বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে: মাওসেতুং।

তথ্য সাংবাদিকতার শুরুতে গেরিলা নেতা লাল ডেঙার মুখোমুখি হওয়া খুব ইচ্ছে ছিলো।

মিজোরামের এই নেতা দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রাম করে মিজো আদিবাসীদের জন্য পৃথক স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট– এমএনএফ’এর গেরিলা সদস্যরা অস্ত্র সমর্পন করেন। ভারতের বুকে জন্ম নেয় মিজো আদিবাসীর স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ। লাল ডেঙ্গা মিজোরামের মূখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। [লিংক]

মিজোবাহিনী — এমএনএফ বহু বছর এপাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়ে, এপাড়ের দুর্গম সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতীয় সেনা বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছে। মিজোবাহিনীকে আশ্রয়, খাদ্য, অর্থ তথা যুদ্ধের খরচ দিয়েছেন পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী জনগণ। বান্দরবানের ক্রেওক্রাডং এর পাহাড়ে মিজোবাহিনীর একাধীক হাইড আউটও ছিলো।

আমি সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর একাধীক নেতার কাছে শুনেছি, জুম্ম (পাহাড়ি) জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত এমএন লারমার সঙ্গে লাল ডেঙ্গার বহুবার সাক্ষাত হয়েছে। মাওবাদী এই দুই নেতার বন্ধুত্ব আমরণ অটুট ছিলো। ধারণা করি, লাল ডেঙ্গার সংস্পর্শই এমএন লারমাকে গেরিলা যুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। [লিংক]

পাহাড়ে প্রায়-দুর্ভিক্ষ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের চরম উদাসীনতা লাল ডেঙ্গার মিজোবাহিনীকে অস্ত্র ধারণে বাধ্য করে। আর এপাড়ে ৬০ দশকে কাপ্তাই জল বিদ্যুত নির্মাণ করে প্রায় এক লাখ আদিবাসী পাহাড়িকে উদ্বাস্তু করে এবং ১৯৭২ সালে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি উপেক্ষিত করে জাতিগত অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে এমএন লারমার শান্তিবাহিনী অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। …

সাবেক শান্তিবাহিনীর নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ পাহাড়ি যারাই আইজল, মিজোরাম গেছেন, তারাই আমাকে বলেছেন, সাবেক মিজোবাহিনীর সদস্যরা এপাড়ে আমাদের দেশের পাহাড়িদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। তারা সব সময়েই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এদেশের আদিবাসীদের আশ্রয় ও খাদ্যদানের কথা। একই সঙ্গে তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এমএন লারমার আদর্শকেও।

বলা ভাল, মিজোল্যান্ড –এর আদলে শান্তিবাহিনী প্রথম দিকে যে পাঁচদফা দাবি আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে, তার প্রথম দফা দাবিটি ছিলো, অনেকটা এ রকম:

পার্বত্য চট্টগ্রামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ প্রাদেশিক শাসিত এলাকা ঘোষিত করিতে হইবে। স্বায়ত্বশাসিত এই অঞ্চলের নাম হইবে — জুম্মল্যান্ড।

পরে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী সংবিধান মেনে সীমিত আকারে আঞ্চলিক সায়ত্বশাসনের দাবি আদায় করে সাক্ষর করে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি, অস্ত্র সমর্পন করে শান্তিবাহিনর প্রায় দুহাজার সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। [লিংক]

এর সাত বছর আগে ১৯৯০ সালে সংবাদপত্রে লাল ডেঙ্গার মৃত্যু সংবাদ পড়ে আমি ব্যথিত হই। আমার আর তাকে প্রত্যক্ষদর্শনের সুযোগ থাকে না।…


Obituaries
Laldenga, Tribal Leader in India, 53

Reuters
Published: July 08, 1990

Laldenga, a leader of India’s Mizo tribe who fought a secessionist war before joining mainstream politics, died today in London, the Press Trust of India reported. He was 53 years old.

Mr. Laldenga was suffering from lung cancer and was on his way to New Delhi after treatment in New York. The Press Trust said that his condition deteriorated on the flight and that he got off the plane at London. He died on the way to a hospital.

Mr. Laldenga, who had one name, led an insurgency in Mizoram state in the northeast for nearly two decades. But in 1986, after reaching an agreement with the Government, he left the secessionist movement and became the state’s chief minister.

He was arrested several times and spent 10 years in exile in Bangladesh and Pakistan. He lost power in 1988 after defections from his party.

[লিংক]

এরপর আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম পাহাড়ের প্রতিবাদী নায়ক লাল ডেঙ্গার কথা। কিন্তু বছর তিনেক আগে বান্দরবানের দুর্গম ক্রেওক্রাডং পাহাড় যাত্রাকালে বম গ্রাম প্রধান সাংলিয়ান কারবারী দা’ আমাকে আবার মনে করিয়ে দেন লাল ডেঙ্গার কথা, মিজোবাহিনী –এনএমএফ’ এর কথা। [লিংক]….

স্মৃতি হাতড়ে সাংলিয়ান দা’ বলেন: আমাদের এখানে শান্তিবাহিনী কখনো স্থায়ীভাবে ছিলো না। তবে এখানে তাদের যাতায়ত ছিলো।

আমাদের এখানে অনেক বছর ছিলো মিজো বাহিনী। কেওক্রাডং এর এই পথটি ধরেই মিজো নেতা লাল ডেঙা চলাচল করতেন।

কেমন দেখতে ছিলেন উনি? — শিশুসুলভ এমন কৌতুহলের জবাবে তিনি বলে চলেন, লাল ডেঙা ছিলেন খুব লম্বা – চওড়া বলশালী মানুষ। বয়স প্রায় ৫০ বছর। পরনে সাদা শাট আর নীল প্যান্ট। সব সময় ওনার নিরাপত্তায় থাকতো ৫০ – ৬০ জনের একটি গেরিলা বাহিনী। ওদের পরনে ছিলো পাতা – সবুজ পোষাক। নানা রকম ভাড়ি অস্ত্র – শস্ত্র সবার হাতে হাতে। মিজো দলে অনেক মহিলা যোদ্ধাও ছিলো। কিন্তু মিজো বাহিনী খুব খারাপ।…

কেনো?

তার উত্তর, ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মিজো বাহিনী আমাদের এখানে ছিলো। তারা দিনের পর দিন আমাদের গ্রামে আস্তানা গেড়ে বাস করতো। আমরা তাদের খাওয়াতাম, আবার চাঁদার টাকাও দিতাম। তাদের ছাগল, মুরগী, শুকর কেটে ভাত দিতে হতো। আমাদের কোনো মেয়েকে তাদের পছন্দ হলে জোর করে ওরা বিয়ে করতো। আমাদের দিয়ে ওরা এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে বিনে পয়সায় বোঝা টানাতো।

একবার আমাদের গ্রামের একজন বম মেয়েকে মিজো বাহিনী বিয়ে করে ওপারে মিজোরামে নিয়ে যেতে চায়। আমি বাধা দিলে ওরা আমাদের তিনজনকে গুলি করে মারার জন্য এক সারিতে দাঁড় করিয়েছিলো। পাহাড় – জঙ্গল ভেঙে আমরা দৌড়ে পালিয়ে সেবার বাঁচি।

সাংলিয়ান কারবারী বার বার আক্ষেপ করে বলেন, আমি শুনেছি, মিজোরাম দেশটি নাকি খুব সুন্দর। মিজো বাহিনী জয়লাভের পর ওখানে নাকি এখন খুব শান্তি। জিনিষপত্রের দাম খুব শস্তা, জুম করা যায়, ঘন বনে শিকারও মেলে প্রচুর। কিন্তু আমি কখনো মিজেরামে যাবো না। মিজো বাহিনী খুব খারাপ।…

আমি জানতে চাই, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সঙ্গে মিজো বাহিনীর কখনো বন্দুক যুদ্ধ হয়নি?

সাংলিয়ান দা বলেন, আরে না! পাকিস্তান আর্মি আর বাংলাদেশ আর্মিই তো মিজো বাহিনীকে এপাড়ে আশ্রয় দিয়েছে। ওরা মিলেমিশে থাকতো। কেউ কাউকে ঘাঁটাতো না। মাঝে মাঝে এ – ওর ক্যাম্পে বসে চা – বিস্কুটও খোতো!…

ছবি: লাল ডেঙ্গা, টাইমস কন্টেন্ট ডটকম। এমএনএফ-এর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৮৬, আন্তর্জাল।