আমার এ লেখাটি অনেক আগের। যতদূর মনে পড়ে এটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এবং দৈনিক ভোরের কাগজে ৫ ই মে, ২০০৬ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে এটি অন্য একটি ব্লগে প্রকাশিত হয়। আজ দৈনিক সমকালের কালস্রোত খুলে দেখি লেখাটি একটু ছোট করে ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান’ শিরোনামে সেখানে প্রকাশিত হয়েছে। পঁচিশে বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী (সার্ধশত রবীন্দ্র জয়ন্তী ১৪১৮) উপলক্ষে আজ লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশিত হল।
:line:
১
রবীন্দ্রনাথের গানের একটি কলি শিরোনাম হিসেবে গ্রহণ করে আমি যখন ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী‘ নামের বিজ্ঞানভিত্তিক সিরিজটি ধারাবাহিকভাবে মুক্ত-মনার জন্য লেখা শুরু করলাম, তখন অনেকেই খুব অবাক হয়েছিলেন। কেউ কেউ এটিকে দেখেছিলেন ‘সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন’ হিসেবে। আমার এই সিরিজটি অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে বই আকারে বেরোয়, ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে। সেই বইয়ের মুখবন্ধে আমি প্রকাশ করেছিলাম কি করে হঠাৎ করেই রবিঠাকুরের গানের লাইনটি আমি শিরোনাম হিসেবে পেয়ে গেলাম:
…বইটির নাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ হল কেন এ নিয়ে কিছু বলা উচিৎ। সিরিজটি লেখার সময় আমি আসলে ভেবে পাচ্ছিলাম না এমন একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক সিরিজের নাম কি হতে পারে। কাব্যিক ধাঁচের নামের প্রতি আমার আকর্ষণ সব সময়ই প্রবল। চিন্তার বেড়াজালে আমি যখন কেবলি ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, সে সময়েরই এক আলস দুপুরে ঘরে পায়চারী করতে করতে বুক শেলফে রাখা আমার প্রিয় কার্ল স্যাগানের বইটি অবচেতন মনেই হাতে তুলে নিলাম। মলাটে ‘The Demon-Haunted World’ শিরোনামের নীচেই সুন্দর একটা উক্তি – ‘Science As a Candle in the Dark’ চমৎকার! এ ধরনের একটি নামই আমি মনে মনে খুঁজছিলাম। এমনি একটি সুন্দর পংক্তির যুৎসই বাংলা কোথায় খুঁজে পাব, যার মাধ্যমে ধ্বনিত হতে থাকবে আঁধার ঘুচিয়ে আলোকিত পথে যাত্রার ইঙ্গিত? স্যাগানের বইটি বুকের উপরে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলাম মনের অজান্তেই – তন্দ্রার মধ্যে শুনলাম ক্যাসেটে বেজে চলেছে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গিতটি :
তুমি কি কেবলি ছবি, শুধু পটে লিখা?
ওই যে সুদূর নিহারীকা –
যারা করে আছে ভিড়,
আকাশের নীড়
ওই যারা দিন-রাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী,
গ্রহ তারা রবি …আর এখানে এসেই আমি থমকে গেলাম। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’- এই শব্দক’টি মনের গহীনে কোথায় যেন একটি অনুরণন তুলল। ভাবলাম এর চাইতে কাব্যিক আর মনোহর শিরোনাম আর কি হতে পারে? তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার প্রথম বইটির শিরোনাম হবে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। যে গানটি কবিগুরু দুঃখভারাক্রান্ত মনে কাদম্বরী দেবীকে স্মরণ করে শত বছর আগে লিখেছিলেন, কখনও কি ঘূর্ণাক্ষরেও ভেবেছিলেন, এর একটি পংক্তি ব্যবহৃত হতে পারে বাংলাদেশের এক অখ্যাত লেখকের প্রথম বইয়ের শিরোনাম হিসেবে?…
বইটি প্রকাশ হবার পর বেশ কিছু ভাল পর্যালোচনা হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রপত্রিকায় । এরপর ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’ নামে আমি আরেকটা সিরিজ শুরু করেছিলাম । সিরিজটি ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকাটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, আর ২০০৭ এর বইমেলাতে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে‘ শিরোনামে অবসর (প্রতীক) থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটার আদি শিরোনাম -‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’ টিও কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আরেকটা গান থেকে চুরি করা! ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ মুলতঃ ছিলো মহাবিশ্ব সৃষ্টির একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। আর ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’ লেখা হয়েছিলো এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির পেছনে আজকের বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাগুলোকে সমন্বিত করে। আমি চাইছিলাম এই সিরিজ দুটি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে, ঠিক যেমন আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধান’ আর ‘অনুমান’। সে সময় বহু পাঠক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ‘আপনার অনেক প্রবন্ধই দেখছি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন দিয়ে! কেন বলুন তো?’ আবার কেউ আবার একটু খোঁচা মেরে বলতেন – ‘আপনি তো দেখছি রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানীই বানিয়ে দিলেন’। আমি হেসে এড়িয়ে যেতাম। আমার মনে হয় ্রবি বুড়োর আজকের এই শুভ জন্মদিনে এর ব্যাখ্যাটাও সেরে ফেলি। কাব্যিক ধাঁচের নামের প্রতি আমার আকর্ষণ আছে বলে কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গিত আমার প্রিয় সেজন্যে শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথের সাথে মানে তার সাহিত্যের সাথে যে বিজ্ঞানের একটা ছোট্ট হলেও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে তা বোধ হয় আমরা অনেকেই জানি না। রবীন্দ্রনাথের বাল্যকাল থেকেই শুরু করা যাক। মাত্র সাড়ে বারো বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একটি অস্বাক্ষরিত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ লেখেন; শিরোনাম-‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’। এটি কিন্তু এখন স্বীকৃত যে, ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্য রচনা । পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথ অন্ততঃ দু’জায়গায় সেই কিশোর বয়সে লেখা রচনাটির উল্লেখ করেছিলেন। এই লেখার অনেক অনেক বছর পার করে শেষ বয়সে এসে কবিগুরু একশো পনের পৃষ্ঠার আরেকটি বিজ্ঞানভিত্তিক বই লিখলেন, নাম – ‘বিশ্বপরিচয়’। শুধু তাই নয়, তিনি বইখানি উৎসর্গ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার কৃতি শিক্ষক, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসুকে। রবীন্দ্রনাথ তার উৎসর্গপত্রে লিখলেন :
‘বয়স তখন হয়তো বারো হবে, পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলোয়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিশৃঙ্গের বেড়া দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম। জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’
আমি যেমনি ভাবে ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ আর ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’ – দুটি সিরিজ একে অপরের পরিপূরক হবে বলে ভাবছিলাম, রবীন্দ্রনাথও কি বিশ্বপরিচয় লিখবার আগে ঠিক তেমন করেই ভাবছিলেন? নয়ত তিনি বলবেন কেন –
‘জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাণবিজ্ঞান – কেবলি এই দুই বিষয় নিয়ে আমার মন নাড়াচাড়া করছে’ ।
কিংবা আইনস্টাইনের মত একাকিত্বের যন্ত্রণা হয়ত রবীন্দ্রনাথও পেয়েছিলেন বিজ্ঞানের নান্দনিক সৌন্দর্যে আবিষ্ট হয়ে, তাই লিখেছিলেন :
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।
২
আইস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয় ১৯২৬ সালে, কবিগুরুর দ্বিতীয়বার জার্মানী ভ্রমণের সময়। এই প্রথম সাক্ষাৎকারের অবশ্য কোন লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে এটি নিশ্চিত যে, রবিঠাকুরের সান্নিধ্য আইনস্টাইনের মনে যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধের জন্ম দিয়েছিলো। সেজন্যই আইনস্টাইন পরে চিঠি লিখে কবিগুরুকে জানিয়েছেন :
‘জার্মানীতে যদি এমন কিছু থাকে যা কিছু থাকে যা আমি আপনার জন্য করতে পারি, তবে যখন খুশি দয়া করে আমাকে আদেশ করবেন।’
আইনস্টাইনের মত জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কাছ থেকে প্রথম সাক্ষাতেই এমন চিঠি পাওয়া চাট্টিখানি ঘটনা নয়। তবে আইস্টাইনের সাথে কবির ‘সত্যিকারের’ যোগাযোগ হয় এর বছর চারেক পরে – ১৯৩০ সালে। সে সময় আইনস্টাইনের সাথে কবিগুরুর অন্ততঃ চারবার দেখা হয়। ১৪ ই জুলাই তারিখে আইনস্টাইনের সঙ্গে তার কথাবার্তার বিবরণ ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ বইয়ের পরিশিষ্টে ছাপা হয়। জীবনের গভীরতম দর্শন, জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়ে তাঁরা সেদিন বিস্তারিত আলোচনা করেন। যারা উৎসাহী তারা মুক্ত-মনায় রাখা দিমিত্রি মারিয়ানফের সাক্ষাৎকারের বিবরণটি (১০ আগাষ্ট ১৯৩০ সালের নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত) দেখে নিতে পারেন ।
চিত্র: কবি ও বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথ।
আইনস্টাইনের আস্থা ছিলো পর্যবেক্ষণ অনপেক্ষ ভৌত বাস্তবতায়। তিনি বিশ্বাস করতেন না মানুষের পর্যবেক্ষণের উপর কখনও ভৌতবাস্তবতার সত্যতা নির্ভরশীল হতে পারে। বোর প্রদত্ত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেনীয় ব্যাখ্যার সাথে তার বিরোধ ছিল মূলতঃ এখানেই। বোর বলতেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানে কাজ প্রকৃতি কেমন তা আবিষ্কার করা নয়, প্রকতি সম্পর্কে আমরা কি বলতে পারি আর কিভাবে বলতে পারি, এটা বের করাই বিজ্ঞানের কাজ।’ এই ধরণাকে পাকাপোক্ত করতে গিয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আরেক দিকপাল হাইজেনবার্গ দেখিয়েছিলেন যে, একটি কণার অবস্থান এবং বেগ যুগপৎ নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। অবস্থান সুচারুভাবে মাপতে গেলে কনাটির বেগের তথ্য হারিয়ে যাবে, আবার বেগ খুব সঠিকভাবে মাপতে গেলে অবস্থান নির্ণয়ে গন্ডগোল দেখা দেবে। নীলস বোরের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি কণাকে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কণাটি কোথায় রয়েছে – এটা বলার কোন অর্থ হয় না। কারণ এটি বিরাজ করে সম্ভাবনার এক অস্পষ্ট বলয়ে। অর্থাৎ, এই মত অনুযায়ী ভৌতবাস্তবতা মানব-পর্যবেক্ষণ নিরপেক্ষ নয় (১৯৮২ সালে অ্যালেইন অ্যাস্পেক্ট আইনস্টাইনের ই.পি.আর মানস পরীক্ষাকে পূর্ণতা দান করেন একটি ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে, যা কিন্তু বোরের যুক্তিকেই সমর্থন করে)। বলা বাহুল্য, আইনস্টাইন এ ধরনের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের সাথে কথোপকথোনেও কিন্তু আইনস্টাইনের সেই একই অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে :
আইনস্টাইন : মহাবিশ্বের স্বরূপ নিয়ে দুটি ধারণা রয়েছে – জগৎ হল একটি একক সত্তা যা মনুষ্যত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল, এবং অন্যটি হল জগৎ একটি বাস্তবতা যা মনুষ্য উপাদানের ওপর নির্ভর করে না।
রবীন্দ্রনাথ : যখন আমাদের মহাবিশ্ব মানুষের সাথে ঐকতানে বিরাজ করে তখন শাশ্বত, যাকে আমরা সত্য বলে জানি, হয়ে দাঁড়ায় সৌন্দর্য, আমাদের অনুভুতিতে।
আইনস্টাইন : এটি মহাবিশ্ব সম্পর্কে পরিশুদ্ধভাবেই মানবীয় ধারণা।
রবীন্দ্রনাথ : এ ছাড়া অন্য কোন ধারণা থাকতে পারে না। এই জগৎ বস্তুত মানবীয় জগৎ- এর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিও হল বিজ্ঞানী মানুষের দৃষ্টি। সুতরাং, আমাদের ছাড়া বিশ্ব জগতের অস্তিত্ব নেই; এটি হল আপেক্ষিক জগৎ, যার বাস্তবতা আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল । যুক্তি ও আনন্দভোগের কতিপয় প্রামাণ্য রয়েছে যার মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হয়; এই সত্যই হল শাশ্বত মানুষের প্রামাণ্য যার অভিজ্ঞতা পুঞ্জীভুত হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই।
আইনস্টাইন : এ তো হল মনুষ্য সত্তার উপলব্ধি।
রবীন্দ্রনাথ : হ্যাঁ, এক শাশ্বত সত্তা। আমাদের এটি উপলব্ধি করতে হবে আমাদের আবেগ ও কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। আমরা মহামানবকে এভাবেই উপলব্ধি করি, আমাদের সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে, যে মহামানবের কোন স্বতন্ত্র সীমাবদ্ধতা নেই; এটি হল সত্যের নৈর্ব্যাক্তিক মানবীয় জগৎ। ধর্ম এসব সত্যের উপলব্ধি করে, এবং আমাদের গভীরতম কামনার সাথে সংযোগ স্থাপন করে; সত্য সম্পর্কে আমাদের ব্যক্তি চেতনা বিশ্বজনীন তাৎপর্য অর্জন করে থাকে। ধর্ম সত্যের ওপর মূল্যবোধ আরোপ করে থাকে, এবং আমরা জানি যে এর সাথে আমাদের স্ব ঐকতানের মিলনের মধ্য দিয়ে এই সত্য মঙ্গলময় বলে প্রতিভাত হয়।
আইনস্টাইন : সত্য তাহলে, অথবা সৌন্দর্য মানুষের অস্তিত্ব নিরপেক্ষ কিছু নয় ?
রবীন্দ্রনাথ : না। আমি তা মনে করি না।
আইনস্টাইন : মানুষের অস্তিত্ব যদি নাই থাকে, তাহলে বেলভেদরের অ্যাপোলোর সৌন্দর্যের অস্তিত্ব থাকবে না ?
রবীন্দ্রনাথ : না।
আইনস্টাইন : সৌন্দর্য সম্পর্কে আপনার এ ধারণার সাথে আমি এক মত, কিন্তু সত্য সম্পর্কে এ ধারণার সাথে একমত নই।
রবীন্দ্রনাথ : কেন নন ? সত্য তো মানুষের ভেতর দিয়েই প্রতিভাত হয়।
‘সত্য তো মানুষের ভিতর দিয়েই প্রতিভাত হয়’ -মনুষ্য প্রত্যক্ষণ-নির্ভর এই সত্যের কথা কবি আরো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তার একটি বিখ্যাত কবিতায় :
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে-
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’
সুন্দর হল সে।তুমি বলবে এ যে তত্ত্বকথা, এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
১৯৭৭ সালে নোবেল পুরস্কারে ভুষিত বেলজীয় রসায়নবিদ প্রিগোঝিন এ সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে মন্তব্য করেন:
“The question of meaning of reality was the central subject of a fascinating dialog between Einstein and Tagore. Einstein emphasized that the science had to be independent of the existence of any observer. This led him to deny the reality of time as irreversibility, as evolution. On the contrary Tagore maintained that even if absolute truth could exist, it would be inaccessible to the human mind. Curiously enough, the present evolution of science is running in the direction stated by great poet.’
অর্থাৎ, প্রিগোঝিনের মনে হয়েছে, আধুনিক বিজ্ঞানের অভিব্যক্তি যে দিকে ঘটছে তাতে আইনস্টাইনের চেয়ে রবীন্দ্রনাথই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছেন বেশী। তবে সবাই যে প্রিগোঝিনের সাথে একমত হয়েছেন তা নয়। বিশেষ করে বার্ট্রান্ড রাসেল কবিগুরু সম্বন্ধে কখনই উঁচু ধারণা পোষণ করতেন না। তিনি একবার রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনে এসে রবীন্দ্র-দর্শন সম্বন্ধে বলেন : ‘আমি দুঃখিত যে রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার একমত হওয়া সম্ভব নয়। অনন্ত (infinite) সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন তা অস্পষ্ট প্রলাপমাত্র (vauge nonsense)। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা সম্বন্ধে তার মন্তব্য ছিলো – ‘It was unmitigated rubbish’।
৩
রবীন্দ্রনাথের সাথে বিজ্ঞানের নিবিড় সম্বন্ধের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে তাঁর বন্ধুত্ব। তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন :
‘বিজ্ঞান ও রসসাহিত্যের প্রকোষ্ঠ সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন মহলে, কিন্তু তাদের মধ্যে যাওয়া আসার দেনা পাওনার পথ আছে। জগদীশ ছিলেন সেই পথের পথিক। সেই জন্য বিজ্ঞানী ও কবির মিলনের উপকরণ দুই মহল থেকেই জুটত। আমার অনুশীলনের মধ্যে বিজ্ঞানের অংশ বেশী ছিল না, কিন্তু ছিল তা আমার প্রবৃত্তির মধ্যে। সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর ছিল অনুরূপ অবস্থা। সেই জন্য আমাদের বন্ধুত্বের কক্ষে হাওয়া চলত দুই দিকের দুই খোলা জানালা দিয়ে।’
অর্থের অভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণা যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগার হয়েছিল, তখন বন্ধুর গবেষণা যেন কোনভাবে বন্ধ না হয়, সে বিষয়ে মুল উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ১৯০০ সালের ২০ এ নভেম্বর একটি চিঠিতে জগদীশচন্দ্রকে বলেছিলেন :
‘আচ্ছা, তুমি এদেশে থেকেই যদি কাজ করতে চাও, তোমাকে কি আমরা সকলে মিলে স্বাধীন করে দিতে পারিনে? কাজ করে তুমি সামান্য যে টাকাটা পাও, সেটা যদি আমরা পুরিয়ে দিতে না পারি, তা হলে আমাদের ধিক্। কিন্তু তুমি কি সাহস করে এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে? পায়ে বন্ধণ জরিয়ে পদে পদে লাঞ্ছনা সহ্য করে তুমি কাজ করতে পারবে কেন? আমরা তোমাকে মুক্তি দিতে ইচ্ছা করি – সেটা সাধন করা আমাদের পক্ষে যে দুরূহ হবে তা আমি মনে করিনে। তুমি কি বল?’
কবিগুরু কতটুকু সাহায্য করতে পারবেন, এ নিয়ে বোধ হয় জগদীশ চন্দ্রের মনে খানিকটা হলেও সন্দেহ ছিল। এ যে বিশাল টাকার ব্যাপার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশ্বাসবানী যে স্রেফ কথার কথা ছিল না, এটি বোঝাতে পরবর্তী চিঠিতেই (১২ ই ডিসেম্বর, ১৯০০) আবারো লিখলেন রবীন্দ্রনাথ :
‘তুমি তোমার কর্মের ক্ষতি করিও না, যাহাতে তোমার অর্থের ক্ষতি না হয় সে ভার আমি লইব।’
চিত্র: কবি ও বিজ্ঞানী। ‘রাজর্ষি’ রচনাকালীন সময়ে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সাথে কবি রবীন্দ্রনাথ
তার বন্ধুকে সাহায্য করার আবেদন রবীন্দ্রনাথ অন্যদেরও জানিয়েছিলেন। এর প্রমাণ আমরা পাই রমেশ্চন্দ্র দত্তের ১৯০১ সালের ১৬ই জুলাই লন্ডন থেকে লেখা একটি চিঠিতে যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে দু’লাখ টাকার একটি তহবিল গঠনের জন্য তাঁকে চেষ্টা করতে বলেন। বলাবাহুল্য জমিদার রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও এত টাকা যোগার করা সে সময় সম্ভব ছিল না। তাই তিনি শেষ পর্যন্ত শরণাপন্ন হন ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের। শুধু জগদীশের গবেষনার জন্য টাকা জোগারের জন্যই ত্রিপুরা ভ্রমণ করেন। সেখান থেকেই অকটোবর কিংবা নভেম্বর মাসে (চিঠিটিতে কোন তারিখ ছিল না) তিনি জগদীশচন্দ্রকে লেখেন :
‘আমি তোমার কাজেই ত্রিপুরায় আসিয়াছি। এইখানে মহারাজের অথিতি হইয়া কয়েক দিন আছি। তিনি শীঘ্র্র বোধ হয় দুই এক মেলের মধ্যেই তোমাকে দশ হাজার টাকা পাঠাইয়া দিবেন। সেটাকা আমার নামেই তোমাকে পাঠাইব। এই এক বৎসরের মধ্যেই তিনি আরো দশ হাজার পাঠাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন। ইহাতে বোধ করি তুমি বর্তমান সংকট হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারিবে।’
জগদীশের জন্য অর্থ সাহায্য করেই কেবল রবিঠাকুর ক্ষান্ত হননি, জগদীশের কাজ যাতে সাধারণেরা জানতে পারে, যাকে আমরা বলি ‘পপুলার লেভেল’-এ পৌঁছানো, তারও ব্যবস্থা করলেন তিনি নিজে। ১৯০১ সালে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত (শ্রাবণ সংখ্যা) একটি লেখায় জগদীশ চন্দ্রের কাজের উপর ভিত্তি করে রবিঠাকুর রচনা করলেন একটি প্রবন্ধ – ‘জড় কি সজীব?’ । তার ও আগে আষাঢ় সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘আচার্য জগদীশের জয়বার্তা’ নামের আরেকটি প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের হয়ত সংশয় ছিল প্রবন্ধগুলোর মান ও গুণ নিয়ে, তাই জগদীশচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে বলেছিলেন – ‘আমি সাহসে ভর করিয়া ইলেক্ট্রিশ্যান প্রভৃতি হইতে সংগ্রহ করিয়া শ্রাবণের বঙ্গদর্শনের জন্য তোমার নব আবিস্কার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছি। প্রথমে জগদানন্দকে লিখিতে দিয়াছিলাম- পছন্দ না হওয়াতে নিজেই লিখিলাম। ভুলচুক থাকিবার সম্ভাবনা আছে – দেখিয়া তুমি মনে মনে হাসিবে।’
না, জগদীশ চন্দ্র বসু হাসেন নি। বরং উলটো বলেছিলেন :
‘তুমি যে গত মাসে আমার কার্যের আভাস বঙ্গদর্শনে লিখিয়াছিলে তাহা অতি সুন্দর হইয়াছে। তুমি যে এত সহজে বৈজ্ঞানিক সত্য স্থির রাখিয়া লিখিতে পার, ইহাতে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।’
১৯১৭ সালের ৩০ এ নভেম্বর জগদীশ্চন্দ্রের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে দিয়ে সমস্ত দেশের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি জগদীশচন্দ্রকে বলেছেন, ‘এ তো তোমার একার সঙ্কল্প নয়, এ আমাদের সমস্ত দেশের সঙ্কল্প, তোমার জীবনের মধ্যে দিয়ে এর বিকাশ হতে চলল।’ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময় কবিগুরু ছিলেন আমেরিকায়। তারপরেও শত ব্যস্ততার মাঝে উদ্বোধনী সঙ্গীত লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেই বিখ্যাত সঙ্গীতটিই হল- ‘মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন কর মহোজ্জ্বল আজ হে’।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। পুরস্কার ঘোষিত হয় ১৯১৩ সালের ১৩ ই নভেম্বর। রবীন্দ্রনাথ খবর পান ১৬ ই নভেম্বর। এর ঠিক তিনদিন পরে জগদীশ চন্দ্র তাঁকে অভিনন্দন জানালেন এভাবে :
‘বন্ধু ,
পৃথিবীতে তোমাকে এতদিন জয়মাল্যভূষিত না দেখিয়া বেদনা অনুভব করিয়াছি। আজ সেই দুঃখ দূর হইল। …’
রবীন্দ্রনাথের জীবনে এভাবে কথা বলার অধিকার যদি কেউ রেখে থাকেন, তবে নিঃ সন্দেহে তা জগদীশ চন্দ্র বসু। জগদীশ চন্দ্র কিন্তু বলেন নি যে কবির পুরষ্কার পাবার ঘটনায় তিনি ‘আনন্দিত’। তিনি বলেছেন – তাঁর ‘দুঃখ দূর হল’। এ যেন যথার্থ বন্ধুর চাপা আনন্দের এক নির্মোহ স্বর!
:line:
কৃতজ্ঞতাঃ Abu Zobaen Hossain Sondhi, যিনি দৈনিক সমকালে (৭ মে, ২০১১) প্রকাশিত লেখাটি নিজে থেকেই স্ক্যান করে ফেসবুকে আমার ওয়ালে শেয়ার করেছেন। এই ছবিটি তাঁর বদান্যতায় প্রাপ্ত –
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। শাব্বাশ অভিজিৎ দা! :guli:
আমার বিনীত অনু্রোধ যদি এই লিঙ্কের প্রতিটি লেখা আবার পুনঃ প্রকাশিত হয় কারন মক্তমনার অনেক নতুন সদস্যরা এই লেখাগুলি পড়তে পারেননি।
@সেন্টু টিকাদার,
সেন্টুদা, আপাততঃ থাকুক এখানে লিঙ্ক হিসবেই। নিজের পুরোন লেখা বার বার দিতে ভাল লাগে না। কেউ চাইলে তো খুঁজে পড়ে নিতে পারেই। আর আমার এবারের বই, অবিশ্বাসের দর্শন (যেটা রায়হান আবীরের সাথে লেখা)-এও এ নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা করেছি। আমার ধারণা আমার বইয়ের পাঠকদের অনেকেই সেটা পড়েছে।
আপনার কেমন লাগল, কী ধারণা হল জানাতে পারেন কিন্তু।
হুমায়ুন আহমেদের লেখা পড়ে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম, ফেসবুক ঘুরে এই লেখায় এসে বিরক্তি কেটে গেলো। এই মহান মানুষদের কথোপকথন বা সম্পর্ক দেখলে কেমন অকিঞ্চিৎকর মনে হয় নিজেকে! যে ব্যাকুলতা নিয়ে তাঁরা সত্য, সুন্দর আর জ্ঞানের সন্ধান করতেন, তা অভিভূত করলো!
লেখাটা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ অভিজিৎ’দা! 🙂
@আন্দালিব, হুমায়ুন আহমেদের কোন লেখাটা পড়ে বিরক্ত হয়েছিলেন?
@SHEIKH, হুমায়ুন আহমেদের লেখাটা* … হবে।
খবরের কাগজে হুমায়ুন আহমেদ একটা লেখা ছাপিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের সাথে আলাপের সময় সত্যেন বোসের নাম শুনে চিনতে পারেন নি। সেই লজ্জা কাটাতে দেশে ফিরে বিজ্ঞান নিয়ে বই লিখেছেন। হুমায়ুন সেই গল্পে এমনকি বইয়ের নামটাও ভুল লিখেছেন (সেই নামে রবীন্দ্রনাথের কোন বই নাই)।
@আন্দালিব, আপনি দয়া করে কোন রেফারেন্স দেন।
@SHEIKH, এই লিংকে দেখুন।
রবীন্দ্র সৃষ্টির ভক্ত আমরা অনেকেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে বাঙ্গালীরা দেবতার আসনে বসিয়ে দিচ্ছে, তাতে আমার তো ভয় ভয় লাগছে। রবিঠাকুরের সৃষ্টির মাঝে নেশায় মাতাল হয়েছি বটে, কিন্তু তাকে পূজো করার মত নির্বোধ এখনো হতে পারিনি। আইনষ্টাইনে সাথে যে কথপোকথন, তাকে কি আসলেই বিজ্ঞানপ্রসূত বলা চলে? দর্শন এবং বিজ্ঞানের মাঝে একটা বিশাল দূরত্ব আছে। আমরা যেভাবে রবীন্দ্রে বিজ্ঞান খুঁজছি, সেভাবে আইনষ্টাইনে কাব্য কেন খুঁজছি না? রবীন্দ্রনাথকে যদি কবি বা সাহিত্যিক ছাড়া আর কিছু বলতে হয়, তাহলে আমি কেবলই একজন ভাববাদী দার্শনিক বলতে রাজি। উনার কিছু ধারণায় বিজ্ঞানের প্রভাব ছিল বটে, উপমহাদেশ এবং বিশ্বের অনেক প্রতিভাবান সমসাময়িকের সাথে পরিচয়ও ছিল। তাদের সাথে মতবিনিময় তার চিন্তাকে প্রভাবিত যেমন করেছে, তেমনি তিনি তাদের চিন্তাকেও তিনি বুঝেছেন, অন্তত বোঝার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা যে অর্থে বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলি, সেই অর্থে তিনি বিজ্ঞানকে বুঝেছেন বলে মনে হয় না। উনার কাছে বিজ্ঞান ছিল একটা রহস্যের দুয়ার, যে রহস্যটার স্বরূপ কেমন, তাই উনি জানতে চেয়েছিলেন। বিজ্ঞান উনার কাছে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান বা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত কিছু ছিল না বা তার করতে তিনি আগ্রহীও ছিলেন না। পান্নার যে রংটা, তার একটা নাম দিয়েছি আমরা, সবুজ। আমার যদি ইমেজ প্রসেসিং এ গন্ডগোল থাকে আর পান্নার রঙ যদি আমি লাল দেখি (মানে অন্যরা যেটাকে লাল বলে জানে) তাহলে আমি কিন্তু আমার চোখে দেখা পান্নার (লাল)রংটাকেই সবুজ বলে জানব। চেতনায় আসলে অনেক কিছুই সৃষ্টি করা যায়… সেটাকে সৃজনশীলতা বলে, কিন্তু চেতনায় যা সৃষ্টি করা যায়, তাকে বিজ্ঞান নাম দেয়া যায় কি?
রবীন্দ্রনাথে যে গোড়ামি সংকীর্ণতা সবই ছিল, তা আমরা প্রায়শই দেখেও দেখিনা। উনার সৃজনশীলতা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর, উনি লিখেছেন, কাজও করেছেন বিস্ময়কর পরিমানে, কিন্তু আমরা উনাকে পূজার বেদীতে বসিয়ে রেখেছি। দর্শন আর বিজ্ঞানে একটা সুকঠিন পার্থক্য আছে, দর্শন ভ্রান্ত প্রমাণিত হবার আগ পর্যন্ত টিকে থাকে, রাজত্ব করে, আর বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিতই হয় সঠিক প্রমাণিত হবার পর। দর্শন সত্যের ধারণা, বিজ্ঞান সত্য।
তাই আমি রবীন্দ্রনাথে বিজ্ঞান খুঁজিনা। আমার চেতনায় রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান সাধক হতে পারেননি। 🙂
@নীল রোদ্দুর,
ভাল বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী ছিলেন না। বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মূল লেখাও তাই বলে।
দার্শনিকদের ভাবে বিনিময় হয় নিজ নিজ বিষয় থেকে বাইরে এসে একটা কমন গ্রাউন্ডে। আইনষ্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তাই হওয়া স্বাভাবিক পারষ্পরিক বিষয়ে শ্রদ্ধাবোধ রেখে।
@নীল রোদ্দুর,
দর্শন ভ্রান্ত প্রমাণিত হবার আগ পর্যন্ত টিকে থাকে, রাজত্ব করে, আর বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিতই হয় সঠিক প্রমাণিত হবার পর। দর্শন সত্যের ধারণা, বিজ্ঞান সত্য।
সুন্দর বলেছেন- (Y)
অভিজৎ দা। আপনার আগেই লেখাটাই আমি পড়েছি। যেটা আপনি বললেন ২০০৬ সালের দিকে। তখন আমার লেখকের থেকে টপিক টার গুরুত্বই বেশী দিয়েছি। কাওরন তখন বিচিত্রা পড়া হতো আমার এক সাংবাদিক দাদা পড়তো বলে, যেহেতু একসাথেই ছিলাম উনি সহ। আর একটা লেখা আমার মনে পড়ে ‘ত্রৈ-মাসিক ‘নতুন দিগন্ত’ এ একটা অনুবাদ ডকিন্স এর উপর।
সেখান থেকেই কিছুটা মনে হচ্ছে প্রথম যখন মুক্ত-মনা ব্লগ পড়া শুরু করলাম সেই অভিজিৎ may be এই অভিজিৎ দা-ই হবে।
তোমার ্লেখা এই এই বাক্য একদিন হয়তো কোটেশন হবে। পাশে লেখা থাকবে তোমার নাম।
নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। পরে কারিগরী বিদ্যাকে উপজিবীকা করি। কিন্তু আমার বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পর তেমন কোন দখল নাই । সত্যিকারে বিজ্ঞান মনষ্ক হতে হলে কি আত্মায় বিশ্বাস রাখা যায় না? রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে আমার বিশ্বাস নেই কিন্তু আমি আত্মার অস্তিতের পর এখনো অবিশ্বাসি হয়ে উঠতে পারছিনা। মনে হয় আত্মার অস্তিত্ব নাই তা বিজ্ঞানিরা প্রমাণ করতে পারে নাই। আর আত্মায় বিশ্বাসিরাও প্রমাণ করতে পারে নাই আত্মা আছে।
@সেন্টু টিকাদার,
সেন্টুদা, অনেক ধন্যবাদ সহৃদয় মন্তব্যের জন্য।
তবে কিছু ব্যাপারে দ্বিমত করছি।
আসলে যে কোন অপবিশ্বাসকেই কিন্তু এভাবে ডিফেন্ড করা যায়। ধরুন যে কেউ বলতে পারে ট্যাশগরু যে নাই তা কি করে বুঝব? ট্যাশগরুর অস্তিত্ব নাই তা বিজ্ঞানিরা প্রমাণ করতে পারে নাই। আর ট্যাশ গরু বিশ্বাসিরাও প্রমাণ করতে পারে নাই ট্যাশগরু আছে। শুধু আত্মা বা ট্যাশগরু নয়, থর, হার্কিউলিস, মা কালী, ফ্লাইং স্পেগেটি মন্সটার সহ সব কিছুই বৈধতা দেয়া যাবে এই বলে যে, ওগুলো যে নেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পারেন নি। কিন্তু সেটা কি কোন শক্তিশালী যুক্তি। কেউ কোন কিছুতে বিশ্বাস করলে তাকেই সেটার পক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে সেটা আছে, অবিশ্বাসীদের দায়িত্ব নয় সেগুলোর অস্তিত্ব নেই সেটা প্রমাণ করা। দর্শনে এটাকে বলে ‘বার্ডেন অফ প্রুফ’। আমার তো মনে হয় যদি কেউ আত্মা, ঈশ্বর বা যেটাতে বিশ্বাস করুন তাকেই প্রমাণ হাজির করতে হবে।
আর বিজ্ঞানের চোখে সর্বোপরি প্রাণের অস্তিত্ব ব্যাখ্যায় যে আত্মা একটি পুরোন এবং বাতিল ধারণা, তা নিয়ে আমি লিখেছি এবারের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইয়ে ইন ডিটেইল। বস্তুতঃ স্নায়ুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, শরীরবিজ্ঞান, জেনেটিক্স আর বিবর্তনবিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা আত্মাকে আক্ষরিক ভাবেই রঙ্গমঞ্চ থেকে হটিয়ে দিয়েছে। আর সেজন্যই যুগল-সর্পিলের (ডিএনএ) রহস্যভেদকারী নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক বলেন ‘একজন আধুনিক স্নায়ু-জীববিজ্ঞানী মানুষের এবং অন্যান্য প্রানীর আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মা নামক ধর্মীয় ধারণার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না’। মুক্তমনাতেও আমি পাঁচ পর্বের একটি সিরিজ লিখেছিলাম ‘আত্মা নিয়ে ইতং বিতং’ নামে ।
http://mukto-mona.com/Articles/avijit/atma1.htm
http://mukto-mona.com/Articles/avijit/atma2.htm
http://mukto-mona.com/Articles/avijit/atma3.htm
http://mukto-mona.com/Articles/avijit/atma4.htm
http://mukto-mona.com/Articles/avijit/atma5.htm
সিরিজটা পড়ে আপনি অভিমত দিলে ভাল লাগবে।
আলোচনা ভাল লাগলো।
@অভিজিৎ,
ভাই অভিজিৎ, আমি তোমার লেখা সিরিজ গুলি এক এক করে পড়বো যা আমি আগে পড়িনি কারন তখন আমি মুক্তমনাকে জানতাম না। লিঙ্ক দেবার জন্যে ধন্যবাদ।
রবীদ্র বিশেষজ্ঞ নয় তাই ঠিক নাও হতে পারে কিন্তু আমি যতদূর চিনি/জানি তাতে উনাকে ঠিক বিজ্ঞানমনস্ক মনে হয়নি বরং রহস্যমনস্ক (!?) ছিলেন। উনি রহস্য ভালবাসতেন, রহস্য উনার বুলাকে নিয়ে প্লানচ্যেটে, রহস্য দূর আকাশের তারায়।
হু, বিজ্ঞানে প্রচুর রহস্য হয়তো তাই তিনি খানিক আকর্ষিত হয়েছিলেন 🙂
ভাল লাগল!
আর একটি অভিজিতিয় লেখা। মন্তব্য নিস্প্রয়োজন। বিজ্ঞানে রবিঠাকুরের স্বল্পতা ছিল নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকার কারণে। কিন্তু বিজ্ঞান নিরোপিত সত্যকে অনুধাবন করেছেন নিবিড় ভাবে তা লেখায় স্পষ্ট।
এই লেখাটায় একটা ধাক্কা খেয়েছি উল্টোদিক থেকে শুরু করার কারণে। “সাম্প্রতিক মন্তব্যে” গিয়ে দেখি অনেকের মন্তব্য। লেখা “রবীন্দ্রে বিজ্ঞান”। আজকাল তো অনেক কিছুতেই বিজ্ঞান আবিষ্কৃত হচ্ছে – “বেদে বিজ্ঞান”, “কোরানে বিজ্ঞান”, “বাইবেল বিজ্ঞান।” কেউ কি আবার গীতাঞ্জলী বা ঘরে-বাইরে কিম্বা দুই বোনের মধ্যে বিজ্ঞান পেল কিনা! লেখক অভিজিৎ রায় না হলে হয়ত পড়াই হত না।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
ভাল লাগলো আপনার এই মন্তব্যটি। রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীকে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্যে নাকি আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন। ” রবীন্দ্রে কৃষি” শিরোনামে কোন লেখা অবশ্য আমি পড়ি নি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ডঃ আতিউর রহমান তো রবীন্দ্রনাথকে অর্থনীতির দিকপাল বানিয়ে ফেলেছেন তার বক্তব্য ও লেখায়। জমিদার রবীন্দ্রনাথ গরীব চাষীদের নাকি সমবায় শিক্ষা দিয়েছিলেন!! একদা মুক্তমনা এবং ইসলাম-পছন্দ একজন তো কোরানের সাথে রবীন্দ্র সংগীতের কোন দ্বন্ধই খুঁজে পান না!
রবীন্দ্রনাথকে যথাপাত্রে মনমত বসিয়ে নেয়া যায়। সুদীর্ঘ জীবনে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তিনি সে উপকরণটুকু রেখে গেছেন। এখন আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে ” ঘিয়ের সাথে পান্তা” মেখে কখনো ঘি, কখনো পান্তা বলে বেড়াচ্ছি।
@ভজন সরকার,
রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু কাজ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক তিনি কৃষি এবং কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে ব্রতী ছিলেন।
১) তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছিলেন।
২) কৃষক সন্তানদের জন্য স্কুলের জন্য টাকায় তিন পয়সা হারে অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
৩) স্থানীয় মহাজনদের গলাকাটা ঋণের হাত থেকে কৃষকদেরকে বাঁচানোর জন্য আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে ব্যাংক করেছিলেন পতিসরে। তাঁর নোবেল পুরষ্কারের সম্পূর্ণ টাকা (১০৮,০০০) এই ব্যাংকে রেখেছিলেন। সেই ব্যাংক অবশ্য লাটে উঠে।
এখানে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।
আমাদের শাশ্বতিকীর পরবর্তী সংখ্যা হবে রবীন্দ্রনাথের ওপর। আগস্ট মাসে প্রকাশিত হবে। আপনার কাছ থেকে আমরা এ-ধরনের একটি লেখা পেতে পারি কি ? জানাবেন প্লিজ। ধন্যবাদ লেখাটি শেয়ার করার জন্য। আমি আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম, আবারও পড়লাম।
@মোজাফফর হোসেন, মুক্তমনায় আমার প্রথম লেখাটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। যদি কারও ইচ্ছে হয়, একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন…
@মোজাফফর হোসেন,
অবশ্যই। এই লেখাটিই নিতে পারেন। শাশ্বতিকীর বহুল প্রচার কামনা করছি।
রবীন্দনাথের নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল। বিজ্ঞান নিয়ে গোটা দুয়েক বইও লিখেছেন। একটির নাম এখানে এসেছে, বিশ্বপরিচয়, অন্যটির নাম বিজ্ঞান (এটির মান অবশ্য খুবই শোচনীয়। ক্লাস ফাইভের পাঠযোগ্যও নয়।)।
বিজ্ঞানে তাঁর আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গপত্রে। সেখানে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে লিখেছেনঃ
অভির এই লেখা এবং রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা বিশ্বপরিচয় পড়লে রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানমনষ্ক হিসাবে মেনে নিতে সমস্যা হয় না। তবে, সমস্যা হয় যখন জানা যায় যে, এই বিজ্ঞানমনষ্ক রবীন্দ্রনাথই অপবিজ্ঞানমূলক প্লানচেটে বিশ্বাস করতেন। প্লানচেট করে মৃত ছেলের আত্মাকে ডেকে নিয়ে আসতেন। সেই আত্মার সাথে কথা বলতেন। কথোপকথনের সেই স্ক্রিপ্টও আবার সংরক্ষণ করে রাখতেন।
বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গের শেষের দিকে একটা লাইন আছে। এর অর্থ একেবারেই বুঝি নি আমি। এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি।
কেউ কি একটু বুঝিয়ে দেবেন, এই বৈজ্ঞানিক মায়াবাদটা কী জিনিস?
@ফরিদ আহমেদ,
হাঁসজারুর অপর নাম নয় তো? 😀
@ফরিদ আহমেদ,
(Y) আমারও তাই মত। এই লেখাটি পড়ে দ্বিমত করার কোন উপায় নেই যে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে ছিলেন একজন প্রোসায়েন্স মানুষ, তবে এটাও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে তিনি ছিলেন সুডোসায়েন্টীফিক অল্টার্নেটীভ ট্রিটমেন্ট ইত্যাদির প্রতি অগাধ অগাধ সহানুভুতিশীল একজন মানুষ।
@ফরিদ আহমেদ,
যাক ফরিদ ভাইয়ের বদৌলতে ভাল আলোচনার সূত্রপাত হল।
আমার পড়াশুনা খুব ভাল নয়। আমার কাছে যা তথ্য আছে তার ভিত্তিতে আমি জানতাম ‘বিশ্বপরিচয়’ই রবীন্দ্রনাথের একমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক বা বিজ্ঞানের বই, যেটা তিনি লিখেছিলেন তার ছিয়াত্তুর বছর বয়সে এসে। ‘বিজ্ঞান’ নামে অন্য কোন বইয়ের কথা আমি শুনিনি (যদূর জানি বঙ্কিমচন্দ্রের একটা বই আছে বিজ্ঞান রহস্য নামে)। তবে বিশ্বপরিচয় লেখার পরেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রবন্ধে বা গল্পগ্রন্থে তার বিজ্ঞানমনস্কতার কথা উঠে এসেছে অবশ্য। এর মধ্যে একটা বোধ হয় ‘তিন সঙ্গী’। এ ছাড়া বিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষাও তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও পরিভাষার চেয়ে ভাষার গতিশীলতার দিকেই তার নজর ছিল। তিনি বলতেন, ‘বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্য পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্যজাতের জিনিস। দাঁত ওথার পরের সেটা পথ্য। সেই কথা মনে করে যতদূর পারি পরিভাষাকে এড়িয়ে সহজ ভাষার দিকে মন দিয়েছি’…
একদম ঠিক কথা। শুধু প্ল্যানচেটেই নয়, রবীন্দ্রনাথের ভিতর আরো অনেক অপবিজ্ঞানের চর্চাই ছিল। তার মধ্যে একটি হল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। জমিদারি দেখভালের জন্য পতিসর কিংবা শিলাইদহর কুঠিবাড়িতে থাকাকালীন লেখালেখির ফাঁকে গরিব প্রজাদের হোমিওপ্যাথির চিকিৎসাও করতেন তিনি। আমাদের বিজ্ঞানবিমুখ বাঙালিসমাজ রবিঠাকুরের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিয়েও যার পর নাই গর্বিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শুধু প্ল্যানচেট কবিরাজি হোমিওপ্যাথি নয়, রবীন্দ্রনাথের বিষ্ঠা পেলেও তারা মাথায় করে রাখবেন। সয়ং রবীন্দ্রনাথের বিষ্ঠা বলে কথা।
এই ‘আপ্লুত’ রবীন্দ্রস্তাবকদের কথা মাথায় রেখেই আমি স্বতন্ত্র ভাবনা (চারদিক, ২০০৮) বইয়ের ভুমিকায় লিখেছিলাম কিছু অপ্রিয় কিছু সত্যি কথা –
‘চিন্তার দাসত্ব’-এর ক্ষেত্রে কেবল মৌলবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য তা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমুন্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল নামধারী বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় বড় নামগুলো তৈরী করেছে ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথের ব্রক্ষ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রক্ষ্মের অস্তিত্ব। শুধু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই নয়, কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রশস্তি করেছেন, ভেবে নিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন ছাড়া ভারতবাসীর মুক্তি অসম্ভব। আবার কখনও বা নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’। এধরনের বিশ্বাস কিংবা মন্তব্যগুলোর কোনটিই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অভ্রান্ততা তুলে ধরে না, বরং প্রমাণ করে যে চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।
আমার এই বক্তব্য ‘রবীন্দ্র স্তাবক’দের পছন্দ হয়নি। আমার রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট করার ব্যাপারে শক্ত মতামত দেওয়ায় মুক্তমনার ভুতপূর্ব একজন সদস্য কুলদা রায় ইনিয়ে বিনিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন অন্য একটি ব্লগে গিয়ে – প্রিয়পুত্র শমীর শোকে কাতর রবীন্দ্রনাথের মানসিক অবস্থা বুঝতে হবে, এমন মানসিক পরিস্থিতিতে যদি প্ল্যানচেট করেও থাকেন, তাতে কি এমন ক্ষতি এই জাতীয়। কুলদা রায়ের লেখাটা পড়া যাবে এখান থেকে –
অন্য আলোয় দেখা –পর্ব ৪ : প্রিয়পুত্র শমী এবং প্লানচেট
এই ধরণের রবীন্দ্র স্তাবকদের আমি কি করে বোঝাই আমার লেখার উদ্দেশ্য রবীন্দ্র বিরোধিতা ছিল না। বরং এটিই বলা উদ্দেশ্য ছিলো যে, ব্যক্তিপূজায় ভেসে গিয়ে আমরা অনেক সময় সব কিছুই ভুলে যাই। আমি রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট করাকে সঠিক মনে করি না, তা তিনি যতই প্রিয়জন হারানোর শোকে করে থাকুন না কেন (বলা বাহুল্য এরকম প্রিয়জন আমরা সকলেই হারাই, কিন্তু প্ল্যানচেট শুরু করি না)। আমি সমর্থন করতে পারি না রবীন্দ্রনাথ রমা বাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে প্রবন্ধে যেভাবে মেয়েদের ছোট করে বলেছেন – ‘ যেমন করেই দেখো প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’’ এটা বলা কি রবীন্দ্রবিদ্বেষ? আমি তো শেখ মুজিব যে চাকমাদের বলেছিলেন “তোরা সব বাঙ্গালি হইয়া যা’ – সেই মনোভাবও সমর্থন করতে পারি না। তবে কি আমি মুজিব বিদ্বেষী হয়ে গেলাম? আসলে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভিঙ্গি আমাদের সংস্কৃতিতে একটু বিরলই বটে। হয় দেবতা, নইলে রাজাকার। এই ধরণের বিভাজন অনেক সময় খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অনেকটা বুশের মতোই – ‘আইদার উইথ মি, অর উইথ দেম’!
কুলদার সেই লেখায় ধ্রুব বর্ণনও কিছু শক্তিশালী মন্তব্য করেছিলেন। প্রাসঙ্গিক মনে করায় উঠিয়ে দিচ্ছি –
এখানটায় রবীন্দ্রনাথকে শক্তভাবে সমালোচনা করাটাই বেশি জরুরি, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে একটি প্রভাবশালী অস্তিত্ব। তার ভুলগুলো জানাটা, জানানোটা, স্পষ্ট সমালোচনা করাটা তাই বেশি জরুরি।
এইটাই সার কথা।
@অভিজিৎ,
বিভিন্ন সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের ষোলটি বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধের সংকলন “বিজ্ঞান” শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলীতে। অনলাইনে এখন সবগুলোই পাওয়া যাচ্ছে এখানে।
আজকের কালের কন্ঠে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন ”
রবীন্দ্রনাথ সত্যেন বসুকে চিনতে পারেন নি এই তথ্য হুমায়ূন আহমেদ কোথায় পেলেন জানি না। সত্যেন বসুর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ যে বইটি লেখেন এবং সত্যেন বসুকে উৎসর্গ করেন তার নাম “বিশ্ব পরিচয়” – ‘বিজ্ঞানের কথা’ নয়। হুমায়ূন আহমেদের মত মানুষ এরকম ভুল তথ্য প্রচার করবেন তা আকাঙ্খিত নয়। সত্যেন বসু ১৯৫৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ভারতীর উপাচার্য হয়েছিলেন।
@প্রদীপ দেব,
খুবই অদ্ভূত লাগছে।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
নৃপেনদা, আমার কাছে অদ্ভুত লাগেনি। হুয়ায়ূন আহমেদ এখন কিছু পড়েন টড়েন বলে মনে হয় না। ভাব নেন পড়ার। আর প্রায়শই বিশ্লেষণের মধ্যে অনর্থক নিজের ছোট ছেলে নয়তো বউ শাওনের কথা নিয়ে আসেন। যেমন কয়েকদিন আগে ইউনুসকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন প্রথম আলোয়, সারবত্তাহীন লেখা, তার মধ্যে হঠাৎ করেই সেঁদিয়ে দিলেন অমূল্য একটি লাইন –
আমার পড়েই মনে হয়েছিলো, হুমায়ূন আহমেদ বানানটাও তো ‘হ’ দিয়ে। আই অ্যাম শিওর, তার ছেলে তাকে গুমায়ুন ডাকে। 🙂
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রথম আলোর লেখাটায়ও অনাবশ্যকভাবে আবার শাওনের প্রসংগ নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে তথ্যের যে এগুলো তাফালিং-এই মনোযোগী বেশি ইদানিং।
@অভিজিৎ,
একটি পত্রিকায় হুমায়ুন ফেইসবুক নিয়ে আলোচনা করেছেন দেখলাম। সেখানেও রীতিমত শাওন চলে এসেছেন। 🙂
@সৈকত চৌধুরী,
হুমায়ুন আহমদের সাম্প্রতিক (গত ৪/৫ বছরের) সব বই, কলাম সব লেখাতেই কারনে অকারনে শাওনের সাথে তার অতি সুখী দাম্পত্য জীবনের বর্ননা এসে যাবেই যাবে। রীতিমত বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে গেছে।
আমার মনে হয় ভদ্রলোক সমালোচনা যতটা পাত্তা দেন না দেখাতে চান অতটা না, শাওন সম্পর্কিত আলোচনা সমালোচনার গিলটি ফিলিংস থেকেই তার কারনে অকারনে কেবল দেখাতে হয় বর্তমানে তিনি কত সুখী।
তার মত লেখকের লেখার মানকে যে এই ধরনের শস্তা ব্যাক্তিগত আলাপ কোথায় টেনে নামাচ্ছে তা তাকে বলার মতও কেউ নেই।
@প্রদীপ দেব,
আমি একটা লিঙ্ক খুঁজে পেয়েছি, যেখানে কিছুটা হলেও হূমায়ুন আহমেদকে সঠিক বলে ধরা যেতে পারে –
তবে এই উক্তির কোন রেফারেন্স দেয়া হয়নি, কেবল Widely repeated anecdote বলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে (উপরে বলা হয়েছে সত্যেন বোসের গ্র্যান্ডসনের বায়োগ্রাফিকাল রিসার্চ)। হুমায়ুন আহমেদও অবশ্য রেফারেন্স খোঁজার প্রইয়োজন মনে করেননি মনে হয়। আর হুমায়ুন আহমেদ বইয়ের নামটা আসলেই ভুল লিখেছিলেন। যে বইটি তিনি সত্যেন বসুকে উৎসর্গ করেন তার নাম “বিশ্ব পরিচয়” – ‘বিজ্ঞানের কথা’ নয়।
@অভিজিৎ,
নাম না শুনলেও অপরাধ কিছু নেই। ভদ্রলোক পয়ষট্টি বছর ধরে লিখে গিয়েছেন এক নাগাড়ে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো নিজেও বলতে পারবেন না সব বইয়ের নাম। ঘটনা হচ্ছে, এই বুড়ো অতি অন্যায় রকমের বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ফলে, অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় আবর্জনাও সৃষ্টি করে গেছেন ভাল জিনিসের পাশাপাশি। কিন্তু রবীন্দ্র পূজোয় আসক্ত আমরা সেই সব বর্জকেও বাতাসা ভেবে জিভে তুলে নেই।
বিজ্ঞানের উপরে যত বই পড়েছি আমি, তাঁর মধ্যে এটি অনন্য-সাধারণ। 🙂 এই বইটা যদি তোমার আগে পড়া থাকতো তবে রবীন্দ্রে বিজ্ঞান নামে এই লেখাটা তুমি লিখতে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। এই বইয়ের একটা প্রবন্ধ আমার অসম্ভব প্রিয়। এরকম বিজ্ঞান বিষয়ক অনন্য প্রবন্ধ শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়েই বের হতে পারে। :)) পাঠকদের সেই প্রবন্ধের রস আস্বাদনের জন্য পুরো প্রবন্ধটাই এখানে তুলে দিচ্ছি আমি।
মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব
পৌরুষ সম্বন্ধে স্ত্রী-মাকড়সার সহিত পুরুষ-মাকড়সার তুলনাই হয় না। প্রথমত, আয়তনে মাকড়সার অপেক্ষা মাকড়সিকা ঢের বড়ো, তার পর তাহার ক্ষমতাও ঢের বেশি। স্বামীর উপর উপদ্রবের সীমা নাই, তাহাকে মারিয়া কাটিয়া অস্থির করিয়া দেয়। এমন-কি, অনেক সময় তাহাকে মারিয়া ফেলিয়া খাইয়া ফেলে; এরূপ সম্পূর্ণ দাম্পত্য একীকরণের দৃষ্টান্ত উচ্চশ্রেণীর জীবসমাজে আছে কি না সন্দেহ।
পাঠকদের জন্য ছোট্ট একটু ধাঁধা। এই লেখাটা যদি রবীন্দ্রনাথ মুক্তমনায় পাঠাতেন প্রকাশের জন্য, তাহলে কি এটি প্রকাশিত হতো মুক্তমনায়? মডারেটররা কি অনুমোদন দিতেন এই লেখাকে?
@ফরিদ আহমেদ,
আপনার কি মনে হয় বয়সের সাথে ওঁর আবর্জনা উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল? আমার তা মনে হয় নি, মনে হয়েছে একটি ধ্রুব ratio তে বরাবরই কিছু আবর্জনা উৎপাদন করে চলেছিলেন।
@রৌরব,
সাধারণত দীর্ঘজীবি কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে ওরকমই হয়। তবে, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে মনে হয় উল্টোটাই ঘটেছিল। শুরুর দিকেই তিনি আবর্জনা প্রসব করেছেন বেশি। তাঁর দীর্ঘ জীবন নিয়ে যে কটাক্ষটা আমি করেছি ওটা আসলে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট শেষের কবিতা উপন্যাসের চরিত্র অমিত রায়ের ছদ্ম রবীন্দ্র সমালোচনা থেকে ধার করা।
কবি সাহিত্যিকরা যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তখন পাঠক-প্রকাশকদের একটা চাপ তৈরি হয়। ফলে, অনিচ্ছাতেও অনেক সময় অনেক আবর্জনা তাঁদেরকে প্রসব করতে হয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ এবং তসলিমা নাসরিন। তসলিমার প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, কবিতা অত্যন্ত উঁচু মানের। কারণ, এগুলো তিনি ভালবেসে, মনের তাগিদে লিখেছেন। অন্যদিকে, উপন্যাসগুলোর দশা শোচনীয়। কেননা, এগুলো লেখার আগেই প্রকাশকরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে অগ্রীম টাকা দিয়ে আসতো।
রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই বিভাজন-রেখাটা ভিন্ন। নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্তিটা এখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। নোবেলপ্রাপ্তির পরেই রবীন্দনাথের মধ্যে নিজেকে শোধরানোর, নিজেকে আধুনিক করার একটা প্রয়াস পাওয়া যায়। আহমদ শরীফ তাঁর ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ প্রবন্ধে এই বিষয়টাকে চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন এভাবেঃ
সে কারণেই হয়তো যেখানে ‘বিজ্ঞান’ গ্রন্থের তাঁর ষোলটি বিজ্ঞান প্রবন্ধ পড়লে হাসি চেপে রাখা দায় হয়ে পড়ে, সেখানে ‘বিশ্বপরিচয়’ এর মোটামুটি উচ্চ মান বিস্ময় তৈরি করে। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে পণ্ডিত কোনো ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে এই গ্রন্থটি লিখেছিলেন। বইটির উৎসর্গেও বিষয়টির কিছুটা উল্লেখ করা আছে। সত্যেন বসুকে তিনি বলেছেনঃ
প্রমথনাথ বইটা লেখা শুরু করেছিলেন, এটা তাঁর বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। কতটুকু লিখেছিলেন, সেটা অবশ্য রবিবাবু চেপে গিয়েছেন। চেপে না গিয়ে উপায়ও ছিল না তাঁর। নাহলে যে দুজনের নামই দিতে হতো বইটাতে।
অবশ্য শেষ বিচারে আমাদের খুশিই হওয়া উচিত এই ভেবে যে, ভূতে ভগবানে সমান বিশ্বাসী একজন লোকের কাছ থেকে বিজ্ঞানের একটা উন্নতমানের বইতো অন্তত পেয়েছি আমরা।
আমাদের এই বিশ্বকবি কতখানি অপবিজ্ঞানে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এই ধরনের মানস যে কতখানি ক্ষতিকর, সেটা আহমদ শরীফের এ উক্তি দিয়েই খানিকটা মাপা যাবে।
@ফরিদ আহমেদ,
আহমদ শরীফের আলোচনা সরলীকৃত মনে হল। আমি অবশ্য পুরো প্রবন্ধ পড়িনি, আপনার দেয়া উদ্ধৃতির আলোকে বলছি। রবীন্দ্র কবিতা পুরস্কার পূর্ববর্তী “জীবনদেবতা” পর্ব ও পুরস্কার পরবর্তী “বিশ্বমানবতা” পর্বে বিভক্ত, এই বিভাজন অতি-বিভাজন। রবীন্দ্র কবিতার পাঠক মাত্রই জানে যে রবীন্দ্রনাথের জটিল ঈশ্বর-প্রেম-নারী-মানুষ মেশানো অনতিস্পষ্ট যে muse বলুন, দেবতা বলুন, তার ক্রমবিকাশ ঘটেছে সারা জীবন ধরে, এবং পুরনো ফর্ম বা দৃষ্টিভঙ্গিটি কখনই পুরো চলে যায় নি। এখানে ১৯১৩ কোন বিশেষ মাইলফলক নয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তার ডিসইলুশনমেন্টের পর তার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা পরিবর্তন আসে, কিন্তু তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ গোরা ১৯০৯ সালে লেখা। এবং সেই ১৯০৯ ও কোন হঠাৎ পরিবর্তন নয়, বিকাশের একটি স্তর।
প্লানচেট-ভূত এব্যাপারে আমার মন্তব্য হল, রবীন্দ্রনাথকে একজন ধর্মীয় গুরুদেব-এর মর্যাদা দেয়াটাই এখানে সমস্যা, নইলে উনি বাড়িতে বসে ওইজা বোর্ড নিয়ে কি ঘষাঘষি করলেন তাতে কি এসে যায়? অযৌক্তিকতা প্রায়শই সৃজনশীলতার corollary। হুমায়ুন আহমেদকেই দেখুন। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আপনি বিজ্ঞান বই পেয়ে যতটা বিস্মিত হচ্ছেন, আমি ততটা হই না, কারণ পরস্পরবিরোধিতাই হচ্ছে সাধারণ (বিশেষত সৃজনশীল শিল্পীদের মধ্যে), তার অভাবটাই অসাধারণ।
@রৌরব,
আহমদ শরীফের আলোচনা সরলীকৃত মনে হওয়ার জন্য কোনো দোষ দেখছি না আমি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় যে পরিমাণ সৃষ্টি করেছেন, তা কালানুক্রম অনুসারে এক এক করে পড়া এবং সেগুলো বিচার বিশ্লেষণটা একটু কঠিন কাজই বটে। তবে, চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে তিনি যে, তাঁর অনেক সমসাময়িক বা পূর্বসূরী সাহিত্যিকদের তুলনায় অনগ্রসর এবং অনাধুনিক ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। চৈতন্যের ক্রমবিকাশ একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, তবে কোথায় কোথাও তার গতির অসমতা যে দৃশ্যমান থাকবে না এমন কোনো কথা নেই। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই ক্রমবিকাশের হঠাৎ গতি পরিবর্তনটা হয়তো নোবেল পুরস্কারের পরে ঘটেছে বলে আহমদ শরীফের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। অন্য কারো চোখে এটা হয়তো ভিন্নভাবে ধরা পড়বে।
সেটাই। রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ বলেই এই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে। আপনি রৌরব হয়তো কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে রবীন্দ্রনাথের মণি-মাণিক্যগুলো তুলে নিচ্ছেন, একজন গৌরব হয়তো গুরুভক্তির সুগভীর প্রাবল্যে তাঁর গুরুদেবের মল-মূত্রকেই মণি-মাণিক্য ভেবে গর্বভরে মাথায় তুলে নিচ্ছে।
অভির মতো একজন সৃজনশীল বিজ্ঞান লেখক যে রবীন্দ্রে বিজ্ঞান খুঁজে পেয়েছে, এটাতেও তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আমার মতো বিস্মিত নন, তাই না? :))
@ফরিদ আহমেদ,
:))
@ফরিদ আহমেদ,
দিতেন, রম্য বিজ্ঞান নামের নুতন বিভাগে।
@ফরিদ আহমেদ,
আজকে আমি মোটামুটি কনফার্ম হলাম যে আমার কথাই ঠিক। বিশ্বপরিচয়ই রবীন্দ্রনাথের একমাত্র বিজ্ঞানের বই। অনলাইন রচনাবলীর যে লিঙ্কটি প্রদীপ দিয়েছেন, সেটি সম্ভবতঃ কোন বই এর লিঙ্ক নয়, সে সময়কার বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নিজ নামে কিছু লেখা, আর অন্যগুলো রবীন্দ্রনাথের বলে মনে করা হয় (অস্বাক্ষরিত লেখা ) সেগুলো একসাথে সঙ্কলন করা হয়েছে। যেমন, সামুদ্রিক জীব প্রকাশিত হয়েছিল ভারতী পত্রিকায় ১২৮৫ বঙ্গাব্দে, বৈজ্ঞানিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বালক পত্রিকায় (এ পত্রিকাটি ১২৯২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল), আর আপনার এই বিখ্যাত ‘মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব’ প্রকাশিত হয়েছিল সাধনা পত্রিকায় ১২৯৮ সালের দিকে ইত্যাদি। এগুলো কেবল ছোট ছোট রচনা, বিজ্ঞানের পূর্নাংগ বই নয়। আপনি চাইলে রেফারেন্স দিতে পারুম!
@অভিজিৎ,
বই হোক আর অনলাইন সংকলনই হোক, লেখাতো সেই বুড়োরই। ছোট ছোট রচনা বলে পার পাওয়া যাবে না, কারণ এগুলো বিজ্ঞানের উপরেই লেখা। 🙂
বিশ্বপরিচয় রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব লেখা, নাকি প্রমথনাথের লেখাকেই ঘষেমেজে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন, এই রকম একটা ক্ষীণ সন্দেহ গত দুইদিন ধরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে। মাথা থেকে বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গের ওই লাইন কটাকে দূর করতে পারছি না কিছুতেই। প্রমথনাথ লেখা শুরু করে শেষ করলেন না কেন? কতখানি-ই বা তিনি শুরু করেছিলেন? সেটুকু কি সহলেখক হিসাবে নাম যাবার মত পর্যাপ্ত ছিল না?
@ফরিদ আহমেদ,
আপনার সন্দেহ একদম অমূলক নয়। আজকে আমার খুব পয়মন্ত দিন। কিছু বিরল মণিমানিক্য খুঁজে পেয়েছি, আপনি জানলে অবাক হবেন (এই মানিক্য যদি আগে পেতাম, তবে এই লেখাটা আমি লিখতামই না)। একে একে বলি তাইলে –
তরুণ শিক্ষক প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনে চাকরী পেয়েছিলেন সত্যেন বোস এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সুপারিশে। তিনি বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বাংলায় খুব বেশি দখল ছিল না, (অন্ততঃ রবীন্দ্রনাথের সমপর্যায়ের নন)। । রবীন্দ্রনাথ প্রমথবাবুকে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস জিনসের একটা বই – থ্রু স্পেস অ্যান্ড টাইম’ পড়তে দিয়েছিলেন। জেমস জিন্স খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে কিছু সুনাম ছিল। ফলে তার বই থেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই কিভাবে লিখতে হয়, তার একটা রসদ পাবেন প্রমথবাবু – সেরকম একটা ধারণা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই রবীন্দ্রনাথ যখন প্রমথবাবুকে বই লেখার প্রস্তাব দেওয়ায় (তখন কি তিনি কস্মিনকালেও জানতেন, তার এই রসদ রবিবাবু পুরোটাই নিজের বইয়ের কাজে ব্যবহার করবেন) যার পর নাই খুশি হয়েছিলেন। কি রকম উচ্ছ্বাস তার হয়েছিল, তা প্রমথবাবুর ভাস্য থেকেই শোনা যাক –
এই উদ্ধৃতিটি আছে প্রমথনাথ সেনগুপ্তের আনন্দরূপম বইয়ে, যা বাসুমতি, কলকাতা থেকে একসয় প্রকাশিত হয়েছিল (এখন পাওয়া যায় না)। এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় লেখক বাংলা নিয়ে অতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু এটি অন্ততঃ ভেবেছিলেন বইটি তারই হবে।
এ সময় পাঠভবনের অধ্যাপক তনয়বাবু (তননেন্দ্রনাথ ঘোষ) এসে বললেন –
ফরিদ ভাই, বুঝতেই পারছেন, কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে ভাষার মাধুর্য বাড়িয়ে তথ্যগুলো হাতিয়ে নেবার পায়তারা চলছে। কিন্তু তারপরেও বইলেখার এ পদ্ধতি ঠিক হবার পরেও হতভাগ্য প্রমথবাবু কিন্তু ভাবছেন বইটা তারই হবে। তিনি বইয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন – ‘বিশ্বরচনা’ –
প্রথম অধ্যায় লেখা শেষ করে প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন, “রচনাটি আমার কাছে রেখে যাও, কাল ফেরৎ পাবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটাতে হলে ভাষাটা কীরকম হবে, তাই শুধু দেখিয়ে দেব”।
শুধু পরমাণুলোক নয়, এর পর নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক এবং উপসংহার সব অধ্যায়ই লিখেছেন প্রমথবাবু। আর রবীন্দ্রনাথ খোল নলচে বদলে দিয়েছেন 🙂 । সেই সংশোধন করা পাণ্ডুলিপিগুলো প্রমথনাথ অবশ্য আনন্দরূপম বইয়ে ছাপিয়েছিলেন কিছু কিছু ।
প্রমথবাবু উপসংহার টংহার শেষ করার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেন বইটার নাম বিশ্বপরিচয় হবে। আর একধরণের নাটকের অবতারণা করলেন ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে নিয়ে এসে। নাটক বলছি কেন শুনুন। নিজেই বুঝতে পারবেন।
ডঃ সেন হঠাৎ ওকে (প্রমথ বাবুকে) বললেন,
গুরুদেব সাথে সাথে বললেন,
নিঃসন্দেহে এটা প্রমথবাবুর জন্য ধাক্কা ছিল বড় রকমের। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন তার নামেই বইটা হবে। বইয়ের সব তথ্য যে তারই যোগাড় করা! তারপরেও রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ভাষার সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছেন, সেহেতু যুক্তগ্রন্থকার হলেও খুব বেশি হারাবার নেই বলেই ভেবেছিলেন হয়তো। সেই বিহবল অবস্থা ধরা পড়ে প্রমথবাবুর লেখায় –
এর বেশ কিছুদিন পর নাটকের আসল যবনিকাপাত। রবি বুড়ো ঠিক করলেন প্রমথবাবুকে জানাবেন ব্যাপারটা, যে নিজেই বইয়ের লেখক হবেন। কিভাবে সেটা প্রমথবাবুর মুখেই শোনা যাক –
এই হচ্ছে বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত। আবার পড়েন রবিবুড়ার স্মরণীয় উক্তিটা – দেখো, বিশ্বপরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না। 🙂 কেমন বুঝতাছেন?
এখন রেফারেন্স দেই। আপনি আনন্দরূপম বইটা সম্ভবতঃ পাবেন না, পাইলে আর কিছু লাগবো না। তবে, আমি দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের একটা বইয়ে (রবীন্দনাথ ও বিজ্ঞান, আনন্দ পাবলিশার্স) ঘটনার পুরা বিবরণ পাইছি। উনি অবশ্য রবীন্দ্রস্তাবকদের একজন। যথারীতি রবিকাকারে মাথায় করছেন। তারপরেও তার গুরুজির মেধাসত্ত্ব মেরে দেয়ার এই লজ্জা তিনিও লুকাতে পারেন নাই। যেমন দীপঙ্কর মশাই বলছেন –
তারপরেই আবার রবীন্দ্রনাথের সাফাই গেয়েছেন এই বলে –
উক্তিটা শুনে সেই ব্যাঙ-এর গল্পের কথা মনে পড়ছে না? রবীন্দ্রনাথের জন্য যেটা ‘মজার ব্যাপার’ সেটা অন্য অনেকের জন্য সর্বনাশের কারণ? 🙂
বাকি আপনে বুইঝা নেন।
@অভিজিৎ, অভিজিৎ দা, আজ আমার মনের দ্বিধা কেটে গেলো। নবম শ্রেনীতে আমার লেখা প্রথম কবিতা পড়ে সবাই বলেছিল, রবীন্দ্রনাথের ছাপ। সেটা ভালো না খারাপ আমি জানতাম না। কিন্তু কিন্তু আম্র লেখার রহস্য উদ্ধার করতেই আমি রবীন্দ্রনাথে ডুবেছিলাম। দুই আড়াই বছর আমি ছেলেমানুষি করে কবিতা লিখেছি আর ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। আমি যত সাধারণ, যত তুচ্ছই হই না কেন, রবীন্দ্রনাথের প্রেতাত্মা হতে চাই না। একসময় আমার এলোমেলো কবিতাগুলো সেই বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়েছে। 🙂
কিন্তু সমস্যাটা আমার হয়ে গেলো অন্য জায়গায়। রবীন্দ্রনাথের এতো সমৃদ্ধ সাহিত্য ভান্ডারে আমি মুগ্ধ হয়ে ডুবে থাকি, কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাই। কিন্তু কেন যেন, তাকে সেইভাবে শ্রদ্ধা করতে পারিনা। এখনো আমি রবীন্দ্রসংগীতে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে যাই, গানগুলোর জন্য অসম্ভব ভালোলাগা আমার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে মনের মধ্যে ঠাঁই দিতে পারিনা। আশেপাশে সবাইকে রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলতে দেখে আমারই কষ্ট লাগতো, সমস্যা আমার, আমিই পারিনা! আপনি আজ রবিঠাকুরের মেধাস্বত্ত্ব চুরির ঘটনাটা জানিয়ে উনাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতে না পারার গ্লানি থেকে মুক্তি দিলেন আমাকে। আমি যেমন তাকে শ্রদ্ধা করার যোগ্য নই, তেমনি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমার মনে ঠাঁই পাবার যোগ্য নন। 🙂
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া, অনেক অনেক। 🙂
🙂
@অভিজিৎ,
দুর্দান্ত!!!
:-X ;-( :spammer:
আপনার এই আবিষ্কার আলাদা প্রবন্ধ হবার যোগ্য। রবীন্দ্রনাথের প্রতিমা-নিধনের এই সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
@রৌরব,
আরেকটু দেখি – আর কোন মনিমানিক্য পাওয়া যায় কিনা! নাইলে স্তাবকের শিষ্যরা আবার ঝাপায় পড়তে পারে।
তবে এইটা আবারো বোঝা গেল – মুক্তচিন্তকদের কোন গুরু থাকতে নেই, সেটা মুহম্মদই হোক, গান্ধীই হোক আর রবীন্দ্রনাথই হোক। স্কেপ্টিসিজম ইজ এ জার্ণি, নট এ ডেস্টিনেশন। আর আমি তো আগেই বলেছি – আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।
@অভিজিৎ,
গতরাতে মন্তব্যটা করার পর থেকে মনের মধ্যে একটু সুপ্ত আতংক নিয়েই ঘুমোতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কোনো রবীন্দ্রপূজারী হয়তো আক্রোশে ফেটে পড়বেন এই বলে যে, কোথাকার কোন ফরিদ আহমেদ রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। তোমার এই নব্য আবিষ্কারের পরেই সেই আতংক এখন অনাবিল আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছে।
আগে জানতাম যে, শুধু সুর চুরি করেছেন তিনি গানের জন্য। এখন জানলাম যে, শুধু ছিঁচকে চুরিই নয়, একেবারে ডাকাতি পর্যন্ত করেছিলেন নিজেকে বিজ্ঞানের সমঝদার প্রমাণের জন্য। যেভাবে এবং যে ভাষায় প্রমথনাথের বইটাকে হাইজ্যাক করলেন, সেটা আগেকার দিনে গরীব প্রজা বা অধঃস্তন কর্মচারীর সুন্দরী বউকে লম্পট জমিদাররা কেড়ে নিয়ে শয্যাশায়ী করার ঘটনার অনুরূপই মনে হলো।
তবে এই ডাকাতির জন্য প্রমথনাথের দায়ও কম নয়। তার অন্ধ গুরভক্তিই এর জন্য দায়ী। তাঁর নিজের ভাষাটা এমন কিছু খারাপ নয় (আনন্দরূপম এর যেটুকু উদ্ধৃতি এখানে দেখলাম তার ভিত্তিতেই বলছি), অথচ আত্মবিশ্বাসহীন তিনি গুরুভক্তির প্রাবল্যে ভেবে নিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা ছাড়া এই বই লেখাই হবে না। এই ভাবনার খেসারত দিয়েছেন তিনি খ্যাতিমান নোবেল লরিয়েটের আরো খ্যাতির লোভের পাল্লায় পড়ে।
আরে কোনো ব্যাপার না এইটা। পরস্পরবিরোধিতাই হচ্ছে সাধারণ (বিশেষত সৃজনশীল শিল্পীদের মধ্যে), তার অভাবটাই অসাধারণ। (কপিরাইট রৌরব)
দীপংকর চট্টোপাধ্যায়ের বইটা যদি পিডিএফ ফর্মে থাকে তাইলে পাঠায় দাও। পড়ে টড়ে দেখি কেমন বিজ্ঞানে অবদান ছিল রবি ঠাকুরের।
@ফরিদ আহমেদ,
অপেক্ষা অপেক্ষা। সংশয় প্রকাশের কারণে এবার রবীন্দ্রপূজারীরা আক্রোশে ফেটে না পড়লেও রবীন্দ্রনাথের দেব মূর্তিকে নাঙ্গা করার অপরাধ মনে তারা ক্ষমা করবেন না। আপনাদের জন্য এইবার তারা :guli: ছুড়বে।
:-[
@অভিজিৎ, @ফরিদ,
রবীন্দ্রনাথের একশত পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের ‘নট-সো-গ্লোরিয়াস’ কার্যকলাপ নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে তা শুধু মুক্তমনাদের পক্ষেই সম্ভব। তোমাদের অভিনন্দন।
মানুষকে দেবতা বানালে আশাহত হতেই হবে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলি, ‘সত্য যে কঠিণ, কঠিণেরে ভালো বাসিলাম।’
@অভিজিৎ,
ছি, ছি, ছি।
তারপরেও, তিনি জীবনের সকল অনুভূতির এত গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার মনের ভাব প্রকাশ করতে আবার তাঁর কথাই ব্যবহার করতে হচ্ছে।
তিনি নিজেই নিজেই কথা প্রমাণ করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথের বয়সের শেষপর্বে এসে মন অভিভূত থাকা বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কিছু বললেন না দেখে, আলোচনার এইপর্বে এসে মনটাই অভিমানে ভরে গেল আমার। 🙁
@ফরিদ আহমেদ,
আপনে দেখতেছি হয়রানের মত। কেউ এর ছাইপাশরে গুরুত্ব দেয়া না বইলা মনে করে ‘আমি জিচ্ছি’। বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ জানেন না মিয়া? এইটা হইল হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল। জীবনটা আর জগৎটা পুরাই মায়া – এইটা ফারুক সাহেব বৈজ্ঞানিকভাবে দেখাইসে এইখানে। তারপরেও আপনে না বুঝলে আমি কি ব্লমু? রবীন্দনাথ সেই কবেই এই বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ প্রেডিক্ট করে গেসিলো …
@অভিজিৎ,
হুম! বুঝলাম মায়াবাদ কী জিনিস!! কিন্তু প্রশ্ন হইলো রবীন্দ্রনাথ এই আইডিয়া পাইছে কই থেইক্যা? বুড়া মিয়া কি কোরান টোরান পড়তো নাকি গোপনে?
রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ব্যাপকতা বিস্ময়কর। এটাই বোধহয় তাকে তুলনীয় কবিদের কাছ থেকে আলাদা করেছে। লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
মাঝে মাঝে মুক্ত-মনায়ই অভিজিৎ রায়ের লেখায় রবীন্দ্র বিরোধী মনোভাবও পেয়েছি। এ মুহূর্তে লিংক দিতে পারছি না।
আবার নিজের প্রায় লেখার শিরোনাম রবি ঠাকুরের গান। আসলে অভিজিৎ রায় রবীন্দ্র বলয়েই হাবুডুবু খান। রবীন্দ্র নাথ ও বিজ্ঞান বা রবীন্দ্রে বিজ্ঞান এরই প্রমাণ।
ভাল লেগেছে চমৎকার রেফারেন্স। আইনস্টাইন ও জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে রবিবাবুর সম্পর্ক। আগেও পড়েছি।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মুক্ত-মনায় প্রথম লেখার জন্য ধন্যবাদ ও আরও লেখা অন্যান্যদের কাছ থেকে আশা করছি।
@গীতা দি,
আমি কিন্তু রবীন্দ্র স্তাবক বা বিদ্বেষী কোনটাই নই। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে শুরু করে, বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা সহ অনেক কিছুই আমার খুব প্রিয়। অপ্রিয় বিষয়ের তালিকাও যে খুব ছোট তা নয়। প্ল্যানচেট, হোমিওপ্যাথি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় প্রগাঢ় সমর্থন, নারীদের সম্পর্কে স্থুল এবং সনাতন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি সহ অনেক কিছুই এসে যাবে ফিরিস্তি দিতে গেলে। কিছু উল্লেখ করেছি ফরিদ আহমেদকে উত্তর দিতে গিয়ে এখানে। আসলে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা। আমি সেটাই করে যেতে চাচ্ছি।