মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হল ভাষা বা ভাষার ব্যবহার। মানুষ অন্যসব প্রাণীদের থেকে এগিয়ে তার অন্যতম কারণ হল মানুষের ভাষা জ্ঞান। ভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সভ্যতার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। ভাষার ব্যবহার করেই মানুষ হয়েছে বিখ্যাত, জাতিগত ভাবে উন্নত। সক্রেটিস যদি ভাষাহীন হতেন, গ্যালিলিও যদি তার বিশ্বাসের কথা না বলতেন তাহলে তাদের ঐভাবে মরতে হত না। ভাষা না থাকলে জন্ম হত না কোন ধর্ম গ্রন্থ কিংবা দর্শন শাস্ত্রের। ভাষা না থাকলে বিখ্যাত হতেন না মিল্টন, রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, তলস্তয়সহ পৃথিবীর কোন কবি সাহিত্যিক। ভাষা না থাকলে জন্ম হত না প্লেটো, ফ্রয়েড, ডারউইন, কার্ল মার্ক্স-এর। ভাষার মধ্য দিয়েই আন্দোলন করেছেন লেলিন, গোর্কি, গান্ধি, ম্যান্ডেলাসহ পৃথিবীর সকল যোদ্ধা। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণ ‘I have a Dream’ কিংবা শেখ মুজিবের রেডকোর্স ময়দানের সেই ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তাঁদের স্ব স্ব জাতির জন্য মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছে। আবার এই ভাষাকেই ব্যবহার করে হিটলার পরিচালনা করেছেন পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। ঘটে গেছে অসংখ্য যুদ্ধ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভাষার ব্যবহার মানুষের অন্যতম হাতিয়ার। বলাই বাহুল্য, মানুষ ভাষাহীন হলে তার চেতনার কোন মূল্য থাকতো না তা যতই মঙ্গলকামী হউক না কেন, এবং অবশ্যই, পৃথিবীর ইতিহাস ভিন্নতর হত।

খ.

গালিগালাজ বা গালমন্দ হল ভাষার অন্যতম বহুল ব্যবহার। গালিগালাজ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বটে তবে ক্ষেত্রবিশেষ এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষ যেদিন থেকে ভাষার ব্যবহার শিখেছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে গালির ব্যবহার। এই গালিগালাজের প্রকার ও ধরণ আবার সমাজ ভেদে ভিন্নতর। এক স্থানের স্তুতি কথা অন্যস্থানে গালি হিসাবে ব্যবহারের নজির দেখা যায়। যেমন, যুক্তরাজ্যে fag মানে সিগারেট, কিন্তু যুক্তরাষ্টে fag বলতে হোমোসেক্সুয়াল পুরুষ বোঝায়। বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে ‘খাসি’ শব্দটা অস্তিবাচক হিসাবে ব্যবহার করা হলেও মেহেরপুরে এটাকে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে, বন্ধুদের মাঝে বা ইনফর্মাল আড্ডায় ‘শালা’, ‘গাধা’, ‘কুত্তা’ এ জাতিয় শব্দ গালি মনে না হলেও বড়দের মাঝে বা ফর্মাল কোন বৈঠকে তা ব্যবহার করা হলে গালি হিসাবে গণ্য করা হবে। আবার সমাজের অশিক্ষিত মানুষের কাছে যা বুলি তা অনেকসময় শিক্ষিত মানুষের কাছে গালি হিসাবে চিহ্নিত হয়। যেমন আমাদের দেশে নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা ‘মাগি’, ‘ভাতার’, ‘মিনসে’ শব্দগুলো সাধারণ অর্থেই ব্যবহার করে কিন্তু এই শব্দগুলো শিক্ষিত সমাজে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জেন্ডার ভেদেও গালির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পুরুষদের সাধারণ আড্ডায় অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয় যা নারী মহলে গালি হিসাবে চিহ্নিত। যেমন, হুদায়, চোঁদনা, বাড়া, বকচোদ ইত্যাদি।

গালি হিসাবে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার বেশির ভাগই এসেছে প্রাণী বা নিম্নশ্রেণীর জীব থেকে, যেমন- কুত্তা, গাধা, ছাগল, পাঠা, শুয়োর, ছুঁচো, পেঁচা, মষ (মহিষ), বান্দর ইত্যাদি; কিছু এসেছে নেতিবাচক শব্দ থেকে, যেমন- ফালতু, রোগা, মূর্খ, বোকা, হাঁদা, মরণ, পচা, চাষা ইত্যাদি; কিছু এসেছে রোগের নাম এবং শারীরিক ত্রুটি থেকে, যেমন- পাগল, কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত, মৃগী, জিনে ধরা, কানা, খুড়া, কালা ইত্যাদি; কিছু এসেছে নিম্নশ্রেণীর পেশা থেকে, যেমন- চোর, ডাকাত, কুলি, মুটে, মুচি, মেথর ইত্যাদি; কিছু এসেছে সম্পর্ক থেকে, যেমন- শ্যালা, শালী, সতীন, মাগ, ভাতার ইত্যাদি; কিছু এসেছে মানুষের যৌনাঙ্গ থেকে, যেমন- বাল, বাড়া, ভোদা, ধন ইত্যাদি; অনেক সময় বিদেশী শব্দ থেকেও গালি আসে, যেমন- হারাম, মাদার-ফাকার, হেল, বাস্টার্ড, ফ্রড, শয়তান, কামিনে, কাফের; কিছু গালি এসেছে ইতিহাস এবং পুরাণের পাতা থেকে, যেমন- মীরজাফর, হিটলার, রাজাকার, নমরুদ, ফেরাউন ইত্যাতি; আবার শব্দ coinage-এর মাধ্যমে কোন কোন সাহিত্যিক গালি নিয়ে আসেন, যেমনটি শেকসপিয়র করেছেন। আবার অনেক শব্দ বুৎপত্তিগত অর্থে অশালীন না হলেও প্রয়োগের কারণে গালি হিসাবে গণ্য করা হয় যেমন, মাগী। এই শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রায়োগিক অর্থে খারাপ স্বভাবের নারী বা বেশ্যার সমার্থক হিসাবে গণ্য করা হয়। অথচ, মাগীর বিপরীত শব্দ মাগ সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয় বেশি।

গালি বলতে যে সবসময় অশালীন শব্দকে বোঝান হয় বিষয়টি তা নয়। এটা নির্ভর করে শব্দটাকে কিভাবে, কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। অশালীন শব্দ প্রয়োগের কারণে গালি হিসাবে গণ্য নাও হতে পারে আবার শালীন শব্দ ব্যবহারের মারপ্যাচে গালি হিসাবে গণ্য হতে পারে। যেমন যখন বলা হচ্ছে, ‘বেশ্যালয় গমনে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ’। তখন বেশ্য শব্দটি গালি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। কিন্তু যখন বলা হচ্ছে, ‘তুই একটা বেশ্যার জাত’, তখন বেশ্যা শব্দটা গালি হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজে কথার মারপ্যাচে গালি দেওয়ার প্রবনতা বেশি। এজন্য ভাষা-জ্ঞান ভাল হওয়া চায়। যেমন, ক্রিকেট মাঠে রড মার্শ একবার ইয়ান বোথামকে বলেছিলেন, ‘হায় ইয়ান, তোমার বউ আর আমার বাচ্চারা কেমন আছে?’ জবাবে বোথাম বলেছিলেন, ‘বউ ভালোই আছে কিন্তু বাচ্চারা সব বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছে দেখছি।’

গালি হিসাবে এসব শব্দের ব্যবহারের অন্যতম কারণ হল মানুষের ভাষার সীমাবদ্ধতা। মানুষকে তার বৈচিত্র্যময় অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে বিভিন্ন প্রকারের রূপকের (image) আশ্রয় নিতে হয়। গালি হচ্ছে ভাষার মেটাফরিক উপস্থাপন। যেমন- সে আস্ত একটা গাধা (metaphor), লোকটি কুত্তার মত ঘেউ ঘেউ করছে (simile)। পেট হাগস-এর মতে, ‘Slang is a non-standard language composed of exaggerated metaphors’। কে.জি. চেস্টারসন বলেছেন, ‘all slung is metaphor and all metaphor is poetry’।

গ.

সাহিত্যে গালির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারও কারও সাহিত্য অত্যধিক গালির কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাহিত্যিকদের হাত ধরে আমদানি হয়েছে হরেক রকমের গালি। যেমন, শেক্সপিয়ারের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন গালি। গ্রীক ড্রামা ’লিসিসট্রাটা’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল অতিরিক্ত খোলামেলা ভাষা বা bawdy language ব্যবহারের কারণে। বাংলাসাহিত্যে গালিগালাজের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ূন আজাদসহ অনেককেই ।

চলতি সময়ে চলচ্চিত্রে গালির ব্যবহার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ইংরেজি সিনেমা এই দিক দিয়ে সবার উপরে। মাদার ফাকার, ফাক্, সাকার, ব্ল্যাডি হেল, ডিক, শব্দগুলো গালি হিসাবে হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন- ‘mother fucker snakes in the mother fucker plain!’ (Movie: Snakes on a Plane)। বাংলা চলচ্চিত্রে একসময় অশ্লীল শব্দের ব্যবহার চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। বর্তমানে সেন্সর বোর্ড-এর তৎপরতার কারণে বেশ কমে গেছে। বাংলা সিনেমায় ইংরেজি সিনেমার মত সব চরিত্র যখন তখন গালি ব্যবহার করে না। সাধারণত, শুধুমাত্র ভিলেনদের মুখেই গালি শোনা যায়। বাংলা সিনেমায় বহুল ব্যবহৃত কিছু গালি হচ্ছে- হারামজাদা, হারামখোর, শুয়ারের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, নটির মেয়ে/ছাওয়াল।

বর্তমানে খেলাধুলাতেও গালির ব্যবহার লক্ষণীয়। বিপরীত খেলোয়াড়দের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা বা মনোযোগের বিগ্ন ঘটানোর জন্য এই গালি দেওয়া হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল থেকে শুরু করে, হালে ভদ্রলোকের খেলা বলে খ্যাত ক্রিকেট খেলাতেও গালির ব্যবহার লক্ষ্য করার মত। একে খেলার ভাষায় স্লেজিং বলা হয়। যেমন, একবার এক বোলার ব্যাটসম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘এই বলেও যদি তুমি ছক্কা মারতে পার, তাহলে তুমি যা চাও তাই পাবে!’ জবাবে ঐ ব্যাটসম্যান বলেছিলেন, ‘যাও তোমার বউকে বিছানায় রেডি হতে বল’গে!’ আর সাইমন্ডস আর হরভজনের একে অপরকে ‘মানকি’ বলে গালিগালাজ করার ব্যপারটা তো সকলেরই জানা।

ঘ.

ভাষা ক্লাস এজেন্ট হিসাবে কাজ করে। তাই তো সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্যের কারণে গালির পার্থক্য ঘটে থাকে। অবশ্যই অর্থনীতি অন্যসব কিছু নির্ধারণের পাশাপাশি মানুষের ভাষা নির্ধারণ করে থাকে। যারা সমাজে উঁচু স্থানে অধিষ্ঠিত বা যাদেরকে আমরা উচ্চবিত্ত বলছি তারা নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমিকশ্রেণীকে তুচ্ছার্থে নানাবিধ গালি ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে শ্রমিকশ্রেণীদের সাথে মালিকশ্রেণী খুব বাজে ভাষায় কথা বলে। এমনকি রিকশাচালক, মুটে, কুলি-মজুর সবাই এই ভাষা-বৈষম্যের স্বীকার হয়। এটা এক ধরনের অপরাধ বটে।

ভাষা জেন্ডার এজেন্ট হিসাবেও কাজ করে। ফলত, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত গালিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, গালিগুলো সুস্পষ্টভাবে পুরুষত্বের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে। সমাজে মাদার ফাকার, বেশ্যা, নটী, খানকি, মাগি, হারামজাদি, ছিনাল, ভুদাই প্রভৃতি গালিগুলো সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। মা তুলে গালি দেওয়াটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কথায় কথায় বলতে শোনা যায়, ‘তোর মাকে **দি,’ ‘জন্মের ঠিক নেই’, ‘বেশ্যার ছাওয়াল’, ‘মাগির কামড় বেশি’- এ গালিগুলো সামগ্রিকভাবে নারী জাতিকে হীন করে তোলে।

গালি নিয়ে সমাজের শিক্ষিত মহলে বেশ অসন্তোষ দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, আইন করে পাবলিক প্লেসে গালি নিষিদ্ধ করা উচিৎ। কারও কারও ধারনা গালি ভাষায় সৌন্দর্য ও পবিত্রতা নষ্ট করে সুতরাং তা ভাষা থেকে ছেঁটে দেওয়া উচিৎ। যদি তাদের কথা মত গালি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে কি ঘটতে পারে তা একবার ভেবে দেখা দরকার। তাহলে গালির প্রয়োজনীয়তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। গালি কখনই ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করে না বরং তা আরও picturesque করে তোলে। ভাষাকে ক্ষেত্রবিশেষ করে তোলে প্রাণবন্ত-সজীব। গালি না থাকলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হত তা হল, মানুষে মানুষে দৈহিক হাঙ্গামা বেড়ে যেত বহুগুণে। মানুষ ভাষা বা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে রাগ মেটাতে না পেরে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। হারামখোর, শুয়োরের বাচ্চা বলে যে কাজটি অনায়াসে হয়ে যায়, সেই কাজটি হতে লাঠি চালাচালি হত। বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেত কয়েকগুণে।

শুধু রাগ না ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রেও গালির জুড়ি নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষই স্ত্রী বা প্রেমিকার সাথে যৌনমিলনের চরম মুহূর্তে একে অপরের উদ্দেশ্যে প্রচুর অশালীন শব্দ বা গালি ছুড়ে মারে এবং এতে তাদের উত্তেজনা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাই। জেমস জয়েস ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যকার পত্রগুলো পড়লে বোঝা যায় যে তাঁদের ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্ল্যাং বা গালি। অনেক সময় নানা কিংবা দাদা সম্পর্কের মুরুব্বিরা নাতি সম্পর্কের ছোকরাদের দিকে গালি ছুড়ে মজা পান। অনেকে মজা করার জন্য সচেতন ভাবেই পরিবারে বা বন্ধু মহলে গালিগালাজ করে। এ জন্য বলা হয়- ‘humors are nothing but slang’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গালি ভাষার নতুন এক উপযোগ সৃষ্টি সাপেক্ষ মানুষের জীবনে রসের সঞ্চার করেছে।