টুগডুগ –টুকডুক- একটানা শব্দটা কানে যাচ্ছে মৌরির। সেই যে শুনেছে নগেন গ্যালো, তারপরেই রিকশার ঝাঁকুনিতে একটু ঝিমুনি আসছে। গোপালের বকবকানিতে ঝিমুনি আরো বেড়ে গেলো।
নগেনটা গেইচে যাক- অদের ভেবে আর কী বা হবে? হাই তুল্ল মৌরি-কাকিমার গালমন্দ তখনো কানে ভাসছে।
-তুই আর বকবক করিসনি তো? মেলা বকচিস তখন থেকে –
তা আমি কী কিছু বাজে কতা কইছি তুমি বলো?
“জানিনা, আমার ভাল্লাগছে না তুই থাম”

হঠাৎ কঁকিয়ে উঠল মৌরি। রিকশা একটা গর্তে পড়েছে।
“তুমি কী চোখের মাতা খেইচো, যত্তসব হতচ্ছাড়া আমার কপালে জুটে” উস্কো-খুস্কো চুল বাতাসে উড়তে লাগলো মৌরির।
গোপালও রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল- শতকখোয়ারির দল কুথা থেকে এইচো গো বলোধিনি? দিলে তো আমাদের কে হাগা-মুতার মধ্যে ফেলে- হ্যাঁ গো সকালে কী খাওনি নাকী-হে?
-আজ্ঞ্যে বাবু –রিকশার প্যাডেল পুরনো হয়ে গিয়েচে তো-পা দুটো পিছলে গেলো, আমি কী ইচ্ছে করে করেছি বাবু মশাইরা?
-দিদিমনিকে নিয়ে বসুন আমি আবার ঠিক মত চালাচ্চি গো-
মৌরি, আর গোপাল আবার রিকশায় বসে। ধিমে তালে চলতে গিয়ে মৌ্রির চোখে ঘুম নেমে আসে।
এই বিকট দুলুনিতেও সে স্বপ্ন দেখে-

মুম্বাই গিয়েছে, সেখানে ভালো একটা ছবিতে চান্স পেয়েছে। হিট হবেই সন্দেহ নাই। একটা দৃশ্যে নায়ক দৌড়ায় পেছনে মৌ্রি দৌড়ায়। এই লুকোচুরি আর থামে না। শেষ মেষ খপ করে ধরে ফেলে মৌরি,
“ এইবার যাবে কোথায় বাছাধন?”
“উরি বাপস –আমাকে ছাড়ো গো দিদিমনি- ইশ খামচে আমায় যে নক্ত বের করে দিলে গো “
মৌরি ধড়ফড়িয়ে চোখ খুলে – হায় ভগবান এ আমার কী হল? এই স্বপ্ন যদি সত্যি হত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৌরি ভাবে।
“ধুর হতচ্ছাড়া এয়েচি আমরা? স্বপ্ন দেকচিলাম গো। ফিচকি হাসি দিয়ে বলে মৌরি।“
“হ্যাঁ গো উদিকে চেয়ে দেকো”
দুজনাই তাকিয়ে দেখে একটা সাইন বোর্ড। একসাথে বলে উঠে –
“তাই তো তাই তো”
তবু মৌরির সন্দেহ যায় না, বলে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলে –
“সুধাস না কেনে সুধা”
গোপাল গলাটা কেশে পরিষ্কার করে গাল চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করে,
“ আজ্ঞে এইটাই কী ইয়েতি “
পুরো কথা শেষ হল না। লোকটার বাসিভাতের আমানির মত করে অন্য দিকে তাকিয়ে পানের পিক ফেলল-।
“ফুচুত”
দিয়ে কি যে বল্ল কানেই গেলনা।

কাকিমার গালবাদ্য কানে তখনো আছে দুজনারই। এক সাথে বলে ওঠে,
“ চল পালাই”

বিহারীকে বাদ দিয়ে গোপালকে কী কুক্ষনেই না এনেছিল মৌরি। যে যায়গাটায় ওরা রিকশা থেকে ধপাস করে পড়ে গিয়েছিল, মৌরি দুর্গন্ধে তাকিয়ে দেখে দেয়ালের এক কোনায় চুন দিয়ে লেখা
“ এখানে প্রশ্রাব করিবেন না”
কোন হতচ্ছাড়া করিবেন” না” টা ঘষে মুছে দিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে
“এখানে প্রশ্রাব করিবেন-“
কী সাংঘাতিক কান্ড? নাক চাপা দিতে দিতে দেখে এক লোক ধুতিটা সান্তপর্নে তুলে বসেছে “ইয়ে” করতে। আর একজন প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে পরিতৃপ্ত চেহারা নিয়ে হাটা দিল। যেন কত আরামে –
‘যত্তো সব” মৌরি মনে মনে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে লাগল। নগেন উবে গেছে তাতে মৌ্রির কী?
এমনেইতেই নগেনকে দু’চোক্ষে দেখতে পারেনা। সেই খ্যাক শিয়ালের মত বুড়ির গাল-মন্দ কানে গেছিল বলেই তো সাত সকালে বের হয়েছে। এখন গা ভর্তি গু-মুতের গন্ধ নিয়ে কোথায় যাবে? বাড়িতে গিয়ে চান না করতে পারলে শান্তি নেই।
‘চল চল বাড়ি যাবো’ মৌ্রি তাড়া লাগায় গোপালকে। গোপাল সমানে তখনও গাল দিয়ে চলেছে,
‘আটকুড়ো- বুড়ো একটুখানি ভালো করে বললে কী হত বল দিদি? আমি কী এম্নেই শুধোলুম? কাজ ছিল বলেই তো-
‘ চল গোপাল সাত সকালে যা হবার তা তো হল’ এখন আর কী হবে? তা আর এক বুড়োর সাথে কি কইছিলিরে?
“ আর বলোনা দিদি, –
মৌরি তখনও গোপালের নাকের কাছে সবুজ দেখতে পায়।
‘ কী কী কইছিল? তোর নাকের পেটি এমন ফুলে আছে কেনে রে?”
‘ কইছিল – গোপাল তার ছাই মাখা চুলে হাত বুলোতে থাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে চুলকোতে চুলকোতে বলে,
“ নগেনের নাকি একটা বৌ আছে- , তুমি বল দিদি এইটা মানা যায়? মৌরির চোখ ছানা বড়া,
‘সে কী?
চিন্তায় পড়ে গেলো মৌরি। হেসে বলে,
‘আরে ধুস- আমার কি রে তাতে? ও মিনসের একখানা না চার খানা বৌ থাকুক না আমার কি রে”
‘আরে দিদি তাই তো এলুম’ গোপাল বলে এইখানে নাকি খবর মিলবে। নগেন যে হাওয়া হল কেইসটা কি?”

পেলুম না ‘ইয়েতি-“ না কি যেনো ছাই” যাগগে চল দিদি।“

অথচ নগেন তাকে কত ইনিয়ে বিনিয়ে নিবেদন করেছে—শালা পুরুষদের এই জন্যে বিশ্বাস করতে নাই। ভাগ্যিস মৌরি পটতে পটতেও ছিটকে গেছিল। এখন যে তার কান্না পাচ্ছে।
বিহারি জানবে, এরপরে অম্বু জানবে- মৌ্রি যেনো আবার স্বরসতী স্ট্যাচু হয়ে রিকসায় দুলকি চালে চলতে লাগলো। আর ভাবতে লাগল, গা ধুতে হবে, গু-মুতের গন্ধের সাথে সব ধুয়ে ফেলতে হবে।