বিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করা এক ঝামেলার বিষয়। অনেকভাবে একে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ বলেছেন এটা হলো জগতকে ব্যাখ্যা করার উপায়। অনেকে বলেছেন এটা হলো সৃষ্টি করার উপায়। কেউ বলেছেন বিজ্ঞান হলো ভবিষ্যতকে জানার উপায়। সংজ্ঞার উপযোগ যদি ধরি একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয়কে পার্থক্য করতে পারা, জগতের ব্যাখ্যা হিসেবে বিজ্ঞানের সংজ্ঞাটা সেক্ষেত্রে অনেকটাই দুর্বল বলা চলে। অনেক কিছুই জগতকে ব্যাখ্যা করতে চায়। ধর্মে জগতের ব্যাখ্যা আছে। অনেক ঘরে বসা দার্শনিকের কাছেও দর্শনের ব্যাখ্যা আছে। বিজ্ঞানেও জগতের অনেক ব্যাখ্যা আছে। ধর্ম বা ঘরে বসা দার্শনিকের দর্শন, সবই কি তাহলে বিজ্ঞান? বোঝা যাচ্ছে যে ‘জগতের ব্যাখ্যা’ কথাটা যথেষ্ট নয়। যেকোন ব্যাখ্যা প্রচেষ্টাকে বিজ্ঞানের কাতারে ফেলে দেয়াটা কাজের নয়। অতিরিক্ত কিছু দরকার।

কৃষ্টি হিসেবে বিজ্ঞানকে বুঝতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়। বিজ্ঞান নামে যে কৃষ্টি তৈরি হয়েছে, সে সময়ের সাথে নানারূপ নিয়েছে। অনেক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা যে নিশ্চয়তার সাথে শেখানো হয়, সেই নিশ্চয়তা প্রকৃত অর্থে বিরাজ করে না। মানুষের কৃষ্টিকে মানুষ নাম দিচ্ছে। সে চাইলে এমন একটা বিষয়কে বিজ্ঞান নাম দিতে পারে যার মধ্যে গতির সূত্র, ধর্মের বিশ্বাস, জ্যোতিষশাস্ত্র এই সবকয়টাই পড়ে। কিন্তু মানুষের কৃষ্টিতে ঐতিহাসিকভাবে বিজ্ঞান ধর্ম থেকে আলাদা থেকেছে। এই ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখা প্রয়োজন, কী কারণে তারা আলাদাভাবে চিহ্নিত। এটা অনেকক্ষেত্রে সংজ্ঞায়নের থেকে বেশি দরকারী। সংজ্ঞা সংক্ষিপ্ত হবার চেষ্টা করে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বোঝাপড়া স্বল্পসংখ্যক শব্দের আড়ালে লুকিয়ে যায়। লুকোলুকির চেয়ে বোঝাপড়াটাই বেশি জরুরি।

গ্রহের গতিপথকে সূত্রবদ্ধ করার ইতিহাস বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমরা কম বেশি সবাই ছোটবেলায় পড়েছি। সেখানে দেখা গেছে সূত্রগুলো শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়েছে নতুন নতুন পর্যবেক্ষণের সাথে। বৈজ্ঞানিক চর্চা বলতে আমরা যা বুঝাতে চাই, এই ইতিহাস তার চমৎকার সংক্ষেপ। পর্যবেক্ষণের উপর প্রকল্প তৈরি, সেই প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে অদেখা পর্যবেক্ষণের উপর পূর্বাভাস দেয়া, অদেখা পর্যবেক্ষণকে দেখার পর প্রকল্পকে পরিমার্জন করা। এটাই সংক্ষেপে সেই চর্চা। অধিকাংশক্ষেত্রে এটি গাণিতিক সূত্রের রূপ ধারণ করে। দেখে ফেলা পর্যবেক্ষণগুলো যখন বারবার আসতে থাকে, তখন একটি প্রতিষ্ঠিত প্রকল্প বেশ শুদ্ধভাবে পূর্বাভাস দিতে পারে। মানে সৌভাগ্যজনকভাবে আমাদের পর্যবেক্ষণে কিছু রেগুলারিটি বিরাজ করে এবং সেগুলোকে গাণিতিক সূত্রে লিপিবদ্ধ করা যায়।

ফলে কেবল জগতকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হিসেবে দেখলেই মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক চর্চাকে বোঝা যায় না। এর সাথে জড়িত হলো পূর্বাভাসের ক্ষমতা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রকল্পের যাচাই ও পরিমার্জন। এই চর্চাটা বিজ্ঞান বলে চিহ্নিত কৃষ্টিকে অন্য বিষয় যেমন ধর্ম বা জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে আলাদা করে। জ্যোতিষশাস্ত্রে যাচাই বা পরিমার্জন নেই, ধর্ম পর্যবেক্ষণসাধ্য জগতের উপর পূর্বাভাসের সাহস বা ক্ষমতাই রাখে না। এই চর্চা যেখানে জড়িত, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে তাকেই বিজ্ঞান বলা হয়েছে। আমরাও এটাকে সাময়িকভাবে সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তবে অবশ্যই এই সতর্কতাটা বজায় রেখে যে এই সংজ্ঞাটা কেবলই ইতিহাসের বোঝাপড়ার মাধ্যমে তৈরি। এটা আমাদেরকে কেবল সাহায্য করছে ঐতিহাসিকভাবে নির্ণীত বিজ্ঞান চর্চাকে ধর্ম বা অন্য চর্চা থেকে আলাদা করতে। কিন্তু আমাদের নতুন বোঝাপড়া তৈরিতে বাধা হিসেবে দাঁড়ানো মোটেও এই সংজ্ঞার উদ্দেশ্য নয়। ফলে নতুন কোন তর্ক সংজ্ঞাটিকে প্রতিষ্ঠিত ধরে নিয়ে এর উপর ভিত্তি করে ঘটবে না, ঘটবে ঐতিহাসিক পার্থক্যগুলোকে চিহ্নিত করে এবং নতুনের সম্ভাবনাকে বিশ্লেষণ করে।

বিজ্ঞানের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো সৃষ্টি। যা বিরাজ করতো না, তাকে তৈরি করা হয়েছে বিজ্ঞান নামক কৃষ্টির আওতায়। আমি এখানে বিজ্ঞানের দু’টি চর্চাকে আলাদা করতে চাই। একটি হলো কেবলই বিদ্যমান জগতকে পূর্বাভাসক্ষমভাবে জানার চেষ্টা। আরেকটি হলো নতুনকে সৃষ্টি। নতুনকে সৃষ্টির চর্চাটিকেও পূর্বাভাস করার চর্চা হিসেবে দেখা সম্ভব। নতুনকে সৃষ্টির জন্যে যেটা লাগে, তা হলো শর্তাধীন পর্যবেক্ষণকে পূর্বাভাস করা। গ্রহের গতিবিধির যে পর্যবেক্ষণ, সেটা শর্তাধীন নয়। গ্রহ নড়বেই। কিন্তু পর্যবেক্ষণকে যখন পরিবর্তন করা যায়, তখন শর্তাধীন পর্যবেক্ষণের প্রশ্ন চলে আসে। নদী যেভাবে গড়াচ্ছে, সেটার পর্যবেক্ষণের পূর্বাভাসকে অশর্তাধীন পর্যবেক্ষণের পূর্বাভাস। নদীতে বাঁধ দিলে নদী কীভাবে গড়াবে সেটার পর্যবেক্ষণের পূর্বাভাস হলো শর্তাধীন পর্যবেক্ষণের পূর্বাভাস। শর্তটা হলো আমাদের ক্রিয়া – নদীতে বাঁধ দেয়া। এটা প্রাকৃতিকভাবে ঘটছে না এমন একটা ঘটনা।

মানুষের ক্রিয়ার শর্তাধীন পূর্বাভাস দ্বারাই কেবল সম্ভব নতুনকে সৃষ্টি। অশর্তাধীন যে পর্যবেক্ষণগুলো, সেগুলো প্রায় সবই শর্তাধীন পূর্বাভাসে সাহায্য করে। নদীর স্বাভাবিক গতি জানাটা বাঁধ দেবার পরের গতিটা জানার জন্যে জরুরি। বিজ্ঞানের যে চর্চাটি শর্তাধীন পূর্বাভাসের সাথে অর্থাৎ নতুনকে সৃষ্টির সাথে জড়িত, সেটা বলা চলে ঐতিহাসিকভাবে বিজ্ঞান নামক কৃষ্টির অনন্য বৈশিষ্ট্য। নতুনকে সৃষ্টি ধর্মের দখলে নেই। জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চাতেও অনুপস্থিত।

নতুনকে সৃষ্টি হলো বিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। সে তুলনায় ঘটমানকে জানার চর্চা নিতান্তই সাদামাটা। ঘটমানকে (মানব ব্যতিরেকে বাকি জগতকে) যখন পুরোটাই জানা হয়ে যাবে, তখন আর সেই চর্চার বাকি কী থাকবে? সে কথা চিন্তা করলে খুব উদ্বেলিত হতে পারি না। বরং একটা বুদ্ধিক আত্মহননকেই দেখতে পাওয়া যায়। সে তুলনায় নতুনকে সৃষ্টির বিজ্ঞান অনেক সম্ভাবনাময়। এই বিজ্ঞানের সম্ভাবনার সীমা ঘটমানকে জানার বিজ্ঞানের সীমার মতো নির্দিষ্ট নয়। বরং বেশ অনিশ্চিত। মানুষের ক্রিয়ার যে অযুত সম্ভাবনা, সেটার যে অনিশ্চয়তা, তার তুলনায় বিশাল এই মহাবিশ্বের অনিশ্চয়তাকে সামান্যই মনে হয়। নির্দিষ্ট কিছু সূত্র মেনে আগামীতে মহাবিশ্বের চেহারা কি আকার নেবে, তার গণনার চেয়ে আগামী শতকে মানুষ কী কী তৈরি করবে সেটার গণনা অনেক বেশি জটিল মনে হয় আমার কাছে। অন্তত এই বিশাল এবং জটিল মহাবিশ্বের যতটা মানুষ জেনেছে, মানুষের মস্তিষ্ক আর আচরণকে সেই তুলনায় কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি।

ফলে মানুষ এই মহাবিশ্বের কী কী পরিবর্তন ঘটাতে পারে ভবিষ্যতে তার সম্ভাবনা বিশাল, অনেক আগ্রহজনক। একটা সীমা নির্ণয় করাও এখানে কঠিন। ঘটমানকে জানতে গেলে মানুষ অমর নয় বলেই আমরা জানতে পারি, কিন্তু মানুষের সৃষ্টির সম্ভাবনাকে যদি আমরা বিবেচনায় আনি, তখন মানুষ অমরত্ব অর্জন করতে কখনো পারবে কি পারবে না, এই প্রশ্নের উত্তর তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এতটাই অনিশ্চিত এবং আকর্ষণীয় মানুষের নতুনকে সৃষ্টির সম্ভাবনা। তেমনি আমরা জানি যে জড় বস্তু প্রাণীর মতো আচরণ করে না, কিন্তু আমরা জানি না জড় বস্তুতে মানুষ প্রাণীর আচরণ আরোপ করতে পারবে কিনা। সম্ভাবনাটা হ্যাঁ-এর দিকেই বেশি ঝঁুকে আছে বলে আমরা আজকাল বোধ করি। আজ থেকে একশ আট বছর আগে তেমনি আমরা জানতাম মানুষ উড়তে পারে না, কিন্তু তারপর খুব দ্রুতই আমরা জেনেছি যে মানুষ তাও পারে। এমন কোন কল্পনা আমি করতে পারি না, যেটা আমি হলফ করে বলতে পারি যে মানুষ সেটা কখনো করতে পারবে না।

নতুনকে সৃষ্টির যে বিজ্ঞান, মানুষকে সে ঈশ্বর করেছে। সর্বক্ষমতাময় ঈশ্বর। নতুনকে সৃষ্টির ক্ষমতা তাই ঐশ্বরিক ক্ষমতা। মানুষের কৃষ্টির বিভিন্ন চর্চার মধ্যে এই ঐশ্বরিক ক্ষমতার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি খুব সহজেই নির্ণয় করা যায়। নির্ণয় করা যায় জাতি থেকে জাতি ভেদে। নতুনকে যে সৃষ্টি করে না, সে ঈশ্বরের পূজক। আর যে করে, সে ঈশ্বর। একজন জগতে বাস করে মৃত্যুর অপেক্ষায়। আরেকজন নতুন নতুন জগত তৈরি করে চলতে থাকে অমরত্বের পাণে।