কক্সবাজারের চকোরিয়া থেকে আরেকটু ভেতরে এক চিলতে এক পাহাড়ি নদীর দেখা মেলে, রাখাইন ভাষায় নদীর নাম হারবাং। এই হারবাং এর নামেই সেখানে গড়ে উঠেছে নদীর পাড় ঘেঁসে ছবির চেয়েও সুন্দর, আর বেশ পুরনো একটি রাখাইন গ্রাম। সেখানে চোখে পড়ে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ দোতলা কাঠের বাড়ি। কোন কোনটির বয়স আবার ৫০ ছাড়িয়ে গেছে।…

একবার রাখাইন স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশ (আরএসওবি)-এর সভানেত্রি ক’চিন ঠে ডলির আমন্ত্রণে রাখাইনেদর বর্ষ বরণ উৎসব সাংগ্রাং-এ বেড়াতে যাওয়া হয় ওই গ্রামে। বলাভাল, এই লেখকের কক্সবাজার, বাঁশখালি, চৌফলদণ্ডি ও টেকনাফের সমস্ত রাখাইন পাড়া ঘোরার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু হারবাং-এর অভিজ্ঞতা আগের সব অতীতকে ছাপিয়ে যায়।

হারবাং গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানে লক্ষ্য করা যায়, এক আমুদে বাঙালি বুড়োর সঙ্গে ডলির অনর্গল রাখাইন ভাষায় সংলাপ।

পরে ডলি জানান, অনেক বছর ধরে হারবাং-এ থাকতে থাকতে অনেক বাঙালি সহজেই রাখাইন ভাষা রপ্ত করেছেন। হারবাং-এর আশেপাশের অনেক বাঙালিই নাকি কাজ চালানোর মতো রাখাইন ভাষা জানেন। তবে দুই জাতির মধ্যে সাধারণ কথাবার্তা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলাতেই।

ডলির বাবা রোগে ভুগে গত হয়েছেন মাত্র। ওর মা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়েছেন এক অনিশ্চিত জীবনের মুখে। তিনি দুঃখ করে বলতে থাকেন বছরের পর বছর তাদের শাল – সেগুনের বাগান ও জায়গা-জমি নানান মোকদ্দমা এবং ফন্দি-ফিকিরে স্থানীয় সংখ্যাগুরু বাঙালিদের হাতিয়ে নেওয়ার ইতিকথা।…

ডলিদের বাড়িটি বেশ সুন্দর শক্তপোক্ত কাঠের। মোটা মোটা গাছের গুড়ির ওপর মাচাং করে বিশাল বাড়িটি বসানো। সেখানে যাওয়া-আসার জন্য রয়েছে একাধিক কাঠের সিঁড়ি। বাড়ির উত্তর ও পূর্ব দিকে রয়েছে বেশ চওড়া দুটি ঝুল বারান্দা। সেখানে রাখা ছোট মাপের কয়েকটি বর্মি আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বসলে গ্রামের নিত্যদিনের আটপৌরে নানা দৃশ্যপট চোখে পড়ে।

ওই ভ্রমন বেলার এক বিকেলে ডলি তাদের পুরো গ্রামটি ঘুরে দেখান। নিয়ে যান আরএসওবি’র কর্মী, তার আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবের বাসায়। জানা গেল, পড়াশুনা, চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ছেলেদের চেয়ে রাখাইন মেয়েরাই অনেক বেশী এগিয়ে। তাই অধিকাংশ মেয়েদের কথাবার্তায় তেমন কোন জড়তা নেই।

এ বাসা সে বাসা ঘুরে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী রাখাইন তাঁতের অতীত সম্পর্কে জানা যায়। অন্যসব দুর্দশার মত একই পরিনতি হয়েছে রাখাইন তাঁত শিল্পের। প্রায় সব রাখাইন মেয়েই এক সময় কিছু না কিছু তাঁতের কাজ জানতেন। তবে সুতা আর ক্রেতার অভাবে এই শিল্পটি এসে পৌঁছেছে একেবারে বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে। তাছাড়া মিলের সস্তা দরের কাপড়ের সঙ্গে রাখাইন তাঁতের কাপড়ও প্রতিযোগিতায় ক্রমেই মার খাচ্ছে।

তবে প্রযুক্তিগতভাবে রাখাইন তাঁত বেশ উন্নত। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িদের সরল প্রযুক্তির কোমড়-তাঁতের চেয়ে এর গঠনশৈলি ও বৈশিষ্টে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। তাই রাখাইন তাঁতের বয়নে নানা রকম কাপড়ে ফুঁটিয়ে তোলা যায় বাহারি অনেক নকশা; এ সব শিল্প-নৈপুন্যে যেন প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত মেলে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এক জনজাতির রাজ্য হারানোর বেদনার্ত অতীত।

একজন রাখাইন মেয়ে এমনই সব তথ্য দিয়ে মাচাং ঘরের নীচের এক খুপড়ির অন্যসব ভাঙাচোরা আসবাবপত্র ও বাতিল মালামালের ভেতর থেকে বের করে দেখান, ব্যবহারের অভাবে তার নিজস্ব দুটি তাঁতের মধ্যে একটিতে এরই মধ্যে ঘুঁনে ধরেছে!

পরে সাংগ্রাং উৎসবে বুদ্ধ পূজা, আনন্দ-হাসি-গান, ছেলেমেয়েদের ঐতিহ্যবাহি পানি খেলা, অবিরাম বরাহ-শামুক-ঝিনুক-কাঁকড়ার মাংস সহযোগে ‘দারা’ নামক কড়া চোলাই খেতে খেতে পৌঁছে যাওয়া হয় অন্য এক অলৌকিক জগতে। রাখাইন এক প্রবাদে নাকি বলা হয়েছে:

যদি তুমি মদ খাও, তোমার ভেতরে প্রবেশ করবে একজন ছোট মানুষ।

তো ওই সব হট্টোগোলের ভেতর রাখাইন নেত্রীর জনৈক প্রেমপ্রার্থী যুবক ওয়াই মং-এর মদো-প্রলাপও ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসে। …

ওই গোধূলি বেলায় আবারো ডলিদের বাসার বারান্দার আরাম কেদারায় হারবাং নদীর দিকে মুখ করে দারা’র বোতল আর ছোট মাপের কাঁচের গ্লাস নিয়ে বসা গেল। পড়ন্ত সূর্যের লাল আভায় নদীর ওপাড়ের রাখাইন গ্রামগুলোতে আগুন লেগেছে বলে ভ্রম হয়।

একটি ছিমছাম ছোট্ট দোতলা বাসা দেখিয়ে ডলির কাছেই জানতে চাওয়া হয়, ওটা কার ঘর? ডলি বলেন, ওটা আমাদেরই এক আত্নীয়র ঘর ছিল। কিন্তু জীবন-যুদ্ধে টিকতে না পেরে সেই আত্নীয় এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বার্মায়। হারবাং ছেড়ে এ রকম অনেকেই বাড়িঘর বিক্রি করে ওপারে চলে যাচ্ছেন। হারবাং-এর অনেক ঘরই এখন প্রায় পরিত্যাক্ত হয়ে পড়েছে। আবার কোন কোন বাড়ি বাঙালিরা কিনে নিয়ে রাখাইন গ্রামের ভেতরেই নিজস্ব বসতি গড়ে তুলেছেন।

শেষ বিকেলের আলোয় ডলির ফর্সা কচিপানা মুখ যেন লাল হয়ে ওঠে। ক্লান্ত গলায় তিনি বলেন, আচ্ছা বিপ্লব দা, আপনি তো অনেক টাকার চাকরি করেন। এ রকম একটা ছোট্ট বাড়ি সস্তায় কিনতে পারেন না? আপনাদের মত অনুভূতিশীল শিক্ষিত মানুষেরা এসব ঘর-বাড়ি কিনলে দেশান্তর হওয়া রাখাইন পরিবারটি অন্তত এই ভেবে নিশ্চিত থাকবে যে, তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটির চিহ্নটুকু অন্তত অবিকল টিকে আছে!

ক্রমেই ডলির কণ্ঠস্বর বিষন্ন হতে থাকে।…

আর কি আশ্চর্য! ওই মদোমাতাল অবস্থাতেই মাথার ভেতর ঝলসে ওঠে তথ্য-বাণিজ্যের অনিবার্য এক চিন্তন। এ যেন অস্তিত্ব রক্ষারই এক বিবর্তনীয় রিফ্লেকশন।

সাংগ্রাং-এর পরে গ্রামটিতে আরো সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়, রাখাইনদের ধীর দেশান্তরের আঁতিপাতি। পরে ঢাকায় ফিরে তখনকার কর্মস্থল দৈনিক ভোরের কাগজের সাপ্তাহিক প্রকাশনা ‘অবসর’ এ করা হয় একটি সচিত্র প্রচ্ছদ প্রতিবেদন: ‘রাখাইনরা কেন দেশ ছেড়ে যান?’

সেটি ২০০০ সালের এপ্রিল-মে মাসের কথা। এতে জানান হয়, প্রায় চারশ বছর আগে বার্মার রাখাইন রাজ্যহারা রাখাইন জাতি, যারা এক সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে কক্সবাজারের বিস্তৃর্ণ এলাকায় ছিল সবচেয়ে অগ্রসর, তারাই এখন বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অতি ধীরে সপরিবারে একে একে দেশান্তরী হচ্ছেন বার্মায়। আবার কোন কোন পরিবারের একাংশ এপারে রয়ে গেলেও আরেকাংশ ভাগ্যান্বেষনে যাচ্ছেন ওপারে। প্রতিবেদনটিতে নিজস্ব পরিসংখ্যান এবং একাধিক সাক্ষাৎকার তুলে ধরে জানান হয়, এই নিরব দেশত্যাগের নিষ্ঠুর বাস্তব সব তথ্য।

জানা মতে, সে সময় কোন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত সেটিই ছিল প্রথম প্রতিবেদন। তাই তখন এর ধাক্কাও ছিল ব্যপক।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর পরই রাখাইনদের মধ্যেই এর ব্যপক মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে। কক্সবাজারের সাংবাদিক বন্ধুরাও পক্ষে-বিপক্ষে নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করেন। এই নিয়ে ‘অবসর’ এর পরবর্তী সংখ্যাতেও চলে তীব্র বাদানুবাদ।

তখনকার একমাত্র বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের একজন বিশেষ প্রতিনিধি টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, রাখাইনদের নিয়ে নাকি একটি আজগুবি প্রতিবেদন ফাঁদা হয়েছে! তিনি নিজেই এক সপ্তাহ আগে কক্সবাজার সদরে বেড়াতে গিয়ে একটি রাখাইন পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, ওই প্রতিবেদনটি নাকি আদৌ সত্য নয়। পুরোটিই নাকি আগাগোড়া কাল্পনিক, ভিত্তিহীন ও সত্য বিবর্জিত।

চিন্তন যেখানে উগ্র জাত্যাভিমান জনিত অহং, ফর্মূলা সর্বস্ব কেতাবী বিদ্যা, আর দৃষ্টিসুখের মোহে বৃত্তাবদ্ধ, যুক্তি সেখানে নিস্ফল; সত্য সেখানে দূরাগত মাত্র। …পেশাগত কাজে বহুবছর ভাষাগত সংখ্যালঘু আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘোরার দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেত অনেক কথাই। কিন্তু এর জবাবে বলা হয়নি কিছুই ।…


ফুটনোট: ২০০৭ সালে একই শিরোনামে লেখাটি অন্য একটি ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন শিরোনাম বাদে পুরো লেখাটি পুনর্লিখন করা হয়েছে।

সংযুক্ত: খসড়া লেখায় ক’চিন ঠে ডলির প্রাসঙ্গিক মন্তব্য:

kyaw Sein Thay Dolly: …I would like to emphasize is that we are the son of this land and we have right to live in this land as many others. peacefully… we will alwyas voice out to raise public awareness to have the right as a country men.. this will always go on….


ছবি: সাংগ্রাং, কক্সবাজার, এম. ইউসুফ তুষার।