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
তখন পশ্চিমা মুসলমান ভাইদের রাজনৈতিক শাসন ও অর্থনৈতিক শোষনের চক্রান্ত বাঙালি উপলদ্ধি করতে পারল। তাই জাগো, জাগো-বাঙ্গালী, জাগো; তোমার, আমার, ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; তুমি কে, আমি কে-বাঙালি বাঙালি; প্রভৃতি শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালী জেগে উঠতে লাগল, ক্রমে ঐক্যবদ্ধ হতে লাগল প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ হল। অত:পর নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানীদের নতুন চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র এবং সামরিক শক্তি দিয়ে বাঙালির বিজয় নস্যাৎ করার লক্ষ্যে বাঙালির উপর হামলা, প্রতিক্রিয়ার বাঙালির অসমসাহসী প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙ্গালী নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনল। পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙ্গেই জন্ম হল বাংলাদেশের ।
পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীকার থেকে স্বায়ত্ত্বশাসন এর আন্দোলন এবং স্বায়াত্ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তপিচ্ছিল পথপরিক্রমায় যে স্বপ্নের অঙ্কুরোদগম সেদিন বাঙালি মানসে হয়েছিল, তাহল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র, যা পরিচালনার মৌলনীতি হবে, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
সঙ্গতঃ কারণেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ, এ চার নীতিমালা সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধানে মূলনীতি হিসাবে গৃহীত হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো-স্বাধীনতার সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের সে চেতনা বা মূল্যবোধের কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি ?
একটি শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক,ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপরীতে আমাদের আজকের রাষ্ট্রের বিদ্যমান চিত্রটি কি ? আজকের এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম??
আজকের বাঙলাদেশ : আর্থ-সামাজিক অবস্থা।
স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল একটি শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ৭৫ এর ১৫ ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যে উল্টো পথে দেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে পথপরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হোসেন মো: এরশাদ আমাদের সংবিধানকে সংশোধন করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, যার সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু সর্বসম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সামরিক শাসকদের সে সকল সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে একাত্তুরে সংবিধানকে পুনর্জীবিত করলেও বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আজকের সংবিধানে একই সাথে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বহাল রেখে দেশের সর্বোচ্চ আইনকে এক স্ব-বিরোধী গোজামিলে পরিণত করেছে। আজ বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলা, আদর্শহীন লুঠেরা রাজনীতিকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী মাফিয়াচক্র নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি। বলাবাহুল্য, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। তাই সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে অনেক কালটাকার মালিক, ঋণ খেলাপী বেনিয়া ও বিভিন্ন গুরুতর ফৌজদারী মামলার আসামী। তারা কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে না, জনগণের মুক্তির কোন মিশন বা ভিশন তারা লালন করে না। তাদের কাছে রাজনীতি আজ সর্বাপেক্ষা লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাদের রাজনীতির লক্ষ্য হল, যে কোনভাবে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় গিয়ে স্ত্রী-পুত্র-ভ্রাতা-ভগ্নি-ভাগ্নে প্রভৃতি আত্মীয় পরিজন সমবিহারে রাষ্ট্র তথা জনগণের সম্পত্তি লুঠপাট করা। এ অসুস্থ রাজনীতির পরিণামে আজ অপশাসন-দুঃশাসনে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠেছে। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আজ চরম আকার ধারণ করেছে। এ অশুভ শক্তির দোর্দণ্ড দাপটে দেশের সৎ-দেশপ্রেমিক মেধাবী মানুষেরা আজ রাজনীতি থেকে নির্বাসিত। স্বাধীনতার দীর্ঘ চার দশক পরেও আমাদের দেশে যেমন একটি সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত হয় নি, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও শাসনকারী দলগুলোর চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উন্নয়নের অব্যর্থ মডেল হিসাবে গ্রহণ করা হলেও বস্তুতঃ দেশে কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়নও ঘটে নি। মুক্ত বাজার অর্থনীতির অপরিহার্য পূর্বশর্ত আইনের শাসনও এখনো সুদূর পরাহত। সমাজে যেমন শ্রেণী বৈষম্য তীব্র হয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে গ্রাম শহরের বৈষম্য। উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কহীন এক শ্রেণীর শহুরে লুঠেরা ধনিকদের সীমাহীন জৌলুস, আধুনিক জীবন যাপন, আর অন্যদিকে গ্রামের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর সংগ্রাম, এ স্ববিরোধী অবস্থা আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। দেশে আজ বেকারের সংখ্যা তিন কোটির উপরে। ফি বছর ২১/২২ লক্ষ শিক্ষিত বেকার শ্রমের বাজারে প্রবেশ করছে। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করে পুরো সমাজকে গিলে ফেলেছে। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের কলঙ্ক তিলক দেশের কপালে শোভা পাচ্ছে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে। নির্মম হলেও যে সত্যটি আমাদের স্বীকার করতে হবে, তাহল আমাদের দেশ এখনো বিশ্বের অন্যতম একটি পশ্চাৎপদ দেশ।
রাজনৈতিক অবস্থা:
স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরও আমাদের দেশের রাজনীতি উন্নত হওয়ার পরিবর্তে স্বাধীনতা পূর্বকালের ঐতিহ্য হারিয়ে নিদারুন এক রুগ্ণ সংস্কৃতিতে আক্রান্ত হয়েছে। কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য লড়াই এবং ক্ষমতায় গিয়ে দলীয় লোকজন মিলে লুটপাট, এ যেন রাজনীতির মুখ্য লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার পর হতে আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলশ্রুতিতে আজ গ্রামীণ ও শহুরে নিন্ম-মধ্যবিত্ত দরিদ্র যুবশ্রেণীর মনে যে নিদারুন হতাশা দানা বেঁধেছে, তা তাদরকে কেবল মাদকসেবী বানাচ্ছে না, তাদেরকে ধর্মীয় জঙ্গীবাদের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে দেশে আইনের শাসন এর পরিবর্তে চলছে দলের শাসন। যে দল ক্ষমতায় যায়, প্রশাসন, বিচার সব তাদের কথায় চলে। স্বাধীনতার এত বড় ত্যাগের পরও গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের আমজনতা বারংবার লড়াই সংগ্রাম করেছে-প্রাণ দিতে হয়েছে নুর হোসেন, তাজুল, রাউফুন বসুনিয়া, মোজাম্মেল, দীপালি শাহার মত অগুণিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে। কিন্তু গণতন্ত্রের লড়াইয়ের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে যে দল ক্ষমতায় গেছে, নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারাই বেঈমানী করেছে জনতার সাথে। স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়া, এ যেন এ জাতির অনপণেয় নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশে যে সকল বৃহৎ রাজনৈতিক দল বারংবার ক্ষমতার মসনদে বসেছে এবং গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে, ঐ সমস্ত দলগুলো বস্তুত: বহু আগেই প্রাইভেট (পারিবারিক) লিমিটেড কোম্পানীতে পরিণত হয়ে গেছে এবং গণতন্ত্রে তাদের আদৌ কোন আস্থা নেই-গণতন্ত্র তাদের কেবল মুখের বুলি। এ সকল দলে গণতন্ত্রের লেশমাত্র চর্চা হয় না । এমনকি গণতান্ত্রিক ভাবে তাদের কোন নেতা-নেত্রী কখনো নির্বাচিত হয় না-মূল নেতা বা নেত্রী তাদের নিয়োগ দেন, প্রয়োজনে কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে বরখাস্ত করেন। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির যত সভা হউক কিংবা জাতীয় কাউন্সিল, এক দিন, দুই দিন, তিন দিন ব্যাপী, কিন্তু সিদ্ধান্ত দেন একজন-মূল নেতা বা নেত্রী। তাই সে সকল দলে গালভরা ডিগ্রীধারীরাও মুখে ফেনা তুলে নেতা-নেত্রীর অহর্নিশ বন্দনায়, না হলে নেতৃত্ব থাকবে না যে । নেতা নেত্রীর সন্তান-সন্ততিরা পুকুর চুরি করলেও মুখ ফুটে দলের কোন নেতা তার প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না, বরং সাফাই গায় । তাদের একদল ক্ষমতায় গেলে অন্যদল সেদিন থেকে শুরু করে ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই। জনগণকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করলেও যারা ক্ষমতায় যায়, তারা সে সকল প্রতিশ্রুতি আর মনে রাখে না। আর যারা ক্ষমতায় যেতে পারে না, তারা প্রথম দিন থেকেই তৎপর হয় সরকারী দলের যাত্রাভঙ্গে, জাতির নাক কেটে হলেও-যার সূচনা হয় সংসদ বর্জনের মাধ্যমে। জনগণের সংকট সমস্যা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই, তাদের ল্ক্ষ্য এবং একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতাসীন দলকে ব্যর্থ করে তাদের ক্ষমতারোহন এর পথ মসৃন করা- কারণ ক্ষমতার হালুয়া-রুটির স্বাদ তারা যে সহজে ভুলতে পারে না। সব মিলিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতি আজ দুর্বৃত্তায়িত, রুগ্ণ এবং দ্বি-দলীয় ধারায় বিভক্ত। এ বিভক্তি জনগণের মধ্যেও মারাত্মকভাবে অনুপ্রবিষ্ঠ। দেশের আইনজীবি, ডাক্তার, শিক্ষক, শিল্পী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, শ্রমিক-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবি, সবাইকে আজ দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে-হয় আওয়ামী-পন্থী, নতুবা বিএনপি-পন্থী। মানুষের শেষ ভরসাস্থল দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ অপবাদ থেকে মুক্ত নয়। আদালতের রায় যাদের পক্ষে যায়, তারা বলে ন্যায় বিচার পেয়েছি, আর যাদের বিপক্ষে যায় তারা চিৎকার করে বলে, এটা দলীয় বিচারপতি। সমাজের তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আজ এহেন অবস্থা। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, ঊনসত্তর, সত্তর ও একাত্তুরে এ জাতি কী ভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল!
সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনার অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে দেশের মানুষ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে তথাকথিত মহাজোটকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে ছিল আজ থেকে আড়াই বছর আগে। নির্বাচনের প্রাক্কালে মহাজোট যে নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল, একে একে তার সব কয়টি যেমন তারা ভঙ্গ করে চলেছে, তেমনি কথা রাখে নি বিরোধী দলও। নির্বাচনের পর হতে অদ্যাবধি তারা সংসদ অধিবেশন বর্জন করে যাচ্ছে লাগাতার। দেশে বর্তমানে বিদ্যু, গ্যাস,ও পানি সংকট, সর্বোপরি দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতিতে নাকাল দেশের মানুষ। সে সমস্ত সমস্যা নিয়ে তারা মানুষের পাশে নেই। তাদের সকল আন্দোলনের লক্ষ্য তাদের নেত্রী ও নেত্রী-পুত্রদের মামলা থেকে অব্যাহতি। মহাজোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যা ঘোষণা দিয়েছিল, যেমন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান জোরদার করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দেশে আইনের শাসন কায়েম করা, দলবাজি পরিহার করে সুশাসন নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা, বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে প্রতি ঘরের একজনকে চাকুরী দেওয়া ইত্যাদি ওয়াদার একটিও বাস্তবায়ন করে নি তাদের আড়াই বছরের শাসনামলে। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উল্টোটা করেছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার অঙ্গীকারের বিপরীতে তারা রাষ্ট্রকে একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিগৃহীত-লাঞ্চিত-নিহত মানুষের পক্ষে রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে না । রেব কর্তৃক লিমন নামক নিরীহ কলেজ ছাত্রকে গুলি করে পঙ্গু করা, পুলিশের নীরব উপস্থিতিতে ৬ জন স্কুল ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা, কাদের নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে ডাকাত বানিয়ে নির্যাতন করা, মিলন নামক কিশোরকে গণপিঠুনীতে খুন করার জন্য পুলিশ কতৃক জনতার হাতে সোপর্দ করা, ইত্যাকার ঘটনার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত বলে দাবী করছে, পুলিশ-রেবের পক্ষে সাফাই গাইছে। অর্থাৎ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার বিপরীতে রাষ্ট্র আজ নিগ্রহকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সর্বোপরি সারাদেশ ব্যাপি সন্ত্রাস, ভুমি দখল, হাটবাজার, হাওড়-বাউড়-নদী দখল, এডভোকেট নুরুল ইসলামের হত্যাকারী লক্ষিপুরের তাহেরের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পুত্র বিপ্লবকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন, ইত্যাদি ঘটনা প্রমান করে, দেশে এখন বস্তুত: আইনের শাসন নয়, দলের শাসন তথা আওয়ামী শাসন চলছে। ফলত: আওয়ামী নেতারা বুঝতে পারুক বা না পারুক, ইতোমধ্যেই তাদের জনপ্রিয়তায় ধ্বস্ নেমেছে। সে সুযোগে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বি,এন,পি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট। সে লোভে কিছু ছোট ছোট নাম সর্বস্ব দলও তাদের সাথে নতুন করে জোটবদ্ধ হচ্ছে। তারা নাকি গড়বে মহাঐক্যজোট। মহাজোটের বিপরীতে মহাঐক্যজোট আবার ক্ষমতায় গেলে জনগণের ভাগ্যে যে কোন পরিবর্তন হবে না, তা বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এমতাবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাস বা মেরুকরণ অপরিবর্তীত থাকলে, মহাজোট সরকারের ব্যর্থতার ফলে জনগণের সামনে এক মাত্র বিকল্প হিসাবে থাকছে আবারো সেই ৪ দলীয় জোট-বা নবগঠিতব্য কোন মহাঐক্যজোট, যাদের প্রত্যাবর্তন দেশ ও জাতিকে আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে। কোন বিবেকবান, প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক মানুষের এ অবস্থাটা কাম্য হতে পারে না।
তাই দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির একটি বিকল্প ধারার প্রয়োজনীয়তা পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন আরো তীব্র হয়ে ওঠেছে।
দেশ ও জাতিকে আরো মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে আসুন, সকল প্রগতিশীল, বাম, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবি-পেশাজীবি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলি। জাতিকে এ দুবৃত্তায়িত রুগ্ণ রাজনীতির অচলায়তন থেকে মুক্ত করে উন্নয়নের মকছুদ মঞ্জিলে পৌঁছানোর আর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।