অন্যান্য মশহুর ব্লগারদের মত দর্শন ও বিজ্ঞানের জটিল জটিল গলি ঘুপচিতে চলাচলে আমার বরাবরই পেরেশানি। এসবে দন্তস্ফুট যদিবা হয়, হজম আর হয়না। তাছাড়া ধর্মেও মতি নাই। নিজ জীবনে অপ্রয়োজনীয় বিধায় ধর্মের মিথিক্যাল জগতেও খুব একটা ঘুরতে ইচ্ছা করেনা। “দেখো, হতে পাত্তেম আমি একজন প্রত্নতত্ববিদ/কিন্তু গবেষণার কথা শুনলেই হয় আতঙ্ক উপস্থিত” এবং “হতে পাত্তেম…’। তাহলে আমাহেন আমড়া কাঠের উপযোগিতা বা ই কি আর কি বিষয় নিয়েই বা একটু আংগুল চালাচালি সম্ভব? ভেবে দেখলাম, আনন্দের সাথে দন্তস্ফুট করা যায় আর পরিপাক তন্ত্রের খেয়ালও রাখা যায়, এরকম বিষয় রয়েছে একটিই—খানাদানা। জি জনাব। চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়- এই চতুর্জগতের বিষয়ে কেবল লিখতেই নয়, ভাবতেই কেমন মনটা চনমন করে উঠে, ডগমগ করে উঠে। খানাদানার ব্যাপারে মুক্তমনা না হয়ে বরং মুক্তকচ্ছ হওয়াটাই আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়।

তবে জনাব, হ্যাপা এখানেও কম নেই। এত মজার মজার, চিত্বহরা খাদ্যবস্তু যে রয়েছে, তা প্রকৃতিতে বাতাস বা পানির মত পাওয়া যায় না। কি দুর্ভাগ্য ভেবে দেখুন। এগুলো বানিয়ে নিতে হয়, বা রান্না করে নিতে হয়। আফসোস। রান্না করা কি সহজ কোন কিছু? মাঝে মাঝে ডিজিটাল রান্না করার চেষ্টা করেছি বটে (ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা রেসিপি বিধায় এগুলো ডিজিটাল রান্না), তাতে নিজের অকালকুষ্মাণ্ডতাই কেবল প্রমাণিত হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একবার এক বন্ধুকেও দাওয়াত করে খাইয়েছিলাম। বন্ধুটি বড় ভদ্র। মুখের উপর কিছু বলতে পারে নি। শুধু বলেছিল, “হলুদটা একটু কম, মরিচটা একটু বেশি আর নুনটা পরিমাণমত হলেই খাওয়াটা আরো ভালো হত”। কাজেই এক্ষণে, খানাদানার কথা বলে, রেসিপি টাইপের কিছু লিখছিনা। তার চেয়ে নিজের খানাদানার এক্সপিরিয়েন্স আর কিছু গল্প বলা গেলেই বোধকরি ভাল করব।

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। কলকাতায় তখন ইংরেজ সাহেবরা গিজ গিজ করছে। অনেকে দু-তিন পুরুষ ধরে আছে। অনেকটা কলকাতায় স্থায়ী। এছাড়া রয়েছে এংলো ইন্ডিয়ানদের একটা কম্যুনিটি। পার্ক স্ট্রিট থেকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এরিয়াসহ বিস্তীর্ণ সাহেব পাড়া। জনশ্রুতি আছে যে পার্কস্ট্রিট নাকি শ্যাম্পু দিয়ে ধোয়া হত। সাহেবরা আর মেমরা ফিটন গাড়িতে করে বিকেলে সে রাস্তা ধরে পার্ক স্ট্রিট এ আসত। সে সময়ে মিস্টার এন্ড মিসেস ফ্লুরি আসেন কলকাতায়, সুদুর ইংল্যান্ড থেকে। পার্ক স্ট্রিটের কোনায় তিনি একটা বেকারি শপ খোলেন এবং নাম দেন ফ্লুরিস। ফ্লুরিসের কেক, পেস্ট্রি আর স্যান্ডউইচ তখন বেশ নাম করেছিল। এখনো কোলকাতায় গেলে ফ্লুরিসে ঢুকে সকালে স্যান্ডউইচ সহকারে নাস্তা একটি রসালো ব্যপার। এই ফ্লুরি সাহেবদের একজন কর্মচারি ছিল ট্রিনকা নামে। কিছুদিন পর দেখা গেল মি ট্রিনকা উধাও। তার সাথে মিসেস ফ্লুরিও। মিস্টার ফ্লুরি যারপরনাই দুখিত হলেন। কিছুদিন পরে ফ্লুরিসের উলটা দিকে নতুন আরেকটি বেকারি শপ খুলল। নাম- ট্রিনকাস। ফ্রন্ট ডেস্ক-এ বসছেন সাবেক মিসেস ফ্লুরি তথা বর্তমান মিসেস ট্রিনকা। এখনো ট্রিনকাস বহাল তবিয়তে আছে। কলকাতার মিউজিক রেস্তরাগুলোর মধ্যে ট্রিনকার ঐতিহ্যই সবচেয়ে বেশি। কলকাতার রক-পপ শিল্পের সুতিকাগার এই ট্রিনকাস। বলা হয়ে থাকে যে ট্রিনকাতে না গেয়ে কেউ রক-পপ জগতে কিছু করতে পারে না। ৬০ এর দশকে ট্রিনকা ছিল মিজিশিয়ানদের মক্কা- শধু কলকাতায়ই নয়, পুরো ভারতবর্ষে। অঞ্জন দত্ত থেকে ঊষা উথথুপ – অনেকেই ট্রিনকাতে গেয়েছেন- বড় শিল্পী হয়েছেন।

পার্ক স্ট্রিটের আরো কিছু ঐতিহ্যবাহী শতাব্দী পেরোনো রেস্তরা আছে। ম্যুলা রুজ (MOLINE ROGUE) তার মধ্যে অন্যতম। শরতচন্দ্রের উপন্যাসে ম্যুলা রুজের উল্ল্যেখ আছে। আর দুটি প্রিয় যায়গার কথা বলতেই হয়। পিটার ক্যাট এবং মোগাম্বু। পিটার ক্যাটের একটি ডিশ আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে আছে। চেলো কাবাব। একটু খানি ফাইন রাইস, তার সাথে একটা অমলেট আর বাটার এবং কিছু কাবাব- এর সাথে এক গ্লাস রেড ওয়াইন হলেতো তোফা। চেলো কাবাব আসলে একটি ফিউশন ফুড। মোগলাই কাবাব আর ইউরোপিয় অমলেট-বাটার। এদেশে ফিউশন ফুডের ইতিহাস পাওয়া শক্ত। তবে আমার ধারনা ইউরোপীয়দের আগমনের পর এ নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। যেমন পোর্ক ভিন্দালু- টাইপের রেসিপি। স্পেনিয়ার্ডরা জাহাজে চিতকার করত- ভিন্ডাল হো…। সম্ভবত ভিন্ডাল হো থেকেই ভিন্দালু’র জন্ম। এছাড়া আছে বাটার নান, পালক পনির – ইত্যাদি। ফিউশন ফুডগুলো আসলেই ইন্টারেস্টিং কারন দুটো ভিন্ন কালচার খাবারের মধ্যে এক হয়ে মিশে যাচ্ছে।

আবহাওয়া, স্থান আর উপকরণের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে একটি এলাকার খাদ্যাভাস গড়ে ওঠে। সেকারনেই অঞ্চল ভেদে খাবারের এত বৈচিত্র। তাছাড়া সামাজিক কারন ও রয়েছে। নিরামিষ রান্না বাংগালী সমাজে একটি বিষেশ স্থান দখল করে আছে। বাংলার নিরামিষ রান্না পূর্ণতা পায় এদেশের অগনন অসহায় বিধবাদের হাতে। অবদমিত শারিরীক চাহিদা যাতে চিত্তচাঞ্চল্য না ঘটাতে পারে সে জন্য তাদের আমিষ খাওয়া বারণ। তাছাড়া, বিধবারা সংসারের এককোণে পড়ে থাকতেন। নিতান্ত অবহেলা অনাদরে কাটত জীবন। বাড়ির সবার জন্য খেটে মরলেও তাদের ছিল পৃথক স্বপাক আহার। তাই অপ্রতুল জোগানের মধ্য দিয়েই তাদের রান্না করতে হত। নিয়মিত বাজার করা হত না। ফলে বাড়ির আশ পাশ থেকে শাক পাতা কুড়াতে হত প্রায়ই। বাধ্য হয়েই তাদের স্বল্প পরিসরের রান্নায় বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করতে হত। ফলে আমরা পেয়েছি অনেকগুলো বাই-প্রোডাক্ট রান্না। ধোকার ডালনা, ছেচকি, চচ্চরি, সুক্তো- এরকম আরো অনেক নিরামিষ রান্নার জন্য আমরা সেই অগনন নারীদের কাছে ঋণী।

প্রয়োজনের তাগিদেও অনেক সময়ে রান্নার প্রকৃয়া আর প্রকরণে বৈচিত্র আসে। মুসলমানরা এদেশে মোগলাই খাবার এনেছে সেটা বলাই বাহুল্য। মুরগী মুসল্লম, কাবাব, পরাটা, হালিম—আহা আরো কত কি। বিরিয়ানী- মুসলিম শাসকদের পাকস্থলী ধরে এদিকে আসলেও, ভারতবর্ষে প্রবেশের পরে তাদে নানা ধরনের বৈচিত্রের সমাবেশ ঘটে। কাজেই আমরা এখন লক্ষ্ণৌ ঘরানা, হায়দারাবাদী ঘরানা, কাশ্মিরী বিরিয়ানী- নানা বিভাজন দেখি। এই বৈচিত্রও ঘটেছে শাসকদের যার যার ঐতিয্যের হাত ধরে। বলা হয়ে থাকে যে, আসল বিরিয়ানীতে নাকি আলু থাকতে নেই। কিন্তু আমাদের ঢাকাই বিরিয়ানীতে আলুর প্রচলন আছে। তার কারনও নাকি আছে। নবাবদের যে সেনাবাহিনী ছিল তাদের জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে দ্রুত রান্না করতে হত। তাছাড়া ফৌজিদের জন্য পরিমানও বেশি থাকতে হত। তাই বিরিয়ানীর সাথে আলু মিশিয়ে দিয়ে পরিমান বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। তার পর থেকেই নাকি আলু আমাদের বিরিয়ানীর অংশ হয়ে পড়ে পড়ে।

প্রয়োজনের তাগিদে শুধু বৈচিত্রই নয়, একেবারে নতুন রেসিপির জন্মও হতে পারে। ইস্টবেংগল-মোহনবাগানের খেলা তো শুধু খেলা নয়, বরং একটা বিশাল যুদ্ধ। পুরো কলকাতা দুভাগ হয়ে যাবার ব্যাপার। তো, ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়দের বিরতীকালীন খাবার সাপ্লাই হত নিউমার্কেটের মুসলিম রেস্তরা ‘নিজাম’ থেকে। তাছাড়া বিরতির সেই পনের মিনিটের মধ্যে খেলোয়াড়, দর্শক সবাইকেই খাবার সারতে হত। পরাটা-গোস্ত বা আরেকটু ভারী খাবার এই স্বল্প সময়ে খাওয়া এবং তার পর পরই আবার খেলায় ফিরে যাওয়াটা একটু কষ্টসাধ্যই ছিল। তখন নিজাম হোটেলকে বলা হল একটা কিছু বানাও যেটা ভারীও হবে খেতে আবার তাড়াতাড়িও খাওয়া যাবে। নিজামের বাবুর্চি তখন ভেবে দেখলেন, মাংশটা পরাটা দিয়ে পেচিয়ে দিলেইতো হয়। বাস শুরু হয়ে গেল কোলকাতা রোল। এখন তো মোটামুটি লাইন দিয়ে সেই রোল কিনতে হয়।

ব্রিটিশ সরকার টিপু সুলতানের পরিবারকে যেমন কলকাতায় নিয়ে এসেছিল তেমনি ফয়জাবাদের নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে ও। ব্রিটিশরা হয়ত ভেবেছিল নিজ এলাকায় তাদের রেখে দিলে আবার তারা বিদ্রোহীদের উসকে দেবে। তাছাড়া কলকাতায় তাদের চোখের সামনেও রাখা যাবে। ওয়াজেদ আলী শাহ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে মাসোহারা পেতেন। তার সাথে ছিল এক বিপুল লটবহর এবং তার বাবুর্চির সংখ্যাও ছিল অনেক। তার বাবুর্চিদের দুটি ভাগ ছিল—রকবদার এবং বাওয়ার্চি। একটি রেকাবিতে যে পরিমাণ ধরে শুধু সে পরিমাণ খাবারই রান্না করতেন রকবদাররা। শুধুমাত্র নবাব আর তার খুব কাছের দু একজনের জন্য সেই রেকাবির খাবার পরিবেশন করা হত। বাকি সবার জন্য রান্না করত বাবুর্চিরা। কাজেই রকবদাররা স্বভাবতই বাবুর্চিদের থেকে একটু উচুতে থাকত। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার নবাবের মাসোহারা দিন দিন কমিয়ে দিচ্ছিল। এই বিশাল লটবহর পোষার ক্ষমতা তার কমে আসছিল। তখম এই রকবদার বাবুর্চিরা বের হয়ে গিয়ে নতুন নতুন রেস্তরা খোলে। এই প্রথম কলকাতায় নবাবী ঘরানার রেস্তরা খোলা হয়। চিতপুর রোডে যাত্রা শুরু করে রয়াল রেস্তরা। রয়ালের রুমালী রুটি এবং চাপ- এখনো কলকাতার সেরা। রকবদাররা করলেন রয়াল- ওদিকে বাবুর্চিরাও বসে নেই। তারাও শুরু করলেন। নাম দিলেন আরমানিয়া। তখনো রয়ালের উচু পদের রকবদাররা আরমানিয়ার দিকে তাচ্ছিল্য করে বলতেন- ‘উন লোগ ভি বিরিয়ানি পাকাতা হ্যায়?’

বাংগালির খাবারের আরো কিছু দিক আছে। মিস্টি- ক্ষীর, পিঠা পায়েস এসব। মাছের কথায়তো এখনো আসিই নি। কিন্তু আমার রান্নাঘর থেকে কিসের যেন সুগন্ধ ভেসে আসছে। পুডিং কি? উম হম হম উম (নাহ, ব্রিটিশরা কিছু ভালো জিনিস দিয়েছে মাইরি)। বাকি বিষয়-আশয় নিয়ে আবার পরের পর্বে লিখব

‘যত কিছু খাওয়া লেখে বঙ্গালি ভাষাতে,
খুজে পেতে আনি খেতে, থাকো সেই আশাতে”

(ডিসক্লেইমারঃ এই প্রবন্ধটি খাদ্য বা খাদ্যের ইতিহাস সম্পর্কিত কোন জটিল গবেষণাপ্রসুত লেখা নহে। নিতান্তই মামুলি গালগপ্প কিসিমের লেখা। ইহাকে বিশ্লেষণ করা যাইবেক তবে চুল না চিরিলেও চলবে)